জ্বলদর্চি

রাজ্যশ্রী /অংশু পাণিগ্রাহী


রাজ্যশ্রী


অংশু পাণিগ্রাহী

দেবগুপ্তর অনুগ্রহে আমার রুচি নাই। তাঁর দ্বারা নিযুক্ত দাসীদের বিদায় করে আমি ঘাটের সিঁড়িতে বসে আছি। স্বামীর ঘরে আমার নিজস্ব পরিচারিকা ছিল। এখানেও আছে। দেবগুপ্ত সেসবের কার্পণ্য করেননি। না, ভুল ভাবছি আমি। হত্যাকারীকে 'আপনি' 'আজ্ঞে' করে ভাবনা সাজানো অনুচিত। দেবগুপ্ত হন্তারক। আমার অনুভবে এর চেয়ে উত্তম কিছু স্থান পাওয়ার যোগ্য নয় সে। 

হয়তো রাজধর্ম পালন করেছে দেবগুপ্ত। কিন্তু আমি ক্ষত্রিয় কন্যা হয়েও তা গ্রহণ করতে পারব না। সে আমার স্বামীকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করেছে। স্বামীর প্রাণ হরণ করেছে। তারপর আমাকে অপহরণ করেছে। বন্দি করেছে। পরাভূত নরপতির বিধবাকে বলপূর্বক অবরুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে কোন ক্ষাত্রধর্ম রক্ষিত হয় আমার প্রশ্ন রইল। বুদ্ধের কাছে প্রশ্ন রইল। হে, মহামতি আপনিই বলুন, এক নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার গাত্রস্পর্শ করা এবং শক্তিপ্রয়োগ করা কোন পৌরুষের পরিচয়!
স্বচ্ছ সরোবরকে চুম্বন করে আসা দখিন হাওয়াও কটূ বোধ হচ্ছে। গাত্রদাহ হচ্ছে আমার। সরোবরের চতুর্দিকে গাছের অবরোধ। তাদের কোনোটিতে স্ত্রী-কোকিল দোল খাচ্ছে। পুরুষটি তাকে প্রসন্ন করার নিমিত্ত প্রাণপণ প্রয়াস চালাচ্ছে। সেই সুর-শলাকায় আমার হৃদয় ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। হে, গ্রহবর্মা! হে, প্রাণাধিক প্রিয়পুরুষ। আমি যে আপনার বিচ্ছেদে ঋতুতাড়িত কাতর কোকিলটির মতোই আকূল। আমি এই লগ্নে জলে ডুবে মরতে ইচ্ছা করি। কিন্তু সে উপায় নেই।  সাঁতারে যে আমি পটু!

কাঁচুলি সরিয়ে জলে অবতরণ করলাম আমি। রুচি নাই। কোনোকিছুতেই রুচি নাই আর। স্নান, আহার, নিদ্রা। সর্বক্ষণ দাসীবেষ্টিত হয়ে থাকি। দেবগুপ্ত কোনো কৌশলই বাকি রাখেনি আমার মন পেতে। আমার স্বাচ্ছন্দ্য সমৃদ্ধি ভিন্ন তার যেন অন্যতর কোনো চিন্তনীয় বিষয় নাই । কিন্তু না, এই রমণী এত সহজলভ্য নয়। বিশেষ করে, সেই পুরুষের কাছে যে, আমাকে অবরুদ্ধ করেছে। আমি তাকে ঘৃণা করি। তার মুখদর্শনেও আমার চরম বিতৃষ্ণা হয়। প্রয়োজনে আমি আত্মহনন করতে প্রস্তুত কিন্তু ওই শয়তানের গলায় বরমাল্য দেব না।

গলাজলে ডুবে থাকি সরোবরে। বুদ্ধকে শরণ করি। এটুকুই আমরা নিভৃতচারণা এখন। পরম শান্তির আশ্রয়স্থল। অবশ্য আরও একজন আছেন। তিনি তিলোত্তমা। বুদ্ধই সম্ভবত তাঁকে প্রেরণ করেছেন আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। তাঁর নাম আমার জিভে উচ্চারিত হয় না। তাই তিলোত্তম বলি। তিনি আলোকসামান্য রূপসী। বিদুষীও বটে। তিনি বলেন, তিনি নাকি অন্য যুগ থেকে এসেছেন। 
জল থেকে উঠে এলাম। শনশন করে একটা শব্দ হচ্ছে। তিনি আসছেন। দেবগুপ্তর রক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে কীভাবে যে তিনি আমার সমীপে উপস্থিত হন, এ নিয়ে আমার মনের ধোঁয়াশা কাটে না। তিলোত্তমা অবশ্য বিস্তারিত বলেছেন, তাঁর আগমনের পদ্ধতির বিষয়ে। বহুযুগের ওপার থেকে সময়যানে আরোহণ করে তিনি কীভাবে আমায় দেখা দেন, তার খুঁটিনাটি বর্ণনা আমি শুনেছি। কিন্তু বোধগম্য হয়নি সেসব । সেসবে আমার প্রয়োজনও নাই। জগতে কতকিছুই তো ঘটে। অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত। এ হয়তো তেমনই কিছু। 
আজও অদৃশ্য এক দরজা ঠেলে যুগের ওপার থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিলোত্তমা। সুন্দর করে হাসছেন।
"কেমন আছেন, রাজ্যশ্রী!"
তাঁর সেই সুরেলা কন্ঠে আমার প্রতিটি রোমকূপ শিহরিত হচ্ছে। প্রাণিত হচ্ছি আমি।
"আপনার দয়ায় আমি খুব ভালো আছি। অন্তত কয়েকদিন আগেও যেমন ছিলাম, তার চাইতে অনেক ভালো। আপনি কেমন আছেন দেবি?"
"আঃ! আপনাকে কতবার বলেছি, আমি কোনো দেবি নই, সাধারণ এক মেয়ে। এর বেশি কিছু নয়। বয়সের দিক দিয়েও আপনি আমার চেয়ে… উমম, কম করে দেড় সহস্রাব্দ প্রবীণা। আপনি আমার অগ্রজ।"
তিলোত্তমার সারল্য আমাকে মুগ্ধ করে। তিনি অবশ্যই অমিতশক্তির অধিকারী। নচেৎ এরূপ সময়-অতিক্রম কার্য সাধারণ মানুষের অসাধ্য। তবুও তিনি দম্ভহীন। 
আমার চিন্তার ফাঁকে তিলোত্তমা বলছেন, "খাওয়া-দাওয়া করবেন ঠিক করে। নিজেকে প্রস্তুত রাখবেন। রাজ্যবর্ধন আপনাকে উদ্ধার করতে আসছেন শীঘ্রই।" 
'খাওয়া-দাওয়া'। তিলোত্তমার থেকে আমি এই ভাষা শিখেছি। আগে তো 'আহার' বলতাম। এখনও বলে ফেলি মাঝেমধ্যে। তিলোত্তমা কথা বলেন দেড় সহস্রাব্দ-পরবর্তী কোনো বাক-কৌশলে। আমি শিখে নিয়েছি অনেকটাই। আমার বেশ তৃপ্তি হয় ভবিষ্যতের ভাষাটি ব্যবহার করতে। 
আজ তিলোত্তমা আশার কথা শুনিয়েছেন। দাদা আসবেন শীঘ্রই। তিলোত্তমার কথা অভ্রান্ত। কারণ তিনি ভবিষ্যৎ থেকে আসছেন। কথাটা অবিশ্বাস্য। জানিনা, এ আমার স্বপ্ন-বিভ্রম কিনা! তবুও… এই বিশ্বাসে স্বস্তি আছে। 
"আবার দেখা হবে। বিদায় দিন দেবি।" 
তিলোত্তমার সময় ফুরিয়েছে। তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর বেশভূষা অনন্য। কাঁচুলি,পটবস্ত্র নয়। বস্ত্রের বয়নরীতি সম্পূর্ণ পৃথক। তাঁর নিম্নাঙ্গের বসন আমাদের মতো পায়ের কাছে ঘের দেওয়া নয়। ঊরুসন্ধি থেকে বিভাজিত হয়ে সেই পোশাক তুই চরণকে আবৃত করেছে পৃথকভাবে। ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাকও অত্যন্ত বিচিত্র। কাঁচুলির মতো বক্ষের শেষপ্রান্তে ফুরিয়ে যায়নি। কোমর অবধি তার ব্যাপ্তি। তাতে ফুলের কারুকলা সুতো দিয়ে বুনে তোলা হয়েছে। আমি বিভোর হয়ে দেখি তিলোত্তমাকে। তিনি হাত নেড়ে অদৃশ্য হয়ে যান। 
দাদা আসছেন। নিশ্চয়ই তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শিলাদিত্য কী করছে? সে-ও কি দাদাকে সঙ্গ দেবে! 
আবার যুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই রক্তক্ষরণ। রক্তের অপচয়। অপচয়! ক্ষত্রিয় হয়েও এই কথা মনে হচ্ছে। হে বুদ্ধ, এ পথ কি তোমারই দেখানো! হ্যাঁ, অবশ্যই তাই। অতীতে তুমিই পেরেছিলে রক্তলোলুপ এক নরপতিকে মানবতার পথে আনতে। চণ্ডরূপকে করেছিলে দয়াসিক্ত। কিন্তু দেবগুপ্ত আমার হৃদয়কে ফালা ফালা করেছে। ক্ষমা নয়, তার শাস্তিই প্রাপ্য।

পূর্ণিমা। প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে আছি। এ বড় অস্থিরতার সময়। দেবগুপ্ত সৈন্য সাজাচ্ছে। গতবারের মতোই সে একাকী নয়। শশাঙ্কের সঙ্গে মৈত্রী আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। দাদাকে লড়তে হবে এই যৌথশক্তির বিরুদ্ধে। 
আমি যদি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হতাম! যদি সাহায্য করতে পারতাম দাদাকে! সে উপায় নাই। আমি শুধুমাত্র প্রার্থনা করতে পারি। এর অধিক কিছু নয়। 
তিলোত্তমা বলেছেন, তাঁর সময়ে মেয়ে-পুরুষের বিভেদ ক্রমশ বিলীন হচ্ছে। কোনো কাজই আর বিশেষ কোনো লিঙ্গভিত্তিক সক্ষমতার উপর নির্ভর করছে না। বিবিধ বিদ্যার্জন এবং কায়িক পরিশ্রম। সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দিন-দিন বাড়ছে। তিলোত্তমার যুগে জন্মগ্রহণ করলে আমিও হয়তো যুদ্ধকৌশল শিখতাম। সে-যুগেও অনবরত যুদ্ধ হয়। মানুষ নাকি ভয়ংকর মারণাস্ত্র উদ্ভাবন করে চলেছে দিনদিন। বসুন্ধরা এক লহমায় প্রাণশূন্য হয়ে যেতে পারে সেইসব হাতিয়ারের প্রয়োগে।
সে-যুগের মানুষ যদি বিদ্যায়-জ্ঞানে-মানবিকতার উন্নততর তবে তারা যুদ্ধের নেশা, রাজ্যলিপ্সা ত্যাগ করতে পারেনি কেন? তিলোত্তমাও জবাব দিতে পারেননি এই প্রশ্নের। 

চাঁদের পানে চেয়ে প্রহর কাটছে। পৃথিবীর যা কিছু আছে সম্পদ, তার মধ্যে চাঁদ সবচেয়ে মনোহর। গ্রহবর্মা বলতেন, আমি নাকি চাঁদের চেয়েও… নাহ, এ নিশ্চয়ই তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম। অতিকথন। প্রেয়সীর জন্য প্রশংসা। ভালোবাসায় কত কিছুই না হয়! 
আমার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল। এক সেবিকা নতশিরে নিবেদন করছে, "দেবি, মহারাজ দেবগুপ্ত আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী।" 
আবার দেবগুপ্ত! এই অপার্থিব রাতের মায়ায় কালিলেপন করতে আসছে ওই শয়তান। আমার মধ্যে যে প্রীতির আবেশটুকু তৈরি হচ্ছিল তা নষ্ট করতে আসছে। এই অলিন্দ, এই ঝিরঝিরে বাতাস, মহাজগতের শ্রেষ্ঠ রূপসী চাঁদ আমাকে গ্রহবর্মার সঙ্গে সাক্ষাৎ করায়। দু'দণ্ড অতীতযাপনের সুযোগ দেয়। সেই মধুময়তাকে অভিশপ্ত করতে আসছে দেবগুপ্ত।
"আমি নিষেধ করছি। আমি আগ্রহী নেই তোমার মহারাজের সাথে সাক্ষাতে। আমার কুমকুমের রঙ ফ্যাকাশে হতে না হতেই সে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। আমি তাকে সহ্য করতে পারব না এইমুহূর্তে।" তপ্তকন্ঠে বললাম।
সেবিকা কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। অট্টহাসি শোনা গেল পর্দার অন্তরাল থেকে। তারপর এক বিকৃত কদর্য লালসা মানুষের রূপে বেরিয়ে এল। আমার সামনে দাঁড়াল। দেবগুপ্ত। এইক্ষণে তাকে নরখাদক এক রাক্ষস ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না।
সেবিকা ইতিমধ্যে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে। দেবগুপ্ত এগোচ্ছে আমার দিকে। তার অধৈর্যভাব ক্রমশঃ প্ৰকটিত হচ্ছে। আমি এক-এক পা পিছিয়ে আসছি। অলিন্দের প্রাচীর আমার শরীর স্পর্শ করেছে।
আমি চিৎকার করে উঠলাম, "সাবধান দেবগুপ্ত! আমি এই অলিন্দ থেকে লাফিয়ে পড়ব। আত্মবিসর্জন দিতে আমার ভয় হয় না।"
দেবগুপ্ত একটু চমকাল। থমকে গেল তার পাদচারণা। তার কদর্য বাসনা ধীরে ধীরে পরিণত হল এক অক্ষম অসহায়তায়।
"আমার অপরাধ কী?এক ক্ষত্রিয় রাজা হিসেবে রাজ্যলিপ্সা, যুদ্ধকার্য এবং প্রতিপক্ষের প্রাণ হরণ কি ধর্মবিরুদ্ধ! বিজিত রাজার সর্বস্ব হরণ করাও সেই নীতিরই অঙ্গ। আমি অন্যতর কিছুই করিনি। আমি চাইলেই এই দণ্ডে আপনাকে ধর্ষণ করতে পারি, রানি! ‘রানি’ সম্বোধনটি খেয়ালে রাখবেন। আমি আপনাকে রানিরূপেই কামনা করছি। তাই বলপ্রয়োগ করা থেকে বিরত রেখেছি নিজেকে। আপনার অনুমতির অপেক্ষা করছি।"
দেবগুপ্তর কথা সংবেদনশীল প্রেমিকের মতো! ঈপ্সিত নারীটিকে সে কতোই না প্রেম করে, তাই তার দেহে হাত দিচ্ছে না। না, আমি তাকে বিশ্বাস করছি না। এ কেবল ছলনা। সে জানে বলাৎকারের প্রচেষ্টা দেখলেই আমি আত্মাহূতি দেব। তাই এই প্রেমিক সাজার অপচেষ্টা।
"তোমার দিন ঘনিয়ে এসেছে, দেবগুপ্ত। গুপ্তচর মারফত নির্ঘাৎ খবর পেয়েছো, দাদা এতক্ষণে রওনা দিয়েছেন। যাও, তুমিও যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। আমি শুধুমাত্র মরীচিকা। তোমার কালহরণ করব। এখানে সময়ের অপব্যয় কোরো না।"
"বেশ। দেখি আপনি কতদিন আমায় প্রতিরোধ করতে পারেন! রাজ্যবর্ধনকে কচুকাটা করব। স্বয়ং শশাঙ্ক আমার সহায়। তারপরেই নাহয় আপনার সঙ্গে বিবাহটা…" 
দেবগুপ্তর পৈশাচিক অভিসন্ধি ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হল পর্দার আড়ালে।
চাঁদের আলো ম্লান লাগছে। আগের মতো ঔজ্জ্বল্য নাই। এমনই এক রাতে দেবগুপ্ত বন্দি করেছিল আমাকে। নৈসর্গিক রূপসজ্জা উপভোগ করার মতো মানসিক অবস্থা তখন নয় আমার। বিকালেই বার্তা এল, দেবগুপ্ত অতর্কিতে হানা দিয়েছে। রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে দাবানলের মতো এগিয়ে আসছে। ছারখার করে দিচ্ছে তার যাত্রাপথের সমস্ত বাধা। পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়ার কোনো অবকাশ পাননি আমার মহারাজ। গুপ্তচর মারফত কোনো গূঢ় বার্তা আসেনি। কূটনীতিকদের মধ্যেও এ নিয়ে কোনো কথা চালাচালি হয়নি। অবশ্য বাতাসে ভাসছিল একটি খবর। গ্রহবর্মার সঙ্গে আমার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন নাকি কিছু রাজার চক্ষুশূল হয়েছে। আমার পিতৃবংশের সঙ্গে গ্রহবর্মার এই নতুন মৈত্রী তাঁদের শিরঃপীড়ার কারণ। গ্রহবর্মাকে শায়েস্তা করার ষড়যন্ত্র রচিত হচ্ছে। 

সেই ষড়যন্ত্র সফল করতেই দেবগুপ্ত আমাদের রাজ্য আক্রমণ করে বসে। আমাদের রাজ্য বললাম বটে। আমার কি নিজস্ব কোনো রাজ্য আছে? কিশোরীবেলা অবধি বাবার রাজ্যকে নিজের বলতাম। বিবাহের পরে স্বল্প দাম্পত্য-কালে গ্রহবর্মার রাজ্য আর এখন দেবগুপ্তর রাজ্য। মাটি তো মাটিই থাকে। তার কোনো ভেদ নাই। আমি মাটিতে বাস করছি। মাটির পৃথিবীতে। এ মাটি যেমন বুদ্ধের, তেমনই আমার, বাবার, স্বামীর, পিশাচ দেবগুপ্তের। কিন্তু সেই কথা কেন বোঝেন না তাঁরা! এমনকী তিলোত্তমাও বলেছেন, তাঁর যুগেও মাটি নিয়ে কাড়াকাড়ি। কে আগে দখল করবে, কতটা দখল করবে, কীভাবে তার পরিসর বাড়াবে, এই নিয়ে রক্তারক্তি। সবার অধিকার নেই সেই মাটিতে। যে দখল করবে আগে, মাটি তার। তার নামেই মাটির পরিচয়। মাটি হবে সেই প্রভুর অধীন এবং মাটির জীবকুলও। তাই আমার নিজের রাজ্য বলতে আসলে কিছু ছিল কি? অথচ ভাগ্যের করুণ পরিহাসে আমার নাম রাখা হয়েছে রাজ্যশ্রী। 

গ্রহবর্মার সঙ্গে আমার বিবাহও তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমার বাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফসল। জাতে ওঠার সিঁড়ি। শক্তিশালী সামন্ত রাজা থেকে রাজাধিরাজ হওয়ার উদ্দীপক। অবশ্য গ্রহবর্মা আমাকে ভালোবাসতেন। তাঁর প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নাই। 
সেই বিকালে যে তিনি রণযাত্রা করলেন… ফিরলেন পূর্ণিমার আলো আর রক্তে মাখামাখি হয়ে। তাঁর প্রাণটুকু শুষে নিয়েছে শোণিত-পিপাসু নির্দয় যুদ্ধক্ষেত্র। আমি এই অলিন্দেই অস্থির পাদচারণা করছিলাম। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আমি চেতনালুপ্ত হই। ক্ষত্রিয় কন্যা হিসেবে আমি এসবের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু নিজের স্বামীকে হয়তো প্রাণাধিক প্রেম করতাম। তাঁর এহেন মর্মান্তিক পরিণতি আমি সহ্য করতে পারিনি। মূর্ছা গেলাম। যখন সংজ্ঞা ফিরে পেলাম তখন থেকেই আমি দেবগুপ্তর বন্দি। 
আজ পুনরায় সেইসব বীভৎস স্মৃতি জেগে উঠছে। আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। তীব্র বিষাদে মনটা ভরে যাচ্ছে। তিলোত্তমা, এখন আপনাকে খুব আশা করছি। আপনাকে প্রয়োজন আমার। আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন আমার ডাক! 
শনশন শব্দ হচ্ছে কি বাতাসে? হ্যাঁ, ওই তো অদৃশ্য দরজাটা খুলে গেছে। তিলোত্তমাকে দেখতে পাচ্ছি।


কিশোরীবেলা। প্রাসাদ থেকে সরস্বতী দেখা যেত। স্বচ্ছতোয়া সরস্বতীর বুকে রঙবেরঙের পালতোলা নৌকা। মাঝি-মল্লার হাঁকডাক। মানুষের নদী পারাপার। গোধূলির সময় অলিন্দ থেকে নদীকেন্দ্রিক কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ ছিল আমার একমাত্র বিনোদন। তারই মধ্যে আমার অপূর্ণ বাসনা দীর্ঘশ্বাস হয়ে মিলিয়ে যেত পুবালি হওয়ায়। নৌকায় চাপার তীব্র বাসনা হত। কিন্তু প্রাসাদের চৌহদ্দির বাইরে পা রাখা নিষিদ্ধ। 
অথচ পশ্চিমের আকাশের গায়ের ফাগের ছোঁয়া। কী অপার্থিব এই পরিমণ্ডল! 

ওই মানুষেরা কত সুখী,স্বাধীন! ইচ্ছেমতো নদী পারাপার করে। আঁজলা ভরে নদীর জল তুলে মাথায় ছিটিয়ে নেয়। অস্তগামী অর্ককে প্রণাম করে। হই হল্লায় মাতিয়ে রাখে নদীর বাতাস। সবই দেখি আমি। সখী চুল বেঁধে দেয়। 
"আমরা একদিন নদীর তীরে যেতে পারি না? নৌকাবিহার করতে পারি না?"
আমার কথায় সখী শিউরে ওঠে।
"সামন্তরাজ জানলে কঠিন শাস্তি দেবেন, কুমারী। তুমি একথা আর মুখে আনবে না।"
"বাবা জানবে না। তুই শুধু আমায় সঙ্গ দিবি। রাজি কিনা বল! নইলে আমি একাই যাব।"
"তোমার কী হয়েছে, কুমারী? জেদ করছো কেন!"
"এই অন্তঃপুরে বন্দি থাকতে তোর ক্লান্তি লাগে না? কী ভারী এখানকার বাতাস! আমার বুকে কষ্ট হয়। কীসের যেন অপূর্ণতা টের পাই। শরীরে কেমন এক শিহরণ। মনের মধ্যে অস্থিরতা। কী যেন, কীসের যেন অভাব! কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। মন বড় অশান্ত হয়ে থাকে। আমি জানি, নদী গেলে, নৌকাবিহার করলেই সন্তুষ্টি মিলবে।"
সখী মুখ টিপে হাসে, "নদী-টদি নয় গো! তোমার একজন কুমারের প্রয়োজন।"
"রসিকতা করবি না।" বলে আমি চুপ হয়ে যাই। 

সেই রাতেই প্রথম তিলোত্তমার সাথে সাক্ষাৎ।

তখন মধ্যরাত। প্রদীপের তেল ফুরিয়ে এসেছে। কী এক অস্বস্তিতে নিদ্রাভঙ্গ হল। আমার পাশেই যেন অন্য কারোর শ্বাসের শব্দ। আমি চমকে উঠলাম। এই শয়নকক্ষ আমার নিজস্ব। এখানে আমার অনুমতি ছাড়া কেই-বা প্রবেশ করবে। তাও এত রাতে! নিরেট অন্ধকার ঠাসা কক্ষে আমি ছাড়াও অন্য কেউ রয়েছে। কে হতে পারে? তার উদ্দেশ্য কী? এই কালিমাখা আঁধারে তার গতিবিধি বোঝা অসম্ভব। কক্ষের বাইরেই দাসীদের কেউ না কেউ থাকবে। আমি চিৎকার করতে গেলাম। একটি মেয়েলি হাত আর মুখ চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল, "ভয় পাবেন না। আমি আপনার ক্ষতি করব না।"
আমার সখীদের মধ্যে কেউ নয়। দাসীদের মধ্যে কেউ নয়। আমার পরিচিত কেউ নয়। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মেয়ে আমার ব্যক্তিগত কক্ষে এত রাতে কী করছে? রক্ষী এবং দাসীদের নজর উপেক্ষা করে এখানে প্রবেশ করল-ই বা কী উপায়ে! তীব্র কৌতূহল হল। সেই সাথে শিরশিরে ভীতি।
"কে আপনি? আপনার অভিপ্রায় কী?" স্বর কম্পিত হল আমার।
মেয়েটি ততক্ষণে আলো জ্বালিয়ে ফেলেছে। এ আলো আমি আগে দেখিনি। প্রদীপের আলো হলদেটে, ক্ষীণ।এই আলো সাদা, উজ্জ্বলতর। চোখে ধাঁধা লাগল আমার। খানিকক্ষণ পরে চোখ সয়ে এল। মেয়েটি দৃষ্টিগোচর হল। বয়স আমারই মতো। কিন্তু এ কী অদ্ভুত সাজ! সাজহীনতা বলাটাই বরং যথার্থ হবে। বিচিত্র বেশবাস। কেশরাশি অসংবৃত। শরীরে কোনো আভরণ নেই। মুখমণ্ডলে, হাতের উল্টো পিঠে কোনো প্রসাধন নেই। 
"আপনি কি আমার কথায় বিশ্বাস করবেন?" ঠোঁটের কোণে কৌতুক নিয়ে মেয়েটি বলল। 
"জানি না। আমি বুঝতে পারছি না কিছু। আমি কি স্বপ্ন দেখছি?"
"একরকম তাই। আপনাদের যুগে এ সবকিছু স্বপ্নই। কিন্তু আমাদের যুগে বাস্তব। আর তাই খুব পরিচিত ও সাধারণ।"
"আপনাদের যুগ?" 
"হ্যাঁ, আমাদের যুগ। আপনাদের দেড় সহস্রাব্দ পরবর্তী যুগ। আমি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছি। আমার নাম…"
"তিলোত্তমা?"
"তিলোত্তমা! না না, তিলোত্তমা নয়… আচ্ছা থাক, আপনি তিলোত্তমাই বলুন।"
দেড় সহস্রাব্দ পরবর্তী যুগ। ভবিষ্যৎ। আমি নিজেকে চিমটি কেটে দেখলাম। বেদনা হল। তার মানে আমি জেগে আছি। 
"আপনার পরিচয় তো জানা হল না! আমি আসলে কোন সময়ে, কোন স্থানে এসেছি সেসব জানি, কিন্তু কার সাথে কথা বলছি সেটা ঠিক…" মেয়েটি বলছে শুনলাম।
"আমি রাজ্যশ্রী। প্রভাকরবর্ধন আমার পিতা।"
"তাই বলুন! তাহলে সব ঠিকই আছে। আমার পরীক্ষা সফল হয়েছে। ভালো লাগল আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে। চলি আজ। আবার কোনোদিন আসব সুযোগ পেলে।" মেয়েটি প্রস্থান করতে উদ্যত হল।
অনেক কিছুই জানার ছিল। কিন্তু আমি শুধু বললাম, "যাবেন কী উপায়ে?"
"এই আমার পোশাকে একটি বোতাম আছে। ওটায় চাপ দিয়ে আমি ইচ্ছেমতো যেকোনো সময়ে যেকোনো যুগে অবাধে যাতায়াত করতে পারছি।"
রোমাঞ্চিত হলাম আমি। এ কী অদ্ভুত যান! জামায় সেলাই করা একটি পুঁতি। এ যে অলৌকিক!  তিলোত্তমার কি কোনো গূঢ়বিদ্যা জানেন! নিশ্চয়ই জানেন। তিনি সাধারণ মানুষ নন। নাকি মানুষই নন! দেবী! আমার মতোই বয়স। কিন্তু অমিত শক্তির অধিকারী। আমার মধ্যে গোধূলিবেলার সেই বাসনা হঠাৎ তীব্র হয়ে উঠল। ইনিই পারবেন। 
"দেবি, আমার একটি অনুরোধ রাখবেন?" করজোড়ে বললাম।
"আমি দেবী নই। মহাবিশ্বের এক অকিঞ্চিৎকর প্রাণী। আপনি আদেশ করুন। আপনি সামন্তকন্যা। অদূর ভবিষ্যতে এই ভূখণ্ডের ইতিহাস আপনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আপনিই ইতিহাসকে দিশা দেখাবেন।" 
আমি চমকে উঠলাম। তিলোত্তমা এ কী কথা বললেন? তাহলে কি পিতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা সফল হবে? আমি শুনেছি, পুবের এক মহারাজের সাথে পিতা আমার বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছেন। তিলোত্তমা কি সেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন? 
"আপনি কি আমার বিবাহের কথা বলছেন?" কৌতূহল দমন করা সম্ভব হল না। 
"ধরুন তাই। এর বেশি কিছু বলব না। উচিত হবে না বলা। আপনার স্বাভাবিক জীবনযাপন তাতে বিঘ্নিত হবে।"
"আমার ভবিষ্যৎ কি সুখের নয়?" তিলোত্তমার কথায় আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম।
"সুখ-দুঃখ নিয়েই তো জীবন। এখন বলুন, আপনি কী আদেশ করবেন? আমার হাতে সময় নাই খুব বেশি।" বললেন তিলোত্তমা।

চারিদিকে জটিল কুয়াশা। চাঁদের আলোও তাতে পথ হারিয়ে ফেলে। এই সব রাতে নদীতীরের মায়াবী দৃশ্য রক্তে এক অন্যতর শিহরণ জাগায়। এই পরিচিত বাস্তব জগৎ, এই যুগ অতিক্রম করে এক অবিশ্বাস্য কোনোকিছুর হাতছানি দেয়। এক অন্যতর জগৎ। ধরাছোঁয়ার বাইরের জগৎ। যে জগৎ থেকেই হয়তো তিলোত্তমা এসেছেন। আমি নদীতীরে বসে কিছু সময় অতিবাহিত করতে চাই। নদীর কালো জলে ভেঙে যাওয়া চাঁদকে দেখতে চাই। কুয়াশায় হিমকণা গায়ে মাখতে চাই। এই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে মুক্ত পরিবেশে কিছু সময় বিচরণ করতে চাই।
তিলোত্তমা আমার মনের কথা জেনে বললেন, "চোখ বন্ধ করুন। আমার হাত ধরুন।"
চোখ বন্ধ রেখেছি। একটি দীর্ঘ গোলাকার পথের মধ্য দিয়ে পিছলে এগিয়ে যাচ্ছি মনে হল। একসময় তিলোত্তমার আদেশে চোখ খুললাম। 
হ্যাঁ, নদীতীরে বসে আছি। তিলোত্তমাও বসেছেন পাশে। 
"কেমন লাগছে, রাজ্যশ্রী?" বললেন তিনি।
"বর্ণনাতীত। অপূর্ব। আজ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিবস। কী বিচিত্র অভিজ্ঞতার অংশীদার হলাম আপনার অনুগ্রহে!"
তিলোত্তমা মুচকি হাসলেন।
 "তাই কী? দিবস শেষ হতে ঢের বাকি।"
তিলোত্তমার কথা শেষ হতেই দূরে ঢাক-ঢোল-কাঁসির শব্দ শোনা গেল। অনেক লোকজন আসছে নদীর উল্টো দিকের শ্মশানে। কোনো প্রজার মৃত্যু ঘটেছে। ক্রমশঃ লোকগুলির অবয়ব বর্ধিত হল। দৃশ্যপট পরিষ্কার হল। মরণদোলায় রক্ষিত দেহ বহন করছে চারজন। তার পশ্চাদবর্তী হয়ে এক রমণীকে নৃশংসভাবে টেনে হিঁচড়ে আনছে কয়েকজন শক্তিশালী পুরুষ। তারও পিছনে বিরামহীন ঢক্কানিনাদ। সতীদাহ হবে। বাল্যকাল থেকে এই নিয়ে আমার ঔৎসুক্য ছিল প্রবল। আজ চাক্ষুষ দেখব। মৃত স্বামীর সাথে সহমরণে অপার পুণ্যপ্রাপ্ত হবে রমণীটি। সতীসাধ্বী বলে পরিচিত হবে।
কিন্তু সতীদাহ তো আনন্দের উৎসব। অন্তত তা-ই জানা ছিল আমার। সদ্যবিধবারা নাকি স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় আরোহণ করেন! কিন্তু আমার সামনে এইমুহূর্তে যা ঘটছে, তা আমার সমস্ত ধারণাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। নারীটির অসহায়ত্ব আর পুরুষগুলির পাশবিকতা পরিস্ফুট হচ্ছে।

আমি অবাক নয়নে তিলোত্তমার পানে চাইলাম। তিলোত্তমা অনুধাবন করলেন আমার মনের কথা।
বললেন, "চলুন দেবী। আপনি সহ্য করতে পারবেন না এই উৎসব। আমিও পারব না। আসলে কোনো স্বাভাবিক মানুষই পারবে না। এই স্থান এখন নরক।"
নরকের ব্রহ্মনাদে কর্ণপটহ বিদীর্ণ হবার উপক্রম। আমি তিলোত্তমার হাত আমার মুষ্টিতে চেপে ধরলাম।
তিলোত্তমা বললেন, "আপনি আজ কিশোরী থেকে রমণী হলেন। নারীত্বে পদার্পণ করলেন।" 


৪ 
গ্রহবর্মার মৃত্যুর পর তেত্রিশটি দিন অতিবাহিত। আমার অন্তরীন দশার-ও। শারীরিক ক্লেশ বলতে কিছুই নাই। মানসিক পীড়াও সহ্যের মধ্যে। এখন শুধুই উৎকণ্ঠা। দাদার অপেক্ষা। শুনছি শিলাদিত্যও আসছে। আসছে আমাদের বিপুলসংখ্যক সেনা। হাতি, ঘোড়া, পদাতিক সেনা। সবমিলিয়ে আয়োজন কম নয়। দেবগুপ্তর কপালে সর্বক্ষণ চিন্তার ভ্রুকুটি। তার লোকবল, অস্ত্রবল সীমিত। শশাঙ্ক সাহায্য করবেন বটে। কিন্তু তিনি যুদ্ধে যোগদান করার পূর্বেই দাদা এবং শিলাদিত্য সম্ভবত রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে ফেলবেন। এই গম্ভীর বাতাবারণের মধ্যেও অবশ্য দেবগুপ্ত আমার প্রতি সমান উৎসুক। দিনে দুইবার আমার সামনে সে উপনীত হয়। কোমল অনুরোধ, দাম্ভিক আস্ফালন, বলপ্রয়োগের প্রচেষ্টা। বিবিধ কৌশল পরখ করে। 

প্রত্যূষে নিদ্রাভঙ্গ হওয়ার পর আমি বুদ্ধের আরাধনা করি। উদীয়মান সূর্য সাক্ষী থাকে। আর সাক্ষী থাকে দেবগুপ্ত। পর্দার অন্তরালে সে অপেক্ষা করে। আরাধনা শেষে মনটা প্রসন্ন হয়ে যায়। হৃদয়ের জলাশয়ে নতুন শতদল মাথা তোলে। কুঁড়ি থেকে ফুল হয়। বড় বড় পাপড়ি মেলতে থাকে। কিন্তু সেই স্বর্গীয় এবং পবিত্র অনুভূতি এক লহমায় অন্তর্হিত হয় দেবগুপ্তর আবির্ভাবে।
"প্রাতঃকালে রানির মুখদর্শনে দেবীদর্শনের পুণ্য অর্জিত হয় অধম সেবকের। আপনার মুখমণ্ডলে অদ্ভুত এক আভা খেলা করে আরাধনার পর। এক তপোক্লিষ্ট শুদ্ধ রমণী যেন। রানি, আপনি প্রসাধন ত্যাগ করেছেন বহুদিন। উচিত কাজ করেছেন। এক আশ্চর্য সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধনের তাপে পুড়ে আপনার রূপ যৌবন ক্রমে-ক্রমে দেবভোগ্যা হয়ে উঠছে। এই অধম দাস কি আপনার অনুগ্রহ পেতে পারে?"
দেবগুপ্ত নিত্যদিনই এজাতীয় কিছু-না-কিছু বলে। রাজকবির লিখে দেওয়া সংলাপ আমার সম্মুখে আওড়ায়। আমি মনে মনে হাসি। 
আমার গম্ভীর মুখ দেখে ব্যর্থ ও ক্রুদ্ধ হয়ে দেবগুপ্ত প্রস্থান করে। 
রাতের নিদ্রার পূর্বে যখন অলিন্দে দাঁড়িয়ে থাকি, গ্রহবর্মার স্মৃতিযাপন করি, দেবগুপ্ত হাজির হয়। মদিরার প্রকোপে কিছুটা বেসামাল থাকে সে। সকালের থেকে আচরণ হয় ভিন্ন। রাতে সে হয়ে যায় দাম্ভিক শাসক। মহারাজার অমিত বিক্রম প্রমাণ করতে তখন সে বদ্ধপরিকর। পায়ে-পায়ে সে অগ্রসর হয় আমাকে ভোগ করার উদ্দেশ্যে। 

আজ কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ অন্য খাতে বাহিত হল। দেবগুপ্ত এল না। আজ সম্ভবত দেবগুপ্ত আসন্ন যুদ্ধের রণকৌশল রচনায় ব্যস্ত। নিশ্চয়ই সে চিন্তিত। দাদার সেনাবহর দেবগুপ্তর কপালে ভাঁজ সৃষ্টি করেছে। এই যুদ্ধের একমাত্র ফলাফল হবে দেবগুপ্তর পরাজয়। আমি মনে মনে প্রসন্ন হলাম। গ্রহবর্মা আমার মনে লেগে রইলেন ফুলের সুগন্ধের মতো। হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে রইল। আমি শয়নের আয়োজন করলাম। আভরণ খুলে রাখার ব্যাপার নেই। ধাতুনির্মিত কিংবা পুষ্প, সব ধরনের আভরণ আমি ত্যাগ করেছি। কোনো প্রকার প্রসাধনও আমি ব্যবহার করি না আজকাল। একাধিক সেবিকা সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকে আমাকে রূপচর্চিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু আমার এইসবে আর রুচি হয় না। গ্রহবর্মার বিচ্ছেদ বা আমার বৈধব্যযাপন অবশ্যই একটি কারণ। কিন্তু তার চেয়েও গূঢ় এবং গভীর একটি কারণ রয়েছে। তিলোত্তমা। তাঁর প্রসাধনহীন রূপ।
আমি তাঁকে একবার এই নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি হেসে জানিয়েছিলেন, তাঁর যুগে প্রসাধনের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমছে। নারীর যশ খ্যাতি বা যোগ্যতা আর সৌন্দর্যনির্ভর নয়। বুদ্ধিমত্তা বরং নারীর নতুন অভিমান। সেই বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অর্জিত জ্ঞানই নারীর অহংকার। আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম তিলোত্তমার কথায়। সত্যিই তো, প্রসাধনের প্রয়োজনীয়তা কী! আসল চেহারা লুকোনোর দরকার কী! আর কী অদ্ভুত! আমার এই অনাড়ম্বরতা দেবগুপ্তকে আকর্ষণ করছে। পতঙ্গের মতোই সে আলোর উৎসের চারিদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে।

শেষ রাতে নিদ্রাভঙ্গ হল। এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটছে। আমি ঘৃণা, ক্রোধ এবং ভীতিতে বাকহারা হয়ে গেলাম। সমস্ত শক্তিটুকু জড়ো করে চিৎকার করতে চাইলাম। অস্ফুট এক গোঙানি ছাড়া কিছুই নির্গত হল না। দেবগুপ্ত আমার মুখ চেপে ধরেছে।
এই প্রথমবার। এই প্রথমবার সে আমার অনুমতির অপেক্ষা করেনি। 
আমি কীভাবে এই নরপিশাচকে প্রতিরোধ করব। কে রক্ষা করবে আমাকে? সেবিকা, দ্বাররক্ষী সকলেই তার অনুগত… একমাত্র সহায় তিলোত্তমা! কিন্তু তিনি কি আমার ডাক শুনতে পাবেন? 
আমি আর দ্বিতীয় চিন্তা না করেই দেবগুপ্তর হাত দংশন করলাম। দেবগুপ্তর হাত কম্পিত হল। আমি সেই সুযোগে তিলোত্তমার নাম চিৎকার করে উঠলাম।
"কে? কার নাম ধরলে?" দেবগুপ্ত বিস্মিত হল।
আমি চুপ করে রইলাম। দেবগুপ্ত যেন কোনো ঘোরের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল। সভয়ে দু'পা পিছিয়ে গেল।
"আমার মনে তোমার জন্য রয়েছে শুধুই ঘৃণা। তুমি কখনওই আমাকে ভোগ করতে পারবে না দেবগুপ্ত। এই মুহূর্তে আমি আত্মহত্যা করব।"
দৌড়ে যেতে চাইলাম অলিন্দের দিকে। দেবগুপ্ত আমাকে আবদ্ধ করল তার বাহুপাশে
"ছাড়ো নরাধম। তুমি কোন সাহসে আমায় স্পর্শ কর?"
আমার কথায় দেবগুপ্ত মুক্ত করল আমাকে।
আমার শরীর কাঁপছে উত্তেজনায়, ঘৃণায়। হৃদয়ের গতিবৃদ্ধি হয়েছে। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস নির্গত হচ্ছে।
এবার দেবগুপ্ত কী করবে? আলো-আঁধারিতে তার মুখের ভাব পড়া যাচ্ছে না। 
"ক্ষমা করবেন রানি। রমণীর হৃদয় লাভ করার কৌশল আমার জানা নেই। আমি স্বীকার করছি। আমার মাসাধিককালের যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আপনাকে বশ করতে পারিনি কোনোকিছুতেই। কিন্তু, বিশ্বাস করুন রানি, আপনি আমার হৃদয় হরণ করে নিয়েছেন। আমি অস্থির হয়ে উঠেছি।" দেবগুপ্ত বলল।
আমার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হল না। দেবগুপ্ত লক্ষ করল। তারপর আবার বলল, "ক্ষমা করবেন। তবে এই শেষবারের মতো, আমার সমস্ত দাম্ভিকতা, ঔদ্ধত্য, সমস্তকিছু বিসর্জন দিয়ে আপনাকে আমি কামনা করছি। আপনি সাড়া দিন রানি। মাত্র একবার। আমি আপনার সাথে মিলিত হতে চাই… আজই  মর্ত্যে আমার শেষ রাত। রাজ্যবর্ধন যে বিপুল সেনাসম্ভার নিয়ে আক্রমণ করবেন, আমি খড়কুটোর মতোই উড়ে যাব। খবর এসেছে, আজই সায়াহ্নে তিনি রাজ্যের সীমান্তে শিবির ফেলেছেন। শশাঙ্ক এখনও বহুদূরে… এই যুদ্ধে আমায় পরাভব অনিবার্য… দেবি, আপনি আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করুন। মৃত্যুর আগে অন্তত একবারের জন্য এই দেবভোগ্যা…" 
"শয়তান। আর একটা কথাও নয়। এই মুহূর্তে  কক্ষ ত্যাগ করো। আমি তোমার উপস্থিতি আর সহ্য করতে পারছি না।" কর্কশ কন্ঠে বললাম।
দেবগুপ্ত ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। যুদ্ধের আগেই পরাজিত এক কাপুরুষ নরপতির সঙ্গে সেই আমার অন্তিম সাক্ষাৎ।


৫ 
আজ আমি নির্ভার। মন শান্ত। গতরাতের ঘটনা অপ্রত্যাশিত ছিল। তার চেয়েও অদ্ভুত ছিল দেবগুপ্তর শারীরিক ভাষা। নিয়তিকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। দেবগুপ্তও করেনি। আমার প্রতি তার দুর্নিবার কামনা প্রবলভাবে প্রতিরুদ্ধ হয়েছে। এ নিশ্চয়ই তার ভাবনার বাইরে ছিল। একটা বিষয়ে অবশ্য আমার কৌতূহল। দেবগুপ্ত চাইলেই আমাকে ধর্ষণ করতে পারত। কিন্তু শেষ অবধি সে আমার ঘৃণার কাছে পরাভব স্বীকার করেছে। দম্ভ ভুলে নতশির হয়েছে। সহমত প্রার্থনা করেছে। প্রাথমিকভাবে বলপ্রয়োগ করলেও নিজেকে সংযত করেছে। হে বুদ্ধ, এর নেপথ্যে যুক্তি কী! ধর্ষণ বা সমজাতীয় কোনো কার্যকলাপের ফলাফল হৃদয়বিদারক হবে? আমি আত্মাহুতি দেব? দেবগুপ্তর সত্যি কি হৃদয় আছে! আমার প্রাণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয় সে? সত্যিই কি তাই! তিলোত্তমা হয়তো বলতে পারবেন। আজ তিলোত্তমা এলেই আমি তাঁকে প্রশ্ন করব। দেবগুপ্তর চরিত্র মূল্যায়নে আমার কোনো ত্রুটি থেকে গেছে কি? 
পুবের আকাশে লাল রঙ লাগার আগেই যুদ্ধযাত্রা করেছে দেবগুপ্ত। আমার সম্মুখে আর আসেনি। রাতের ঘটনায় সে কি গ্লানিতে সম্পৃক্ত! নারীর হৃদয় জয় করতে না পারার গ্লানি। বিজয়ী নরপতি হয়েও বিজিত নরপতির যুবতী বিধবাকে অঙ্কশায়িনী করতে না পারায় গ্লানি। বারবার প্রত্যাখ্যাত ও অপমানিত হওয়ার গ্লানি। নাকি এ শুধুই অনুতাপ! নিজের আচরণে লজ্জিত হওয়া! 
এখন আহারের সময়। দীর্ঘকাল পরে আজ তৃপ্তির সাথে আহার করছি। দাদার বিজয় নিশ্চিত। আজই, সম্ভবত আজই তিনি উদ্ধার করবেন আমাকে। কতদিন পরে তাঁর দেখা পাব। শিলাদিত্যও আছে সাথে। 
আহারের পরে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম। রজনী আজ বিনিদ্র কাটবে নিশ্চয়ই। আজ তো বিজয়ের রাত। কতদিন আপনজনদের সাথে কথা হয় না। আজ হবে। উত্তেজনায় প্রসন্নতায় কি আর ঘুম আসবে?

"রাজ্যশ্রী… উঠুন, কথা আছে।" 
নিদ্রার জাল ছিন্ন হল। স্বপ্নাবিষ্ট এক ঘোর জড়িয়ে রইল চোখের পাতায়। এখন কি রাত? যুদ্ধ কি সমাপ্ত? সেই বার্তায় কি বহন করে এনেছে কেউ? আমার নিদ্রাভঙ্গ করেছে? বহু প্রতীক্ষিত সেই সাফল্য এবং দেবগুপ্তর পরাজয়ের খবর দেওয়ার জন্যই কি দূতীর এত উৎসুকতা! 
আমি শয্যায় উঠে বসলাম তাড়াহুড়ো করে। 
তিলোত্তমা এসেছেন। 
আহ! অপার শান্তিতে ভরে গেল বুকটা। তিলোত্তমার হাত ধরে টেনে তাঁকে পাশে বসালাম। এই বহুদূরের বহুযুগের ওপার থেকে আসা নারীকে আজ পরমাত্মীয় মনে হচ্ছে। আপন সহোদরা। তিনিই আমাকে খাদের অতল থেকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়েছেন। গ্রহবর্মার মৃত্যুর পর টানা তিনদিন আমি মুখে কিছু তুলিনি। জলগ্রহণ পর্যন্ত করিনি। সেই অবস্থায় বেঁচে থাকার ইচ্ছা অন্তর্হিত হয়েছিল। জীবন সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বুদ্ধকে স্মরণ করছিলাম। কিন্তু তাঁর সেই দিব্যকান্তি রূপও যেন আমাকে সঠিক দিশা দর্শাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। বারবার আত্মহত্যার প্রয়াস করেছি। 
আজ এই বিশেষ দিনটিতে তিলোত্তমার আগমন অত্যন্ত প্রত্যাশিত ছিল। সুখ-দুঃখ সবেতেই তিনি সাথে থাকেন। তিনি নিশ্চয়ই যুদ্ধের সংবাদ এনেছেন। সুসংবাদটি আমি তার মুখেই শুনতে চাই।
আমি অত্যন্ত প্রসন্নতার সাথে বললাম, "বলুন, কী সংবাদ এনেছেন! নিশ্চয়ই যুদ্ধের খবর!"
তিলোত্তমা ম্লান হেসে বললেন, "কিছুটা অবশ্য তাই-ই। কিন্তু...."
কী ব্যাপার! তিলোত্তমা হাসিটা যেন কষ্টার্জিত। সাবলীল নয়। খারাপ কিছু ঘটেছে নাকি? আমার মধ্য থেকে খুশির ভাবটা এক ঝটকায় উধাও হল। এক অজানিত আশঙ্কা কটূ ধোঁয়ার মতো ধীরে ধীরে গ্রাস করছে আমাকে। 
অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বললাম, "যুদ্ধের ফলাফল কি আমাদের বিপক্ষে গেছে?"
" না না। একেবারেই নয়। দেবগুপ্ত মারা গেছেন। রাজ্যবর্ধনের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি বেশিক্ষণ!"
এর চেয়ে ভালো খবর আর কী-ই বা হতে পারে! সমস্ত অপেক্ষার অবসান হয়েছে। আমি এবারে মুক্ত। আর কোনো দেবগুপ্ত আমাকে বন্দি করে রাখবে না। ধর্ষণ করার প্রয়াস করবে না। এর চেয়ে খুশি আর কীসে হবে!
"কিন্তু শশাঙ্ক এসে উপস্থিত হয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে।" বললেন তিলোত্তমা।
"আবার একটি যুদ্ধ!"
"যুদ্ধ হবে না। যুদ্ধ হলে রাজ্যবর্ধন জিতবেন। শশাঙ্ক যুদ্ধ করতে চাইছেন না।"
"এ তো অতি চমৎকার কথা। আর তবে কীসের দুশ্চিন্তা! আপনি কী নিয়ে উৎকন্ঠিত, তিলোত্তমা!"
তিলোত্তমা উত্তর দিলেন না। উঠে দাঁড়ালেন শয্যা থেকে। কক্ষ থেকে বেরিয়ে অলিন্দে দাঁড়ালেন। গোধূলির সময়। দিন-রাতের সন্ধিক্ষণ। দিনের চেহারায় রাতের প্রসাধন লাগতে শুরু করেছে। 
"অতীত পরিবর্তন করা যায় না,দেবি।" তিলোত্তমা ধ্রুবতারার পানে চেয়ে বললেন।
তিলোত্তমা কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছেন! কিছু একটা ঘটছে। আমি জানতে পারছি না। তিলোত্তমা সবই জানেন। পরবর্তী ঘটনাক্রম নিশ্চয়ই তাঁর জানা। তিনি ভবিষ্যতের মানুষ। 
"আপনি বলুন। আপনি গোপন করবেন না দয়া করে।" আমি কাতরভাবে বললাম।
"আপনি সহ্য করতে পারবেন না। অনেক ক্লেশ সয়েছেন। অনেক লাঞ্ছিত হয়েছেন। প্রতীক্ষা করেছেন। বন্দি থেকেছেন। আপনি…"
" অমঙ্গলজনক কিছু ঘটবে কি? আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন তিলোত্তমা। আপনি বললে এখন জানব। নচেৎ দুই দণ্ড কিংবা দুই প্রহর বা দুই দিন পরে জানব। আপনি বলুন। আমি শুনতে প্রস্তুত।"
তিলোত্তমা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আমার হাতটা মুঠোয় নিলেন। বললেন, "আপনার জন্য আমি ঝুঁকি নেব একবার। চলুন, শশাঙ্কের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার চেষ্টা করি। শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে নৈশাহারের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর শিবিরে। রাজ্যবর্ধন স্বীকার করেছেন আমন্ত্রণ। কিন্তু শশাঙ্কের উদ্দেশ্য অত্যন্ত অসৎ। আজ রাতেই নিরস্ত্র অবস্থায় রাজ্যবর্ধনকে…"
আমি শিহরিত হলাম। দাদা তবে নিরাপদ নন। প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা রয়েছে। কেউই জানে না শশাঙ্কের অভিসন্ধি। সত্যিই কি তা-ই ঘটবে? অর্থাৎ তিলোত্তমার জ্ঞাত অতীতে তা ঘটেছিল?
তিলোত্তমা তাঁর পোশাকের সেই বিশেষ পুঁতিটি স্পর্শ করলেন। প্রথমবারের মতোই এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে পিছলে এগিয়ে চললাম। হঠাৎ কীসের সঙ্গে যেন সংঘর্ষ হল। অত্যন্ত তীব্র এক বেদনা ছড়িয়ে পড়ল মাথার মধ্যে। আমি সংজ্ঞা হারালাম। 

"রাজ্যশ্রী, কেমন আছিস বোন!"
"এবার খুব ভালো থাকব দাদা। তুমি এসেছ। আমার সমস্ত দুঃখ কষ্ট বেদনার উপশম হল।"
"আহা রে, এইটুকু বয়সে কতই না সয়েছিস!"
"তা ঠিক। কিন্তু আমি আর কতটুকু সহ্য করেছি! সহ্য করেছেন গ্রহবর্মা। তুমি। শিলাদিত্য। আমার সাথে বিবাহসূত্রেই প্রাণ গেল আমার স্বামীর। তোমাকে যুদ্ধ লড়তে হল। "
"আমরা ক্ষত্রিয় যুদ্ধ করাই আমাদের কাজ। আর সে যুদ্ধে পরাজয় আছে। মৃত্যু আছে। মানবজীবন সম্পর্কে গূঢ় উপলব্ধি এখানেই ঘটে। এই আছি, এই নেই। জিতলে সাম্রাজ্য, হারলে অপমান। কিংবা মৃত্যু। জীবন অনিত্য, অনিশ্চিত। কেউ বেঁধে রাখতে পারে না তাকে। সে একদিন উড়বেই। খাঁচায় বেশিদিন আটকে রাখা যায় না তাকে। মুক্ত বিহঙ্গ সে। আমাদের বুকের খাঁচায় আটকে পড়ে সে ছটফট করে। উত্তেজনা বাড়ায়। তাই তো মানুষ কখনও সুস্থির থাকতে পারে না। যুদ্ধ, লড়াইয়ের উন্মাদনা তার প্রাণের এহেন চরিত্রের জন্যই। এ খুব স্বাভাবিক। তুই আর অযথা নিজেকে দোষারোপ করিস না।"
"শিলাদিত্য কোথায় দাদা?"
"তার কাঁধে এখন দুটো রাজ্যের দায়িত্ব। আমাদের জন্মভূমি। আর এই গ্রহবর্মা অর্থাৎ তোর রাজ্য।"
"সে কী? তুমি তো জ্যেষ্ঠ। তুমি কেন অধিকার ত্যাগ করলে?"
"আমার আর রুচি নাই রাজ্যশাসনে। আমি আর তুই এই সমস্ত কিছু থেকে অনেক দূরে পরম শান্তিতে বসবাস করব। বনচারীর জীবন পালন করব। বুদ্ধের আরাধনা করব। তুই আমার সঙ্গে যাবি তো!"
"এ তো আমার স্বপ্নের অতীত। আমার হাত ধরো… এ কী! তোমার হাত কোথায় দাদা… তোমার হাত দুটো ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে কেন, এবার মাথা… পুরো শরীর… দাদা, আমাকে একা ফেলে যেয়ো না…"
বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। নাকি চেতনালুপ্ত ছিলাম! কোথায় আমি। ভোরের আলো ফুটছে। আমার শরীরের নিচে তৃণভূমি। ঝিঁঝিঁ এবং বন্যজন্তুর শব্দে মুখর এই স্থান। 
আঃ! মাথায় তীব্র বেদনা। চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে। কীসের সাথে যেন সংঘর্ষ হয়েছিল! তিলোত্তমার সাথে সুড়ঙ্গের মধ্যে… তিলোত্তমা কোথায়! আমরা যাচ্ছিলাম দাদার কাছে। শশাঙ্কের ধূর্ততা বিষয়ে তাঁকে সাবধান করতে। তাহলে, এই স্থান কি শশাঙ্কের শিবিরের নিকটবর্তী!
কিন্তু এ যে নিবিড় বনভূমি। প্রাচীন ও দীর্ঘ গাছগুলি পেরিয়ে দৃষ্টি যে বেশিদূর যায় না। কোনদিকে এগোব! তিলোত্তমার সাড়া নাই কেন! 
ওই তো তিলোত্তমা। তিনিও সম্ভবত সংজ্ঞাহীন। তাঁকে জাগাতে হবে। উঠুন তিলোত্তমা। আমরা এই বনভূমিতে কী করছি! তিলোত্তমা। তিলোত্তমা।
দেহ ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছি। সাড়া নেই। তিলোত্তমা পাথরের মতোই অচল অনড়। শ্বাসের গতি নেই। বুকের ওঠা-পড়া নেই। জল। জল প্রয়োজন। ওই তো নদী…
তিলোত্তমা। সাড়া দিন দেবী। এ কী বিপদ ঘটল আমাদের...


শেষকথা

সূর্য এখন মধ্যগগনে। নদীর ধারে বসে আছি। তিলোত্তমা একইরকম। জড়। স্থাণু। অচঞ্চল। সম্ভবত প্রাণহীন। তিনি আমার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। আমার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। হয়নি। 
একটি রাত অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। দাদাও নিশ্চয়ই এতক্ষণ আর জীবিত নন। দাদা, গ্রহবর্মা, তিলোত্তমা। আমার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। কিছুটা আমার কারণে দেবগুপ্ত-ও। 
আমি বেঁচে আছি। এতগুলো মহান জীবনের বিনিময়ে আমি বেঁচে আছি। আমার অশ্রুগ্রন্থি শুষ্ক হয়ে গেছে। হে বুদ্ধ, আমাকে এখন অশ্রু দাও। অশ্রুই এখন আমার একমাত্র উপশম। বুকের উপর পাথর চেপে বসে আছে। সেই পাথর অশ্রু হয়ে গলে যাক।
দূরে কোথাও আগুন লেগেছে বনে। এদিকেই তার গতিপ্রবাহ। আমার কি আর বেঁচে থাকার কোনো অর্থ আছে? সম্ভবত নাই! এই আগুনেই আমি আত্মাহুতি দেব। সেই সতীদাহের মতো। তবে এখানে বলপ্রয়োগ করার মতো কেউ নাই। আমি স্বেচ্ছায় অগ্নিদগ্ধ হব। হে দাবানল গ্রাস করো আমাকে। এক অসহায় ব্যর্থ সর্বনাশা জীবনের এখানেই ইতি হোক।

তিলোত্তমাকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরি। তিনি প্রতিবার আমাকে পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু এখানেই সব পথের পরিসমাপ্তি। অন্তিম বিন্দু। তিলোত্তমা আমার ভবিষ্যৎ জানতেন। প্রথম রাতে সতীদাহ দেখিয়েছিলেন। তাঁর কি কোনো উদ্দেশ্য ছিল? নারকীয় প্রথাটির প্রতি আমার ঘৃণা জন্মেছিল সেই প্রথম। আর আজ আমি অনুরূপ এক মৃত্যু নির্বাচন করতে চলেছি নিজের জন্য। তাহলে প্রথম রাতের সেই অভিজ্ঞতা কি আমার মানসিক প্রস্তুতি জোগাবার জন্য! নাকি এই আত্মাহুতির কদর্যতা সম্বন্ধে সচেতন করবার জন্য! 
তিলোত্তমা আমায় রক্ষা করতে চেয়েছেন সর্বদা। আমার কষ্টলাঘব করতে গিয়ে বিসর্জন দিয়েছেন। আমার নারীজীবন তাঁরই দান। আমার নারীমনের রূপকার তিনিই। তাঁর দেওয়া এই অস্তিত্ব কি এই দণ্ডে আগুনে বিলীন হবে?
না, কখনওই না। আমি বাঁচব। আমাকে এই স্থান থেকে পালানোর পথ খুঁজতে হবে। এক্ষুণি। 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments