জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-২১/সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-২১

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

এই অধ্যায়গুলো কখনো আলোয়, কখনো দেখি এক শুন্য গাছের তলায়। ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টানোর মতো দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেল। আমি তখন এক ওয়ারিওর যুবতী। পড়াশুনা করে আমাকে দাদাদের মতো অনেক বড় হতে হবে, এই আমার স্বপ্ন তখন। মেয়েরা তো কতকিছু ভাবে ঠিক আমার মত-সবার কি আর সব মনের মত হয়? তবে আমি বিশ্বাস করি, হয় হয়-চেষ্টা আর ধৈর্য থাকলে হতে বাধ্য।

বাবার ইচ্ছাতেই সেতার শিখতে শুরু করেছিলাম। অবশ্যই বাড়িতে। পড়াশুনোর সঙ্গে তা চলছিল নিয়মিত। বাবার ইচ্ছে ছিল না যে, অবসর সময় বসে বসে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা মারি-তাই এই ব্যবস্থা।

অপরিণত বয়সে-সবার মত আমার জীবনেও প্রেম বারে বারে হৃদয়ের সদর দরজায় কড়া নেড়েছিল। বয়সটাই তো তখন স্বপ্ন দেখার। অবশ্যই তা দূর থেকে। মনে মনে... ঘুম ভাঙ্গা রাতে।

উদ্ধত জীবনের সেই হরমোনাল আর বায়োকেমিক্যাল রিয়াকশনে ঘটে গেছে কত গল্প। প্রেম শুধু না। সে তো সবার জীবনেই আসে। আবার একটা বেশ পরিপক্ক সময়ের ঘটনা।

--তোমার কি মনে হয়? প্রেম করতে পেরেছিলে? সাকসেফুল হয়েছিল, মনে হয় না। আর তুমি প্রেমের কাঁচকলা বুঝতে। পলাশ আবার একটা চুটকি দিল।

--তোমার মাথা। তখন তো চোখের সামনে যা দেখতাম তাই মনে হত দেদার প্রেম। কাউকে দেখে ভালো লাগলেই... ব্যস! স্বপ্নের শুরু। কানে বাজত প্রভাত পাখীর গান। প্রেমের ছায়া পড়ে এত এত স্পর্শকাতরতা। জ্যোৎস্না চলে গেলে অন্ধকার থাকে না যেমন শব্দ থেমে গেলেও গোলমাল ঘুমোতে পারে না ।

তবে আমি বুঝেছি... জীবনের রাস্তায় চলতে চলতে মানুষের মন খুব ছোট হয়ে যায়। কোন সাদা জায়গা দেখলেই তাতে কালো আঁচড় দিতে কিছু মানুষ খুব ভালোবাসে। দেখতে দেখতে অনেকটা পথ অতিক্রম করে এসেছি আমরা। অতিক্রম করেছে সমাজ। কিন্তু পৃথিবীর কোণে কোণে মানুষের মানসিক ভাবধারা বদলায়নি একটুকুও।

২০১৯-এ গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন অফ কালচার-এ ছিলাম। বটির জব্বলপুরের বন্ধু শিবুদার সাথে দেখা হয়েছিল। ও তো লন্ডনে স্পোর্টস মেডিসিন -এর ডাক্তার।

শিবুদা বলল শুনলে তো... “শিমুল একটা মিষ্টি ফুটফুটে মেয়ে ছিল। প্রায় চল্লিশ বছর পরে দেখা।”

ওখানে সবাই আবার শিবুদাকে রাগাচ্ছিল আমাকে নিয়ে। শুনেছ তো। কি অদ্ভুত মানুষের মন। আমি এই প্রথম ওর সাথে কথা বললাম। আগে কোনদিন কথা বলি নি। অথচ আমাদের বাড়ির পেছনেই থাকত ওরা।

সবাইকে বলছিল, “আমি শিমুলকে এইটুকু দেখেছি। খুব লাজুক ছিল।”

আমাদের ছিল খুব কড়া অনুশাসনের বাড়ি।

মেয়েদের কলেজ। মিলিটারী ভ্যানে যেতাম। হাসি পায় এখনও। জীবনটা বড্ড ধরা-বাঁধার মধ্যে কেটেছে গো। সবাই যেন মিলিটারি শাসনে রেখেছিল। প্রশ্ন জাগে মনে, “মা বাবা ছিল না তাই কি?”

সেই ভ্যানে ঢোকার মুখে আবার দুজন বন্ধুকধারী গার্ড থাকত। কারণ ভ্যানে যেত অর্ডন্যান্স ফ্যাকট্রীর জেনারেল ম্যানেজারের দুই মেয়ে। ব্যস! কেল্লা ফতে। আমার সেজদা আর পাশের বাড়ির পপ্পির বাবাও যেন হাতে স্বর্গ পেল।
এইবার একটু মজার গল্প বলি। আমাদের কলেজ যেতে ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ পাশ করলেই একটা বিশাল গাছের তলায় ছোট্ট মতন হনুমানজীর মন্দির ছিল। সেই মন্দিরের কাছে একটা সাধু দাঁড়িয়ে থাকত। যেই আমাদের ভ্যানটা কাছাকাছি আসত আর সে তার অরেঞ্জ কালারের লুঙ্গি উপরে তুলে আমাদের ভ্যানের দিকে তাকাত। দুস্টু মেয়ের দল সেই সাধুর ঠিক নির্দিষ্ট জায়গায় একদিন কিছু কুল ছুঁড়ে মেরেছিল। তারপর ওই বন্ধুকধারী গার্ডেরা তাকে শায়েস্থা করেছিল। সত্যি এখনও ভাবলে অবাক লাগে। একটুও মিথ্যে বলছি না গো। পপ্পির সাথে যখন কথা বলব, তখন ভালো করে বলে দেবে ও।

-হা হা হা এটা কিন্তু দারুন! যাই বলো। মেয়েদের মধ্যেও দুষ্টু মেয়ে আছে, তাই না?

--তোমার জব্বলপুরের কলেজ লাইফের কথা বলো, শুনি। তোমাদের কলেজে তো শুনেছি মিস ফেমিনা দেবিকা হর্ষে, জয়া ভাদুড়ির বোন রীতা ভাদুড়িও পড়ত।

--তুমি জানলে কিভাবে?

--তোমার বটি বলেছিল।

--ওহ! জয়া ভাদুড়ি-রা ছিল সেজবৌদিদের নিকট আত্মীয়। -হ্যাঁ! সে নিয়েও একটা গল্প আছে। কলেজে ফ্যাশন প্যারেড হত। চুল খুলে ডায়াস এর ওপর দিয়ে হাঁটতে হবে। ফার্স্ট ইয়ার থেকে আমাকে সিলেক্ট করেছে। আমার তো কোঁচকানো কোমর পর্যন্ত চুল ছিল। আর তো সবার প্রায় বব কাট চুল। দশ বারোজনের সুন্দর লম্বা চুল ছিল।

জাজ হবেন-জয়া ভাদুড়ি, আরো দুজন। জয়া ভাদুড়ি দুই ছোট ছেলে মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন বাপের বাড়ি। বৌদির ব্যাচ-এর মেয়ে ছিল জয়া ভাদুড়ি। তারপর ওনারা সেই বাড়ি খালি রেখে চলে গেছিলেন মুম্বাই এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

আমি রিহার্সাল দিয়েছি-কিন্তু প্রোগ্রাম এর দিন যাইনি ভয়ে আর লজ্জায়। বাড়িতে বলেছিলাম “পেটে খুব যন্ত্রণা করছে।” তবে জ্বর ও এসে গেছিল জানি না কেন? তারপর পপ্পিকে বলে দিয়েছিলাম কলেজে জানাতে।

দিদিয়া তো ঠিক বুঝতে পেরেছিল—কিন্তু কিছু বলেনি তার জন্য। কলকাতায় বাণীচক্র গানের স্কুল থেকে একডালিয়ায় সরস্বতী পুজোর সময় আমাকে সবার সাথে গীটার বাজাবার জন্য স্কুল থেকে ঠিক করা হয়েছিল। সেই আগের ঘটনার মত সেখানেও বাজাইনি। আমেরিকায়ও সবাই আমার চুল খুব পছন্দ করত। কিন্তু তোমার জন্য কাটতে হল। চুল নিয়ে আমার খুব গর্ব ছিল।

--তোমার সেই ছোটবেলার বান্ধবী পপ্পির সাথে তো কথা হল। খুব ভালো ওরা। আমার খুব ভালো লেগেছে কথা বলে। কি সুন্দর বাংলা বলে।

--হ্যাঁ! ওরা খুব ভালো। আমার সব পাঞ্জাবী, মারাঠি আর মাদ্রাজী বান্ধবীরা খুব ভালো ছিল।

ঝাড়গ্রাম থেকে গিয়ে প্রথম প্রথম বাংলা বলতাম, মারাঠি বান্ধবীরা শুনে বলত, “ সরি-মচ্ছি আউর পিলপিলা-ভাত...”।

মুখ কাঁচুমাচু করে যত বলতাম- “ম্যায় সরি মচ্ছি আউর পিলপিলা ভাত নেহি খাতি।” নিজেরা কিন্তু মারাঠিতেই কথা বলছে--আমি বাংলা বললেই ওরা ওইভাবে আমাকে রাগাত।

তখন আমার এক মারাঠি প্রিয় বান্ধবী সুনীতা দীক্ষিত আমাকে শিখিয়েছিল, “শিমুল! তু ভি বোলা কর... “ কারি ভাও”---আর ওরা তখন রেগে যেত—পরে অবশ্য ভাব হয়েছিল সবার সাথে।

– “কারি ভাও”- মানে কি আবার? কি মজা তুমি কত রকম ভাষা শুনেছ।

--কারি ভাও মানে -কারি-এর মত হাব-ভাব। মারাঠিরা তো সব কিছুতেই কারি পাতা দেয় আর কারি খায়, তাই এই প্রচলিত প্রবাদ বাক্যটা বললে ওদের প্রেস্টিজে লাগত।

বান্ধবীদের মধ্যে বাঙালি ছিল না, বললেই চলে। যারাও বা ছিল তারা বাংলা বলতে পারত না। আমার পাল্লায় পড়ে মাঝে মাঝে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলত।

বাড়ির সামনের মাঠ পেরিয়ে প্রভা আর লছমিদের জমজ বোনেদের কোয়ার্টার ছিল। ওরা আমাদের সাথেই পড়ত। একবার কি হয়েছে জানো?

ওদের বাড়িতে ইডলি করেছে ওদের মা বলেছেন সীমাকে ডেকে আন-একসাথে খাবি আর ওর মাঠায় বেলি ফুলের গজরা লাগিয়ে দেব। আমি চান করে দেখি দুই জমজ বোনে বসে আছে-আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে যাবে বলে। দিদিয়া বলল, “ যা ওর মা ডেকে পাঠিয়েছেন তোকে।”

গেলাম-যাওয়ার সাথে সাথেই ওর মা আমার মাথায় গজরা লাগিয়ে দিল। এইবার খাবার টেবিলে বসতে গিয়ে দেখি-একটা স্টিলের বাসনে ইডলিরা সা্রি বেঁধে আছে। পাশে সম্বরম আর চাটনি। ওর বাবা-মা টেবিলের দুপাশে বসেছেন। আমি আর প্রভা একদিকে আর লছমি আর ওদের দাদা মুন্না একপাশে। এবার খাওয়া শুরু হল। আমি তো আগে ইডলি খাই নি-টক দইয়ের গন্ধে আমার নাড়ীভুঁড়ি বেরিয়ে আসবার জোগাড়। কোনরকমে বমি আটকে একটু করে খাই আর 'ওয়াক' ওয়াক' করি--কিন্তু না সবার সামনে না--মুখ টিপে। দেখলাম এবার ওরা খাওয়ায় মত্ত- আর আমি আমার প্লেটের খাবার টেবিলের তলায়। ভাগয়িস ওদের বেড়াল্টা টেবিলের তলায় বসে ছিল-আমি ফেলছি আর ও টুক করে খেয়ে নিচ্ছে। কি অস্বস্তিকর অবস্থা হয়েছিল আমি আর আমার ভগবান জানেন। বাড়ি আসার সময়ে ওর মা জিজ্ঞেস করলেন, “কেইসে লগি ইডলি-” বেশি কথা তখন বলতাম নাতো। ঘাড় নেড়ে জানালাম-খুব ভালো লেগেছে।

-এখন তো খাও?

মানুষ অভ্যাসের দাস-সেটা বিশ্বাস করি মনে প্রাণে।

পপ্পির খুব ইচ্ছে ছিল...বাঙালি ছেলে বিয়ে করবে। কিন্তু পেল না তো। সবার আগেই আমার তো বিয়ে হয়ে গেছিল। পপ্পির গল্প করি-শোনো...

আমাদের বাড়ির একপাশে পপ্পিরা থাকত আর অন্যপাশে থাকত বিল্লেরা। এখন যে ওর বর্তমান স্বামী। ধরো- ছোটবেলা থেকে দেখাশোনা। ওর বিয়ে হল শেষে সেই বিল্লের সাথে।

পপ্পি বলত, “রাতে জুড়াওয়ালা হাজবেন্ডের... জুড়া আউর দাড়ি কেটে দেব।”

পলাশ হা হা হা করে শব্দ করে হেসে উঠল। পরের দিন কথা বলার সময় বলব তো ওকে।

সেদিন বিল্লের সাথে কথা বলতে সে বলল দেখলে না? “হাঁ হাঁ! সব ইয়াদ হ্যায় সীমাজী।”

-ভবিতব্য আর কাকে বলে?

পপ্পি মন খারাপ হলে গীতা দত্তের পুরনো গান গাইত... “এ দিল মুঝে বাতা দে।” এটাই বেশি গাইত। আর আমি তো এইসব গান শুনিই নি। টিপিক্যাল এক বাঙালি মেয়ে তখন। ওর গান শুনে আমরা রাগাতাম ওকে। ও একটুতেই তখন রেগে যেত। বাড়িতে ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় ছিল তো তাই। আমরা খেলবার জন্য ডাকাডাকি করলে নিজের ঠাকুরমার ওপর রেগে গিয়ে বলত,-” মম্মি বহু নেহি-ম্যাঁয় হুঁ। পাপাজি আয়েগা কাম সে, গরম গরম উনকে লিয়ে রোটি বনানা হ্যায়। তু লোগ খেল আজ।”

তবে কলেজ থেকে এসে রোজ-ই প্রায় পিট্টু খেলতাম। লাভলি,বাবলি, বেবি, গোপা, মিঠু য়ামার ছোট ভাই বাবু আর ওর বন্ধু বার্নাড ওরাও খেলতে। পপ্পিদের সামনের বাগান আর আমাদের বাগান মিলিয়ে খেলা চলত। আমাদের বাগান আর ওদের বাগানের মাঝখানের পার্টিশন ওর বাবা ভেঙ্গে দিয়েছিল। বাইরে খেলার তো সুযোগ ছিল না। সেখানে ছেলেরা আড্ডা মারত। যেদিন বৃষ্টি পড়ত, কলেজ থেকে এসে আমরা পপ্পিদের বারান্দায় বসে গল্প করতাম,...ওরা তিন বোন আর আমি। পপ্পির মা জানলা থেকে উঁকি মেরে দেখত। আমাদের কথা আর হাসির আওয়াজ শুনে বাইরে এসে আমাদের বলত- “কঁহি নেহি যাতি-ইতনা ক্যা ফুসুর ফুসুর করতি রে রাতদিন। চল সিলাই কর। শিমুল যা ক্রোসিয়া লেকে আ”...

যাই হোক ওর মা-এর বকাবকিতে ক্রুশটা এখন ভালোই পারি। আমাদের সময়ে বকলে আমরা রাগ করতাম না-বরঞ্চ খুশি হতাম। পাঞ্জাবীদের বিয়ের সময় ছেলের বাড়ি থেকে জানতে চায়-মেয়ে সেলাই জানে কিনা। আর মেয়ের হাতের সেলাই দিয়ে তত্ত্ব সাজাতে হয়। এখন সেই নিয়ম আছে কিনা জানি না অবশ্য। তবে পপ্পি আর বোনেরা নিজেদের ছেলেদের মাথায় লম্বা চুল রাখে নি। মোনা পাঞ্জাবীদের মত রেখেছে... ওদের মাথায় চুল আমাদের মতো স্বাভাবিক।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments