জ্বলদর্চি

আজও একমাত্র তিনিই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ শ্যামশ্রী দাশগুপ্ত

আজও একমাত্র তিনিই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

শ্যামশ্রী দাশগুপ্ত          
                                                                    

বড় সাধ হচ্ছে বছরের সবকটা মাসের নাম যদি ‘বৈশাখ’ মাস হয়, তাহলে বেশ হয়। বাঙালি এমনিতেই উড়ু উড়ু স্বভাবের। বৈশাখ মাস এলে সারা পৃথিবী যেন উড়ু উড়ু হয়ে যায় রবীন্দ্র প্রেমে। অবশ্য নতুন প্রজন্ম এই সুখ থেকে বঞ্চিত। তাদের কারুর মতে কাজ ছিল না বলে গাদা গাদা লিখেছেন, কারুর মতে প্রচণ্ড পেশাদারী ছিলেন বলে নিজের সব সৃষ্টিকে এমন সযত্নে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে গেছেন, যেন গিনিস্‌ বুকের জন্য প্রস্তুতি। তা ওরা বলতেই পারে কারণ ওদের না আছে সময়, না আছে পেশাদারী মনোভাব। আমরা, মানে একটু পুরানো প্রজন্মের জন্য রবীন্দ্রনাথ চির সখা, চির নবীন প্রেমিক। তাই সব দিন তার জন্মদিন, সব দিন রবীন্দ্র জয়ন্তী। ছোটবেলা থেকেই এই ‘রবীন্দ্র জয়ন্তী’ নিয়ে এমন আবেগপ্রবণ ছিলাম যে মন হত যা কিছু করি, তিনি শুনবেন।

 বহু বছর পর ঠিক এমন অনুভূতি হল জ্যোতিষ কুমার দেবের বাড়িতে ‘রবীন্দ্র জয়ন্তী’ অনুষ্ঠানে গিয়ে। একেবারেই অপ্রস্তুত অবস্থায় সেখানে উপস্থিত হয়ে মনে হল, কী কাণ্ড, কী কাণ্ড।

        ঘরে ঢুকে চোখ চলে যায় যে ছবিটার দিকে সেটা বাল্মীকি প্রতিভার বাল্মীকির বেশে রবীন্দ্রনাথ। মানে যুবা রবীন্দ্রনাথ। উনার প্রেমে না পড়ে উপায় আছে? বাড়ির চারিদিকে রবীন্দ্র রবীন্দ্র ভাব। ক্রমশঃ তা জমে উঠতে শুরু করলো শিল্পীদের আগমনে। গৃহকর্ত্রী আর গৃহকর্তা প্রচণ্ড সাবলীল। যেন নিজের বাড়ির কোন এক সদস্যর জন্মদিন। প্রথমে এলেন সরকারী উচ্চ পদস্থ অধিকারী  শ্রী অবনী রঞ্জন পাঠক  যিনি বেতার শিল্পী। জ্যোতিষ উনার হাতে গিটার ধরাতেই উনি টুংটাং বাজাতে শুরু করলেন। আমাদের মত হাভাতে দর্শকদের সামনে বাজাতে বোধহয় খুব একটা উৎসাহ না পেয়ে সবাইকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করলেন গুন গুন গান গেয়ে। গৃহকর্ত্রী স্বপ্না দেব গুণমুগ্ধ শ্রোতার মত উনার পাশে গিয়ে বসতেই উনি নিজেই উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বললেন-

 ‘শুরু করুন গান। আমি বাজাব’। 
স্বপ্না- ‘আমি গান গাইতে জানি না। আপনি বাজান আমি শুনবো’।
 ‘ কিছু নিশ্চয়ই বাজান। তবলা, হারমোনিয়াম, কিছু’? 
স্বপ্না- ‘হ্যাঁ, সেটা পারি’।
‘কি বাজান’?
 স্বপ্না- ‘আগে রেডিও, এখন টেপ রেকর্ডার’।

              এমন উত্তরের জন্য অবশ্যই তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। আমি অনেক কষ্টে হাসিটা চেপে রাখলাম পাছে এবার আমাকে পরীক্ষায় বসতে হয়। আমি তো ওটাও জানি না। তখনও অতিথিরা আসতে দেরী করছে বলে যারা বসে ছিলাম, সবাই সুরে বেসুরে শুরু করলাম ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’। রবিঠাকুর বাঙ্গালীদের চরিত্র জানতেন তো তাই উনি এমন একটা গান লিখেছেন যেটা গাইলে কেউ আর না এসে থাকতে পারে না কারণ গহন পথের ভয় সবার। এবার একে একে আসতে শুরু করলেন। নারায়ণ দা প্রদীপ জ্বালিয়ে আমাদের মাঙ্গলিক কিছু করার জন্য বলতেই আমরা বেশ তারস্বরে ‘আগুনের পরশমণি’ গাইতে শুরু করলাম। বাল্মীকির সামনে যে প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে তাতে উনি বলতেই পারেন ‘ জ্বালিয়ে মশাল-আলো এই বেলা আয় রে’। উনি পারেন কারণ যতবার আমি গাই ‘আমার এই দেহখানি তুলে ধরো’, তত বার একটু সুন্দর হলাম না কেন বলে বেশ আফসোস হয়। যেন উনিই আমাকে তুলে নেবেন। এবার কিন্তু এই দুঃখ ঘুচেছে। কারণ ততক্ষণে ঘরে ঢুকছেন যারা তারা সবাই ‘চিত্রাঙ্গদা, রাজেন্দ্রনন্দিনী’। এ বলে আমাকে দেখো, ও বলে আমাকে দেখো।  যদিও কেউ একজন গাইলেন ‘রূপে তোমায় ভোলাব না’, আমার কিন্তু স্থির বিশ্বাস, বাল্মীকিও নিশ্চয়ই গাইছিলেন ‘কেন আজি আঁখিজল দেখা দিল নয়নে...সব ভেসে গেলো গো, সব ভেসে গেলো গো’। রবীন্দ্রনাথ  সেদিন জ্যোতিষের বাড়িতে না এসে পারেননি । একে তো ঘর ভর্তি রূপসীরা, কিন্তু তেমন কোন রূপবান পুরুষ যে ছিল না উনি ছাড়া যাকে বলা যেতেই পারে ‘তোমার গরবে গরবিনী আমি, রূপসী তোমার রূপে’। জ্যোতিষের লেখা ‘রবীন্দ্র জয়ন্তী’ কবিতাটা আবৃতি করতে করতে ভাবছিলাম, আমাদের নিত্য দিনের জীবনযাপনে তিনি কি সত্যি হারিয়ে যাচ্ছেন। নতুন প্রজন্মের কোন আগ্রহ নেই ‘বাংলাটা তেমন আসে না’ বলে। কিন্তু আমরা? তিনি আমাদের পৃথিবী, তিনি আমাদের সৌর জগত অথচ তেমন করে কি বুঝি?     

   এমন অনুষ্ঠানের শিল্পীরা সবাই সবার জায়গায় তারকা অথচ সেদিন তাঁর সামনে  সবাই ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে’। ভায়লিন, তবলা, নুপুর, গিটারে, গান সব মিলিয়ে ‘আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে’। হয়ত আমাদের চেয়ে আরও অনেক বেশী করে তাঁকে বুঝেছেন সেখানে উপস্থিত মাসিমা, স্বপ্না’র মা, ভগ্নী, ভগ্নী-পতি কারণ উনারা জ্যোতিষকে ঘিরে আছেন, যে নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান, আধুনিক বাল্মীকি। সময় একেবারেই বাধ্য সন্তান নয় তাই শেষটুকু দেখা হল না। তবে তাতে কোন ক্ষোভ নেই কারণ মন একেবারে ময়ূরের মত পেখম মেলেছে, সঙ্গদোষে।  আজই উন্মোচন হয়েছে জ্যোতিষের গানের ক্যাসেট ‘তোমার প্রেমত’। এমন প্রেমের ভাণ্ডার সেখানে যা আমাদের সবার। রবিবাবু –‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’।   

    পরের দিন অনুষ্ঠানের ভালো লাগার কথা, সুন্দরীদের, সুন্দরদের কথা বলতেই স্বপ্না বললও- ‘সুন্দরীদের মাঝে আমাকে ধরছেন তো। আমি কিন্তু নিজেকে বিশ্ব সুন্দরী ভাবি’। 
সাধে কি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘ আমরিই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ......এ আমার অহংকার, অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে’। তাই বলছিলুম সব দিন-সপ্তাহ-মাস-ঋতুর নাম মুছে যাক। আমাদের সব দিন রবির দিন, আমাদের সব মাস বৈশাখ মাস।     

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


                                   

Post a Comment

0 Comments