জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা -৩০/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৩০

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত 

 শ্রীরামকৃষ্ণ তারককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তাঁর সাকার না নিরাকার কোনটি ভালো লাগে। তারক জানান যে, নিরাকারই ভালো লাগে। ঠাকুর একথা শুনে তাঁকে বলেন, শক্তি মেনে চলতে হয়। ধীরে ধীরে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলেন। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের আদেশে রাত্রিবাসও করতে শুরু করলেন। প্রথম যে রাতে তিনি ঠাকুরের কাছে থেকেছিলেন সেদিন ঠাকুর তাঁকে প্রসাদী লুচি খাইয়ে দক্ষিণের বারান্দায় শয়নের নির্দেশ দেন। মনের আনন্দে তারক বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করলেন। মধ্যরাতে দেখলেন উলঙ্গ ঠাকুর ভাবের ঘোরে পায়চারি করছেন এবং নিজের মনে কী যেন বলছেন। বারান্দায় এসে জড়ানো কন্ঠস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,  “ওগো,ঘুমিয়েছ কি? ” তারক সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, “না,  ঘুমুই নি তো।” ঠাকুর কর্তৃক আদিষ্ট হলেন, “একটু রাম-নাম শোনাও তো।” তারক রাম-নাম গাইতে শুরু করলেন। এইভাবে এক দিব্য আবেশে সারা রাত্রি যাপন করলেন। সকালে বিদায় নেওয়ার সময় ঠাকুর তাঁকে বললেন, “আবার এসো।” পরবর্তী দর্শনের সময় ঠাকুর অধিকতর কৃপা বর্ষণ করেন। শ্রীচরণ তুলে দেন তারকের বক্ষে। সেই দিব্যস্পর্শে এক ইন্দ্রিয়াতীত ভাবরাজ্যে চলে যান তারক। এই স্পর্শে তারক সম্যকভাবে অনুভব করেন যে, তিনি চিরন্তন মুক্ত আত্মা, আর ঠাকুর স্বয়ং ঈশ্বর যিনি জগতের কল্যাণের জন্য নরদেহে অবতীর্ণ হয়েছেন।
 দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে যাঁরা থাকতেন তাঁদের রাত তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠিয়ে ধ্যানে বসাতেন ঠাকুর।

 কোনোদিন খোল সহযোগে কীর্তন হত আবার কোনোদিন নৃত্য হত। লাজুক প্রকৃতির যারা বসে থাকত ঠাকুর জোর করে তাদের নৃত্য করাতেন। ঠাকুরের সঙ্গে থেকে রাত তিনটের সময় ওঠা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল তারকের কাছে। ঠাকুর সবসময় চাইতেন তাঁর যুবক ভক্তেরা ভগবদ্ভাবে বিভোর থাকুক। তাঁদের মধ্যে সেই অভ্যাস সঞ্চারের বিষয়ে তিনি সর্বদা সতর্ক থাকতেন। তারক প্রমুখ যুবক ভক্তদের বলতেন, “হ্যাঁ রে তোরা কি এখানে ঘুমুতে এসেছিস? সারা রাত যদি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিবি তো মাকে ডাকবি কখন?” পরবর্তী সময়ে তারক তথা মহাপুরুষ মহারাজের ভগবদ্ভাবে বিভোর জীবনপ্রবাহের বর্ণনা দিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অষ্টম সঙ্ঘগুরু স্বামী বিশুদ্ধানন্দজী। বর্ণনাটি এইরকম -- “ ১৯০৭ সালে জুলাই মাসে আমি, খগেন মহারাজ ও গিরিজা যখন জয়রামবাটীতে শ্রীশ্রীমার নিকট গেরুয়া নিয়ে হেঁটে কাশীতে এলাম তখন কাশী অদ্বৈত আশ্রমে পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজ, চন্দ্র মহারাজ, পর্বত এবং আর একজন ব্রহ্মচারী ছিলেন। চন্দ্র মহারাজের বর্তমান ঘরটি তখন রান্নাঘর ছিল। এখন যেটি দুর্গাভাণ্ডার, সেই পিছনের হলঘরে তখন মহাপুরুষ মহারাজ থাকতেন। আর আমরা তারই পাশের ঘরে যেখানে লাইব্রেরি হয়েছিল সেখানে ছিলাম। বর্তমান ঠাকুর ভাঁড়ার ঘরে তখন ঠাকুরের পূজা হত। মহাপুরুষ মহারাজ তখন শ্রীশ্রীঠাকুর-পূজা করতেন। চন্দ্র মহারাজ হাটবাজার সব করতেন। তিনিই আশ্রমের ম্যানেজার। মহাপুরুষ মহারাজের পূজার বিধি-টিধি তেমন কিছুই ছিল না। কেবল ধ্যান, প্রার্থনা ও অর্চনাদি। পূজার সময় দেখলে তাঁকে রামকৃষ্ণময় মনে হতো। কিন্তু শশী মহারাজের মতো পূজার খুঁটিনাটির দিকে তাঁর অত নজর ছিল না। তাই তো আশ্রমের নাম দিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ অদ্বৈত আশ্রম। তাঁর ঠাকুরই দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, অদ্বৈত সব। ওখানে প্রায় ছ-সাত বৎসর একনাগাড়ে ছিলেন। আশ্রমের বাইরে বড় একটা বেরুতেন না -- বেড়ানোও আশ্রমের ভিতরেই। এত রাশভারী পুরুষ ছিলেন যে, দূর থেকে সম্ভ্রম হতো। কাছে যেতে সাহস হতো না। গৌরবর্ণ টকটকে রং, সুন্দর দোহারা চেহারা। আবার তেমনি দীর্ঘবপু। ” (শিবানন্দ স্মৃতিসংগ্রহ, সংকলক-স্বামী অপূর্বানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়)

 এই কাশী অদ্বৈত আশ্রমে মহাপুরুষ মহারাজের জীবনে ঘটেছিল এক অভাবনীয় ঘটনা। তিনি তখন বার্ধক্যে উপনীত। কিছুদিন আগে পরম প্রিয় গুরুভ্রাতা শরৎ মহারাজের (স্বামী সারদানন্দ) জীবনাবসান ঘটেছে। এর ফলে খুব ভেঙে পড়েন তিনি। তাঁকে একান্তে বসে কাঁদতে দেখা যেত। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।
 চৌদ্দদিন জ্বরে ভোগার পর বায়ু পরিবর্তনের জন্য ডাঃ অমরবাবু তাঁকে মধুপুরে নিয়ে আসেন। সেখানে জনৈক ভক্তের প্রাসাদোপম ‘শেঠ ভিলা’ নামক একটি বাড়িতে তাঁরা ওঠেন। মধুপুরে প্রায় দু-মাস ছিলেন। কিছুটা সুস্থ শরীরে যখন কাশী অদ্বৈত আশ্রমে ফিরলেন তখনও কিন্তু তাঁর মানসিক অবস্থার তেমন কোনও পরিবর্তন হয় নি। ঠাকুরকে প্রায়ই দেহত্যাগের প্রার্থনা জানাতেন। স্বামী অপূর্বানন্দজী স্মৃতিকথায় লিখছেন -- “ একদিন কথাপ্রসঙ্গে বললেন -- ‘এ হচ্ছে মহাশ্মশান। যারা ভগবানকে ডাকবে, তাঁর নাম করবে, কেবল তাদেরই এখানে থাকা উচিত। বিষয়ীদের এখানে থাকা উচিত নয়। এ অবিমুক্তপুরী কাশীক্ষেত্রের সবটাই শিবের শরীর। আমরা শিবের মধ্যে বাস করছি।’ ... ঐ সময় তাঁর এক অলৌকিক দর্শন হয়েছিল যার প্রভাব তাঁর মনের উপর পড়েছিল বিপুলভাবে। একরাত্রে তিনি শুয়েছেন,  কিন্তু কিছুতেই ঘুম হচ্ছিল না। রাত ১২টার পরে তিনি দেখতে পেলেন যে, তাঁর ঘরটি স্নিগ্ধ আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।  হঠাৎ ঐ আলো দেখে তিনি বিছানায় উঠে বসলেন -- এমন সময় দেখলেন, এক শ্বেতকায় জ্যোতির্ময় পুরুষ, জটাজূটধারী, ত্রিনয়ন -- সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর দিব্যকান্তিতে চারদিক আরও আলোকিত হয়ে উঠল। সেই কমনীয় মূর্তি সকরুণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রসারিত হস্তে যেন তাঁকে আলিঙ্গন করবার জন্য তাঁর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। ঐ শ্বেতকায় পুরুষকে দেখামাত্রই তাঁর ভিতর থেকে মহাবায়ু গড়গড় করে একেবারে উপরের (সহাস্রার) দিকে উঠতে লাগল এবং তিনি ক্রমে গভীর ধ্যানস্থ হয়ে পড়লেন। ঐ অবস্থায় তিনি দেখলেন যে, ঠাকুর ত্রস্তব্যস্ত হয়ে উৎকণ্ঠিত ভাবে ডান হাত তুলে ঐ দিব্য পুরুষের পেছনে এসে দাঁড়ালেন যেন কোন বিষয়ে বাধা দিচ্ছেন। ক্রমে সেই জ্যোতির্ময় শিবমূর্তি বিলীন হয়ে গেল। ঠাকুর তখন সহাস্য বদনে মহাপুরুষজীকে হাত দিয়ে ইসারা করে বললেন -- তোর এখন যাওয়া হবে না, আরো কিছু কাজ বাকি আছে -- তোকে থাকতে হবে। ঠাকুর ঐ কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মন আবার নিচের দিকে আসতে লাগল এবং প্রাণবায়ুর ক্রিয়া চলতে লাগল। 

 পরদিন সকালবেলা তিনি পূর্বরাত্রের ঐ দর্শনের কথা-প্রসঙ্গে বলেছিলেন, সবই তাঁর ইচ্ছা। আমি কিন্তু বেশ আনন্দে ছিলাম। তিনি আর কেউ নন, সাক্ষাৎ বিশ্বনাথ আমায় নিতে এসেছিলেন, এদিকে ঠাকুর তা হতে দিলেন না।... কাশীক্ষেত্রে বিশ্বনাথ ও ঠাকুরের যুগ্ম দর্শন মহাপুরুষজীর জীবনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।”

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments