জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-২৩/সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-২৩


আসানসোল, বর্ধমান
আত্মবিলুপ্তির অপমান

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

হিমান্ত -এর মা রিউমাটয়েড আরথাইটিস-এ আক্রান্ত।...ওনার পক্ষে জব্বলপুরে এসে ছেলের বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আসানসোলেই বিয়ে হবে স্থির হল। বটি তখন বার্নপুরে কাজ করে।

 ফেব্রুয়ারীতে চলে গেলাম আসানসোল। কারণ ন'দাদা আমেরিকা থেকে কলকাতায় সোজা আসছে। মুম্বাই থেকে জব্বলপুরে এসে আবার ট্রেণে কলকাতায় যাওয়ার চেয়ে সোজা কলকাতায় নেমে আসানসোলে গেলে সুবিধা হবে। জব্বলপুরে কোনো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ছিল না। আর সময় অনেক চলে যাবে যাতায়াত করতে করতেই। একুশ দিনের বেশি ছুটি তো পাওয়া যায় না।

 বিয়ে হল আসানসোলের একটি অভিজাত হোটেল থেকে। নামটা মনে নেই এখন আর। সানাই বসল বিসমিল্লা খানের । সাজানো গোছানো সব দিক থেকে সেরা...আসানসোলের লোকেরা অবাক এত তোড়জোড় তারা দেখেন নি, এর আগে। হবে নাই বা কেন? এতদিন পর বাড়িতে সবচেয়ে ছোট মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। দাদারা সব ওয়েল সেটেল্ড। দিদিদের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছিল।তারাও বেশ স্বচ্ছল পরিবার। তারপর সবার মা বাবা হারা ছোট বোন। ন'দাদা তখন আমেরিকায় বেশ স্থায়ীভাবে সেটেল্ড। খুব কষ্ট করে তবে সে আমেরিকার মাটিতে নিজের পা শক্ত করেছিল। শিবপুর বি ই কলেজ থেকে পাশ করার সাথে সাথেই স্কলারশিপ নিয়ে হাজির হয়েছিল নিউ ইয়র্কে।

 বাড়িতে মানে হোটেলে বিয়ে বিয়ে সাজ। জব্বলপুর থেকে আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে গুল্লুকেও আনা হয়েছে কারণ, শিমুলকে সে ফ্রক পরা থেকে দেখছে। তার বিয়ে কাজেই সে তো আসবেই।

  আর একটা কি জানো? আমার যখন গায়ে হলুদের তত্ত্ব এল। ঠিক সেই সময় বটির বন্ধু হাবিব এর মা দাঁড়িয়ে ছিলেন ছোদ্দির পাশে।

ছোদ্দিকে উনি বলেছিলেন যে, “আপনারা বোনটাকে গলায় কলসি দিয়ে জলে ফেলে দিলেন না কেন?” ছোদ্দি ওনাকে চুপ করতে বলেছিলেন।

 কেন যে এমনি কথা বলেছিলেন, জানা যায় নি। আমার মনে হয় ওনারা তো থাকতেন হিমান্তদের বাড়ির পেছনেই, কাজেই ওদের বাড়ির সব খবরাখবর জানতেন বোধহয়।

 একটা মজা হয়েছিল দারুন! বিয়ের সময় পাশের ঘরের বরযাত্রী ভুলে বর নিয়ে আমাদের বিয়ে বাসরে ঢুকে পড়ে। হাসাহাসি এসবের সাথে তখন তারা বিদায় হয়। আসে আমার বরযাত্রী। হঠাৎ হয়ে যায় লোডশেডিং। আমার মনে হয়-সেটাই জীবনের একটা খারাপ সংকেত। কিছুক্ষণ পরে অবশ্য এসে গেছিল আলো। হিমান্ত খুব ভালো গান গাইতে পারত। বাসরে গাইল,...

"ওগো, কাজল নয়না হরিণী।

তুমি দাও না ও দুটি আঁখি।”

সেজদা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই-যে দাদাকে বাবার মত শ্রদ্ধা করতাম।

সেজ'দা ন'দাদা আরো কিছু আত্মীয় স্বজন আর ওদের দিকেও ওর ভাইরা বন্ধুরা আত্মীয় স্বজন মিলে নেচে নেচে গাইছিল, “এন্টনী ফিরিঙ্গী সিনেমার মতো করে...

“বৃন্দাবনো বিলাসিনী রাই আমাদের,
রাই আমাদের, রাই আমাদের,
আমরা রাইয়ের শ্যাম তোমাদের,
রাই আমাদের,
বৃন্দাবনো বিলাসিনী রাই আমাদের”

পরের দিন হিমান্তদের বাড়ী যাবার আগে আমি কাঁদি নি-আগেই বলেছিলাম- “তোমরা আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ-আমি একটুও কাঁদব না দেখো।” ছোটভাই বলেছিল, “বিয়ের আগে কাঁদতিস-আর এখন চোখে জল নেই? কি অসভ্য রে তুই!”

হা হা হা--পলাশ আবার আওয়াজ করে হেসে ফেলল। তোমরা প্রবাসী তো তাই বাবু সরল মনে ওইরকম বলেছিল।

বিয়ের পর ওদের বাড়িতেও বিসমিল্লা খান এর সানাই। সেই সানাই-এর সুরে কী কোন অন্তরা ছিল না? না মন জেনেছিল “বাঁশি শুনে আজ কাজ নাই।” ওর এক আত্মীয় বৌভাতের দিন আমার পাশে বসেছিল বলে সে কি রাগ হিমান্তের-পরে বটিরা সব বন্ধুরা মিলে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিয়েছিল। ওর বন্ধুরা আমেরিকার পারফিউম থেকে লাইটার এর বাহার দেখে ওকে বলেছিল, “তুই তো লাকি রে । একদিকে রাজকন্যা আর রাজত্ব পেয়েছিস।।আমাদের কপালে ছিটেফোঁটা জুটলেও বর্তে যেতাম। যাই হোক, এইভাবে বৌভাত শেষ হল।

পরের দিন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত কি এক অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিলাম! সে সব গল্প। কেউ বিশ্বাস করবে না সে সব গল্প। বড়লোকদের বাড়িতে ওইরকম হয়, জানতাম না। কিন্তু কাল রাত্রির দিন আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিল হিমান্ত। হিমান্তের মা-কে বলেছিলাম এই কথা। যেন আলফা-বিটা-গামার অঙ্ক।

আরো পাঁচটা নববিবাহিতদের মত গেলাম হানিমুন...দার্জিলিং। বিশ্বাস করোঃ ঠোঁটে ঠোঁট, এর চেয়ে বিশুদ্ধ আগুন জ্বলেনি কখনো আমাদের মধ্যে। আগুনের তীব্র তেজ ওঠার আগেই সে নিস্তেজ হয়ে যেত হঠাৎ। আমি কিছু জানতাম না। কিছু বুঝতাম না। ঠিকমত ম্যাচিওর্ড ছিলাম না বোধহয়। সে-কী দাহ! সে এক যন্ত্রণা! কাউকে বলতেও পারছি না কিছু।

কেমন যেন একটা সন্দেহের চোখে দেখত যখন নিজেই কোন পুরুষ বন্ধুর সাথে কথা বলে আলাপ করিয়ে দিত, সেটা লক্ষ্য করেছি হানিমুন এ গিয়ে। কিন্তু এসব থিওরোমের সূত্র আমার অজানা ছিল। বাড়ির দাদা দিদিরা কোনরকম কোয়ান্টাম থিওরী শেখায় নি। এক এক সময় নিজেকে নিয়েই থাকতে ভালবাসতাম।

বিয়ের পরে হিমান্ত যখন দুর্গাপুর স্টীল প্ল্যান্টে যেত কাজের জন্য, তখন আমার পেছনে সর্বক্ষণ ঘুর ঘুর করত হিমান্তর মেজ ভাই অনন্ত। নিজেকে খুব অসহায় লাগত।

--তোমার খুব রাগ, অভিমান হত তখন নিশ্চয়-ই হিমান্তর ওপর।

--না! ওটা আত্মসম্মানে আঘাত করত। আমার মনে হয়, আত্মসম্মানের চেয়ে বড় আর কিছু হয় না। হিমান্ত আবার উইকেন্ডে বাড়ি আসত। একদিন তো দুপুরে নিজে্র ঘরে শুয়ে আছি, মেজ দেওর অনন্ত পা টিপে টিপে আমার ঘরে এসেছে । আমার হুট করে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বলে, “লাইটার-এর গ্যাস নিতে এসেছি যা তোমার দাদারা আমেরিকা থেকে এনে দিয়েছেন।” অসহায়তায় ওর মুখ চোখ বিবর্ণ।

ওদের একটা কুকুর ছিল। নাম ছিল জিনা। মানুষের চেয়েও বেশি সেন্সিটিভ হয় বোধহয় প্রাণী। কেন জানি না দুপুরে আমি শুলেই ও আমার পাশে এসে শুয়ে থাকত। অবশ্য তারপর আমি ভয় লাগে বলে আমার হিমান্তের মা -এর কাছে শুতাম, যখন হিমান্ত দুর্গাপুরে থাকত।

হুম... দীক্ষা হল। আরেক শিক্ষাও হল। বেশি ভড়ং করলে সে পূজা হয় না ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছিলেন।

আরো বলেছিলেন, “ভগবান কাজ দেখেন না, মন দেখেন।” সেটা হাতে নাতে প্রমাণ পেয়েছিলাম। তখন আমার দীক্ষা হয় নি। প্রথম সরস্বতী পূজার সময় খুব সাজালাম। হিমান্তের মা-এর ছিল রিউমাটয়েড হার্ট। তাই বাড়িতে পুজো -আচ্চা বন্ধ ছিল। কিন্তু আমি করেছিলাম পুজোর সব আয়োজন। পরের দিন সব ফল মিষ্টি সাজিয়ে ঠাকুরের জল দিয়ে... সবে উঠে ভাল শাড়ি পড়বার জন্য আমার ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছি, দেখি হিমান্তর মা সেই জল ফেলে দিলেন। আমি ঘুরে এসে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “কেন মা? জল ফেলে দিলে?”

বললেন, “তোর তো দীক্ষা হয় নি। দীক্ষা না হলে ঠাকুর তার দেওয়া জল গ্রহণ করেন না।” খুব ধাক্কা খেলাম এই প্রথম। মা বাবাও তো দীক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু বাবা তো ঠাকুরকে মিষ্টি জল দিতেন। আমার কেন জানি না সব সময় মনে হয়, “আচ্ছা মানুষ কেন এরকম হয় আর কেনই বা হয়?”

অথচ আসানসোলে যখন কোনো মিশন ছিল না-মহারাজরা এসে ওনাদের বাড়িতে উঠতেন।

স্মৃতি ফিকে হয়, মোছে না। সময়মত জীবন্ত হয়ে ওঠে। মনের মধ্যে হাঁটাচলা করে। বর্তমানের পথ আটকে দাঁড়ায়।

বিয়ের পরেই কম্পিটিভ পরীক্ষায় পাশ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে চাকরি পেল হিমান্ত। পোস্টিং মুম্বাইয়ে। ব্যাঙ্ক থেকেই মুলুন্দ-তে একটা ওয়েল ফার্নিশড ফ্ল্যাট দিল। শ্বশুড়বাড়িতে ও আমাদের বাড়িতে সবাই আমাকে 'পয়মন্ত' বলতে লাগল। প্রবাদ বাক্য প্রচলিত আছে যে, “স্ত্রী ভাগ্যে ধন ও পুরুষ ভাগ্যে জন”।

নিজেকে নতুন করে জানা আর নতুন করে পাওয়া জীবন এই প্রথম শুরু হল। নিজেকে জানার সঙ্গে আরেকজনের পরিচয় পাওয়া -এও...রহস্যময় রস। মাস খানেক যেতে না যেতেই যে আমার জীবনটা কেন জানি না চড়াই-উৎড়াই এর পথ ধরল।

আমি তখন নিজে থেকে কারোর সঙ্গে ভাব জমাতে পারতাম না। মিশতে পারতাম না ভালো ভাবে। বেশি কথা বলতে পারতাম না। মেয়েদের স্কুল, মেয়েদের কলেজ আর বাড়িতে অত্যধিক কড়া শাসন সব আমাকে কেমন যেন জড়ভরত তৈরী করে দিয়েছিল। দিদি, বৌদিদের ছত্রছায়ায় থাকতাম সব সময়। একা একা হিমান্তের সঙ্গে মুম্বাই যেতে হবে শুনেই চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। তাই হিমান্তর কাছে বায়না ধরলাম, ঘ্যান ঘ্যান শুরু করলাম, “আমি একা যেতে পারব না। মা-কে সাথে করে নিয়ে যাই, কেমন। অচেনা শহর। তুমি অফিসে চলে গেলে একা থাকতে ভয় করবে আমার।”

তাই হিমান্তের কাছে বার বার বায়না করতে লাগলাম একা যাব না সঙ্গে বাড়ির সকলকে নিয়ে যেতে। নয়ত হিমান্ত-এর মা কে নিয়ে যেতেই হবে। হি্মান্ত অফিসে চলে গেলে একা থাকতে আমার খুব ভয় করবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমার এই ইচ্ছের কথা হিমান্ত-এর মনে অন্য প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। আমাকে একাই যেতে হল হিমান্তের সঙ্গে।


(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments