জ্বলদর্চি

একমাত্র ঠাকুর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর /মিলি ঘোষ

একমাত্র ঠাকুর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

মিলি ঘোষ


সাগরের উপরিতল থেকে তাঁকে দেখি, তবু ডুব দেবার সাহস হয় না। হ্যাঁ, তিনি রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে
নিয়ে বলতে যাওয়া ধৃষ্টতার নামান্তর। তবু কিছু কথা থাকে, যা একান্তই নিজের।
 রবীন্দ্রনাথের একটি অন্যতম সৃষ্টি হলো তাঁর নৃত্যনাট্য । গীতিনাট্য না বলে নৃত্যনাট্য এই জন্যই বলছি, নৃত্যনাট্যে গান এবং নাচ একে অপরের পরিপূরক। এই কারণেই গীতিনাট্যের তুলনায় নৃত্যনাট্য অনেক বেশি আকর্ষণীয়। 

নৃত্যনাট্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ হলো 'তাসের দেশ'। অসামান্য কল্পনাশক্তির প্রকাশ এই 'তাসের দেশ'। নিয়মের বেড়াজাল সে'কালেও ছিল, এ'কালেও আছে। কিন্তু তখন তা ছিল অনেক প্রকট। এই নৃত্যনাট্যে রবীন্দ্রনাথ সেই অন্ধ সংস্কারের বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণা করেছেন। 

  দুই উল্লেখযোগ্য চরিত্র রাজপুত্র আর সওদাগরপুত্র বানিজ্যে বেরিয়ে এমন এক দেশে গিয়ে উপস্থিত হন, যে দেশের সবাই কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ। সে দেশ তাসেদের দেশ। সেখানকার নিয়ম-কানুনের বহর দেখে বাদানুবাদ শুরু হয় তাসের দেশের নাগরিকদের সাথে রাজপুত্র আর সওদাগরপুত্রের। কিন্তু মানুষের স্বাধীন ও খোলামেলা জীবনযাপনে আকৃষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে ওই দেশের বাসিন্দাদেরও নিয়ম ভাঙতে ইচ্ছে করে, এমনকী তাসের দেশের রাজা-রানীরও। পুরোনো নিয়ম ভেঙে নতুনকে আহ্বান জানায় সকলে। ভেঙে পড়ে তাসের ঘর। এই জায়গা থেকেই আমরা বুঝতে পারি কেন নৃত্যনাট্যটির নাম 'তাসের দেশ'। রাজপুত্রকে রবীন্দ্রনাথ এখানে সমাজ সংস্কারক হিসেবে দেখিয়েছেন। তাই নৃত্যনাট্যের শেষ গানে তিনি বলেছেন,
       "জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক।" 
       
  সমাজের আর এক রূপ দেখা যায় 'চন্ডালিকা' নৃত্যনাট্যে। যখন চন্ডালকন্যা হবার অপরাধে একটি মেয়ের দিকে আঙ্গুল ওঠে , "ওকে ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছি। ও যে চন্ডালিনীর ঝি।"
 তখন এক বৌদ্ধসন্ন্যাসী ওই মেয়ের হাত থেকেই জল খেয়ে যান।
বলে যান, " যে মানব আমি, সেই মানব তুমি কন্যা।" 
এখানেও রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন সমাজের চালচিত্র এঁকেছেন এবং মানুষকে জাতপাতের ঊর্ধে  নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন তাঁর লেখনী দিয়ে। 

আবার 'চিত্রাঙ্গদা' শুরু হয় একটি গান দিয়ে, "গুরু গুরু গুরু গুরু ঘনমেঘ গরজে...। "
 এটি শুনে মনে হয়, যেন আকাশ কালো করে এখনই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে।
  এখানে আছে একজন নারী, যে তার রূপের প্রশংসার থেকে অনেক বেশী চায় সম্মান, আত্মমর্যাদা। রবীন্দ্রনাথ এই আধুনিক মনস্কতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন এই নৃত্যনাট্যে। 
রাজপুত্র, বৌদ্ধসন্ন্যাসী, চিত্রাঙ্গদা এরা প্রত্যেকেই আলোর দিশারী হয়ে দেখা দিয়েছেন।  
  
  রবীন্দ্রনাথের বহুমুখিতার মধ্যে যা বিশেষ উল্লেখযোগ্য, তা হলো তাঁর ছোটগল্প। প্রতিটি গল্পের অপ্রাপ্তির জায়গা থেকেই গল্পগুলির প্রতি আমরা আকৃষ্ট হই।  
যেমন, 'সুভা' গল্পের শেষে আমরা ভাবি, এরপর সুভা-র কী হলো এবং এই ভাবনাটা আমাদের আজীবন তাড়িয়ে বেড়ায়। এই গল্পটিতেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "রুদ্র মহাকাশের তলে কেবল একটি বোবা প্রকৃতি ও একটি বোবা মেয়ে মুখামুখি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত -- একজন সুবিস্তীর্ণ রৌদ্রে, আর একজন ক্ষুদ্র তরুচ্ছায়ায়।" 
একজন লেখকের কী ভয়ঙ্কর অনুভূতি থাকলে, তার প্রকাশ, এই বাক্যগুলির মধ্য দিয়েই হতে পারে।
   
 'অতিথি' গল্পটিতে যে তারাপদকে আমরা পেলাম, সে সমাজ সংসারের নিয়মছাড়া, বাঁধনছাড়া এক চরিত্র। প্রকৃতির প্রতি তার এক অদ্ভুত ভালোবাসা, যা ব্যক্তি ভালোবাসার ঊর্ধে। এই গল্পেও আমরা চেয়েছি তারাপদ ফিরে আসুক। কিন্তু ফিরে এলে কি আমরা তাকে নিয়ে আর ভাবতাম ? এই যে সারাজীবন ধরে তারাপদ-র কথা ভেবে যাওয়া, সে ফিরে এলে এই ভাবনায় ছেদ পড়তই। 
 
  আবার 'পোস্টমাস্টার' গল্পে, গল্পের নাম 'পোস্টমাস্টার' হলেও ভরকেন্দ্রে আছে 'রতন'। যুক্তাক্ষর শেখা বা না শেখার ওপর রতনের জীবনের মানচিত্র একটুও বদলায় না। শুধু পাল্টে যায় অনুভূতি। তার 'দাদাবাবু'র স্নেহ-ভালোবাসায় সে বালিকা থেকে বড় হয়ে উঠল। দাদাবাবু সেটা বুঝল না।
 এখানেই রবীন্দ্রনাথ। এই অপ্রাপ্তিই, পাঠকের মনে গভীর রেখাপাত করে।  

 রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের বিপুল ভান্ডার থেকে অল্প কথায় বলা খুব মুশকিল। প্রকৃতি, প্রেম, পূজা, সকল বিষয়ে এত কবিতা ও গান, যা পড়ে শেষ করা যায় না।
 আমাদের চোখে যা সামান্য, তাকেই তিনি অসামান্য করেছেন তাঁর লেখনী দিয়ে। ক্ষুদ্র জোনাকিকে তিনি কবিতায় স্থান দিয়েছেন, সুর ঢেলেছেন পরম মমতায়।
জোনাকির উদ্দেশ্যে লিখেছেন,
 "তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র,
  তোমার তাই বলে কি কম আনন্দ!
  তুমি আপন জীবন পূর্ণ ক'রে 
  আপন আলো জ্বেলেছ।" 
  
 আবার মাত্র দু'টি বাক্যে 'ক্ষুদ্রের দম্ভ' দেখিয়েছেন।
  "শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির
  লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।" 

কখনও তিনি অভিমানী। লিখেছেন,
"আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে, চাও কি -
হায় বুঝি তার খবর পেলে না।"

কখনও বা তিনি একাকী, ঠিক আমাদেরই মতো। না হলে কী করে লিখলেন, 
"আমি কী বলিব, কার কথা,
কোন সুখ কোন ব্যথা -
নাই কথা, তবু সাধ শত কথা কই।"

রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সব সময়ই শিক্ষামূলক। প্রবন্ধের ছত্রে ছত্রে তাঁর জীবনদর্শন। আমাদের চিন্তার পরিধিতে যা থাকে না, সেটাই পাই তাঁর প্রবন্ধ থেকে। জীবনকে নতুন করে ভাবতে শেখায় এই প্রবন্ধগুলি। মনে হয়, এমন করে তো আগে কখনও দেখিনি। 

  তাঁর শৈল্পিক চিন্তার প্রকাশ থাকে কাটাকুটিতেও। লিখতে গিয়ে যে জায়গাটা কেটেছেন, সেটাও একটা ছবির আকার পেয়েছে। কখনও বীণা, কখনও তবলা বা খোলের রূপ দিয়েছেন তিনি। 
তাঁর সূক্ষ্ম রসবোধ আমাদের মোহিত করে। 'খ্যাতির বিড়ম্বনা' , 'আশ্রম পীড়া' এর অন্যতম উদাহরণ। আবার ততোধিক তেজস্বীও ছিলেন তিনি।

 জালিয়ানওআলাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ইংরেজের দেওয়া 'নাইট' উপাধি হেলায় ফিরিয়ে দিলেন। হুজুকে মাতায় তাঁর বিশ্বাস ছিল না। তাই গোটা দেশের আবেগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি 'ঘরে বাইরে' উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর নোবেল প্রাইজ চুরি হওয়াতে আমরা ব্যথিত। তিনি জীবিত থাকলে, এই ঘটনায় তাঁর কিছু এসে যেত বলে মনে হয় না। আমরা তাঁকে যতটা বুঝেছি, তার চেয়েও বেশি বোধহয় তিনি বুঝেছিলেন নিজেকে।
 তাই লিখে যেতে পেরেছিলেন, 

 "আজি হতে শতবর্ষ পরে,
কে তুমি পড়িছ বসি
আমার কবিতাখানি, কৌতূহলভরে।" 

  সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় সুখ-দুঃখ পালা করেই আসে জীবনে। কিন্তু একজন মানুষ এত দুঃখ সহ্য করলেন কীভাবে? একটার পর একটা শোক সামলেছেন। এই শোকের মধ্য দিয়েই নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন।তারপরেও মানুষকে বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছেন। যন্ত্রণা ছিল তাঁর ঠাকুর চাকরের ঘেরাটোপের জীবনেও। বিরোধী ছিলেন প্রথাগত বিদ্যার। তিনি হয়ত উপলব্ধি করেছিলেন, যে একটা সময় আসবে যখন আমরা তাঁকে ছুঁয়ে দেখতে চাইব। তাই বোধহয় বলেছিলেন,
"আবার যদি ইচ্ছা করো,
আবার আসি ফিরে।" 
কিন্তু তিনি এলেন না, থেকে গেলেন তাঁর সৃষ্টিতে। 

  রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই।  ছোটবেলায় পড়া 'অমল ও দইওয়ালা' আজও স্মৃতিতে অটুট। ভুলতে পারি না মহাভারতের চরিত্রদের নিয়ে তাঁর 'গান্ধারীর আবেদন', 'কর্ণকুন্তীসংবাদ'। 'শেষের কবিতা'ও একটি অসমাপ্ত প্রেমের কাহিনী। তবে এই উপন্যাসের চরিত্ররা রতন বা সুভা'র মতো নয়। শিক্ষিত, অভিজাত পরিবারের চরিত্র এরা। রবীন্দ্রনাথের বিচরণ কোথা থেকে কোথায়, তা নির্ধারণ করা একমাত্র রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব। নিজেদের ক্ষুদ্রতা দিয়ে তাঁকে পরিমাপ করতে যাওয়া মূর্খতা। তাই আজও, তিনিই একমাত্র ঠাকুর, আমার রবীন্দ্রনাথ।

  মাঝেমাঝে সৃষ্টি ছাপিয়ে যায় স্রষ্টাকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সদা বিকশিত। তাঁর অসীম সৃষ্টির গভীরতায় আমরা একটু একটু করে হারিয়ে যাই, আবার ফিরে ফিরে আসি। হয়ত ব্যস্ত জীবনে ভুলে থাকি, তবু কাজের ফাঁকে ফাঁকে কাছে পাই। অবসরে ঘিরে থাকি তাঁকে। খুঁজে পাই রাতের আঁধারে, ভোরের আলোতেও। তাঁর সুরেই দুঃখে থাকি, তাঁর সুরেই আনন্দে। তাঁর সুরেই সুর মিলিয়ে বলি, 
  "তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা
   তুমি আমার সাধের সাধনা।"

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

10 Comments

  1. অত্যন্ত সুখপাঠ্য

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর বিশ্লেষণ ও সমীক্ষা

    ReplyDelete
  3. সহজ সরল ভাষায় সুন্দর সমীক্ষা করলে।

    ReplyDelete
  4. অপূর্ব অনবদ্য লেখনী.. গভীর মনন ও উপলব্ধির প্রলেপে অনুভূতির সহজ সুন্দর প্রকাশ...আহাঃ

    ReplyDelete
  5. Khub bhalo laglo

    ReplyDelete
  6. ধন্যবাদ

    ReplyDelete