জ্বলদর্চি

নরেন্দ্রনাথকে গান শেখাতেন রবীন্দ্রনাথ/ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

নরেন্দ্রনাথকে গান শেখাতেন রবীন্দ্রনাথ

ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

কল্পনা করুন সেই দৃশ্য, সঙ্গীতের মহড়া চলছে। “শুভদিনে এসেছে দোঁহে চরণে তোমার, শিখাও প্রেমের শিক্ষা, কোথা যাবে আর” -গানটি রবীন্দ্রনাথের কাছে বসে শিখছেন নরেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বাজাচ্ছেন অর্গান, আর নরেন্দ্রনাথ বাজাচ্ছেন পাখোয়াজ। সময়টা ১৮৮১। রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লীলাবতীর বিবাহ। পাত্র কৃষ্ণকুমার মিত্র। রাজনারায়ণের পুত্র যোগেন্দ্রনাথের অনুরোধে এই বিবাহ উৎসবের জন্য রবীন্দ্রনাথ তিনটে গান রচনা করে নিয়ে এসেছেন,  – ‘দুই হৃদয়ের নদী’, ‘জগতের পুরোহিত তুমি’ এবং ‘শুভদিনে এসেছে দোঁহে’, আর সংগীতে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান নরেন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ নিজে নরেন্দ্রনাথকে শেখাচ্ছেন সেই গান আর সুন্দরী মোহনদাস, নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, অন্ধ চূণীলাল সবার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও নরেন্দ্রনাথ গলা মিলিয়ে সে গান গাইছেন উদাত্ত কন্ঠে, -  
দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি বলো, দেব, কার পানে আগ্রহে ছুটিয়া যায়॥
রবীন্দ্রনাথের তিনটি গানই গাওয়া হয়। নরেন্দ্রনাথ গায়কদের অন্যতম ছিলেন। রবীন্দ্র-নরেন্দ্রের এই প্রথম সাক্ষাৎ। 
পরবর্তীকালের বিশ্বপথিক দুই মহাপুরুষ সেদিন সঙ্গীতের ছন্দে ঘনিষ্টভাবে একসূত্রে গ্রথিত হয়েছিল। দুই হৃদয়ের নদী একত্রে মিলিত হতে চেয়েছিল। ‘এক চায় একেরে পাইতে দুই চায় এক হইবারে’। এক হওয়ার জন্য দু’জনে চাইলে কী হবে – পরবর্তীকালের ইতিহাস কিন্তু অন্যরকম – দু’জনের জীবনের মোড় নিল দু’দিকে – দুই হৃদয়ের নদী একসঙ্গে গিয়ে সাগরে পড়ল না। দু’জনের উৎস একই, - সেই গঙ্গোত্রি; মোহনা একই সেই – বঙ্গোপসাগর। অথচ গতিপথ রইল পৃথক, মোহনার মুখ রইল পৃথক, অশান্ত অশ্রান্ত দু’দিকে ছুটে মিলল গিয়ে একই শান্তির পারাবারে। তবু পদ্মা রইল পদ্মা, গঙ্গা রইল গঙ্গা। 

 একটি ব্রাহ্ম বিবাহকে কেন্দ্র করে উভয়ের পরিচয়। তারপর একজন হলেন চিরকুমার ব্রহ্মচারী-- কামিনী-কাঞ্চন-ত্যাগময়ের গুরুর শিষ্য, অপরজন লিখলেন 'চিরকুমার সভা' যেখানে কৌমার্যকে বিদ্রূপ করা হয়েছে নাটকীয়তার মাধ্যমে।

 রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ ধর্ম সম্পর্কে দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতেন। একজন নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক আর অন্যজন সাকার দেব-দেবীর উপাসক। অথচ উভয়েই সেই সৎ-চিৎ-আনন্দ-কে উপলব্ধি করেছেন, অন্তরে। রবীন্দ্রনাথের গানে সীমার বন্ধন থেকে অসীমের মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন বিবেকানন্দ। তাই রবীন্দ্রনাথের গানে মগ্ন থাকতেন বিবেকানন্দ।

 নরেন্দ্রনাথ যখন স্বামী বিবেকানন্দ হয়েছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ঘনিষ্ঠতা হয় বলে কোনো সমকালীন নথি-পত্র প্রমাণ এখনো হস্তগত হয় নি। 
তাই রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের সম্পর্ক কেমন ছিল তা আজও ধোঁয়াশাবৃত৷ সে প্রসঙ্গে আজও অনেক আলোচনা নয়। তবে রবীন্দ্রনাথ যখন শুধুমাত্র ‘রবি’, আর ‘নরেন’ যখন বিবেকানন্দ হননি তখন দু’জনের গানের মধ্য দিয়েই সংযোগ ঘটেছিল৷ ঠাকুরবাড়ির বাইরে সম্ভবত তিনিই প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনদরবারে নিয়ে আসেন৷ পরে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকেও মাঝে মাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতেন৷ একথা ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ গ্রন্থের বিভিন্ন খন্ডে এবং অন্যান্য সমকালীন গ্রন্থে উল্লেখ আছে: 
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রাদি ভক্তের প্রতি) — নরেন্দ্রের শরীর তত সুস্থ নয়, কিন্তু তাঁহার গান শুনিতে ঠাকুরের ভারী ইচ্ছা। তিনি বলিতেছেন, “নরেন্দ্র, এরা বলছে একটু গা না।” নরেন্দ্র তানপুরা লইয়া গাইতেছেন: (১৮৮৩, ৭ই এপ্রিল)
“গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে।
তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে”।
কীর্তন ও নৃত্যের পর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে আসিয়া বসিয়াছেন। মণি প্রভৃতি ভক্তেরা তাঁহার পদসেবা করিতেছেন। নরেন্দ্র ভাবে পূর্ণ হইয়া তানপুরা লইয়া আবার গান গাহিতেছেন: 
“তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
এ-সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা”৷ (১৮৮৫, ১৪ই জুলাই)
রবীন্দ্রসংগীতের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন স্বামীজি৷ নরেন্দ্রনাথের কন্ঠে রবীন্দ্র-চর্চার মাধুর্য্যই ছিল আলাদা অনুভূতি৷ তাই যৌবনে মাঝে মাঝেই রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে ওঠা ছিল নরেন্দ্রনাথের স্বভাব। 
নরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের সহপাঠী। উভয়েই তাঁরা জেনারেল অ্যাসেম্বলি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। এই সূত্রেই ছিল ঠাকুরবাড়িতে নরেন্দ্রনাথের যাওয়া-আসা।

 দ্বিপেন্দ্রনাথের স্ত্রী হেমলতা ঠাকুর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন-“আমার স্বামী আর স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন বাল্যবন্ধু। সন্ন্যাসধর্ম নেওয়ার আগে তিনি প্রায়ই আমার স্বামীর কাছে আসতেন, কিন্তু পরে দেখাসাক্ষাৎ হতো মধ্যে মধ্যে। বিবেকানন্দ বাল্যবয়সে আমার স্বামীর কাছে এসেছেন, তখন তিনি সন্নাস গ্রহণ করেননি-সে আমি দেখিনি। কিন্তু পরে বিবেকানন্দ আমাদের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এসেছেন, পরনে গেরুয়া বসন, মাথায় পাগড়ি। আসতেন মহর্ষির (দেবেন্দ্রনাথ) সঙ্গে দেখা করতে”। 

  তবে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নরেন্দ্রনাথ যখন রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য হয়ে গেলেন, তখন স্বল্প সময়ের জন্য হলেও, রবীন্দ্রনাথের মনে নরেন্দ্রনাথের প্রতি বিরূপতার সঞ্চার ঘটেছিল। অনেকেই সে সময়ে বলতে শুরু করেছিলেন যে, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নানা দেবদেবীর মূর্তিপূজার মধ্য দিয়ে গভীর আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করায় ব্রাহ্মদের নিরাকারতত্ত্বের অসারতাই প্রমাণিত হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ তখন ‘সাকার ও নিরাকার উপাসনা’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই মতের তীব্র সমালোচনা করে লিখেছিলেন - “ঈশ্বরকে আমরা হৃদয়ের সংকীর্ণতাবশত সীমাবদ্ধ করিয়া ভাবিতে পারি, কিন্তু পৌত্তলিকতায় তাঁহাকে একরূপ সীমার মধ্যে বদ্ধ করিয়া ভাবিতেই হইবে। অন্য কোনো গতি নাই।”
তবু, এ সবের পরও, রবীন্দ্রনাথ রচিত সঙ্গীতের প্রতি নরেন্দ্রনাথের আকর্ষণ একটুও হ্রাস পায়নি। আবার ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি, শনিবার সন্ধ্যায় ভগিনী নিবেদিতার বাগবাজারের বাড়ির উঠানে আয়োজিত চা-পান সভায় রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ মুখোমুখি হয়েছিলেন। ৩০ জানুয়ারি ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মিস ম্যাকলাউডকে লেখা একটি চিঠিতে নিবেদিতা তার বিবরণে বলেছেন, - “শনিবার আমি একটা অব্যবস্থিত পার্টি দিয়েছিলাম। মিসেস পি. কে.রায় ও মি.মুখার্জী, মি. মোহিনী এবং কবি – তার একটু পরেই ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন স্বামী [বিবেকানন্দ]। চমৎকার ঝলমলে পার্টি, কারণ মি. টেগোর তাঁর অসাধারণ চড়া গলায় ৩টি স্বরচিত গান গাইলেন – আর স্বামী তো অপূর্ব। আমি সেই অসামান্য কবিতাটি ভুলতে পারছি না, “এসো শান্তি”– তার সেই সকরুণ কোমল মুর্ছনা (plaintive minor air)- মি. টেগোর সেদিন আমাদের জন্যেই গানটি বেঁধে গেয়েছিলেন - “বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে।শূন্য ঘাটে একা আমি, পার ক'রে লও খেয়ার নেয়ে”।
নিবেদিতা আরও লেখেন, “ঠাকুরবাড়ির সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে যে কোনো সচেতন বাঙালিই অবহিত। সে রকম অবহিতির সুযোগ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথসহ ঠাকুরবাড়ির অন্য অনেকেই আমাদের জন্য অবারিত করে দিয়েছেন। দত্ত পরিবারের ব্যাপারে কিন্তু ঠিক তেমন কথা বলতে পারি না। ওই পরিবারে যে সঙ্গীতের চর্চা ছিল, সে কথা আমাদের জানা আছে বটে, কিন্তু সেই ‘জানা’টা একেবারেই ভাসা-ভাসা”।

  ১৮৮৭ সালে নরেন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সঙ্গীত কল্পতরু’। সেখানে নরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের ১২টি গান অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
বিবেকানন্দের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের যে গানগুলি নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের বিভিন্ন ভাগে সেগুলির বিস্তৃত বিবরণ আছে -
১। ‘গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে’ -এই গানটি স্বামী বিবেকানন্দ দু’বার (২৫ চৈত্র, ১২৮৯ ও ২৭ বৈশাখ, ১২৯২) শ্রীরামকৃষ্ণকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম গান। 
২। ‘দিবানিশি করিয়া যতন’- এই গানটি স্বামী বিবেকানন্দ (৩০ ভাদ্র, ১২৯১) শ্রীরামকৃষ্ণকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। 
৩। ‘দুখ দূর করিলে দরশন দিয়ে’- এই গানটি স্বামী বিবেকানন্দ দু'বার (২৯ ফাল্গুন, ১২৯১ ও ৫বৈশাখ, ১২৯৩) শ্রীরামকৃষ্ণকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। 
৪।‘তোমারেই করিয়াছিজীবনের ধ্রুবতারা’- স্বামী বিবেকানন্দ দু'বার এই গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণকে (৩১ আষাঢ়, ১২৯২ ও ৯ কার্তিক, ১২৯২)।
৫। ‘মহাসিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিতঃ’- এই গান স্বামী বিবেকানন্দ (৯ কার্তিক, ১২৯২) শ্রীরামকৃষ্ণকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনীকার প্রমথনাথ বসু উল্লেখ করেছেন, নরেন্দ্রনাথ বি.এ. পরীক্ষার প্রথম দিন [31 Dec 1883 সোম ১৭ পৌষ ১২৯০] প্রত্যুষে চোরবাগানে বন্ধু হরিদাস দাশরথীর বাড়ির সামনে গানটি গেয়ে শুনিয়েছিলেন।
৬। ‘এ কি সুন্দর শোভা’- স্বামী বিবেকানন্দ (১২ কার্তিক, ১২৯২) শ্রীরামকৃষ্ণকে গানটি গেয়ে শুনিয়েছিলেন। ভারত পরিব্রাজনের সময় কাশিতে (১২৯৫) যজ্ঞেশ্বর তেলী-র বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ এই গানটি এবং 'মরি লো মরি ও সখী' ও 'আমারি দুয়ারে কেন...' এই গানগুলি গেয়েছিলেন। 
৭। ‘আমরা যে শিশু অতি, অতি ক্ষুদ্র মন’- শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের ন-মাস পরে (২৫ বৈশাখ, ১২৯৪) নরেন্দ্রনাথ এই গানটি বরাহনগর মঠ-এ গেয়েছিলেন। 
এই গানগুলির মধ্যে‘দিবানিশি করিয়া যতন’, ‘দুখ দূর করিলে দরশন দিয়ে’, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ প্রভৃতি গানগুলি স্বামীজী এক বা একাধিকবার শ্রীরামকৃষ্ণকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন।
নরেন তাঁর বন্ধুদের বলেছিলেন, “গান শুধু মনকে কেবল শান্তিতে রাখে না, গান দেহকেও শান্ত রাখে”৷  
গুরুদেব বলতেন, “আমার মেজোগিন্নি - আমার গান সে। যখন আমার কাছে আসে তখন কাউকেই সে সইতে পারে না। বড়ো অভিমানী। কেউ এল কি, অমনি সে যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল - কত সাধ্যসাধনা করে তবে আবার ফিরিয়ে আনতে হয় তাকে”।

ঋণ: রানী চন্দ, গুরুদেব। রবিজীবনী: প্রশান্তকুমার পাল। গীতবিতান। শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments