জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-২৫ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-২৫

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

ম্যান্ডেভিলি গার্ডেন
কলকাতা


আমার বান্ধবী শিপ্রাই জানায় আমাদের বাড়িতে। আমার কাছে একদিন বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নম্বর চায়। আমি বললাম, 'কেন?'

“আমার ছোট বোনের সঙ্গে ভাবছি তোর যে ছোরদাদার বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছে বললি, তার জন্য মা বাবাকে লিখব আর তোদের বাড়ির ঠিকানা দেব।” তাই দিয়েছিলাম। ওর বর দেবুদার সাথেও সন্দেহ করত। দেবুদা টেক্সটাইল ইঞ্জিনীয়ার ছিল। কখনও কখনও কাজে আটকা পড়ত অফিসে, রাতে ফিরতে পারত না। হিমান্ত খবর নিয়ে জানতে পারত যে, দেবুদা বাড়ি নেই। সেই সুযোগে নিজের অফিস যাওয়ার পথে ওদের বাড়ী গিয়ে আমার আর দেবুদার নামে অকথা কুকথা বলত। সে তো সাঙ্ঘাতিক মেয়ে ছিল। ভালবেসে বিয়ে। ভাগিয়ে দিত তাকে বাড়ি থেকে।

--“আপনি শিমুলকে চেনেন না কিন্তু আমি এই কদিনেই চিনে ফেলেছি। সহজ সরল বলে নিজের নতুন বিবাহিতা স্ত্রীকে বদনাম দিতে আপনার একটুও লজ্জা লাগে না? আপনি শিক্ষিত? ছিঃ! আপনি জানেন না-ও ঘরে আমার মেজ দেওর শুয়ে আছে। ও জানতে পারবার আগে প্লিজ চলে যান এই মুহূর্তে।

আর শুনুন, আমি আমার স্বামীকে যতটা চিনি-তা আপনি জানেন না। চলে যান বাড়ি থেকে প্লিজ। ওর অবর্তমানে কেন এসেছেন ভোরবেলা আমাদের বাড়িতে? লজ্জা করে না আপনার? আপনি কি সুস্থ ?”

ভাববে মিথ্যে কথা -না, একটুও বাড়িয়ে বলছি না। তারপরেই শিপ্রা ট্রেণ ধরে চলে আসত আমার কাছে। কিন্তু আমায় কিছু বলত না, সব চিঠিতে আমাদের বাড়িতে জানাত।

হঠাত দেখি কালো কালো মেঘ এসে জড়ো হল কোথা থেকে? জানোতো চোখের সামনে আমাদের মুম্বাই-এর মুলুন্দের ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে দেখা গেল সমুদ্রের নীলচে সবুজ জল ঘোর কালো হয়ে উঠল। সাদা ফেনা আছড়ে পড়ছে। চোখ মুছে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম মন ধীরে ধীরে বালি ছেড়ে আকাশে পাড়ি দিচ্ছে। সমুদ্র আর আকাশের বিশালত্বের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে। আশ্চর্য! ভেতরটা ফাঁকা, হাল্কা। অনেক ঘূর্নীর ছোঁওয়ায় মনটা তখন তোলপাড়। কাঁদি নি। বিশ্বাস করো। একদম কাঁদি নি। আমার কাছে এক ফোঁটা চোখের জলের তখন অনেক দাম।

ঠাকুর এক অদম্য সাহস যুগিয়েছিলেন সেইসময় আমাকে... মনে হয়। তাই আজও আমি আমার ঠাকুরকে আঁকড়ে ধরে আছি। আর সেই সময় একটুও চোখের নোনাজলের অপব্যয় করি নি। জানতাম চোখের জলের কোনো মূল্য নেই। ভবিষ্যৎ ভাবি নি। কেউ ওইসময় ভবিষ্যৎ ভাবে না, বোধহয়। এখন ভাবি সংসারে এমন কিছু আছে নাকি যা ভাঙে না, মচকায় না, আলগা হয়ে যায় না। যদি থাকে তবে সেটা হয় মিথ্যে, নয় নিয়মের বাইরে।

এইসব জেনেশুনে তড়িঘড়ি দাদারা মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে আমাকে মুম্বাই থেকে কলকাতায় নিয়ে আসে। জানানো হল না কেন যাচ্ছি দাদাদের সঙ্গে।

অনেক কষ্টে বড়বৌদি আমার মুখ থেকে বের করলেন কিসের কি সমস্যা। আমার উপর কি রকম মানসিক অত্যাচার চলেছে দিনের পর দিন।

একেবারে উকিলের চিঠি পাঠানো হল হিমান্তকে।

ডিভোর্স পর্যন্ত আশা করে নি সে। আমাকে ছেড়ে দিতে তাই সে কিছুতেই রাজী নয়। এদিকে যখন আমাদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে টানাপড়েন চলছে ওদিকে তখন হিমান্তের একমাত্র ভগ্নীপতি মারা গেল ছাদ থেকে পড়ে। কেস হল মার্ডার। তোমারই বয়সী ছিল সে। তারপরের খবর আর জানি না।

--ইশ! এ আবার কেউ বলে নাকি? নির্ঘাত পাগল ছিল মানুষটা। নয়ত, শুধু শুধু এমন করতে যাবে কেন? সাংঘাতিক অবস্থার মধ্যে ছিলে তাহলে। শুনে নিজেরই তো হাত পা কাঁপছে রে বাব্বা। আর শুধু তাই না সাঙ্ঘাতিক স্ট্রং মাইন্ডেড তুমি। স্বীকার না করে উপায় নেই। তোমাকে স্যালুট জানাই শিমুল। একদম একা থেকে এই পরিবেশে নিজেকে স্থির রাখা মুখের কথা নয়।

এই অবস্থায় নিজেকে ঠিক রাখা যে কতখানি কঠিন ব্যাপার, তা ভেবেই শিউরে উঠছি।” পলাশের চোখে জল ভরে যায়। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখের জল মুছে ফেলে।

সেই অপরিণত বয়সে আমার উত্তর ছিল, “আমি দোষ করি নি। তাহলে আমি স্যুইসাইড করব কেন? আমি মরে গেলে প্রমাণ হবে যে, আমি দোষী। কিন্তু আমি তো কোন দোষ করি নি।” কিভাবে যে বলেছিলাম সেইসব কথা আজও মাঝে মাঝে এসে তারা সামনে দাঁড়ায়। সিনেমাও তো দেখতাম না। এত কড়া বাড়ি ছিল। আমাকে তাই এই যুদ্ধের সামনে দাঁড় করানোর মূলে আমার দাদারা/দিদিরাও।

ঠাকুর বিশ্বাসী আমি ছুটে গেছি হিমান্তকে নিয়ে মুম্বাই-এর রাধাকৃষ্ণের টেম্পলে ঠাকুরের চরণ ছুঁয়ে বলব বলে, “আমি কোন দোষ করি নি।” বেলুড়ে গুরুদেব স্বামী বিরেশ্বরানন্দ মহারাজের কাছে নিয়ে গেছি। কিন্তু সেই এক কথা, “ঠাকুরের কাছে গিয়ে জোরে বলছ, কিন্তু মনে মনে বলছ 'অন্যায় করেছি'।' যেন ছেলেখেলা জীবন। যেন পাগলের প্রলাপ। আমি এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ, কোন আক্ষেপ বা অভিযোগ করি নি সেদিন। যে মেয়ে একটু বকলেই অভিমানে খাওয়া দাওয়া করতে চাইত না, সেই মেয়ের জীবনে এমনি ঘটবে কেউ আশা করে নি।

যেদিন হাওড়া থেকে বম্বে মেলে মুম্বাই যাচ্ছিল সেদিন আমার এক আত্মীয়ের সাথে হিমান্ত-এর দেখা হয়-তাকে বলেছিল, “একটু গিয়ে শিমুলকে আমার কথা বলে নিয়ে আসতে পারবেন? আমি টিকিট ক্যান্সেল করে দেব তাহলে।” ওই আত্মীয় কিছুই জানতেন না আমার এই ব্যাপারে।

উনি এসেছিলেন বাড়িতে তখন-এবং সব শুনে তিনি তো থ। বললেন, “না, আর পাঠিও না শিমুলকে--এইবার মেরে ফেলবে।”

সে'জদা বলেছিল... “নাঃ আর পাঠাব না কোনোদিন। অনেক কষ্টে এই বোনকে মানুষ করেছি। পরে মা-বাবার কাছে কৈফিয়ত দিতে পারব না।”

--তোমাকে দেখে মনে হয় না যে তুমি এত স্ট্রং। তবে এখন বুঝি যে, তুমি আর পাঁচটা মেয়ের থেকে অনেক আলাদা। তুমি মনের দিক থেকে সাংঘাতিক শক্ত, তাই এত ঝড়-ঝাপটাকে এক তুড়ি মেরে সরিয়ে দিয়েছিলে। একদম ঠিক। তুমি মরে গেলে প্রমাণ হত যে, তোমার চারিত্রিক দোষ ছিল। আমি সত্যি প্রাউড অফ ইউ শিমুল। তোমার মতন আমাদের দেশে আরো মেয়ের জন্ম হওয়া উচিত। যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। নিজেদের শেষ করে দেবে না। আমার মনে হয় অসুস্থ ছিল লোকটা... সন্দেহবাতিক একটা খুব সাঙ্ঘাতিক অসুখ। ছোটবেলায় কোন কিছু ঘটেছিল যা ও নিজের চোখে দেখেছিল।

ওর মামার বাড়ির সবাই খুব ভালোবাসতো। তাই হিমান্তের বড় মামিমা এসেছিলেন আমাদের ফ্ল্যাটে। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কেন এমন হল? আমি ওকে দেখেই বুঝেছিলাম এ বাড়িতে বিয়ে দেওয়া ঠিক হয় নি।” আমি বলতে পারি নি ওনাদের বিশ্বাস করো আমার উপর কি রকম মানসিক অত্যাচার চলেছে দিনের পর দিন। বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। নার্ভাস ব্রেকডাউন তার সাথে ক্রিটিকাল জন্ডিস!

আচ্ছা অলৌকিক বলে কি কিছু হয় পৃ্থিবীতে? মানে ধরো, এমন কিছু ঘটল যা কোনদিন কেউ ভাবে নি, বা ভাবতেই পারে না? কারো সাধারণ লজিকে যার কোনও কার্য-কলাপ বোঝাই যায় না, তাকেই কি অলৌকিক বলে? না কেউ যা আশা করে না, সেটা হঠাত যদি ঘটে যায় সেটাকে অলৌকিক বলে। আমি কিছুই জানি না এসবের। খালি প্রশ্নেরা ভিড় করে বারে বারে।

কাজেই একেবারে উকিলের চিঠি পাঠানো হল হিমান্তকে। নাঃ তার ইম্পোর্টেন্সি নিয়ে না। কারুর ক্ষতি করার দায়ীত্ব আমার নয়, শুধু এইটুকু ভেবেই রাজী হই নি নামকরা উকিল রমাপতি ধরের কথাবার্তায়। অনুপম সোম ছিলেন তখন পুলিশ ডীপার্টমেন্টের সবচেয়ে উঁচু পদে। উনি আমার এক জামাইবাবুর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, উনি বললেন, “বলো শিমুল ওকে নজরবন্দী করে রাখি।” না আমি তাতেও রাজি হই নি।

আমি ওকে শাস্তি দেবার কে? তাহলে তো ঠাকুর মিথ্যে। যদিও জানতাম, নিজের অক্ষমতাকে লুকানোর জন্যই বোধহয় আমাকে চারিত্রিক দোষ দিতে শুরু করেছিল বিয়ের প্রথম দিন থেকেই। অথচ বিয়ে আমাদের পাকা ছিল তিন বছর আগে থেকেই। কতশত প্রেমের চিঠি পাঠাত তখন বাড়ির ঠিকানায়। নিজের চারিত্রিক কোন খুঁত না থাকা সত্ত্বেও অপমানের শিকার হলাম। পুরুষ বা মহিলা কাউকে বাদ দিতে দ্বিধা করত না। তখন নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম।

… “থাকব না, যেখানে নিজের মান সম্মান নেই, তার সাথে ঘর করা এক বাতুলতা মাত্র। তাও সমাজের ভয়ে বলেছিলাম বাড়িতে- আমি হিমান্তের কাছে যাব।” ও ট্রান্সফার নিয়ে বদলি নিয়ে কলকাতায় এলো। থাকলো সানি পার্কে -আমাদের ফ্ল্যাটের কাছেই। এর মধ্যে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। বার বার ফোন করতো-কিন্তু দিদিয়া আমাকে কখনই ফোন ধরতে দিত না।

নদাদা আমেরিকা থেকে উড়ে এল কলকাতায়। বলল, “যদি তুই ওর কাছে যাস, তোর সাথে কোন সম্পর্ক থাকবে না আমাদের। রাজী?”

কেঁদে ফেলেছিলাম-সেদিন হাউ হাউ করে।

 হিমান্তের বোন পম্পি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে স্বামীকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে, সে কথাই রটে গেল তখন। এই ঘটনায় বেশ হৈ চৈ হল। মাঝখান থেকে আমি বেঁচে গেলাম। ননদাই-এর ঘটনাটা ঘটায় কলকাতা হাইকোর্টে আমার কেসটাও তাড়াতাড়ি মিটে গেল। শিক্ষাই মানুষকে মুক্তিদান করে।

এইভাবে জীবন আর সমাজ পাশাপাশি হাঁটে।

(চলবে)
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments