জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা -২৯/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ২৯

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 স্বামী শিবানন্দ

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দশম সঙ্ঘগুরু শ্রীমৎ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ এবং সঙ্ঘের দ্বিতীয় সঙ্ঘগুরু স্বামী শিবানন্দজী বিষয়ে বলছেন -- “ভগবান শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের বিশিষ্ট পার্ষদ শ্রীমহাপুরুষ শিবানন্দজী মহারাজ ভারতের অধ্যাত্মগগনে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কগণের অন্যতম।  অবতার-সহচরদের জীবনের আলোচনায় বা স্মৃতির অনুধ্যানে শ্রীভগবানেরই লীলা আস্বাদন হয়। কারণ তাঁহাদের জীবনারাধ্য শ্রীভগবান ব্যতীত অন্য কোন পৃথক সত্তা তাঁহাদের জীবনে পাওয়া যায় না।  পূজ্যপাদ মহাপুরুষ মহারাজেরও জীবনসর্বস্ব ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁহার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবেরই দিব্যমহিমা প্রকাশ পাইয়াছে।” শিবানন্দজী ভক্ত-অনুরাগীদের কাছে ‘মহাপুরুষ মহারাজ’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। এর কারণটি স্বামী গম্ভীরানন্দজী প্রণীত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তমালিকা’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে। সেটি এইরকম -- “...অশেষ সদগুণাবলীর জন্য তিনি স্বতঃই সকলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। মঠের ভ্রাতৃগণ তাঁহাকে ‘তারকদা’ বলিয়া ডাকিতেন এবং নরেন্দ্রনাথও ‘আপনি’ ভিন্ন অন্যভাবে সম্বোধন করিতেন না। তাঁহার অপর লোকপ্রিয় নাম ছিল ‘মহাপুরুষ’; বরাহনগরের-জীবনে একবার তাঁহারা নিমন্ত্রিত হইয়া বলরাম-ভবনে যান। সেখানে ঠাকুরের প্রসঙ্গে মগ্ন নরেন্দ্রনাথ বলিলেন, এক ঠাকুরই ছিলেন কামজিৎ; নইলে বিবাহিত-জীবনে কামজিৎ পুরুষ জগতে বিরল। শুনিয়া শিবানন্দ মহারাজ বলেন, তা কেন? ঠাকুর আমার ভিতর এমন শক্তি সঞ্চার করেছিলেন যে, তার বলে আমিও কামজয় করতে পেরেছি। তাঁর কৃপায় সবই সম্ভব। সবিস্ময়ে নরেন্দ্রনাথ বলিয়া উঠিলেন, তাহলে তো আপনি মহাপুরুষ। তদবধি লোকসমাজে তিনি ‘মহাপুরুষ’ নামেই পরিচিত হইলেন।”
 ভূকৈলাশের রাজবংশের সঙ্গে সম্পর্কিত ঘোষাল উপাধীধারী ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শিবানন্দজী।  তাঁর পিতৃদেব শ্রীযুক্ত রামকানাই ঘোষাল মোক্তারি পাশ করে বারাসাতে মোক্তারি শুরু করেন। এই আইন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি অর্জনান্তে রানী রাসমণির মোক্তার নিযুক্ত হন। কলকাতা থেকে যশোরগামী বড় রাস্তার উপরে রানীর একটি ছোট কাছাড়ি বাড়িতে ঘোষাল মহাশয় সপরিবারে বাস করতেন। এই বাড়িতেই ১২৬১ সালের ২রা অগ্রহায়ণ (ইং ১৬ নভেম্বর, ১৮৫৪ সাল) চান্দ্র কার্তিক, কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে শিবানন্দজী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বাশ্রমের নাম ছিল তারকনাথ ঘোষাল। মাতা ছিলেন বামাসুন্দরী। একরাত্রে বামাসুন্দরী স্বপ্নে দেখলেন, বাবা৺তারকেশ্বর তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে জানাচ্ছেন, তাঁদের (রামকানাই ও বামাসুন্দরী) ভক্তিতে তিনি তুষ্ট হয়েছেন -- বামাসুন্দরী সুপুত্রের জননী হবেন। ৺তারকেশ্বরের কৃপায় তাঁদের পুত্রসন্তান হল। নাম রাখা হল তারক। ডাক নাম ফুনু। স্বভাবতই খুবই আদরের সন্তান ছিলেন তারক। এদিকে জ্যোতিষীরা জন্মপত্রিকা প্রস্তুত করে জানালেন যে, নবজাতকের পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাসযোগ রয়েছে। আর একান্তই গৃহে অবস্থান করলে রাজসম্মানের অধিকারী হবে। রামকানাই ঘোষাল দেবীভক্ত ছিলেন। তিনি বাড়িতে তন্ত্রমতে পঞ্চমুণ্ডীর আসন প্রতিষ্ঠা করেছি‌লেন। নিয়মিত উপাসনা করতেন। কার্যোপলক্ষে ঘোষাল মহাশয় দক্ষিণেশ্বরে যেতেন। সেখানে গঙ্গাস্নানান্তে লাল চেলি পরিধান করে ৺মায়ের মন্দিরে ধ্যানমগ্ন হতেন। তাঁর লম্বা-চওড়া চেহারা ছিল। অঙ্গ গৌরবর্ণ। বুক থাকত সর্বদাই রক্তিম বর্ণের। সাক্ষাৎ ভৈরব বলে মনে হত। ওঁর সঙ্গে একজন গায়ক থাকত। ধ্যানে মগ্ন থাকার সময় সেই গায়ক ওঁর পিছনে বসে দেহতত্ত্ব ও শ্যামা বিষয়ক গান পরিবেশন করতেন। ধ্যানমগ্ন সাধক ঘোষাল মশাইয়ের গাল বেয়ে চোখের জল ঝরে পড়ত অবিরল ধারায়। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয় এই দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াতের কালে। সাধনকালে ঠাকুরের অসহ্য গাত্রদাহ দেখা দিলে ঘোষাল মহাশয় ইষ্টকবচ ধারণের কথা বলেন। তাঁর কথানুযায়ী এই কবচ ধারণ করলে ঠাকুরের গাত্রদাহ একেবারে কমে যায়। এই ইষ্টকবচ বিষয়ে অনেককাল পরে ঘটা একটি ঘটনা জানা যায় স্বামী নিখিলাত্মানন্দজীর মাধ্যমে। তিনি এইরকম জানাচ্ছেন -- “বোধ হয় ১৯৩১/৩২ খ্রিস্টাব্দের কথা। ঐ সময় বেলুড় মঠের পুরাতন মন্দির থেকে শ্রীশ্রীঠাকুরের ইষ্টকবচ চুরি হয়ে যাওয়ায় মহাপুরুষ মহারাজ খুবই চিন্তিত ও গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। ঠাকুরের মহাসমাধির পর শ্রীশ্রীমা যখন বৃন্দাবনে যাচ্ছিলেন, সে সময় রেলগাড়ির জানালা দিয়ে ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন -- কবচটি যে সঙ্গে রয়েছে, আর হাতটা জানালার ধারে রেখেছ, যদি কবচটা তোমার হাত থেকে কেউ ছিনিয়ে নেয়। ওটি সাবধানে রাখবে। শ্রীশ্রীঠাকুর দেহত্যাগের পূর্বে তাঁর ইষ্টকবচটি শ্রীমা'কে দিয়েছিলেন। মহাপুরুষ মহারাজের সাধক পিতা রামকানাই ঘোষাল শ্রীশ্রীঠাকুরের সাধনকালে গাত্রদাহ নিবারণের জন্য দক্ষিণেশ্বরে তাঁকে ঐ ইষ্টকবচ ধারণ করতে বলেছিলেন। মহাপুরুষজীর পিতা তখন রানী রাসমণির মোক্তার। দক্ষিণেশ্বরে মাঝে মাঝে যেতেন ও সাধনভজন করতেন। বেলুড় মঠে ঐ কবচটি কয়েকবার প্রসাদী বিল্বপত্রের সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে পড়ে যায়; আবার ভাটার সময় খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া যায়। সেই কবচটি বেলুড় মঠে নিত্য পূজা হতো। ঐ সময় এক গভীর রাত্রে ঝড়বৃষ্টির সময় ঐ কবচটি চুরি হয়ে যাওয়ায় মহাপুরুষ মহারাজ বিশেষ উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে হুকুম দিলেন যে,  প্রতি রাত্রে দু'তিনজন সাধু পরপর মন্দিরে সারারাত পাহারা দেবে।” ( শিবানন্দ-স্মৃতিসংগ্রহ, অখণ্ড, সংকলক -- স্বামী অপূর্বানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় )

শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে শিবানন্দজীর প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৮৮০ সালের শেষভাগে। সেইসময় তিনি অবশ্য শিবানন্দ নন,  তারকনাথ। আমরা সেই নামটিই আপাতত ব্যবহার করব। ম্যাকিনন্ ম্যাকেঞ্জিতে কাজ করার সূত্রে তিনি তখন কলকাতায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতেন। সেই বাড়ি সিমলা-পল্লীতে রামচন্দ্র দত্ত মহাশয়ের বাড়ির নিকটেই অবস্থিত ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের রামবাবুর বাড়িতে শুভ পদার্পণের সংবাদ পেয়ে তারকনাথ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। গিয়ে দেখলেন একঘর ভর্তি লোক ঠাকুররের কথা উৎকর্ণ হয়ে শুনছে। লোকের ভিড় ঠেলে এগিয়ে দেখলেন ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। ওই অবস্থাতেই জড়ানো স্বরে জিজ্ঞাসা করছেন, “আমি কোথায়?” একজন উত্তর করলেন, “রামের বাড়িতে”। ঠাকুর “ও” “ও” বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারক উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, কেননা প্রত্যক্ষানুভূতিসম্পন্ন মহাপুরুষের সঙ্গলাভে এতদিন ব্যাকুল ছিলেন। প্রথম দর্শনেই ঠাকুর তাঁর মনপ্রাণ জয় করে নিলেন! তারকনাথ কয়েকদিন পরেই গেলেন দক্ষিণেশ্বরে, উদ্দেশ্য সেই দেবমানবের সঙ্গে সাক্ষাৎ। এর বর্ণনা ভক্তমালিকা অনুযায়ী এইরকম -- “ঠাকুর তখন পশ্চিম দিকের গোল বারান্দায় গঙ্গার দিকে মুখ করিয়া যেন কাহার আগমন প্রতীক্ষায় আছেন। তারক আবিষ্টের ন্যায় তাঁহাকে প্রণাম করিলে তিনি সস্নেহে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি আগে কোথাও আমায় দেখেছিলে কি? তারক রামবাবুর বাড়ির দর্শনের কথা বলিলে তিনি রামবাবুর কুশল-জিজ্ঞাসান্তে তারককে সঙ্গে লইয়া গৃহে প্রবেশ করিলেন এবং ছোট খাটটিতে বসিলেন। ঠাকুরকে দেখিয়াই তারকের মনে হইয়াছিল যেন ‘মা’।”

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments