জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন/ পর্ব- ১৮ /মলয় সরকার

তুর্কী নাচন 

পর্ব- ১৮ (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মলয় সরকার


আমি শহরের প্রতিটা আনাচে কানাচে, এর উত্থানপতনের ইতিহাসকে আঁতিপাঁতি করে খুঁজছিলাম। ছেলেবেলার থেকে যে ইতিহাসকে পড়ে এসেছি, তাকে নিজের চোখে লক্ষ্য করে দেখার চেষ্টা করেছি।

ফিরে আসি, গ্রাণ্ড বাজারের কথায়। তবে ঢোকার মুখেই ভিতরের বিশালত্ব দেখে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। গাইড ঢোকার মুখে আমাকে বলল, আপনি প্রাণ ভরে যতক্ষণ খুশী ঘুরে দেখে এসে আমাকে ডাকবেন। কোন তাড়া নেই। 

আমরাও দুটিতে ভিতরে ঢুকে দোকানের আর পশরার সারি দেখে বিমোহিত।সমস্ত জায়গায় অবশ্য  উপরে লেখা আছে, কোন দিকে কিসের দোকান ও প্রায় একজাতীয় জিনিসের দোকান এক জায়গাতেই। এটা প্রায় সব বড় বড় বাজারেই থাকে , তা না  হলে, মানুষের  কেনাকাটার অসুবিধা।এই ব্যবস্থা কিন্তু সেই পুরানো দিন থেকেই ছিল। শুধু তফাত হয়েছে এই যে, আগে এখানে দোকানীরা বসত , আমাদের পুরানো দিনের মারোয়ারী গদির উপর  আর জিনিসপত্র থাকত পিছনে।তখন আবার জিনিসপত্র বাইরে আজকের মত প্রদর্শন করা হত না। এটুকুই যা তফাত হয়েছে। 

একটা আশ্চর্য ব্যাপার শুনলাম, এখানে নাকি উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কোন দোকানের নাম লাগানোর প্রথা ছিল না। এর উদ্দেশ্য হল ,যাতে এক দোকানের সঙ্গে আর এক দোকানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হয় বা কম হয়। এটি অটোমান সম্রাটদের কীর্তি। এর নির্মাণে আছে বাইজানটিয়াম স্থাপত্যের ছাপ। উপরের ছাদটা টালি বসানো এবং ধনুকাকৃতি অর্থাৎ ডোম আকৃতির। প্রতি দুটো সারির মাঝ দিয়ে রাস্তা রয়েছে।আমার যদিও দেখে কতকটা আমাদের কলকাতার নিউমার্কেটের মত লেগেছে তবে আয়তন ও অন্যান্য ব্যাপারে নিউমার্কেট এর কাছে শিশু।  এখানে কিছুদিন আগেও ৫ টি মসজিদ, একটি স্কুল , কুয়ো, ফোয়ারা ইত্যাদি যথেষ্ট ছিল।এখন বোধ হয় একটি মসজিদ আছে।(অবশ্য আমাদের নিউ মার্কেটের ভিতরেও একটি মসজিদ আছে) এছাড়া এখানে ছিল, নিজস্ব পোষ্ট অফিস, ব্যাঙ্ক, পুলিশ স্টেশন ইত্যাদি নানা প্রয়োজনীয় জিনিস। এককথায় এটাকে একটা ছোটখাট শহরও বলা যায়। ১৪৬১ সালে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে এই অবস্থায় এসেছে। 

এখানে যে কি বিক্রি হয় না তা বলা মুস্কিল। জামাকাপড় জুতো ,সোনা-রূপার গয়না, খাবার দাবার ,শুকনো ফল, নানারকমের ঘর সাজাবার জিনিস, ইত্যাদি প্রায় সমস্ত রকমের জিনিস। আমি তো বাজারের রাস্তার গোলক ধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলি এমন অবস্থা। এত জিনিসের মধ্যে কিনব কি, ভেবে পাই না। 

গেলাম এক কার্পেটের দোকানে। ওরা তো আর জানে না, আমি কার্পেট কিনব না, সে ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই। আমি এসেছি শুধু দেখতে। বাধ্য হয়েই বসলাম অনিচ্ছাসত্বেও। দোকানী তো  বসিয়ে খুব খাতির, ডাকাডাকি। বলে, নেন, না নেন, দেখেই যান।আমি তো, কার্পেট দেখব, না, তার দোকানের বিক্রেতা মেয়েটিকে  দেখব, বুঝতে পারি না।যেমন সুন্দর কার্পেট, তার চেয়েও বেশি সুন্দর বোধ হয় তার বিক্রেতা।সত্যি কথা, বুলবুল নিজেও এদের সৌন্দর্য্য দেখে আশ্চর্য হয়েছিল। ও-ই আমাকে বলল, দেখে নাও প্রাণ ভরে, এমন সৌন্দর্য্য আমাদের দেশে পাবে না।ওর কথাতে, আরও বেশি করে নজর করি। 

সত্যিই,এদের মেয়েরা দেখতে ভীষণ সুন্দরী।  ছেলেরাও বেশ সুন্দর, মেয়েরা আবার তার থেকেও বেশী। গোলাপের আসল গোলাপী দিয়ে রাঙানো দুই গাল, হাল্কা কালোয় মেশানো পাটকিলে রঙের চুল, খঞ্জন পাখীর মত চোখ আর কবির ভাষার সুরা ঢেলে তারিয়ে তারিয়ে খাওয়ার মত ঢেউ খেলানো গভীর গর্তওলা গালের টোল।তার মধ্যে মিষ্টি হাসির ছোঁয়া। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল,কাজী নজরুল ইসলামের অনূদিত রুবাইয়াৎ ই ওমর খৈয়ামের আঁকা বা বর্ণিত সুন্দরী সাকীদের কথা। আসলে, ইউরোপের মেয়েদের মধ্যে কেমন যেন একটা পাশ্চাত্যের কাঠিন্য (শব্দটা ঠিক প্রয়োগ হল না, রুক্ষতা বললেও হয়ত ঠিক হবে না) আছে,  যেটা প্রাচ্যের মেয়েদের মধ্যে যে কোমলতা আছে তার সঙ্গে কিছুটা তফাত আছে। একেই বোধ হয় আমরা বলি ,কোমল মেয়েলী পেলব লালিত্য।এর কাছেই বাঁধা পড়ে যায় সারা পৃথিবীর কঠিন পুরুষত্ব। এখানে পুরুষদের মধ্যেও তা আছে, তবে ঠিক এরকম নয়।এই জন্যই, আমার মনে হয়, ইরান(প্রাচীন পারস্য), ইরাক , আফগানিস্তান, এই দিককার  মেয়েদের মধ্যে ইউরোপের রঙ এবং প্রাচ্যের লালিত্য দুইয়ের একটা সংমিশ্রণ হয়ে এদের আরও স্বর্গীয় সুন্দরী করে তুলেছে।অনেকে বসরার গোলাপের সঙ্গে এদের যে তুলনা করেন, হাতের কাছে আমাদের দেশের কাশ্মীরের মেয়েদের মধ্যে আমরা যেটা পাই, এখানে তাই যেন আরও বেশি করে ফুটে উঠেছে। 

আমরা যখন বিভিন্ন কার্পেট ফ্যাক্টরীতে যাই, সেখানেও দেখেছি, এইরকম।নিজেকে হারিয়ে ফেলি। কার্পেটের সৌন্দর্য দেখব, না, যে বানাচ্ছে তাকে দেখব! শিল্প দেখব, না, শিল্পীকে দেখব তাই ভুল হয়ে যায়। জানিনা, তাই কি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'শাজাহান' কবিতায়  'তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ'।

এই কার্পেট বিক্রেতাদের একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি। এখানেও দেখছি, কার্পেট ফ্যাক্টরীতেও দেখেছি, ওরা কোন জোর করে না, চাপাচাপি করেনা, কিচ্ছু নয়।বরং নানা গল্প বলে, কি ক’রে, কোথা থেকে, কি ভাবে এসব তৈরী হয়, সেই গল্প করে একেবারে আদ্যোপান্ত। শুধু তাই নয়, ফ্যাক্টরীতে দেখেছি, ওরা গুটি থেকে কি করে ধাপে ধাপে সুতো হয়ে রঙ করে শেষে কার্পেট বোনার জন্য প্রস্তুত হয়, সমস্তটা খুঁটিনাটি অনেক ধৈর্য নিয়ে দেখায়। কোন তাড়াহুড়ো নেই।যত্ন করে বসায়, চা স্ন্যাক্স খাওয়ায়। তারপর তোমাকে ছেড়ে দেয়, ইচ্ছা হলে কিনুন, না হলে নয়।চলে আসার সময়, হাসিমুখে বিদায় দিয়ে আবার আসার অনুরোধ জানায়।তাতে, কিছু না নেওয়ার জন্য কোন বিরক্তি নেই।

একই ঘটনা বা একই রকমের আতিথ্য পেয়েছি, সেই কাপাদোসিয়ার পটারীতে গিয়ে। সমস্তটা কি অদ্ভুত ধৈর্য নিয়ে সমস্ত শ্রমিকরা দেখান, ভাবা যায় না। আমরা এরকম একটা ফ্যাক্টরীতে গিয়েছিলাম, সেখানে এই কার্পেট ছাড়াও নানা পোষাকও তৈরী হয়। বললে বিশ্বাস হবে না, তাদের একটা র‍্যাম্প মত স্টেজ আছে। তার চারদিকে সুন্দর দর্শকাসন। সেই আসনে যত্ন করে সবাইকে বসিয়ে, চা জলখাবারে আপ্যায়িত করে আমাদের মধ্যে থেকে অনেককে ডেকে র‍্যাম্পে হাঁটিয়ে তাদের জিনিসপত্র দেখিয়েছিল। এর মধ্যে আমাকেও তুলেছিল সেই র‍্যাম্পে। গায়ে দিয়েছিল, একটা সুন্দর জামার মত জিনিস। আগে বলে দিয়েছিল, কি করতে হবে।আমি তো পড়েছিলাম ভীষণ অস্বস্তিতে।যাই হোক, বেড়াতে এসে সে এক নতুন এবং আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।

তবে আমার দেখা অভিজ্ঞতার মধ্যে, এরকম ভাবে যে বিক্রী  করা যায়, এটা নতুন সঞ্চয়।

ফিরে আসি, গ্রাণ্ড বাজারে। সুন্দরী তো আমাদের, তার গোলাপী দু গালে হাসির ঢেউ তুলে কার্পেট দেখাতে লাগল।

কার্পেট দেখে আমাদের বিস্ময় চরমে। সেসব ছেড়ে, খালি হাতে উঠে আসতে লজ্জায় মরি।ওরা বলে, কোনও চিন্তা নেই, আবার আসবেন, আমাদের কথা সবাইকে বলবেন, ইত্যাদি।

এখানে কোন টুর গাইডের সঙ্গে গিয়ে কিনতে নেই।তাহলে, সেই গাইডকে কমিশন দিতে হবে বলে জিনিসের দাম বেশি হবে।কিনতে হলে, নিজে দর দাম করে কেনাই ভাল।

ল্যাম্প শেডের দোকানেও ,বিভিন্ন রঙের ও ধরণের এত রকমের হস্ত শিল্প যে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।আমাদের কোলকাতাতেও অত সুন্দর জিনিসপত্র দেখিনি সবথেকে বড় দোকানেও। 

আর সেই রকমই সুন্দর সিরামিক্স ও পটারীর দোকান। মনে হয় যেন সেই প্রাচীন যুগের কোন হস্তশিল্পের দোকানে এসে গেছি।এগুলো যেখানে তৈরী হয়, সেই ফ্যাক্টরীও দেখে এসেছি।দেখে এসেছি, সেই শিল্পীদের।শিল্পের সঙ্গে শিল্পীকে চেনাটাও প্রয়োজন। এখানে রয়েছে, ইজনিক, কুটাহিয়ার বিখ্যাত সব হস্তশিল্প। এছাড়া আমাদের দেখে আসা কাপাদোসিয়ার হিতাইত জাগ কিংবা বিভিন্ন ধরণের অন্য জাগ।
সিরামিকের জন্য অবশ্য আর একটি বাজারও আছে  ব্লু মস্কের পিছনে, তার নাম আরাস্তা বাজার (Arasta Bazaar)।সেখানে অবশ্য আমরা যাই নি।

এছাড়া রয়েছে তামার সুন্দর পাত্র, কফি পট ইত্যাদি।

কত ধরণের যে হুঁকো রয়েছে, যে কোন যাদুঘর হার মেনে যাবে তাদের বিচিত্র সৌন্দর্য ও ধরণ দেখে।রঙিন কাঁচ, সিরামিক শিল্পের ছোঁয়ায় তা হয়ে উঠেছে অনবদ্য।
সোনার বা জুয়েলারী দোকান, শয্যাদ্রব্যের দোকান,টার্কিশ হামামের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ফ্যাসন জিনিস, খাবার জিনিস, নানা উপহারের দোকান ইত্যাদির রঙে জৌলুসে, বিচিত্রতায় প্রাচীনত্বের ছোঁয়ায় এক রহস্যময় যাদু মহলের সৃষ্টি করেছে যেন।
চলুন এরপর পরের পর্বে–

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments