জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। চব্বিশ /শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। চব্বিশ 

শুভঙ্কর দাস 

"আমার ঘরেতে নাথ,এইটুকু স্থান 
সেথা হতে যা হারায় মেলে না সন্ধান। 
অনন্ত তোমার গৃহ, বিশ্বময় ধাম"


একটি বৃহৎ বটগাছের নিচে জনা পঞ্চাশেক লোকজন নিয়ে সভা বসেছে। আশেপাশে সব চাষবাসে খেটে খাওয়া মানুষের ভীড়। বটবৃক্ষের বেদীর ওপর সূর্যকান্ত চক্রবর্তী দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, 
এই সরকারের হাতে বন্দুক আছে,গুলি আছে,শিকল আছে,কিন্তু আমাদের হাতে শক্তি আছে।
কীসের শক্তি? 
তা হল শ্রমের। 
সেই শ্রমের ওপর ইংরেজ রাজসরকার বাহাদুরি করে,জাঁক করে এবং আমাদের ওপর অত্যাচার করে। নিজেরা যা কাজ করি,তাতে আমরা যদি নিজেদের জন্য রাখি,তাহলে ওদের সামনে মাথা নত করতে হবে না। সকল শ্রমে কাজে আমরা ইংরেজ রাজসরকারকে সাহায্য করব না।
আমরা যদি নিজেরা শ্রম করি নিজেদের জন্য,পুলিশের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে,তাহলে ইংরেজ রাজসরকার প্রথমে ফোঁপরা বাঁশ,তারপর শুকনো কঞ্চি তারপর বাঁশপাতার দুর্বল হয়ে যাবে।
তারপর একদিন কোথায় হারিয়ে যাবে,কে জানে!
ওরা যা শক্তি পায়, সবই তোমাদের জন্য, তোমরা এককাট্টা হলে ওরা পালানোর পথ পাবে না।
তাই বলছি,যত শক্তি তোমাদের হাতে আছে।

একজনের মাথায় গামছা বাঁধা,সে রীতিমতো অবাক হয়ে বেদির দিকে তাকিয়ে নিজের শীর্ণ-কৃষ্ণবর্ণ হাত দুটো দেখিয়ে,  জিজ্ঞেস করল,মোর এই হাতে এমন শক্তি আছে? কী জানি বাবা,মনে হয় স্বপন শুনছি!
মুই একবার বড়রাস্তায় গেসলি,তরাক করে সামনে একটা লালমুখো হাজির,তার হাতে বন্দুক। সিলুট করিনি বলে,এসেই গাঁক করে লাথি,মুই ধপাস, তখন মোর হাতের ওপর বুট চেপে বন্দুক বুকে চেপে ধরল, তা দেখে মোর হিসি মাথায় উঠে যায়,সত্যি বলিরি! 

তার পাশে অপর জন গা চুলকাতে চুলকাতে বলে উঠল,তবে বুঝ,এই হাতে কী শক্তি আছে? যাতে অতি বড় রাজসরকারকে ভয় দেখানো যাবে! মোকে একবার চাবুক মেরেছিল,দুই-তিন কড়া, তাতেই মোর দুইদিন পিঠে কালসাপের মতো দাগ ছিল।

এবার একটা সমবেত রব উঠল,মোরা কি পারব এইসব লড়াই-,ফড়াই করতে!বন্দুক ধরতে! তারপর যদি জেলে ভরে দেয়,তখন মোদের বউ-বাচ্চাদের কী হবে?
সামনের দিকে মোটা কাপড়ের ধূতি ও ফতুয়া পরে কুমারচন্দ্র বসে ছিলেন। সূর্যকান্ত তাঁর দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন।
কুমারচন্দ্র বেদির ওপর উঠলেন না,তিনি জনতার মধ্যে গিয়ে অদ্ভুত একটা কাণ্ড করলেন।
সেই গামছা বাঁধা লোকটি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছো?

সে লোকটা প্রথমে হতচকিত অবস্থা। এই প্রশ্নটা ঠিক কী? এবং তাকে কেন করা হচ্ছে?  তার মাথায় ঢোকেনি!
সে ঢোক গিলে বলল,ধুলায় 
তারপর পাশের জনকে একই প্রশ্ন করলেন,তুমি?
সে উত্তর দিল,মাটিতে 

আর মাটি যদি না থাকে,তাহলে কোথায় দাঁড়াবে?

একজন চেঁচিয়ে বলে উঠল,পাতালে! 

ঠিক একদম ঠিক, বলতে বলতে লাফিয়ে উঠলেন কুমারচন্দ্র। তারপর বেদীর ওপর উঠে বলতে শুরু করলেন,এই ইংরেজ রাজসরকার যে মাটির ওপর বুট পরে গাঁক গাঁক করে হাঁটে,সেই মাটি হলাম মোরা, বুঝেছো।
মোদের হাতে ফসল ফলে,তাঁত ঘোরে,নৌকা চলে,দোকানে মাল ঠেলে,অফিসে কলম, মোদের এখন শুধু এমন কাজ করতে হবে,যাতে ইংরেজ রাজসরকারের কোনো লাভ না হয়।এই হাতগুলো দিয়ে ওদের কোনো কাজ করব না,তাহলে ওদের হাতখানা ভেঙে যাবে।

একজন উৎসাহিত জিজ্ঞেস করল,কী কাজ?

কোনো বিলাতি কাপড়,কোনো বিলাতি জিনিস কিনবে না,কোনো ইংরেজ অফিস-দোকানপাটে যাবে না,চরকা চলবে,মাটি ফলবে,তাঁত ঘুরবে,আর ততই ওদের পেছন জ্বলবে 

এই কথাতে হাততালি পড়ে গেল।

এবার কুমারচন্দ্র কিছু বলার আগে একজন বৃদ্ধ কাশতে কাশতে দাঁড়ালেন, বলে উঠলেন, কিন্তু বাপ্ এসব করতে গেলে ওরা যদি চাবকায়,ওরা যদি বুট দিয়ে পিষে দেয়, শাস্তি দেয়,তখন কি এই গাঁ ভর্তি হাঁপানিভরা ম্যারেলিয়া মরা বুক সহ্য করতে পারবে?

কুমারচন্দ্রের মুখ গম্ভীর হল। 
তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলেন,এটা কী এমন শাস্তি? তবে শোনো সবাই,এই সুতাহাটার মতো পঞ্জাবে একটা জায়গা আছে,তার নাম জালিওয়ানাবাগ। সেখানে প্রচুর মানুষ একটা বড় প্রাচীর দেওয়া  বাগানে শান্তভাবে সভা করছিল,কিন্তু ইংরেজ রাজসরকারের তাতেও গা জ্বলে উঠল।তখন অসংখ্য বন্দুক তাক করে কচিকাঁচা বুড়োবুড়ি এমন কি দুধের শিশুকে হত্যা করে।চারিদিকে শুধু চিৎকার, আর্তনাদ, কান্না,আর গুলি খেয়ে মৃত্যু। কারা মরল সেখানে? আমাদেরই ভাইবোনেরা, ভাবো তাহলে এই সরকার কি আমাদের দরকার?

প্রশ্ন করে চুপ থাকলেন কুমারচন্দ্র।

চারিপাশে নিঃশব্দতা।

কয়েকজন এই ঘটনার ভয়াবহতা শুনে ভয়ার্ত চোখে আশেপাশের মাঠের দিকে তাকাতে লাগল।এখানেই যদি ওরকম ঘটনা ঘটে!

বলো তোমরা, এরপরেও কী এদের বিশ্বাস করা যায়? এদের সহযোগিতা করা যায়? হ্যাঁ, যারা ভাবছ,এখানেই কি এরকম হতে পারে? হ্যাঁ,জোর গলায় বলছি,হতে পারে,কিন্তু মোরা যদি সাহস করে শুধু এই বর্বর শাসকের বিরুদ্ধে অসহযোগ করি, তাহলে এরা পালাবার পথ পাবে না! গুলি মারা তো অনেক দূর।

সেই বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,মুই কোনো ভয় পাইনি,এরকম অসহযোগ করে যাব,যতদিন বুকের পরান আছে

সকলে এবার একসঙ্গে সশব্দে সমর্থন করল।
কিন্তু সেই গামছা মাথায় বাঁধা লোকটি আবার দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,অসহযোগ করব,কিন্তু অসহযোগ জিনিসটা কীরকম হবে?

তখন কুমারচন্দ্র চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,অসহযোগ মানে কী জানো? হাতে না মেরে পাতে মারা, বোঝা গেছে? 

একটা তরঙ্গ বয়ে গেল জনতার মধ্যে, এই কথাটি তারা সহজে বুঝতে পেরেছে। 
একজন অল্পবয়সী কৃষক কোমরের গামছা শক্ত করে বেঁধে লাফিয়ে উঠল, জিজ্ঞেস করল,বলো কুমারদা,কী করতে হবে?

বাঁশ কাটতে হবে

অ্যাঁ! এই যে বললে,কোনো হাতিয়ার লাগবেনি,তাহলে বাঁশ,তারপর বন্দুকের মুখে বাঁশ ধরে পারা যাবে?

নারে,বাঁশ কাটতে হবে,বন্দুকের সামনে নয়, ঘর বাঁধার জন্য 

মানে?

মানে পাঠশালা তৈরি হবে,এ শুধু পড়ার পাঠশালা নয়,এ হলো, হাতের কাজ শেখা,চরকা কাটা,কাঠের কাজ,তাঁতের কাজ,দেশের কথা জানা, অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়া এইসব নানারকমের কর্মশালা হবে।

এমন পাঠশালার কথা এর আগে কেউ কোনোদিন শোনেনি! 
অনেকেই গালে হাত দিয়ে অবাক হল!
কেউ কেউ দারুণ উৎসাহ পেল।
বেশ, বেশ, কোনো জমিদার কি জমি দান করল?

ছোঃ জমিদার, জমিদারের জমি আছে,বুকে জোর নেই, জমি দিয়েছে,বলেই কুমারচন্দ্র একপাশে আঁচলে মুখ ঢাকা বসে থাকা মহিলাদের মধ্যে বসে থাকা একজন নারীকে দেখিয়ে  বললেন,ইনি হলেন হররমা পতি, এঁর বাড়ি অনন্তপুর।

তারপর কুমারচন্দ্র সেই নারীটির কাছে গিয়ে প্রণাম করলেন এবং বলে উঠলেন,

এই মহিলা এই সৎ কাজের জন্য জমি দান করেছেন। এরকম কেউ করতে পারবে? জমিদার, ওরা শুধু জানে টাকা গুনতে আর ইংরেজের পা চাটতে। 

সকলে আবার হাততালি দিয়ে উঠল।
আরও শোনো এই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পড়াবেন আমার বন্ধু সূর্যকান্ত চক্রবর্তী। আমিও পড়াব আবার লোকের ঘরে ঘরে ভিক্ষাও করব।

একজন বলে উঠল,কেন?

ওরে বিদ্যালয় গড়তে হবে, কাজ শুরু করতে হবে,বাঁশ,কাঠ,টালি আর টাকা লাগবে না!

এসবে মোরা সবাই আছি

তাহলে চলো

বলেই কুমারচন্দ্র ও সূর্যকান্ত সেই অপরাহ্নের আলোয় দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং তাঁদের অনুসরণ করছে অসংখ্য গাঁয়ের মানুষজন, যাদের কেউ কোনোদিন মানুষ হিসেবে সম্মান করেনি! যাদের কেউ কোনো কোনো কাজের লোক বলে মনে করেনি!

হলদি নদীর তীরে অনন্তপুর নামক অঞ্চলে বিধবা হররমা পতির নিঃস্বার্থ দান সত্যিকারের গৌরবময় করতে কুমারচন্দ্র রাতদিন এক করে ফেললেন। প্রথমেই জমিটিকে বাঁশের বাখারি দিয়ে ঘিরে ফেলা হল।তারপর বাঁশ-খড়-কাঠ এবং টালি সহযোগে বানিয়ে ফেলা হল পাঁচ-ছয়টি কক্ষ। একটি অফিসরুম। সেখানেই শিক্ষকমহাশয়গণ বসবেন। আর কয়েকটি রুমে চলবে পড়াশোনার পাশাপাশি হাতের নানারকম কাজ। বিদ্যালয়ের সামনের অংশ ফুলের বাগান এবং পেছনের জমিতে শাক-সবজি চাষের জন্য বরাদ্দ করা হল।একটু দূরে সেই জমিতে একটি বেশ বড় পুকুর ছিল।তার পাশে আরও তিনটি কক্ষ বানানো হল।কারণ এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক-ছাত্ররা আবাসিক। এখানেই পড়বে, থাকবে এবং সমস্ত কাজ নিজের হাতে শিখবে।তারপর পড়াশোনা করে দেশের জন্য কাজ করবে।অল্পদিনের মধ্যে একটা আশ্রমিক পরিবেশের রূপদান করা গেল।শিক্ষক হিসেবে একের পর হরিশ্চন্দ্র ভৌমিক,জীবেশচন্দ্র পট্টনায়ক, প্রমথনাথ মাইতি,সুরেন্দ্রনাথ জানা, বিধূভূষণ মিশ্র,শশিভূষণ দাস,হরিপদ সিং,সেখ কেফায়েত উল্লা,রত্নেশ্বর উত্থাসনী, কালীপদ পাণ্ডা প্রভৃতি।তার ওপর স্বয়ং কুমারচন্দ্র জানা তো আছেনই..

সেদিন সকাল থেকে অনন্তপুর জাতীয় বিদ্যালয়ে সাজো সাজো রব।গাঁয়ের মেয়েরা প্রতিটি কক্ষ গোরব-জল দিয়ে নিকিয়ে আলপনা এঁকে দিয়েছে।বাঁশের বাখারিতে গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। সেদিন প্রায় জনা তিরিশেক ছাত্র পরিষ্কার ধুতি ও পিরান পরে বিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে আছে।সেখানে ঘটের ওপর আমপাতা এবং কলাগাছ রোপিত হয়েছে। কাগজে রঙ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার দুটি চরণ সুন্দর করে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে, " এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন/ এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন "

যথাসময়ে সেই শুভক্ষণ উপস্থিত। কুমারচন্দ্র পথ দেখিয়ে নিয়ে আনলেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমলকে।আজকে তিনি এই জাতীয় বিদ্যালয় উদ্বোধন করবেন।একটা বেদী তৈরি করা হয়েছিল।সেখানে গিয়ে বীরেন্দ্রনাথ দাঁড়ালেন।
কুমারচন্দ্র চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,আমাদের মতো গাঁয়েদেশে দেশগঠন কী জিনিস,এই পাঠ যিনি অন্তর বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন,যিনি  গাঁয়ের মানুষজনকে শিক্ষার আলো দেখাতে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ার জন্য নিজের গৃহটি দান করে দিয়েছেন,সেই পথপ্রদর্শক মানুষটি উপস্থিত হয়েছেন,শ্রী বীরেন্দ্রনাথ শাসমল।

হাততালি এবং শঙ্খধ্বনিতে বরণ করা হল।

বীরেন্দ্রনাথ জাতীয় বিদ্যালয় উদ্বোধন করলেন। তারপর তিনি বলে উঠলেন,একটা কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে,আমাদের মাটি,আমাদেরই নতুন করে গঠন করতে হবে।এই মাটিতে যেমন ধান হয়,তেমনি সেই মাটিতেই নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে হবে।নতুন প্রাণ তৈরি হবে পড়াশোনা আর হাতের কাজ শেখার মাধ্যমে। এই বিদ্যালয়ের একটি মাত্র উদ্দেশ্য হোক,দেশগঠন।
মনে রাখবেন, গ্রাম যদি না জাগে,দেশ কোনোদিন জাগতে পারবে না।
তাই খেজুরি থানার কলাগেছিয়ায়, মহিষাদল থানার কাঁকুড়দা গ্রামেও জাতীয় বিদ্যলয় স্থাপিত হয়েছে। 
শুধু স্থাপন করলে হবে না,এইসব কেন্দ্রকে সত্যিকারের মানুষ তৈরির কারখানা করে তুলতে হবে।এই স্থান থেকে আগামী সময়ে যে নূতন ভারতবর্ষের জন্ম হবে,সেই ভারতবর্ষকে পথ দেখাবে এই জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রগণ।আরও একটি কথা বলার আছে,এই কাছে শুধু ছেলেদের নয়, মেয়েদের এগিয়ে আসতে হবে।মেয়েরাও পড়াশোনা শিখবে,হাতের কাজ শিখবে এবং মানুষ হয়ে উঠবে।
আপনারা আপনাদের বিশ্বাসে, শ্রমে,সাধনায় এই কর্মযজ্ঞ সফল করে তুলুন,এই কামনা সর্বান্তকরণে করছি।

এই বলে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল  বক্তব্য শেষ করলেন।
শঙ্খধ্বনি ও হাততালিতে ভরে উঠল জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ। 
কুমারচন্দ্র নীরবে সেই গ্রামকে পথ দেখানো মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানালেন এবং এই জাতীয় বিদ্যালয়কে সার্থক করতে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এই বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা তিনশো ছাড়িয়ে গেল।

একদিন বিকেলে একজন লোক হন্তদন্ত হয়ে জাতীয় বিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেন। তিনি গরুর গাড়িটি গেটের মুখেই দাঁড় করিয়েছিলেন।
ফুলহাতা ফতুয়া এবং ধূতি পরিহিত। হাতে একটি সংবাদপত্র,বাংলার কথা,যে পত্রিকা সম্পাদনা করেন,চিত্তরঞ্জন দাশ।
তিনি হাঁটতে হাঁটতে অফিসের দিকে না গিয়ে বিদ্যালয়ের কর্মধারা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন।
একটি কক্ষে বেশকিছু মেয়ে চরকায় সুতো কাটছে।একটি কক্ষে সমবেত কণ্ঠে এই আবৃত্তি শোনা যাচ্ছে, 
অয়ি ভুবনমনোমোহিনী, মা
অয়ি নির্মল সূর্যকরোজ্জ্বল ধরণী জনকজননিজননী 
নীলসিন্ধুজলধৌতচরতল, অনিলবিকম্পিত-শ্যামল-অঞ্চল
অম্বরচুম্বিতভালহিমালয়,শুভ্রতুষারকিরীটিনী।।
প্রথম প্রভাত উদয় তব গগনে,প্রথম সামরব তব তপোবনে
প্রথম প্রচারিত তব বনভবনে জ্ঞানধর্ম কত কাব্যকাহিনী।
চিরকল্যাণময়ী তুমি ধন্য,দেশবিদেশে বিতরিছ অন্ন
জাহ্নবীযমুনা বিগলিত করুণা পুণ্য পীযূষস্তন্যবাহিনী।

এই মন্ত্রের রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেন অপরাহ্নের আকাশ বাতাস পবিত্র ও নির্মল করে দিচ্ছে। আগত অতিথি অবাক হলেন। এই গাঁয়েদেশে এই ধরণের কচি কচি কণ্ঠে কবিতার উচ্চারণ বিমোহিত করে দিচ্ছে। 
এতো কঠিন কবিতা কী সুন্দর করে পরিবেশন করছে!

একটি কক্ষে একজন শিক্ষক পাঠদান করছেন।
এমন কি এই বিদ্যালয়ের চত্বরে একটি সরোবর আছে,তার কাছে একটি বৃক্ষের নিচে দুজন শিক্ষক পড়াচ্ছেন। 
একজন কাঠের গুঁড়ি কেটে নকশা তৈরির কাজ শেখাচ্ছেন। 
এইসব দেখতে দেখতে লোকটি অফিসে পৌঁছে গেলেন।

সবকিছু দেখছেন,এবং অনুভব করলেন, এই সবের মধ্যে একটা যেন প্রাণপ্রবাহ সঞ্চারিত হয়েছে। যাঁর জন্য এই বিদ্যালয়,তাঁকে তো কোথায় দেখা গেল না!
কোনো কাজে সেই কলেজ ত্যাগ করা যুবকটিকে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেল না!
তাহলে কী?
লোকটির ভ্রূ কুঞ্চিত হল।
না,এমন তো হওয়ার কথা নয়।
কুমারচন্দ্র জানাকে তিনি যেভাবে চেনেন,তাঁর তো এইসব মানুষ গড়ার কারখানায় থাকার কথা!
তাহলে কি সেই মানুষটি সকলকে খাটিয়ে, সকলকে কাজ করিয়ে নিজের নাম কুড়োচ্ছেন!
নিজে অথচ কিছুই করছেন না!
না,ব্যাপারটি শেষ পর্যন্ত দেখতে হচ্ছে। 

নমস্কার, কাউকে আপনি খোঁজ করছেন? সূর্যকান্ত চক্রবর্তী এগিয়ে এলেন। 

হ্যাঁ

বলুন

কুমারচন্দ্র জানাকে,তাঁকে তো কোথায় এই মহাযজ্ঞে দেখছি না!

সূর্যকান্ত মৃদু হাসলেন।উত্তর না দিয়ে অন্য প্রশ্ন করলেন।
আপনি কোথা থেকে আসছেন?

কলকাতা

আপনার নাম?

মুরলিধর বন্দ্যোপাধ্যায়

ওহ্ আচ্ছা,আপনার নাম আমি শুনেছি,আমার বন্ধুর মুখ থেকে,আপনি বাইরে না দাঁড়িয়ে অফিসে এসে বসুন।

না,ঠিক আছে,এইখানে দাঁড়িয়ে কাজকর্ম দেখতে খুব ভালো লাগছে,তা কুমারবাবুর কতক্ষণ পর দর্শন হবে?

আজ্ঞে, গৃহদেবতার ওপর নির্ভর করছে সবকিছু 

মানে? গৃহদেবতা! 

হ্যাঁ,এই জাতীয় বিদ্যালয় আশ্রমিক।এখানে ছাত্র-শিক্ষক আবাসিক।কোনো জমিদার বা সরকার এ-ই প্রতিষ্ঠানের জন্য এলক কানাকড়ি সাহায্য করে না,বরং এই প্রতিষ্ঠান যত তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়,সেই কু-চেষ্টায় সদা উদগ্রীব। কিন্তু আমার বন্ধু কুমারচন্দ্র পাথর পিটানো বুক,কোনো বাধাকে সে বাধা মনে করে না।


তাই? কিন্তু তাকে তো দেখতে পেলাম না! সব কাজ তো আপনারাই করছেন!

আজ্ঞে, ঐ হাঁড়ির ভেতর চাল ফোটার মতো,সবাই চাল ফুটছে দেখছে,কিন্তু কোন শক্তিতে হাঁড়ির জল গরম হচ্ছে, আর চাল ফুটে ভাত হচ্ছে, তা দেখার জন্য মাথা ঝোঁকাতে হয়,তারপর উনুনে আগুন চোখে পড়ে!

বাহ্,আপনি দারুণ কথা বলেন।
তা সেই আগুনের দর্শনেই তো এসেছি, তিনি এখন কোথায় আলো হয়ে আছেন?

ঐ যে বললাম,গৃহদেবতার দ্বারে দ্বারে.. 

বুঝতে পারলাম না! একটু বুঝিয়ে বলবেন?

আসলে এই বিদ্যালয়ে দিন দিন ছাত্রসংখ্যা বাড়ছে,এবং আগামী মাস থেকে ছাত্রীরাও পড়বে।আরও কক্ষ নির্মাণ করার দরকার।তার জন্য কাঠ-বাঁশ এবং টালি সংগ্রহ করতে হয়, বলা যায়,ভিক্ষে করে করে,ওপর আপনাকে কীভাবে বলব?

বলুন না,কোনো অসুবিধা নেই 

আসলে বিদ্যালয়ের সকলের জন্য আহারের জন্য মাসে প্রায় দশ-বারো মণ চাল লাগে,তাও জোগাড় করতে হয় চেয়েচিন্তে

তা এইসব জোগাড় হয় কীভাবে?

সূর্যকান্ত চক্রবর্তী একটু নীরব থাকলেন। তারপর বিদ্যালয়ের গেটের দিকে তাকিয়ে বললেন,এই দেখুন, এইভাবে জোগাড় হয়।

মুরলীধর ঘুরে পড়লেন।এবং গেটের দিকে দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেলেন।
একদল ছাত্র এবং শিক্ষক মহানন্দে পর পর প্রবেশ করছেন।প্রত্যেকের হাতে কিছু না কিছু জিনিস ধরা।কেউ শাকসবজি, কেউ ত্রিপল, কেউ হাঁড়িকলসি,কেউ বাঁশ,কেউ বা মাথায় নিয়েছে বস্তা।
সবার শেষে একজন হেঁটে আসছেন,তাঁর কাঁধে একটা ভারি চটের ব্যাগ। নিশ্চিতভাবে ওতে চাল আছে।
তাঁর বলিষ্ঠ দেহ।মুখটা রৌদ্রে পুড়ে গেছে।গায়ের ফতুয়া ঘামে জবজবে। সেই ব্যাগ পিঠ থেকে নামিয়ে রাখলেন বারান্দায়। তারপর ফতুয়ার একটি অংশ দিয়ে মুখ মুছলেন। 
সূর্যকান্ত সেই মানুষটির দিকে আঙুল তুলে বলতে যাচ্ছিলেন,তার আগেই মুরলীধরবাবু হাত তুলে থামিয়ে দিলেন এবং মুখে বললেন,বুঝছি।

কুমারচন্দ্র জানাকে চিনতে কোনো অসুবিধা হল না মুরলীধরবাবুর। তিনি এগিয়ে গেলেন কুমারচন্দ্রের দিকে।

যাক,এতক্ষণে আগুনের সাক্ষাৎ হল 

আরে মুরলীধরবাবু,এখানে?কখন এলেন! কোনো চিঠি লিখলেন না তো! কী হল? কলকাতায় কি আগুনের অভাব হল?

তা অবশ্য বলতে পারেন! আমি একটা ভুল করছিলাম,আপনাকে কলকাতায় আটকে রাখতে চেয়েছিলাম,এখন দেখছি, তা ভুল,সত্যি বড় ভুল।আপনাকে এইখানে মানায়

না,মুরলীধরবাবু,ভুল-ভ্রান্তির ওপরে এখন কাজ করে যেতে হবে,সেখানে প্রচুর কাজের লোক আছে,এখানে অভাব,সবকিছু বড়  অভাব,সেই সঙ্গে কাজের লোকের

তা তো নিজের চোখে দেখছি!

তা দেখুন,কিন্তু মহানগরের জৌলুশ ছেড়ে একেবারে লম্ফজ্বলা অজ পাড়াগাঁয়েও,এখানে বড্ড অন্ধকার!  এখানে আর কী দেখবেন?

যা দেখছি,তা তো মহানগরে দেখতে পাই না

তাই! তা কী দেখলেন?

মাটি 

মাটি?

হ্যাঁ,আমি এসে দেখলাম,মাটি জাগছে,সেই সঙ্গে জাগছে সেই মাটিমাখা মানুষগুলো, যাদের কেউ কোনোদিন সম্মান করেনি,মানুষ ভাবেনি! 


ক্রমশ...

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments