জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতিপর্ব - ১৮/সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ১৮

সূর্যকান্ত মাহাতো


বদলে যাচ্ছে গ্রামগুলো

যদুকাকা মেয়ের বাড়ি এসেছেন। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। নাতি আধা-সামরিক বাহিনীতে চাকরি পেয়েছে। মেয়ে মানত রেখেছিল। ছেলের চাকরিটা  হলেই অষ্টপ্রহর ব্যাপী হরিনাম ঘোরাবেন। ছেলে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স(B.S.F.) এ চাকরি পেয়েছে। এবছর অক্ষয় তৃতীয়ায় সেই মানত পূরণ হচ্ছে। সেই উপলক্ষেই যদুকাকার এ বাড়িতে আসা।

অনেক বছর আগে একবার এসেছিলেন। তারপর আর আসা হয়নি। মেয়ে জামাইও এ গ্রামে থাকে না। চাকরি সূত্রে বাঁকুড়াতেই বাড়ি করেছে। ওখানেই থাকে। তাই যদুকাকারও ওখানেই যাওয়া আসা। মেয়ে এবার গ্রামের বাড়িতে ছেলের মানত পূরণ করতে চায়। তাই গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ফোন করেছিল। এখন নাকি ওই গ্রাম দিয়ে একটি বাস চলে। যেতে কোনও অসুবিধা হবে না। একেবারে তাদের বাড়ির মুখেই নামিয়ে দেবে।

মেয়ের মুখে সে কথা শুনে যদুকাকা বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন। "বাস চলে?" বিস্ময়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল শব্দ দুটো।

মেয়ে হেসে বলেছিল, "হ্যাঁ। কত কিছু বদলে গেছে। এখন তো চিনতেই পারবে না। নিজের চোখে একবার দেখে যাও গ্রামের সেই পরিবর্তন।"

ফোনটা রেখে যদুকাকা ভাবছিলেন। সময় কত দ্রুত সবকিছু পাল্টে দেয়। সিনেমার ছবির মতোই বোধহয়। একেবারেই একটা গন্ডগ্রাম ছিল। আলের রাস্তা। সাপের মত এঁকেবেঁকে ঢুকে গেছে গ্রামের মধ্যে। বর্ষার জলে কত জায়গা ভেঙ্গে যেত। প্রচুর গাছ। আম, জাম, কাঁঠাল, শিমুল আরও কত কী। ছায়া ঘন বাঁশঝাড়। কখনও সেখানে রোদ পৌঁছায় না। ছোট ছোট বাড়িগুলো সেই গাছ-গাছালিতে সর্বদায় ঢাকা পড়ে থাকে। দু-একটা বাড়ি তারই ফাঁকে ক্ষীণ আলোর মতো দেখা যায়। বিদ্যুতের আলো নেই। সন্ধ্যা নামলেই লণ্ঠনের হলুদ আলোগুলো জ্বলে উঠত। জোনাকির মতো দেখতে লাগে। তারপর ঝুপ করেই অন্ধকার নেমে আসে।

রাত্রি আটটা বাজলেই ছোপ ছোপ অন্ধকারে ঢেকে যেত গ্রামগুলো। নয় তো মাঠে, ঘাটে, বাড়ির উঠোনে ছড়িয়ে পড়ত চাঁদের নিয়ন আলো। চরাচর জুড়ে তখন খালি নিস্তব্ধতা আর নিস্তব্ধতা। নেই কোনও কোলাহল। শোনা যায় কেবল ঝিঁ-ঝিঁ পোকার একটানা ডাক। মাঝে মাঝেই শোনা যায় প্যাঁচার ডাক। গ্রামের লোকেরা বলে প্যাঁচার ডাক নাকি অমঙ্গল। তবু তারা ডেকে যায় নিজেদের মতো করে। দু একটা শিয়াল ও কুকুরও নিস্তব্ধতা ভাঙতে হঠাৎ করেই ডেকে উঠে। তবে সবথেকে ভয়ঙ্কর ছিল বিড়ালের কান্না। শিশুর "ওঁয়া! ওঁয়া!" সুরে কান্নার মতোই অদ্ভুত সেই ডাক। শুনলেই কেমন যেন শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দেয়।

মেয়ের কথা মতোই যদুকাকা বাসটা পেয়ে গিয়েছিলেন। ছুটে চলেছে বাস। দুই পাশে সবুজ মাঠ আর ধানের ক্ষেত। লম্বা লম্বা তালগাছ। রবি ঠাকুরের কথা মতোই এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবেশীর মতো সঙ্গ দিচ্ছে খেজুর গাছগুলোও। ছোট ছোট গ্রাম। পদ্ম ও শালুক ফোটা পুকর।কখনও শালের জঙ্গল। একটা বুনো গন্ধ নয় তো মেঠো ফসলের গন্ধ নাকে এসে ঝাপ্টা মারছে। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার কালো পিচের রাস্তা। মাঠ ও ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে সেই রাস্তা। রাজ্য সড়কের মূল রাস্তার মতো অতটা চওড়া নয়। সরু রাস্তা। ও পাশ দিয়ে গরুর গাড়ি এসে পড়লে পাশ কাটাতে সমস্যা হচ্ছিল। গ্রামের গরু ছাগলগুলোও পাকা রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে। ছুটে চলেছে একটার পর একটা মোটরবাইক।

বাস থেকে নেমেই যদুকাকা চমকে উঠলেন। কোথায় সেই গন্ডগ্রাম? এ যে আমূল পরিবর্তন। সাপের মতো যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সেই প্রাচীনতাও আর নেই। অনুন্নতির সেই ভৌতিক চেহারাটাই বা কোথায়? গ্রামের মুখেই গজিয়ে উঠেছে কয়েকটা পাকা বাড়ি। ছোট বড় কয়েকটা দোকান। আছে চায়ের দোকান। মাংস কাটার দোকান। চপ, পিঁয়াজি, লুচি সহ তেলেভাজার দোকান। ও পাশেই আছে একটা ছোট্ট ডাক্তারখানা। আর একটু এগোতেই চোখে পড়ল একটি অনলাইনের দোকান। বাইরে বসে একজন খবরের কাগজ পড়ছেন। যদুকাকা অবাক। আজকাল গ্রামেও এতসব?

বিকেলের দিকে গ্রামটা একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছা হল যদুকাকার। তাই বেরিয়ে পড়লেন। বিদ্যুতের খুঁটিতে খুঁটিতে আলো। লাগানো আছে বিজ্ঞাপনের বড় বড় পোস্টার। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই "পল্লী সমাজের" আজ কী দারুন পরিবর্তন। সে দৈনতা এখন আর নেই। অনেকটাই চাকচিক্য। প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পল্লীর সেই ব্যথাটাও এখন আর নেই। একটু একটু করে সেই ব্যথার ক্ষত যেন সেরে উঠছে।

রোদে পোড়া, জলে ভেজা, খেটে খাওয়া মানুষগুলোও কতটা বদলে গেছে। আগের মতো এখন আর তাদের গতর খাটাতে হয় না। আধুনিক সব যন্ত্র দিয়েই চাষবাস হচ্ছে। পরিশ্রমও অনেকটা লাঘব হয়েছে। একটু একটু করে তারাও বিলাসিতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সাইকেলে কিংবা হেঁটে দীর্ঘ পথ আর যাতায়াত করছে না। অথচ আগে আট দশ কিমি পথ হেঁটেই যাতায়াত করত। এখন প্রায় ঘরেই মোটরবাইক। অনেকে ট্রাক্টর কিনেছে। কেউ কেউ মারুতি, কেউ টোটো কিনে ফেলেছে। আজকের ছেলে-ছোকরাদের হাতে দামি দামি স্মার্টফোন। কেতাদুরস্ত পোশাক। দলবেঁধে মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে টিউশন থেকে বাড়ি ফিরছে। অথচ বেশ কিছু বছর আগে গ্রামের মেয়েরা সাইকেল চালাতেই জানত না। দু একজন টুকটাক পারত।

অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা গ্রামগুলো আজ অনেকটাই শিক্ষার আলোয় আলোকিত। বাড়ির ছেলে মেয়েরাই সেই আলো নিয়ে এসেছে। তারা স্কুলে যাচ্ছে। কলেজে পড়ছে। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে। সরকারি জলের কল বসেছে গ্রামে গ্রামে। গ্রামের বুক দিয়ে ছুটে চলা বাইক এর মতোই অর্থনীতির চাকাও আজ ছুটে চলেছে। সকলেই কমবেশি রোজগার করছে। কেউ বেকার বসে নেই। গ্রামেরই দশ থেকে পনেরো জন ছেলে ভিন রাজ্যে গেছে। পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে। কেউ সোনার কাজে। কেউ গেঞ্জির কারখানায়। কেউ বা আরও অন্যান্য কাজে। ওরাই ফিরে এসে পাকা বাড়ি বানাচ্ছে। গাড়ি কিনেছে কেউ কেউ। কয়েকজন আবার পুলিশের চাকরিও পেয়েছে। তবে আনন্দের কথা ওরা কেউ গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে যায়নি। ঘর-বাড়ি গ্রামেই করেছে।

যদুকাকার মনে হল, এটাই তো দরকার। বিভিন্ন পেশার মানুষ জন গ্রামে থাকলে তবেই তো গ্রামের উন্নয়ন হবে। তারাই তো পথ দেখাবে গ্রামের মানুষকে। চাকরি-বাকরি পেলেই গ্রাম ছাড়ার হিড়িক অনেককালের পুরানো। এ যেন গ্রামের মানুষের রক্তে মিশে গেছে। সকলে শহরমুখী হতে চাইলে গ্রামের উন্নয়ন হবে কী করে? পল্লীর ব্যথা তো তাহলে বাড়বেই। তাই বিভিন্ন পেশার মানুষের যুগপৎ অবস্থানই তো সেই ব্যথা সারাবে। একটু একটু করে সেটাই তো সম্ভব হচ্ছে। রাস্তাঘাটের উন্নতি যোগাযোগ মাধ্যমকে কত দ্রুততর করে তুলেছে। অর্থনৈতিক উন্নতির বিকাশ ঘটছে। প্রায় ঘরেই তো এখন টিভির আওয়াজ শোনা যায়। কমবেশি সকলেই কত সচেতন হয়ে উঠেছে।

যদুকাকা দারুন খুশি এ পরিবর্তন দেখে। কাঁচা মাটির রাস্তা তেমন একটা চোখেই পড়ল না। মূল রাজ্য সড়ক থেকে এভাবেই প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তাগুলো জঙ্গলমহলের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে। সাপের মতো পড়ে আছে কালো পিচের রাস্তাগুলো। সে রাস্তায় কেউ মেলেছে ধান। কেউ মেলেছে তিল। কেউ মেলেছে মহুল। ওগুলো শুকনো হচ্ছে। এখন আর বর্ষাকালে রাস্তাঘাট কাদা হয় না। আগের মতো কেউ বিপদে পড়লে তাকে খাটিয়ায় চাপিয়ে কাঁধে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় না। এখন ফোন করলেই মুহূর্তে গাড়ি এসে পৌঁছে যাচ্ছে। এমনটাই জানালেন গ্রামের সুবীর নন্দী।

খাওয়া-দাওয়ারও কত পরিবর্তন এসেছে। মাংস ভাত হল গ্রামের মানুষের দারুণ প্রিয় একটা খাবার। সেই প্রাচীনকাল থেকেই। বাড়িতে আত্মীয় এলে মাংস ভাত হবেই হবে। বেশ সম্মানীয় খাবার হিসাবে মনে করা হয়। যেকোনও শুভ অনুষ্ঠানে মাংস ভাতের কোন বিকল্প নেই। জঙ্গলের পাতা খাওয়া, ঘাস খাওয়া ভেড়া ও ছাগলের মাংস তো অত্যন্ত সুস্বাদু। এছাড়াও দেশি হাঁস, মুরগি তো আছেই। সেই সঙ্গে গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে পোলট্রি বা ব্রয়লার ফার্ম। বসেছে মাংসের দোকান। সহজ লভ্য বলে এখন প্রায় দিনই গ্রামের লোকে মাংস খায়। সেইসঙ্গে মাছ তো আছেই। নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, বাঙালি আগে ডাল খেত না। পরে পরে খেতে শিখেছে। জঙ্গলমহলের মানুষও আগে ডাল খেত না। পরে পরে ডাল খাওয়া শুরু করেছে। এখন তো আবার নিজেরাই ডালের চাষ করছে। এখন প্রায় সকলেই ডাল ভাত খায়।

তবে যদুকাকা অদ্ভুত একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছেন। মাংস বিক্রেতা সকালবেলা সবজি কিনে বাড়ি ফিরছেন। ওদিকে গ্রামের চাষিরা সবজি বিক্রি করে মাংস কিনে বাড়ি ফিরছেন। শুধু তাই নয় গ্রামের চাষীরা কেউ কেউ দুধ বিক্রি করে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরছেন। আবার মদ বিক্রেতা দুধ কিনে বাড়ি ফিরছেন। কী দারুণ কম্বিনেশন!

যদুকাকা মেয়ের মুখে শুনলেন, গ্রামের কয়েকটা মেয়ে নাকি পালিয়ে বিয়ে করেছে। দু-জন আবার অন্য জাতিতে। অথচ বেশ কিছু বছর আগেও গ্রামের দিকে এমনটা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। আজকাল অনেক গ্রামেই এমনটা নাকি ঘটছে। গ্রামের মেয়েরাও তাহলে জীবনসঙ্গী নির্বাচনে সাহস দেখাতে পারছে। মেয়েদেরও তার মানে স্বাধীনতা এসেছে। এখন তাদেরও ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মূল্য দেয়া হচ্ছে। জোর করে বিয়ে দেওয়ার ঘটনাও অনেক কমে গেছে। নাবালিকা বিয়ে এখন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। তারপরেও কয়েকটা ব্যতিক্রম ঘটনা যে ঘটছে না তা নয়। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসনের ভূমিকাও বেশ প্রশংসনীয়।

তবে গ্রামগুলোতে মদ্যপানের আসক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। যেটা অনেক বেশি চিন্তার। কিশোর, যুবক, মধ্য বয়স্ক, বয়স্ক সকলেই সুরা পানের দিকে বেশি করে ঝুঁকে পড়ছে। যে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে সুরাপান এখন স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে তারা শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তো হচ্ছেই। সেইসঙ্গে সামাজিক ভাবেও।

জঙ্গলমহল জুড়ে গ্রামগুলোর খোল নলচে এখন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়া এখন গ্রামেও। কী জীবন যাত্রায়, কী শিক্ষা দীক্ষায় সবেতেই। প্রথাগত সব কিছুই যেভাবে একটু একটু করে ভাঙছে। সেটাই মস্ত বড় ঘটনা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

5 Comments

  1. ঠিক গ্রাম আর আগের মতো গ্রাম নেই অনেক উন্নত হয়ে গেছে

    ReplyDelete
  2. জঙ্গলমহল আর সেই জঙ্গলমহল নেই।

    ReplyDelete
  3. Gram guli ke gram na bole ki bola jai......ans plz...bartaman er chitra lekhar modhye khuje pawa gelo

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো

    ReplyDelete
  5. Khub bhalo laglo

    ReplyDelete