জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—আমেরিকা (কানাডা)/ছুঁচো আর বাদুড়ের জন্মকথা /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—আমেরিকা (কানাডা)

ছুঁচো আর বাদুড়ের জন্মকথা

চিন্ময় দাশ

গ্রামের গা ঘেঁষেই বনের শুরু।  সেখানেই একেবারে একটেরে একটা কুঁড়ে বানিয়ে থাকে এক মা। ঘরে বাপ-হারানো দুটো ছেলেমেয়ে। 

ভারি গরীব তারা। এদিকে তিন-তিনটা পেট।  সেজন্য হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হয় মাকে। নদী থেকে মাছ, বন থেকে কোনদিন ফলমূল, কোনদিন এটা-ওটা শিকার—এসব জুটিয়ে এনে পেট ভরাতে হয় মাকে।
কখনও কখনও অনেক দূরের এলাকায়ও যেতে হয়। তখন ঘরে ফেরা হয় না সব দিন। তাতে ছেলেমেয়ে দুটোর যত্ন-আত্তি তো হয়ই না,  দেখভালও হয় না ঠিক মতো।  

মাথার ওপর কেউ না থাকলে যা হয়। বিগড়ে যাচ্ছে বাচ্চা দুটো। যেমন অবাধ্য, তেমনি বেয়াড়া। আজকাল তো মায়ের কথাও শোনে না তারা। সেটাই করে,  যেটা তাদের মন চায়। 
যত বড় হতে লাগল, ততই বেয়াড়া আর অবাধ্য হয়ে উঠতে লাগল দুটিতেই। তাদের সামাল দেওয়া মায়ের সাধ্যে কুলোচ্ছে না এখন আর।
মায়ের মন। আগাম বুঝতে পারে সব। তার মন বলে, কোনও দিন নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনবে এরা।
সত্যি সত্যিই একদিন বিপদ ঘটে গেল বাচ্চাগুলোর।  বড় একটা কড়াইতে চর্বি চাপিয়ে, পড়শির ঘরে গেল মা। পইপই করে বারণ করে গেল ছেলেমেয়েদের—খবরদার, কড়াইর কাছে যাবি না। কোথায় আগুন-টাগুন ধরে যাবে। বিপদ হবে তখন। 

আগুনের নাম শুনেই, পুলকিত হয়ে উঠল দুটিতে। মা বেরিয়ে যেতেই, উনুনের কাছে পৌঁছে গেল দুটিতে। চর্বিতে কী করে আগুন জ্বলে, নিজেদের চোখে পরখ করে নেওয়া দরকার। 
চর্বি ফুটছিল কড়াইতে। ছেলেটা করল কী,  উনুনের জ্বলন্ত একটা কাঠি তুলে, দিল কড়াইতে ফেলে। আর যায় কোথায়? জ্বলে উঠল কড়াইর চর্বি। হঠাতই একটা আগুনের ঝলকানি। লেলিহান শিখায় কড়াই থেকে ছিটকে উঠল আগুন। দুজনেরই চোখ-মুখ ঝলসে গেল সেই আগুনে। 
চেঁচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল যখন, দুজনেই কিছু দেখতে পাচ্ছে না তখন। অন্ধ হয়ে গিয়েছে দুজনেই।
শেকড়-বাকড়, পাতার রস— মায়ের হাজারো তুকতাকেও কোন কাজ হোল না। মা রেগে বলল—অবাধ্যতার এটাই ফল। এবার সারা জীবন অন্ধ হয়ে কাটাতে হবে তোদের। 
সত্যি সত্যিই অন্ধ হয়ে গেল ছেলেমেয়ে দুটো। পৃথিবীর সব আলো মুছে গেল দুজনের চোখ থেকে। তবে একটা উপকার হোল তাতে। যত দিন যেতে লাগল, ততই শান্ত আর সুবোধ হয়ে উঠতে লাগল দুটিতে। এখন মায়েরও ভারি বাধ্য তারা।

একদিন মা নাই বাড়িতে। হটাত এক বুড়ি এসে হাজির। একেবারে দোরের চৌকাঠেই বসে পড়ল বুড়ি—ঘরে কিছু আছে, বাছারা? একটু কিছু খাবার দেবে আমাকে? খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে গো। একটু দয়া করো আমাকে।
থুত্থুরে বুড়ি। উলুঝুলু পোষাক। মাথায় শনের নুড়ির মতো এক বোঝা চুল। শুকনো চিমসে হয়ে যাওয়া হাত দুটো দেখে, ভারি দয়া হোল দুই ভাইবোনের।
--এক্টুখানি বসো, বুড়িমা। দিচ্ছি তোমাকে খাবার। বলেই, চটপট কিছু খাবার এনে ধরে দিল বুড়িকে। 
খাওয়া শেষ করার পর, বুড়ির খেয়াল হোল, ছেলেমেয়ে দুজনেই অন্ধ। ভারি কষ্ট হোল দেখে।
বুড়ি বলল— এতক্ষণ খেয়াল করিনি, বাছারা। তোমরা তো দেখছি দুজনেই অন্ধ। কিন্তু ভারি দয়ালু তোমরা দুজনে। ছোট্ট একটু উপকার করতে পারি আমি তোমাদের। 

একটা ঝোলা ছিল বুড়ির। কী বিস্ময়ের ব্যাপার! তা থেকে একটা চোখ বের করে, বুড়ি বলল—বরফের দেশের মানুষ আমি। তোমাদের দুজনের চোখের ব্যবস্থা করে দেওয়া আমার সাধ্যে নাই। তবে, এই একটা চোখ আছে আমার কাছে। সেটা দিয়ে যাচ্ছি তোমাদের। দুজনের যার যখন দরকার পড়বে, বদলা-বদলি করে নিয়ে, ব্যবহার করতে পারবে। তাতে অনেকটাই উপকার হবে তোমাদের। 
দুই ভাইবোনের তো মহা আনন্দ চোখটা পেয়ে। যাবার বেলায় বুড়ি বলল—তবে সাবধান, বাছারা। খুব যত্নে রাখবে চোখটাকে। কোনদিন যেন মাটিতে না পড়ে যায়। তখন কিন্তু আর কোন কাজই করবে না এটা। এই কথাটা ভুলে যেও না।
বুড়ি চলে গেলে, দুই ভাইবোনে বদলা-বদলি করে চোখটা ব্যবহার করতে লাগল। যখন যার দরকার পড়ে, বা ইচ্ছে হয়, সে তখন চেয়ে নেয় চোখটা। অন্যজন সতর্কভাবে চোখটা তুলে দেয় তার হাতে। 
দিন দুই বাদে মা ঘরে ফিরে এলো। ভারি খুশি হোল চোখটা দেখে। হোলই বা একটা মাত্র চোখ। দরকারের সময়, দেখতে তো পারছে। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে তো হচ্ছে না! তিনজনেই তারা ভারি খুশি।
একদিন মা নাই বাড়িতে। ছেলেটা বলল—বোন, চোখটা দাও আমাকে। যাই, কিছু শিকার পাই কি না, দেখি। 
তীর-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ছেলেটা। বেশি দূর যেতে হোল না। হৃষ্টপুষ্ট এক হরিণ পেয়ে গেল সামনে। এক তীরেই মারলও সেটাকে। কিন্তু সমস্যা হোল, হরিণটাকে ঘরে নিয়ে যাওয়া। এত ভারি, একা বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। 

ছেলেটা ঘরে ফিরে এসে, বোনকে সাথে নিয়ে ফিরে চলল। দুজনে মিলে কাটা শুরু করল হরিণটাকে। তখন খেয়াল হোল, একটা ঝুড়ি বা থলে আনা হয়নি বাড়ি থেকে। তাহলে, কাটা মাংস রাখবে কোথায়? বা মাংস নিয়ে যাওয়া হবেই বা কেমন করে?
বোনকে মাংসের কাছে বসিয়ে, ছেলেটা বলল—একটু বোস এখানে। আমি আসছি। 
এক বোঝা লতা ঘাড়ে করে ফিরে এল ছেলেটা। বোনকে বলল—এগুলো দিয়ে একটা ঝুড়ি বানিয়ে ফেলো। তাতে ভরে মাংস নিয়ে যাব আমরা। 
বোন বলল—ঠিক বলেছ। এবার চোখটা দাও আমাকে। চোখে না দেখলে, বুনব কী করে ঝুড়ি? বোনকে চোখ দিয়ে দিল ভাই। 
হাতের টিপুনি দিয়ে দিয়ে, বেশ জুতসই করে একটা ঝুড়ি বানানো হোল। আবার মাংস কাটা শুরু হোল তখন। কাটাকুটি শেষ হলে, ছেলেটা বলল—অনেক দেরি হয়ে গেল যে বোন। এদিকে ভারি খিদে লেগেছে আমার। বোন বলল—ঠিক বলেছ, খিদে আমারও লেগেছে। এক কাজ করলে হয় না, দাদা?
--কী কাজ?
--এখানেই খানিকটা মাংস রান্না করে নিলে, কেমন হয়? বেশ একটা চড়ুইভাতি হয়ে যাবে দুজনের। কথাটা বেশ মনে ধরল ভাইয়েরও। সে সানন্দে রাজি। বলল—তুমি রান্নাটা কর। আমি মাংসটা বাঁধাছাঁদা করি জুত করে। 
রাঁধতে বসে, বোন বলল—চোখটা আমাকে দাও। নইলে রাঁধবো কী করে? 
মাংস গোছানোর কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল ভাইয়ের। চোখটা বোনকে দিয়ে দিতে, সে রান্না শুরু করে দিল। খানিক বাদে বোন বলল—আরও দু’চারটে শুকনো ডালপালা চাই। উনুনে দেওয়ার মত আর কিছু নাই। 
ভাই চলল শুকনো ডালের খোঁজে। দু-চার পা গিয়েছে কি যায়নি, একটা গাছের শিকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল ছেলেটা। তাতে ভারি রাগ এসে গেল তার মাথায়। চেঁচিয়ে বলল—তোমার কেবলই এক কথা—চোখটা দাও, আর চোখটা দাও। চোখ না থাকলে,  আমি শুকনো ডাল খুঁজব কী করে? উলটে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাম।

শুনেই বোন দৌড়ে এল দাদার পাশে। হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে, চোখটা তার হাতে তুলে দিল।
আন্দাজ করে করে মেয়েটা উনুনের কাছে ফিরে এল যখন, একটা পোড়া গন্ধ নাকে লাগলো, মনে হোল। বোন চেঁচিয়ে বলল—ভাই, মাংসটা বোধহয় পুড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি চোখটা দাও আমাকে। দেখি, খাবারের কী অবস্থা।

খানিকটা দূরেই ছিল ছেলেটা। সে বিরক্ত হয়ে বলল—পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। অত আসা-যাওয়া করতে পারব না। নিজে এসে নিয়ে যেতে পারছো না? আলসের ধাড়ি কোথাকার। ছুঁড়ে দিচ্ছি। খুঁজে নাও চোখটা। 
বলেই চোখটা বোনের দিকে ছুঁড়ে দিল সে। দুজনের মাঝখানে মাটিতে গিয়েই পড়ল সেটা। কী হবে এখন? শুরু হোল দুজনের দু’দিক থেকে চোখ খোঁজা। সবুজ ঘাস, শুকনো ঝরা পাতা, ধুলোবালি—তন্নতন্ন করে খুঁজছে দুজনে। কিন্তু চোখের সন্ধান নাই। পাবে কী করে? চোখ তো নাই দুজনের কারও কাছেই। দুজনের চোখেই তো অন্ধকার। 
হয়েছে কী,  সেই কখন থেকে পাশেই একটা গাছে বসে ছিল একটা কাঠঠোকরা পাখি। দুজনের কাজকর্ম দেখে যাচ্ছিল বসে বসে। এখন মওকা পেয়ে ,ঝুপ করে নেমে এল পাখিটা। টুক করে কুড়িয়ে নিয়ে, কপ করে গিলে ফেলল চোখটাকে। তারপর? যেমন চুপিসারে এসেছিল, তেমনই সরে পড়ল সেখান থেকে। দুই ছেলেমেয়ে ঘটনাটার বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানতে পারল না।
দুজনে চোখ খুঁজছে হন্যে হয়ে, সেই বুড়ি এসে হাজির। বলল—অমন আঁতিপাঁতি করে কী খুঁজছো তোমরা? চোখটা দিয়েছিলাম, সেটা কোথায় গেল?
ছেলেটা বলল—চোখটাই তো খুঁজছি গো। এক্ষুনি মাথায় ছিল আমার। পড়ে গেল এখানে। 
মেয়েটাও বলে উঠল—হ্যাঁগো, ওর মাথতেই ছিল। পড়ে গেল এক্ষুনি। 
আসলে বুড়ি ছিল গাছের আড়ালেই। সবই দেখেছে নিজের চোখে। মিথ্যে কথা শুনে, ভারি রাগ হোল বুড়ির। বলল—সেদিন নিজেদের খাবার ভাগ করে খেতে দিয়েছিলে আমাকে। সেজন্যই চোখটা দিয়েছিলাম তোমাদের। সাবধান করে দিয়েছিলাম,  কোন দিন যেন মাটিতে না পড়ে জিনিষটা। 

একটু থেমে, বুড়ি আবার বলল—হাতে পাওয়া উপহারের মর্যাদা দাওনি তোমরা। রক্ষা করতে পারোনি দরকারের জিনিষটাকে। দ্বিতীয় কথা, একজন বুড়োমানুষকে কথা দিয়েছিলে, সেকথাও তোমরা রাখোনি। সবচেয়ে বড় কথা, নিজেদের দোষ ঢাকতে, মিথ্যে কথা বলতেও বাধছে না তোমাদের। আর এজন্যই শাস্তি পেতে হবে তোমাদের।
দূরের বরফের দেশের মানুষ বুড়ি। অনেক যাদু জানে বরফের দেশের লোকেরা। বুড়িও জানে সেসব। 
চোখের পলকও পড়তে পেল না। ছেলেটাকে একটা ছুঁচো আর মেয়েটাকে একটা বাদুড় বানিয়ে দিল বুড়ি। ভয়াণক রাগ করে বলল—এরপর থেকে সারা জীবন কোনদিন আর চোখে দেখতে পাবে না তোমরা। কেবল শব্দ শুনেই অনুভব করতে হবে সব কিছু। এই শাস্তি ভোগ করে যেতে হবে তোমাদের বংশধরদেরও। চিরকাল।

সেদিন থেকেই ছুঁচো আর বাদুড় সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে। বুড়ো-বুড়িরা বলে থাকে, তার আগে নাকি ছুঁচো আর বাদুড়ের অস্তিত্বই ছিল না দুনিয়ায়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments