জ্বলদর্চি

অরণ্যষষ্ঠী (জামাইষষ্ঠী) /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ২৩

অরণ্যষষ্ঠী (জামাইষষ্ঠী)

ভাস্করব্রত পতি 

"জৈষ্ঠ্যমাসে অরণ্য ষাট / ফিরে ঘুরে এলো ষাট / বার মাসে তের ষাট / ষাট ষাট ষাট / ঝি চাকরের ষাট / গোরু বাছুরের ষাট / কর্তার ষাট, ছেলেমেয়ের ষাট / বউ ঝিয়ে ষাট, নাতিনাতনির ষাট / ষাট ষাট ষাট"।

এভাবেই অরণ্যষষ্ঠীর ব্রতে বাড়ির গরু বাছুর, পশুপাখি, ঝি চাকর, ছেলে মেয়ে, আত্মীয় স্বজন, বউ, জামাই -- সকলের মঙ্গল কামনা করা হয়। 'অরণ্যষষ্ঠী' আসলে জামাইষষ্ঠীরই নামান্তর।

তবে অরণ্যষষ্ঠীর ব্রতে বেশকিছু বাধানিষেধ আছে। মূলতঃ সন্তান ও জামাইয়ের সুখ সমৃদ্ধির কামনায় এই ব্রত। যিনি ব্রতী তিনি সধবা হবেন। আইবুড়ো বা বন্ধ্যা নারীদের নেওয়া হবেনা। আর এই ব্রত পালন করতে করতে ছেড়ে দিলে সেই নারী রাক্ষসী সদৃশ হয়ে যায় বলে বিশ্বাস। তবে ব্রতীকে নিরামিষ খেতে হয়। ভাত খাওয়া চলবে না। কৃষ্ণরাম দাস লিখেছেন -- "অদ্য যে অরণ্যষষ্ঠী বিদিত সংসার / আমিষ ভোজন কর দেখি কদাকার"। অরণ্যষষ্ঠীর ধ্যানমন্ত্র হোলো "দ্বিভূজাং হেম গৌরাঙ্গীং রত্নালঙ্কার ভূষিতাং / বরদা ভয় হস্তাঞ্চ, শরচ্চন্দ্র নিভাননাং / পট্টবস্ত্র পরিধানং পীনোন্নত পয়োধরাং / অঙ্কার্পিত সুতাং ষষ্ঠী মম্বজস্থাং বিচিন্তয়েৎ"। 

বাঙালী সংস্কৃতিতে ষষ্ঠীপূজা এক অতুলনীয় লোকাচার। অশোকষষ্ঠী, আতুরষষ্ঠী, অন্নষষ্ঠী, লোটনষষ্ঠী, কোড়াষষ্ঠী, একশ্যাষষ্ঠী, অরণ্যষষ্ঠী, কদলীষষ্ঠী, চাপড়াষষ্ঠী, কার্দমীষষ্ঠী, ছয়ষষ্ঠী, মূলাষষ্ঠী, স্কন্ধষষ্ঠী, সূর্যষষ্ঠী, সেটেরাষষ্ঠী, শীতলষষ্ঠী, ষাটষষ্ঠী, লুন্ঠনষষ্ঠী, চন্দ্রষষ্ঠী, গোষষ্ঠী, জলষষ্ঠী, দুর্গাষষ্ঠী, মা গোষ্ঠষষ্ঠী, চম্পাষষ্ঠী, চান্দনীষষ্ঠী, গোঠষষ্ঠী, জামাইষষ্ঠী, হলষষ্ঠী, সূতিকাষষ্ঠী, নারীষষ্ঠী, ধূলাষষ্ঠী, নীলষষ্ঠী, হলষষ্ঠী, পাটাইষষ্ঠী, মন্থনষষ্ঠী, বোধনষষ্ঠী, বিবাহষষ্ঠী, মাথানষষ্ঠী, কৃষ্ণষষ্ঠী ইত্যাদি। তবে এদের মধ্যে অরণ্যষষ্ঠী বা জামাইষষ্ঠী একটু অন্যরকম। একটু যেন পরিবেশ প্রীতির ছোঁয়া পাওয়া যায় এখানে। 

সাধারণত অরণ্যষষ্ঠী পালিত হয় অশ্বত্থ গাছের গোড়ায়। জৈষ্ঠ্যর শুক্লা ষষ্ঠীতে পিটুলি দিয়ে কালো বেড়াল ও কঙ্কন তৈরি করে ৫ থেকে ৯ ধরনের ফল (বিজোড় সংখ্যায়) দিয়ে 'বাটা' সাজানো হবে প্রথমে। এর মধ্যে করমচা রাখতেই হয়। প্রত্যেকের হাতে থাকবে থালা। তাতে থাকবে ফল। ৭ টি পান, ৬ টি সুপারি, আমপাতা, বাঁশপাতা, হলুদে ছোপানো নেকড়ায় জড়িয়ে ৬ টি হলুদে ছোপানো সূতোয় বাঁধা হবে। একে বলে "ষাট সূতা"। চির সবুজ তথা চিরকাল সতেজতার লক্ষ্যে ১০৮ গাছা দূর্বা রাখার নিয়ম আছে কোথাও কোথাও। রাখা হয় তালপাতার পাখাও। সাধারণত আপদ বিপদ দূরে ঠেলে চারিদিকে শান্তির কামনায় তা দিয়ে বাতাস করে উচ্চারিত হয় ছড়া --- "জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / শ্রাবণ মাসে লোটন ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / ভাদ্র মাসে মন্থন ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / আশ্বিন মাসে দুর্গা ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / অঘ্রাণ মাসে মূলা ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / পৌষ মাসে পাটাই ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / মাঘ মাসে শীতল ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / চৈত্র মাসে অশোক ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / বারো মাসে তেরো ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট"। এই তিনবার 'ষাট' বলা হয়, দীর্ঘায়ু কামনার জন্য।

এবার ষষ্ঠীতলায় বা অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় তেল হলুদ দিয়ে পূজো ক'রতে হবে ষষ্ঠীর। ঐ গাছেও সূতা জড়িয়ে দিতে হবে। পূজার শেষে সেই হলুদ ছেলে মেয়ে জামাইয়ের কপালে ছুঁইয়ে ডানহাতে ষাট সূতা (ছয় গাছি) বেঁধে দিতে হয়। এই সূতা আসলে চিরকালীন নিবিড় বন্ধনের প্রতিক। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক যেন অটুট থাকে। শাশুড়িরা তাঁদের জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় না খেয়ে কপালে চন্দনের ফোঁটাও দেন। মাথায় ধান দুর্বা ছড়ান। ধান হল সমৃদ্ধি এবং বহু সন্তানের প্রতীভূ। সেইসাথে আশীর্বাদ করেন দীর্ঘ সুস্থ জীবনের। দেওয়া হয় নতুন বস্ত্র। জামাইকে ভুরিভোজ করানোর ব্যবস্থাও থাকে। ওড়িশায় জামাইষষ্ঠী পালিত হয় কার্তিক মাসে। জৈষ্ঠ্যতে উৎকলদের জামাইষষ্ঠী হয়না। পুরুলিয়ার আদিবাসী মহিলারা অরণ্যষষ্ঠী ব্রত পালন করেন সন্তানের মঙ্গল কামনায়। এটি হল আদিম সমাজের আচরণজাত উর্বরতা ও প্রজননশক্তিবৃদ্ধির কামনা। 

আর এই জামাইষষ্ঠী এলেই পোয়াবারো হয় জামাইদের। যাইহোক, সংস্কৃত শব্দ 'জামাতা' থেকে প্রাকৃত 'জামাউ' হয়ে বাংলায় এসেছে 'জামাই' বা 'জামাঞি'। হিন্দিতে ও গুজরাটিতে 'জমাঈ', মারাঠিতে 'জারঈ', মৈথিলীতে 'জামায়' ও 'জমাঈ', ওড়িয়াতে 'জ্বাই' ও 'জুআঁই' , ফারসীতে 'দামাদ' এবং সিন্ধীতে 'জাটো' বলে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও 'জামাই' শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মনসামঙ্গলে আছে 'বেহুলার জামাই', শিবায়ণে আছে 'কুরণ্ডো জামাই' এবং দ্বিজ বংশীদাসের 'বিষহরি ও পদ্মাবতীর পাঁচালি'তে আছে 'কালীর জামাই'। দীনবন্ধু মিত্রের 'জামাই বারিক' এ আছে 'ভগবতী, তোমার যম জামাই দুই উপস্থিত'।

পশ্চিম রাঢ়ে এই জামাইষষ্ঠীকে বলে "জামাইবাঁধনা"। এখানে জামাইষষ্ঠী হয় কালীপুজোর পরে ভাইফোঁটার সাথে। আর জামাইষষ্ঠী মানেই নাকি জামাইদের কামাই করার অনুষ্ঠান! জামাইদের জীবনের দুর্গাপূজা যেন ! চব্য চোষ্য লেহ্য পেয় খাবারের সাথে সাথে উপঢৌকন জোটে ভালো মতোই ! মেয়ের দাম্পত্যজীবনে সুখ শান্তি আনতে শ্বশুর শাশুড়ির এদিনটায় দম ফেলার সময় থাকেনা। ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যার কথায় - "এ হলো উর্বরতা বা ফার্টিলিটি তত্ব । কিন্তু তা-ই কালক্রমে রূপ নিয়েছে জামাইয়ের প্রাপ্তিযোগে । ফলে অফিসে অফিসে এদিন অলিখিত লিখিত ছুটির বন্যা!" 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কথা বলতে গিয়ে প্রায়শঃই ভুরিভুরি প্রবাদ প্রবচন ব্যবহৃত করি। লোকসমাজ তো গড়েই উঠেছে প্রবাদের রমরমাতে। এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের জনজীবনের ধারা তথা সংস্কৃতি। এই প্রবাদ যেন বাঙালির নিত্যদিনের জীবনচর্চার জলছবি। তেমনি সেই প্রবাদের দুনিয়াতে বারবার এসেছে এই 'জামাই'য়ের উপস্থিতি। 'জামাই' আসলে নিজের ছেলের মতো। বেশিরভাগ শাশুড়িই জামাইকে পরের বাড়ির ছেলে ভাবেননা। কিন্তু প্রবাদ প্রবচনে জামাইদের নিয়ে জমজমাট রসিকতা রয়েছে।

'জামাই' মানেই নাকি 'লোভী' একশ্রেণীর চরিত্র। যেন শ্বশুর শাশুড়ির রক্ত চুষে খাওয়া 'ভ্যাম্পায়ার'! বাংলা প্রবাদেও ভুরিভুরি তার নিদর্শন। 'জামাই হারামখোর, আর বেড়াল হারামখোর'। ভাবা যায়! 'জামাইয়ের জন্য মারে হাঁস, গুষ্টিশুদ্ধ খায় মাস' ( সংস্কৃতে আছে ' জামাত্রর্থং স্রপিতস্য সূপাদেরতিথ্যুপকারকত্বম')। আসলে জামাইয়ের নাম করে নিজেদের উদরপূর্তির মহানন্দ। জামাইকে তুলনা করা হয় 'জামাতা দশম গ্রহ'। সংস্কৃতে আছে 'সদা বক্রঃ সদা ক্রূরঃ সদা মানধনাপহঃ। কন্যারাশিস্থিতো নিত্যং জামাতা দশমো গ্রহঃ'। স্বাভাবিকভাবে জামাইয়ের সম্পর্কে মানুষের ধারনা প্রতিভাত এখানে। আর বেয়াদপ জামাইকে কিভাবে ঢিঁট করা যায় তার নিদান এরকম - 'কিল কনুই মুষ্টি, তবে জামাইয়ের তুষ্টি'। অনেক সময় আমরা পরিচয় দিই 'অমুকের জামাই' বলে। এটা সম্মানজনক নয় জামাইবাবাজীর পক্ষে। লোকজনের মুখে ফেরে 'রাজার যুবরাজ, মোহন্তের চেলা / ফলনীর জামাই, এ নহে ভালা'।
 জামাই কখনও আপনার জন হতে পারে না। নিজের রক্তের মেয়েকে জামাইয়ের হাতে তুলে দিলেও সেই জামাই কখনও নিজের হয়না। তাইতো বলতে শোনা যায় 'জন জামাই ভাগনা, তিনজন নয় আপনা'। 'জন' অর্থে লোকজন বা মজুর বা পরিচারক বোঝায়। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন 'জামাতা ভাগিনা জন আপনার নয়'। তেমনি আমরা বলে থাকি 'মামা ভাগনে জামাই শালা, আর পোষ্য পুত / ঘরে ঘরে বিরাজ করে, এই পাঁচটি ভূত'। ঠিক এরকমই একটি কথা 'ঝি দিলেও জামাই নয়, মা দিলেও বাপ নয়'। অর্থাৎ সব জামাই কিন্তু প্রকৃত জামাই হয়ে উঠতে পারে না। তেমনি সব বাবাও প্রকৃত বাবা হয়ে উঠতে পারেন না। আবার অনেক ছেলের কাছে নিজের গর্ভধারিনী মা আপন হয়না। বৌয়ের মা তথা শাশুড়িই হয়ে ওঠে আপনার জন। তাই বলা হয়ে থাকে 'দুঃখের কথা কারে জানাই / মায়ের পুত নয় , শাশুড়ির জামাই'।

  মেয়ে জামাইয়ের সম্পর্ক নিয়ে অনেক প্রবাদ রয়েছে। 'চতুরালি করে কয় জামায়ের ভূতে / চল সোয়ামী ঘরে যাই কাঁথার ভিতর শুতে' অর্থাৎ জামাই - ভূত ইঙ্গিত বুঝেনা, তাই চতুরালি করে বলা হয়েছে এটা। যে জামাই তাঁর বৌকে ভালো রাখতে চায়, তা বৌয়ের সাজগোজেই মরদের পরিচয় বুঝিয়ে দেয়। তাই বলা হয় 'জামাই যে মরদ মেয়ের খোঁপাতেই পরিচয়'। যে জামাই কর্মহীন বা বেকার তাঁর পক্ষে সংসার চালানো খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ফলে তাঁর স্ত্রীকে সুখে রাখাও কঠিন। প্রবাদে বিষয়টা এরকম - 'জামাইয়ের গোদে শয্যা জুড়লো, মেয়ে শোবে কোথা'! আর ঝি জামাইয়ের খাতির হবে শ্বশুরবাড়িতে। পাড়াপড়শির শুধু দেখা ও সমালোচনা ছাড়া কিছুই করার নেই - 'যাঁর ঝি তাঁর জামাই, পাড়াপড়শীর কাটনা কামাই'। কাজ করতে যে পারে তাঁকেই বলে উপার্জনশীল। ঠিক তেমনি যদি মেয়েকে সুখে রাখতে পারে তবেই হয় সত্যিকারের জামাই। এটাই লোকমুখে উচ্চারিত হয় 'খেয়ে বাঁচলে কামাই, মেয়ে বাঁচলে জামাই'। যদি কখনও জামাই রেগে যায় তবে ক্ষতি হতে পারে নিজের মেয়ের। তাই প্রবাদে আছে 'জামাইয়ের রোষে, আপনার মোষে'। এখানে 'মুষ' এর অর্থ ক্ষতি হওয়া। 

  জামাই যে হয় তাঁর কাজ কেবল বাড়ির মেয়েকে নিয়ে যাওয়া। এতোদিন ছোট থেকে বড় করে তোলার পরে সেই মেয়েকে তুলে দিতে হয় পরের বাড়ির ছেলের হাতে। এটাই সুন্দরভাবে উপস্থাপিত এখানে -- 'আসবেন জামাই নেবেন ঝি, এর বাড়া আর করবেন কি'। পেটের ছেলে যা করতে পারে তা কখনও জামাই করতে পারেনা। এটাই প্রবাদে এরকম 'গতর কুশলে থাক, করে খাব কামাই / বিস্তর করলে পেটের পুত, কি করবে জামাই'।

মেয়ে জামাই নিয়ে লোকসমাজে এরকম কথাও চাউর রয়েছে 'জামাইও ভালোনা, পাঁচ ব্যন্নন ছাড়া খায়না/ ঝিও ভালো না, তিন ব্যন্নন ছাড়া রাঁধেনা'। আসলে মেয়ে জামাইয়ের মধ্যেকার ঝগড়া থাকা বা মিলিতভাব না থাকার ঘটনাই প্রতিভাত। আর কিছু জামাই তো খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কোনো জিনিসেই মন ভরেনা তাঁর। তাই বলা হয় 'পাঁচ ব্যন্নন দুধ রুটি / তবু জামাইয়ের ভিরকুটি'।

  জামাইয়ের পাতে বড় কই মাছ দিয়ে লোভী শাশুড়ির উক্তি এরকম - 'পাড়ার লোকও কয়, আমার মনেও লয় / জামাইয়ের পাতের কই মাছ খেলে শাশুড়ির পোলা হয়'। জামাইয়ের ছেলে তথা নাতির ভাতখাবানি ( অন্নপ্রাশন ) নিয়েও চালু আছে - 'ঢেঁকিতে বারা, পুকুরে পানি, জামাইয়ের বেটার ভাত ছোঁয়ানি'। এখানে বারা অর্থে চাল কোটা। একটু তীর্যকভাবে জামাইয়ের সমালোচনা করা হয়েছে। আর বদমাস জামাইকে সাইজ করতে 'কিলদগড়ী ওঠ ওঠ / জামাই এলো, কিলে কোট'। 'কিলদগড়ী' হোলো  যাঁর কিল খেয়ে গায়ে দড়ার মতো দাগ পড়ে গেছে।

 শ্বশুরবাড়িতে জামাইয়ের আদর' কেমন? অনেকটা ঠিক এরকম - 'জামাই এলো বাড়িতে, ভাত নেইকো হাঁড়িতে'। জামাই যেন শ্বশুর বাড়িতে আসে পেটপুরে খাওয়ার লোভে। প্রবাদে মেলে - 'খাওয়া দাওয়ার গন্ধে / জামাই আসে আনন্দে'। জামাইয়ের খাওয়াতেও হিসেব কষতে থাকে যাঁরা, তাঁদের কাছে 'জামাই এলে খায় ভালা, বোঝা যায় হিসাবের বেলা'। আবার দাশরথি রায়ের পাঁচালীতে আছে - 'জামাই গেলে শ্বশুরবাড়ি, তিনদিন আদর বাড়াবাড়ি'। জামাই বাড়িতে এলে শ্বশুর শাশুড়ির যে আনন্দ, তা নিয়ে শোনা যায় 'জামাই এলো কামাই ক'রে, বসতে দাও গো পিঁড়ে / জলপান করতে দাও গো সরু ধানের চিঁড়ে'। তেমনি জামাইয়ের সম্মান যে আলাদা, তা প্রকাশিত এই প্রবাদে - 'জামাই আসে কামাইয়া, ছাতি ধর নামাইয়া'। কথায় বলে 'জামাই আদর করা'। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'ষোড়শী'তে লিখেছেন 'তোমার অনুচরগুলো সন্ধান পেলে জামাই আদর করবে না'। শ্বশুরবাড়িতে জামাইয়ের আদর যে কতখানি উপাদেয়, তা যেন পৃথিবীর সেরা আদর। প্রবাদেই তার প্রমান। তেমনি শ্বশুর শাশুড়ির কাছে জামাইয়ের খাতির এরকম 'রুইয়ের মুড়ো, কেটো মুড়ো, দাও আমার পাতে / আড়ের মুড়ো, ঘিয়ের মুড়ো, দাও জামাইয়ের পাতে'। যদি মেয়ে সুখে শান্তিতে থাকে, তবে শ্বশুরবাড়িতেও আদর যত্ন ঘটে জামাইয়ের -- 'মেয়ে বাঁচলে জামাইয়ের আদর'।

  যাচা জিনিস কখনও ছাড়া উচিত নয়। কথায় বলে যাচা অন্ন ফেলে দিলে পরবর্তীতে নিরন্ন থাকার সম্ভাবনা থাকে। এই বিষয়টিই জামাইয়ের অনুষঙ্গে এভাবে এসেছে বহুবার - 'যাচলে জামাই খায়না পোনা মাছের মুড়া / শেষে জামাই পায়না ঢেঁকিশালের কুঁড়া', 'সাধলে জামাই খায়না, শেষে এঁটো পাতটাও পায়না', 'সাধলে জামাই ভাত খায়না, শেষে জামাই আমানিটাও পায়না', 'সাধলে জামাই খাননা পিঠে, শেষে মরেন ঢেঁকশাল চেঁটে', 'আগে জামাই কাঁঠাল খান না / শেষে জামাই ভোঁতাও পাননা', 'সাধলে জামাই খাননা, না সাধলে পাননা' ইত্যাদি।

  অনেক সময় যাঁর উদ্দেশ্যে করা হয় তাঁকে পাওয়া যায়না। অন্য অবাঞ্ছিত লোক দাঁও মেরে চলে যায়। তাই বলা হয় 'জামাইয়ের লাগি পিঠা বানাই / এসে খায় জামাইয়ের ভাই'। এই জামাইয়ের ভাই কিন্তু সামাজিক ভাবে একটু অন্য রকম। কোনো রকম বিপদে কিন্তু সে ত্রাতা হয়ে ওঠে। তাই বলা হয় 'জামাইয়ের ভাই গোঁজের আলা'। এখানে 'গোঁজ' অর্থে খুঁটি এবং 'আলা' আর্থে সেরা। মানুষের দেখনদারি স্বভাব চরিত্র অদ্ভুতভাবে প্রকাশিত এখানে 'জামাইয়ের বড় কোঁচার ফের / দু'বুড়ি কড়ি সূতোর ফের'।

  জামাইয়ের মধ্যে নিকৃষ্ট নাকি ঘরজামাই। অর্থাৎ যে জামাই শ্বশুরবাড়িতে থাকে। 'ঘরজামাইয়ের নাম নাই / লোকে বলে ফলনীর জামাই'। ঘরজামাই মানেই নাকি শ্বশুরের সম্পত্তির খাদক। ফলে বেশিরভাগ ঘরজামাই পান পাড়া প্রতিবেশীর খোঁটা। ঘরজামাই মানেই শ্বশুরের চাকর- 'ঘরজামাই আধা চাকর সর্বলোকে চলে / বাপদাদার নাম নাই, ফলনীর জামাই বলে'। আবার 'ঘরজামাই আনলাম কামাই খাবার আশে / থক দে রে, ঘরজামাই গেঁটের কড়ি নাশে'। দীনবন্ধু মিত্রের 'জামাইবারিক' এ আছে 'ঘরজামায়ের পোড়ার মুখ'। সত্যিই ঘরজামাইদের শুনতে হয় আরও নানা গালাগাল। এই 'জামাইবারিক'য়েই রয়েছে - 'ঘরজামায়ে পোড়ার মুখ, মরা বাঁচা সমান সুখ' এবং 'ঘরজামায়ে ভাতার যার, কানের সোনা নিন্দে তার'। যে পরিবারে ঘরজামাই রয়েছে, তাঁর দুর্দশা কহতব্য নয়। আসলে তাঁর যত্নই মেলেনা। যেন অন্য গ্রহের প্রাণী। শ্বশুরবাড়িতে গলগ্রহ। তাই শোনা যায় 'দূর জামাইয়ের কাঁধে ছাতি / ঘর জামাইয়ের মুখে লাথি'।

 'প্রহারেণ ধনঞ্জয়' প্রবাদটিও জামাই অনুষঙ্গতেই। চার জামাই হরি, মাধব, পুণ্ডরীকাক্ষ এবং ধনঞ্জয় শ্বশুরবাড়িতে জামাইষষ্ঠীতে এসে গ্যাঁট মেরে বসেছিল। বাড়ি যাওয়ার নামই ধরেনা। এরপর শ্বশুর ভাতে ঘি দিলোনা। হরি রেগে পালিয়ে গেলো। পরের দিন বসতে পিঁড়ি দিলোনা। মাধব রেগে পালিয়ে গেলো। এরপর বাজে রান্না করা হোলো। পুণ্ডরীকাক্ষ পালিয়ে গেলো। কিন্তু ছোট জামাই ধনঞ্জয়ের আর শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যেতে মন চায়না। তখন বেশ করে উত্তম মধ্যম দিয়ে তাড়ানো হোলো। তখন থেকেই প্রবাদে এলো 'প্রহারেণ ধনঞ্জয়'!

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments