জ্বলদর্চি

এশিয়া (কম্বোডিয়া)-র লোকগল্প / চিন্ময় দাশ


দূরদেশের লোকগল্প—এশিয়া (কম্বোডিয়া)

তাল পড়ল দু-উ-উ-উ-ম 

চিন্ময় দাশ

বন-জঙ্গল শেষ হয়ে একটা টিলা মত জায়গা। সেখানে একটা তালগাছের নীচে গা এলিয়ে, বিশ্রাম করছিল খরগোশ। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, খেয়াল নাই।
কতক্ষণ বাদে, ঘুম যখন বেশ গভীর, হঠাতই ভয়াণক একটা আওয়াজ। সে কী আওয়াজ! আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে, যেন মাটি ভেদ করে উঠে এল আওয়াজটা। আর, তার সাথে একটা কম্পন। পৃথিবী বিদীর্ণ হয়ে যাবে যেন, এমনই কম্পনটা!
খরগোশের তো প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। শব্দটা কানে যাওয়া মাত্র, কোথায় গেল ঘুম! কোথায় গেল বিশ্রাম! তিড়িং করে এক লাফ। হাত দুয়েক উঠে গেল, মাটি থেকে ছিটকে। তার পর? তার পর আর কী? দৌড় দৌড় আর দৌড়।
কীসের আওয়াজ, কীসের কম্পন – সেসব পরে খোঁজ নিলেও, চলবে। প্রথমে প্রাণটা বাঁচানো দরকার। তাই দৌড়।
গোটা চারেক ষাঁড় মাঠে চরছিল। খরগোশকে অমন পড়ি-মরি করে দৌড়তে দেখে, তারা জিজ্ঞেস করল—হোলটা কী হে? অমন দৌড়োও কেন?
দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করা বিবেচনার কাজ নয় এখন। তবুও, বিপদ বলে কথা। এ সময় কেবল নিজের কথা ভাবতে নাই। সবাইকে সাবধান করে দিতে হয়।
ছুটতে ছুটতেই খরগোশ বলল—ভয়াণক বিপদ। ভূমিকম্প হচ্ছে। বাঁচতে চাও, তো পালাও এক্ষুণি। 
কথা শেষ হওয়ার আগেই, খরগোশ হাওয়া। 
প্রাণের ভয় কার নাই? খাওয়া-দাওয়া রইল পড়ে। ষাঁড়েরাও লেজ উঁচিয়ে দৌড় লাগালো। 
টিলার ঢালু এলাকায় খুঁড়ে খুঁড়ে আলু খাচ্ছিল একদল বুনো শূকর। চার-চারটে ষাঁড়কে অমন লেজ উঁচিয়ে দৌড়তে দেখে, একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল শূকরগুলো। জানতে চাইল—কী হয়েছে গো, দৌড়চ্ছো কেন? 
--পালাও, বন্ধুরা। ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। দাঁড়াবার মত ফুরসত নাই তাদের। দৌড়তে দৌড়তেই সাবধান করে দিয়ে গেল ষাঁড়ের দল। 
শূকরেরা বনের ভিতরের দিকেই থাকে। বেঁচে থাকলে, আলু পরে এসেও, খাওয়া যাবে। ঘরমুখো হয়ে দৌড়তে লাগল তারা।
যাওয়ার পথে এক দল হরিণের সাথে দেখা তাদের। দূর থেকেই তাদের দৌড়ে আসতে দেখে, ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে দেখছিল হরিণগুলো। হোলটা কী? অমন করে দৌড়য় কেন এরা?
কাছাকাছি হতেই, হরিণেরা জিজ্ঞেস করল—ব্যাপার কী, বলো তো? সবাই মিলে এমন হাঁফাতে হাঁফাতে চললে কোথায়? 
--চলেছি না গো, পালাচ্ছি। তোমরাও পালাও। ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প তেড়ে আসছে পিছনে। প্রাণের মায়া থাকলে, সরে পড়ো এক্ষুণি। 
আর দেরী করা যায়? শূকরদের সব কথা ভালো করে শোনার আগেই, দৌড় লাগিয়ে দিয়েছে হরিণের দল। গভীর বনের ভিতর ঢুকে পড়ছে তারা। 
যাবার পথে এক দল হাতির সাথে দেখা। হরিণের পুরো দলটাকে অমন দৌড়তে দেখে, হাতিরা ভাবল, বাঘ কিংবা সিংহ তাড়া করে আসছে বুঝি! সাবধান হয়ে যাওয়া ভালো? কোন বিশ্বাস নাই ধুরন্ধরগুলোকে। 
তবু জেনে নেওয়া ভালো, হয়েছেটা কী? একটা দাঁতাল হাতি এগিয়ে এসে বলল—বাঘ, না সিংহ? কে তাড়া করে আসছে পেছনে? 
হরিণেরা দৌড়তে দৌড়তেই বলে গেল—বাঘও নয়, সিংহও নয়। অনেক বড় শত্রুর খপ্পরে পড়তে চলেছে সবাই। ভূমিকম্প তেড়ে আসছে পিছনে। পালাও সক্কলে। 
শুনে তো চোখ কপালে উঠে গেল হাতিদের। ওরেব্বাস, ভূমিকম্প! সর্বনাশের মাথায় পা একেবারে। 
প্রথমে বিশাল এক গর্জন। বন পাহাড় জঙ্গল, আকাশ বাতাস সব কেঁপে উঠল সে শব্দে। তার পর শুরু হল হাতিদের দৌড়। ঝোপঝাড় গাছপালা ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যেতে লাগল। মনে হতে লাগল, সত্যিসত্যিই যেন ভূমিকম্পই শুরু হয়ে গিয়েছে গোটা বন-পাহাড়টা জুড়ে। 
সিংহ হোল বনের রাজা। নিজের গুহার সামনে, হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আয়েস করছিল। হাতির গর্জন কানে গিয়েছে তার। রাজামশাইর মেজাজ গেল বিগড়ে। একটু শান্তিতে বিশ্রাম নেবে, তারও জো নাই। 
রাজার গুহার সামনে দিয়েই পালাচ্ছিল হাতির দল। সিংহ তাদের দাঁড় করিয়ে বলল—তোমরা ভালো করেই জানো, বেয়াদপি আমি সহ্য করি না। দূপুর বেলা খামোখা অমন চেঁচাচ্ছিলে কেন? তার উপর, দল বেঁধে অমন চলেছ কোথায় হাঁফাতে হাঁফাতে? কোন রাজ্য জয় করতে চলেছ, সেটা বলো তো, শুনি। 
হাতিরা দাঁড়িয়ে পড়েছে রাজার ধমক খেয়ে। দাঁতাল হাতিটা বলল—রাজ্য জয় কী বলছ তুমি? প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছি। ভূমিকম্প তেড়ে আসছে যে পেছনে?
--ভূমিকম্প? সেটা আবার কখন শুরু হোল?
হাতিরা বলল—সে তো আমরা জানি না। হরিণরা সাবধান করে দিয়ে গেল পালাতে পালাতে। তাই আমরাও পালাচ্ছি।
সিংহ এবার হরিণদের জিজ্ঞেস করল—ভূমিকম্পটা কোথায় দেখলি তোরা?
হরিণরা জবাব দিল—আমরা তার কী জানি? শূকররা সাবধান করে দিয়ে গেল যে! তাই তো পালাচ্ছিলাম। 
সিংহের ধমকে প্রাণ যায় যায় অবস্থা শূকরদের। তোতলাতে তোতলাতে বলল—ষাঁড় বলল, ভূমিকম্প আসছে। সেটাই আমরা বলেছি হরিণদের। 
ষাঁড়রা বলল—আমরা কী করে জানব, ভূমিকম্প কোত্থেকে এলো। আমরা তো ঘাস চিবোচ্ছিলাম মাঠে। হতভাগা খরগোশই তো দৌড়তে দৌড়তে বলে গেল—পালাও, পালাও। ভূমিকম্প আসছে। তার কথাতে দৌড়ে দৌড়ে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে আমাদের। 
সিংহের তো করুণ অবস্থা। হাসবে, না রাগ করবে—মাথায় ঢুকছে না কিছুই। 
একটা পুঁচকে খরগোশ, বনশুদ্ধ এতগুলো জীবকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। একেবারে হুলুস্থুল কাণ্ড বেধে গেছে সারা বন পাহাড় জুড়ে।
--হতভাগা খরগোশটা কোথায়। সিংহের গর্জনে, সে বেচারার হাত-পা সেঁধিয়ে গিয়েছে পেটে। ঠকঠক করে কাঁপতে লেগেছে বেচারা। সে ভালোমতোই জানে, সিংহের লেজের একটা ঝাপটা খেলেই, প্রাণ বেরিয়ে যাবে তার। 
কোন রকমে চিঁ-চিঁ করতে করতে সে জানাল—আসলে হয়েছে কী, একটা তালগাছের নীচে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাতই বিকট একটা আওয়াজ। তারপর মাটি কেঁপে উঠল থরথর করে। ভূমিকম্প ছাড়া আর কী হতে পারে? তাই পালাছিলাম প্রাণ নিয়ে। 
--পালাচ্ছিলি, বেশ করছিলি। বনশুদ্ধ সবাইকে অমন নাচাতে গেলি কেন তুই। 
খরগোশ এবার বেশ একটু গুমোর দেখিয়ে বলল—বিপদের সময় পড়শিদের সাবধান করে দিতে হবে না? নিজের প্রাণটুকুর কথা ভাবলেই কি আর চলে? 
সিংহ গম্ভীর গলায় বলল—বেশি পাকামি করবি না। চল তো দেখি, কোথায় ভূমিকম্প তাড়া করেছিল তোকে।
খরগোশ চলেছে সামনে। তার ঠিক পিছনটিতে সিংহ। রাজার পিছনে পুরো বাহিনীটা। 
তালগাছের তলায় এসে, সে এক দৃশ্য! মোটামুটি ফাঁকা প্রান্তর। এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা তালগাছ। গাছের তলায় বসে আছে একটা শেয়াল। পা ছড়িয়ে বসে, আপন মনে পাকা তাল খাচ্ছে সে। 
--আরে, পণ্ডিত যে! হচ্ছেটা কী এখানে। 
চমকে উঠে, চোখ তুলে সামনে পুরো বাহিনী দেখে, শেয়ালের তো পিলে চমকে গেল। সামনে সাক্ষাত যম সিংহ। তাল খাওয়া মাথায় উঠে গেল তার।
কিন্তু ভয় পাওয়াটা দেখালে চলবে না। সে বিনয়ে গদগদ হয়ে বলল—পেন্নাম হই, রাজামশাই। তা, দলবল নিয়ে এদিকে কোথায় চললেন? 
সিংহ বলল—রাখো তোমার পেন্নাম। এখানটাতে তুমি কতক্ষণ আছো, বলো তো?
শেয়াল বলল—এই গাছটার তাল ভারি মিস্টি। আমি তক্কে তক্কে ছিলাম। আজ যেই তাল পড়ার শব্দ কানে গেল, অমনি হাজির হয়ে গেছি। 
--সেসময় এই হতভাগা খরগোশটাকে চোখে পড়েছিল তোমার? 
-- কী করে পড়বে। তালটা পড়ল মাটিতে। ও ব্যাটা ছিটকে আকাশে উঠে গেল একেবারে। তার পর যা লম্বা দৌড় লাগালো, চোখে পড়া দায়! শেয়াল বলল—কেন, কী হয়েছে?
জবাব দেবে কী, হাসিতে পেট ফেটে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে সিংহের। একটা পাকা তাল পড়েছে মাটিতে, তা থেকেই এক্কেবারে ভূমিকম্প-এর উদয়! সারা বন তোলপাড়!
সিংহ গর্জন করে বলে উঠল—পুঁচকেটাকে সামনে ধরে আন তো আমার। ভূমিকম্প কাকে বলে, দেখিয়ে দিই হতভাগাকে। 
কিন্তু ধরে আনতে বললেই কি আর ধরে আনা যায়? না, ধরে আনা সোজা কাজ? সবাই যখন শেয়ালের বিবরণ শুনছিল, কখন যে সুড়ুত করে সরে পড়েছে খরগোশ, কেউ নজরই করেনি।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments