জ্বলদর্চি

সেঁদরা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ২১

সেঁদরা

ভাস্করব্রত পতি


"দেন তিঞ গড়ম যা আঃ সার সাকওয়া / দেন তিঞ গড়ম যা টেণ্ডার কাপি দ / সেঁদরা ক সারেসা ক / কারে ক বির ক বলন কান" --
সাঁওতালী শব্দ 'সেঁদরা' অর্থে শিকার বোঝায়। আসলে তা 'দিশম সেঁদরা'। মুণ্ডারী ভাষায় বলে 'দিশুম সেঁদরা'। এটাই 'দিশুয়া সেঁদরা' বা দেশ শিকার নামেও পরিচিত। যদিও সাঁওতালি সমাজে এই শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁদের দৈনন্দিন জীবন জীবিকা এবং খাদ্য সংগ্রহের উৎসমুখ। সাঁওতালীদের কাছে মাঘ মাস হল নববর্ষের মাস। এ সময় প্রতিটি গ্রামে মাঘি পূজা হয়। তা আসলে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো এবং গ্রাম পরিচালনার কাজের মূল্যায়ন করা। সেই মূল্যায়নের পর ছাড় দেওয়া হয় গ্রামের মানুষের জীবন যাপন এবং দৈনন্দিন কাজকর্মের ক্ষেত্রে। এরপর থেকেই তাঁরা বেরিয়ে পড়ে সেঁদরা তথা শিকারে।

 যৌথভাবে জঙ্গলে শিকারকে বলে 'বিরু বুরু সেঁদরা'। তবে এক্ষেত্রে ইচ্ছে হলেই শিকারে যাওয়া যায়না। এই শিকারের Permission দেবে 'মুলুক দিহরি'। তিনিই জানাবেন কোথায় শিকার করা যাবে, কি নিয়ম মানা হবে এবং কিভাবে শিকার করতে হবে। পরিস্কার করে জানিয়ে দেওয়া হয় কোন কোন প্রাণীকে বাদ দিয়ে শিকার করতে হবে। এই নিয়ম মেনে শিকারে যেতে হয়।

  প্রথমে বিভিন্ন এলাকায় একটি শালপাতায় পাঠানো হয় 'সেঁদরা গিরা' বা শিকারের খবর। এই 'শারজম ডারউয়া'র ডাকে তখন শিকারপ্রিয় মানুষজন একসাথে জড়ো হন 'সুতান টাঁডি' বা 'গিপিতিজ টাঁডি'তে। সেখানে গ্রামীণ ওঝা দুর্বাঘাস, লজ্জাবতী পাতা এবং বনজ কাঁটা নিয়ে শিকারে আসা মানুষজনকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে ঘুরে ঘুরে মন্ত্রোচ্চারণ করে। এরপর তা তাঁদের শিকারে যাওয়ার পথে ছড়িয়ে দেয়। শিকারীরা সেসব মাড়িয়ে এগিয়ে যায় শিকারের উদ্দ্যেশ্যে। গ্রামের সীমানায় 'কুড়া মনায়কে' তে নিজের শরীরের কয়েক ফোঁটা রক্ত দিয়ে দেবতার পূজা করে। একে বলে 'বুল মায়াম'। এই লোকাচার আসলে যাবতীয় অশুভ শক্তির হাত থেকে শিকারে যাওয়া মানুষদের বাঁচানোর উদ্দেশ্য।

 এরপর শিকার শেষে ঐ গিপিতিজ টাঁডিতে ফিরে এসে মৃত পশুর কিছু অংশ দেবতার থানে দিয়ে বাকি অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করা হয়। তবে যে শিকারী এই প্রাণীটির শিকারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নেয় তাঁর জন্য সামনের দুটি পায়ের একটা বরাদ্দ। বাকিটা অন্যেরা ভাগ করে নেয়। এমনকি শিকারে নিয়ে যাওয়া কুকুরদের জন্যেও মৃত পশুর ভাগ দেওয়া হয়। মূলতঃ বৈশাখ এবং জৈষ্ঠ্য মাসের বিভিন্ন দিনে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় লৌকিক সেঁদরা উৎসব পালিত হয়।

 বিভিন্ন গ্রাম থেকে তাঁরা সেঁদরায় যেসব প্রাণী শিকার করে সেগুলি হল -- Felis chaus (বনবেড়াল), Viverricula indica ( ভাম), Paradorurus harmaphroditus (খটাশ), Prionailurus viverrina (মেছো বেড়াল), Herpestes edwardsi (নেউল), Pteropus giganticus (বাদুড়), Funumbulus palmmarum (কাঠবিড়ালি), Bandicota bengalensis (ইঁদুর), Vandeleuria oleracea (ইঁদুর) ইত্যাদি। এছাড়া যেসব পাখি শিকার করা হয় সেগুলি হল -- Anastomus oscitans (শামুক খোল), Treron phocnicoptera (হরিয়াল), Psendoibis papillesa (Heron), Ardeola grayil (বক), Nettapus coromendelianus (Duck), Columbia livia (পায়রা) ইত্যাদি। আর যেসব সরিসৃপ ও উভচর প্রাণী শিকার করা হয় সেগুলি হল -- Varamus bengalensis (গোসাপ), Ptyas mucosus (ঢ্যামনা সাপ বা দাঁড়াশ), Microtyla ornata (ব্যাঙ), Rana tigrina (ব্যাঙ) ইত্যাদি। তবে এদিন তাঁদের প্রিয় শিকার "তরহত" বা গোসাপ এবং 'মাহাড়' বা নেউল। 

  যেসময়টা বাড়ির পুরুষরা শিকারে বের হয় সে সময়টা বাড়ির মহিলারা ব্যস্ত থাকেন পচাই তৈরিতে। এই সময় পরিবারের কেউ বাড়িতে আমিষ জাতীয় খাবার খায়না। ঘরের কোনো জিনিস বাইরের কাউকেই দেওয়া হয়না। বাড়ির বৌরা মাথার চুলে তেল মাখবে না এবং চুল আঁচড়াবেও না। তবে সাঁওতালী সমাজে এই সেঁদরা মোটেও নিছক শিকার উৎসব নয়। আসলে শিকারে যাওয়া বহু শিকারীই জীবন নিয়ে ফিরে আসেনা বাড়িতে। শ্বাপদ সংকুল অরণ্যে তাঁদের মৃত্যুও ঘটতে পারে বন্য পশুর আক্রমনে। তাই শিকারে যাওয়ার আগে স্ত্রীর কাছে মঙ্গলকামনা চাওয়ার পাশাপাশি স্ত্রীর হাতের বালা বা নোয়া বা খাড়ু খুলে রেখে যেতে হয়। শিকার থেকে সশরীরে ফিরে এলে স্ত্রী তাঁকে স্বাগত জানায় স্বামীর পা ধুইয়ে। তখন এক ঘটি জল নিয়ে ঐ স্বামী তাঁর স্ত্রীর হাতে ফের বালা পরিয়ে দেয় এবং স্বামীর দেওয়া চাঁপা ফুল আঁচল পেতে গ্রহণ করে। ঐ চাঁপা ফুল একটা নির্দিষ্ট পবিত্র স্থানে রাখা হয়। এ যেন যুদ্ধজয়ের স্বীকৃতি প্রদান। স্বামীর পুনরুজ্জীবন পাওয়ার স্বীকৃতি। সবশেষে স্নান সেরে দেবতাকে হাঁড়িয়া উৎসর্গ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়।

  চর্যাপদেও এঁদের কথা লেখা আছে। বন জঙ্গল ঘিরে হরিণ শিকার, ভাত গচিয়ে পচাই মদ (হাঁড়িয়া) তৈরির আয়োজন, শবরী বালিকার সুসজ্জিত পোশাকে ঘুরে বেড়ানো চর্যাপদে পরিলক্ষিত হয়। স্মরণ করিয়ে দেয় আদিবাসীদের জীবন্ত সামাজিক ছবি। ভুসুকপাদের ২০ সংখ্যক গদে এবং কাহ্ণপাদের ৬ সংখ্যক পদে যে শিকার কাহিনী লিপিবদ্ধ তার 'সিনেমাটিক' প্রতিচ্ছবি দেখা যায় শিকার উৎসবে। সাহিত্য অ্যাকাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত কবি সারিধরম হাঁসদার মতে, "সেঁদরা হয়ে উঠে সামাজিক জীবন ধারনের এক নীতিচার অঙ্গ। বন্য প্রাণীর শিকার ক্ষেত্রেই হোক অথবা দৈনন্দিন খাদ্য অন্বেষনের ক্ষেত্রেই হোক উভয় কর্ম পদ্ধতি আলাদা হলেও অতীত কাল থেকে সাঁওতাল সমাজে একার্থেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ করে যখন তখন মন জাগলেই যে সেঁদরা করা যায় তা ঠিক নয়। তার একটি নির্দিষ্ট ঋতু কালের সময়ের সাথে সামাজিক সংগঠনের অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে।"

  মূলতঃ সাঁওতালদেরই উৎসব 'সেঁদরা'। এঁদের যে ১২ টি শাখা আছে তার মধ্যে তিনটি শাখা 'পাউরিয়া’, ‘বিশ্রা' এবং ‘চোরে’ শিকারে যায়না বললেই হয়। অবশ্য ‘চোরে’ এখন প্রায় লুপ্ত। প্রতি বছরই সেঁদরায় মাতোয়ারা হয় হাঁসদা, মুর্মু, বেসরা, হেমব্রম, সোরেন, কিস্কু, টুডু, মাণ্ডি এবং বাস্কে শাখাগুলি। এছাড়া মুণ্ডা, কোল, কোল হো, ভূমিজ, লোধা, কোরা, ওঁরাও, মহালীদের কেউ কেউ আজকাল যুক্ত হয়েছে সেঁদরায়। সঙ্গে থাকে তীর, ধনুক, টাঙ্গি, গুলতি (চুটকি), গুপ্তি ইত্যাদি শিকারের উপকরণ। শিকারের সময় অনেকেই নিয়ে যায় ধামসা, মাদল, বাঁশি। অস্ট্রিক গোষ্ঠীর লোকেরা আড়বাঁশিই বেশি পছন্দ করে। থাকে কেঁদরি, হারমোনিয়াম, শিঙ্গা, চুড়চুড়ি, ঝাঁই খরতাল। গ্রামীণ বেহালাও থাকে সাথে। শিকারের সাথে সাথেই দিনের শেষে মেতে ওঠে গানে -- 'জমাঃ ঞুআঃ লাগিৎ গে হো / তিরয়াও লেনা নোআ জিবন দ / বির বুরু উডাও পারম / দাঃ দরয়া ঘান্টা পারস দ / বরং বাতর দেয়া কাতে / জানুম ঝান্টি তালম কাতে / তবে নাহি হো শোষ সাহার দ / ঞামতে লেন হো জীবন আহার দ"! 

 পুরুলিয়ার অযোধ্যা বুরু সেঁদরা আয়োজিত হয় বৈশাখের বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে। এর আগে ২৯ শে চৈত্র, মেল সেঁদরা হয় পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়খণ্ড সীমান্ত এলাকায়। এছাড়া আরও যেখানে যেখানে সেঁদরা আয়োজিত হয় সেগুলি হল -- ৩ রা বৈশাখ রহড়াগড়া গল্লা সেঁদরা, রাণীবাঁধ > ৩ রা বৈশাখ বিষ্ণুপুর এলাকায় সাঁওলিয়া সেঁদরা > ৪ ঠা বৈশাখ, পাটাঘর সেঁদরা, লাগাদোড়ি, বেলপাহাড়ী > ৫ ই বৈশাখ বিষ্ণুপুর এলাকায় ওন্দালিয়া সেঁদরা > ৬ ই বৈশাখ বান্দোয়ান থানার লব্দা সেঁদরা > ৭ ই বৈশাখ বান্দোয়ান এলাকার রাইকা সেঁদরা > ৮ ই বৈশাখ শালতোড়া বিহারীনাথ সেঁদরা > ১০ ই বৈশাখ টাটগাড়ি লড়গা সেঁদরা, রাণীবাঁধ > ১১ ই বৈশাখ গুণপুরা সেঁদরা, রাণীবাঁধ > ১১ ই বৈশাখ, কাওয়াটাঙ্গা সেঁদরা, বাঁকুড়া পশ্চিম মেদিনীপুর সীমান্ত > ১২ ই বৈশাখ খাতাআম সেঁদরা, রাণীবাঁধ > ১২ ই বৈশাখ, মালিঙ্গড়া সেঁদরা, কাঁকড়াঝোড়, বেলপাহাড়ী > ১৩ ই বৈশাখ, বুড়িজোড় সেঁদরা, বেলপাহাড়ী > ২৫ শে বৈশাখ ছাতনা ব্লক এলাকায় শুশুনিয়া বুরু সেঁদরা > ৫ ই জ্যৈষ্ঠ টুরা পাহাড় সেঁদরা, রাইপুর ব্লক, বাঁকুড়া > জৈষ্ঠ্যতে বাঁকুড়ার রাণীবাঁধ এলাকার গুড়মা বুরুতে খেজুরিয়া সেঁদরা > জৈষ্ঠ্যের অমাবস্যার আগের দিন পূর্ব মেদিনীপুরের ক্ষীরাইতে হাডাডঙার শিকার উৎসব। এছাড়াও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলার বহু জঙ্গলে সেঁদরায় মাতোয়ারা হয় মানুষজন।

  দ্রিম দ্রিম সুরে ধামসা আর মাদলের মাখামাখি। চারিদিক প্রায় অন্ধকার। আকাশে নেই জোছনার উপস্থিতি। শুধু কয়েকটা কুপির মোলায়েম আলো। অজানা ভাষার গান। চারিদিকে নেশাতুর মানুষের ভিড়। কোথাও কোমরে হাত দিয়ে অথবা হাতের সঙ্গে হাত দিয়ে 'শিকল' গড়ে নাচের আসর। এক ঝাঁক আদিবাসী নারী পুরুষের সেই মিলন মেলা। এভাবেই যে মেলার অবয়ব ছিল তা হঠাৎই হয়ে উঠল বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর বধ্যভূমির উৎসব। স্থানীয়দের ভাষায় এটা ছিল 'হাডডাঙার হাঁড়িয়ার মেলা'। আসলে তা সেঁদরা পরবের একটা অঙ্গ। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে যে সেঁদরা বা শিকার কাহিনীর দেখা মেলে এখানেও ঠিক তাই। কিন্তু তা তেমন প্রসারিত এবং প্রচারিত ছিলনা। আসলে এখানকার শিকার উৎসব খুব বেশিদিনের পুরোনো নয়। কোনো ঐতিহ্যশালীও নয়। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠের অমাবস্যার আগের দিন এই মেলার আসর বসে ক্ষীরাই, পাঁশকুড়া, হাউর, কোলাঘাট রেলস্টেশন এলাকায়। 

 একসময় হাডডাঙার হাঁড়িয়া মেলায় ছিল যৌবনের উদ্দামতা। ছিলনা আলোর আতিশয্য। ছোট্ট ‘কুপি' অথবা লণ্ঠনের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার চুঁইয়ে আসা আলোতেই 'দংড়ে' নাচের জন্ম নেয়। খোঁপায় কুরচি ফুল গোঁজা, কানে শাল ফুলের ঝুমকা, বাহুতে আটাঙ বলয়, হাতে অলগপুঁই এর সোনালি কঙ্কন, অরণ্যরঙা শাড়ি পরিহিতা কুমারী বনবালাদের অবশ্য এই মেলাতে দেখা যায়না। এখানে আদিবাসীরা আসে নেশায় বুঁদ হতে। নিত্যদিনের একঘেঁয়েমী জীবনের আস্বাদ বদলাতে। কবে এই মেলার জন্ম তা কেউ জানেনা। ঊষৎপুর হাইস্কুল মাঠের পাশেই দুটি প্রাচীন কালীমন্দির -- বেগুনবাড়ি এবং গুলিখানা। সেগুলির বয়স প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ বছর। মূলত অন্ত্যজ শ্রেণীর উপাস্য এই দুই মন্দিরে আসা শুরু করেছিলেন পশ্চিমের আদিবাসীরা। সেসময় মেলা প্রাঙ্গণ থেকে অনতি দূরে ঐ বিদ্যালয়ের মাঠটাই ছিলো তাদের বিশ্রামের পক্ষে প্রশস্ত জায়গা। কেননা ক্ষীরাই নদীর গর্ভে থাকা মন্দির দুটির সামনে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জায়গা অপ্রতুল। কালেক্রমে বিদ্যালয় মাঠটিই হয়ে উঠলো আদিবাসীদের এক নতুন তীর্থক্ষেত্র। সকাল থেকে ট্রেনে চেপে দলবল নিয়ে এসে শিকারে বেরিয়ে পড়া। বিকেলে ফিরে এসে নানা জীবজন্তুর মাংস রান্না করে হাঁড়িয়ার সাথে খেয়ে সারা রাত নাচগান। পরদিন ভোরে মন্দিরে পুজো দেখে দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে যাওয়া। ঠিক যেন 'উইক এন্ড’-এ ছুটি কাটানো।

  এক সময় এই মেলায় বসতো স্বয়ংবর সভা। শিকারে পারদর্শী আদিবাসী যুবকের জুটতো মনের মতো বউ। কিভাবে ? তিনটে কলা গাছ পোঁতা হতো। দূর থেকে তীর নিক্ষেপ করতে হতো। তিনটে কলা গাছের জন্য তিনজন রমণী। যে তিন যুবকের তীর কলা গাছের নির্দিষ্ট অংশে এসে বিঁধতো, তাঁর কপালে জুটতো কোনও সুন্দরী আদিবাসী মহিলা। এই তীর নিক্ষেপ পদ্ধতিকে সাঁওতালীতে বলে 'বেঝা বিঁধা'। 

  তবে এইসব উপজাতি গোষ্ঠীরা ধীরে ধীরে তাঁদের উপজাতি সুলভ বিনম্রতা হারিয়ে ফেলছে। চলমান জীবনধারার সঙ্গে একাত্মীভূত হয়ে পড়ছে তাঁরা। এঁদের কেউ অরণা নির্ভর শিকারজীবী, কেউ বন্য প্রথায় চাষে অভ্যস্ত দেশান্তরী শ্রমজীবী। অথবা শিল্পাশ্রয়ী 'নামাল' বা অন্যরাজ্যের খেতমজুর হিসেবেও পরিচিত হচ্ছে অনেকেই। বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ এবং গবেষক ডাঃ সুহৃদ কুমার ভৌমিক বহুদিন ধরেই আদিবাসীদের সমাজ জীবনের সাথে রয়েছেন। তাঁর চোখেও ধরা পড়েছে উপজাতি গোষ্ঠীর সামাজিক পট পরিবর্তনের ধারা। একদিকে সরকার এঁদের জীবনের মানোন্নয়নে প্রয়াসী অন্যদিকে জীবিকার কারণে অরণা ছেড়ে শহরমুখী প্রবণতা এই দৃষ্টান্তের উদ্ভবের কারণ। তবে এখনও এইসব সম্প্রদায়ের বহু মানুষ প্রকৃত শিক্ষার আলো থেকে বহু যোজন দূরে। ফলে ঘটমান বর্তমান সম্পর্কে কোনো ধারনাই জন্মায়নি।

  আসলে একটা ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার নামেই চলে দেদার 'সেঁদরা'। পুরানো রীতিটাকে টিকিয়ে রাখার অনন্য প্রয়াস এই শিকার উৎসব। এসময়টা কাজকর্ম থাকেনা। বর্ষা আসতে দেরি। ফলে এই অবসরটায় বাহা, করম, সহরায় কিংবা দংড়ে গানের পাশাপাশি ইচ্ছে করে 'গুডু' শিকারের। আর বিশুদ্ধ আনন্দোৎসবের গানের সাথে একাত্মীভূত হওয়া। 

  আদিবাসীদের জীবনে সেঁদরা বা শিকার জড়িয়ে থাকলেও সেই শিকার কাহিনী সাঁওতালী ভাষায় খুব কম জনই লিখেছেন, আক্ষেপ ড. সুহৃদকুমার ভৌমিক এবং ড. শ্যামল বেরার। পাঁটিয়া মেধা, খেমটা, আড় খেমটা, গাড়আ, রিকা মাঠা রাগরাগিণী যেমনি আদিবাসী গানের সাথে জড়িয়ে আছে, ঠিক তেমনি শিকার উৎসবও জড়িয়ে থাকবে তাঁদের জীবনে। শিকার যেন মালভূমি প্রান্তের অধিবাসীদের রক্তমজ্জার সাথে যুক্ত। তাকে কি বন্ধ করা যায়? 

  হ্যাঁ বন্ধ করা যায়। পরিবেশপ্রেমীদের দাবি, এতোদিন ধরে অনেক হয়েছে হত্যালীলা। সেই ১৯৭২ এ বন্যপ্রাণী আইন লাগু হওয়ার পরেও বেদম চলছে হত্যা। রাজ্য বনদপ্তরের উদ্যোগে গত কয়েক বছর ধরেই এই সেঁদরার নামে লুপ্তপ্রায় প্রাণীহত্যা বন্ধের প্রয়াস শুরু হয়েছে। লৌকিক উৎসবের নামে চলছে বেলাগাম বন্যপ্রাণী হত্যা। আর নয়। এবার সেঁদরার নাম করে বেআইনি প্রাণীহত্যায় লাগাম পরাতে তৎপর বনদপ্তর। তূণ (তীর), সার (ধনুক), বাটুড় গুলি (গুলতি), টাঙ্গা (কুড়ুল), কাপি (টাঙ্গি) নিয়ে বনবেড়াল, নেউল, দাঁড়াশ, পাখি, গোসাপ, ভাম, কাঠবিড়ালি শিকার এবার বন্ধের ডাক উঠেছে।

আর তাই পূর্ব মেদিনীপুর বনবিভাগের পক্ষ থেকে এই সেঁদরা পরবের নামে অবৈধ প্রাণীহত্যা বন্ধে জনমানসকে সচেতন করতে প্রতিটি রেলস্টেশনে করা হচ্ছে বন্যপ্রাণ শিকার না করার ঘোষনা (ঘোষক - মধুসূদন পড়ুয়া)। সেইসাথে লেখা হয়েছে থিম সঙ (লিখেছেন -- ভাস্করব্রত পতি) এবং তা গান গেয়ে (গেয়েছেন -- কৃষ্ণেন্দু পাত্র) রেকর্ডিং করে বাজানো হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায় --
"আমাদের লোভ আর লালসায়,
              প্রকৃতিটা হচ্ছে যে বন্ধ্যা!
পাখি আর প্রাণীদের জলসায়,
              কন্ঠতে আঁধারের সন্ধ্যা!!

দ্যাখো দেখি চোখ মেলে বাইরে,
              থেমে গেছে সুমধুর সব গান!
আর নেই সময় যে ভাইরে,
              বাঁচাতেই হবে বন্যের প্রাণ!!

শেয়ালের ডাক নেই,
কটাশের হাঁক নেই -
   হারিয়েছে কোকিলের শব্দ!
বাবুই বোনেনা বাসা,
শকুনের নেই আশা -
   বনে আজ হাতিরাও জব্দ!!

ঝাঁকে ঝাঁক নেই টিয়া,
ফিরে গেছে সাতভায়া -
    গোসাপের দুনিয়াটা শূন্য!
চখাচখি হরিয়াল,
বাঘ বক ঘড়িয়াল -
    লড়ছে যে বাঁচবার জন্য!!

পৃথিবীটা শুধু নয় ফানুসের,
             সকলের আছে এতে অধিকার!
শেষ হোক দাদাগিরি মানুষের,
             মাটি জল বন হোক বাঁচবার!!

দ্যাখো দেখি চোখ মেলে বাইরে,
            থেমে গেছে কিচমিচ সব গান!
আজ তাই সবে মিলে গাইরে,
            বাঁচাতেই হবে বন্যের প্রাণ!!"

তথ্যসূত্র --
১) হাডডাঙার শিকার উৎসব -- ভাস্করব্রত পতি, গনশক্তি ( ২৮ শে মে, ২০০৫ )
২) সাঁওতাল সমাজে শিকার প্রথা ও তার নিয়ম নীতি -- সারিধরম হাঁসদা, আমাদের মেঠোপথ, ২০১৫
৩) চোরা শিকারিদের নজরে পটাশপুরের জঙ্গল -- রঞ্জন মহাপাত্র, সংবাদ প্রতিদিন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৮
৪) উৎসবের শিকারে পশুহত্যা নয় -- আর্যভট্ট খান, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৮
৫) শিকারের নামে তাণ্ডব, নির্বিচার পশুপাখি নিধন -- সমীর মণ্ডল, এই সময়
৬) শিকার উৎসবে মাতোয়ারা আদিবাসীরা -- রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, আজকাল
৭) ঐতিহ্য আর পরিবেশের দ্বন্দে বাঁচল বন্যপ্রাণ -- রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য ও দিগন্ত মান্না, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ শে মে, ২০২০
৮) পূর্ব মেদিনীপুরে অবাধে চলছে বন্যপ্রাণ নিধন -- ভাস্করব্রত পতি, গনশক্তি, ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৮
৯) আদিবাসীদের সেঁদরা পরবে প্রাণীহত্যা হচ্ছে ব্যাপক হারে -- ভাস্করব্রত পতি, উপত্যকা, ২১ শে মে, ২০১২
১০) অনুপম খান (DFO, পূর্ব মেদিনীপুর) এবং বলরাম পাঁজা (ADFO, পূর্ব মেদিনীপুর)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments