জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম-পর্ব-(৫৪)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম-পর্ব-(৫৪)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম


এই সব ধর্মের উল্লেখযোগ্য গুরুজনরা হলেন- গোপীচন্দ্র, মুকুন্দদেব, শাহ করিম (খ্রিঃ ১৬০০) শাহ লতিফ,বেদিল, বেকাস (মহম্মদ হোসেন) লোহার কুতুব, বাওয়ারি সাহেব (খ্রিঃ ১৬০০) বীরু সাহেব, ইয়ারি সাহিব (খ্রিঃ ১৬৬৮-১৭২৫) গুলাল সাহিব, জগজীবন (খ্রিঃ ১৬৮২) ভিখা (খ্রিঃ ১৭২০) গোবিন্দ সাহিব, পালটু সাহিব, ঘাসিদাস, লালগির, দারিয়া সাহিব, পিবান শাহ, শিবনারায়ণ (খ্রিঃ ১৭১০) মহম্মদ শাহ (খ্রিঃ ১৭১৯-১৭৪৮), বুলে শাহ (খ্রিঃ ১৭০৩), প্রাণনাথ (খ্রিঃ ১৭০০-১৭৫০) শান্তারাম (রামচরণ, খ্রিঃ ১৭১৫-১৭২০) নরসিংহ সহজানন্দ (খ্রিঃ ১৭৮০) তুলসী সাহিব (খ্রিঃ ১৭৬০) হাথরাশি দেবরাজ (খ্রিঃ ১৭৭১), যারা লোকসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে নানা জাতির মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের মহিমা প্রচার করে মানুষের মননের জগতকে সমৃদ্ধ করেছিলেন শুধু নয়, তারা সর্বধর্ম সমন্বয়ে বাণী সারা ভারতবর্ষ জুড়ে বহন করেছিলেন এবং যত মত তত পথের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ভারতকেধর্মবোধকে উজ্জীবিত করেছিলেন। 

ঐতিহাসিক যুগ থেকে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থানের স্বাতন্ত্র্য বারবার লক্ষ্য করা গেছে। উত্তরে বিন্ধ্য পর্বত, পশ্চিমে আরব সাগর এবং পূর্বে বঙ্গোপসাগর- এই অংশ জুড়ে দক্ষিণ ভারতের বৈশিষ্ট্যগুলির পিছনে রয়েছে বহির্দেশীয় আক্রমণ, বাণিজ্যসূত্রে ভারতে তাদের আগমন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস ও কালক্রমে ভারতের নাগরিক হয়ে ওঠা। মূলত হিন্দুদের জনজীবনে প্রাধান্য থাকা সত্বেও বহিরাক্রমণ জনিত কারণে হিন্দু রাজাদের জয় পরাজয় সবই দক্ষিণ ভারতের জনজীবনকে বৈচিত্র্য দান করেছে। দক্ষিণ ভারতের হিন্দুধর্ম ছাড়াও বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিপুল প্রভাব ছিল। ভারতবর্ষে বিজয়ী হয়ে যারা এসেছে তারা কেউ-ই ফিরে যায়নি। জিউজগণ কোচিনে, মুসলমানগন মালাবারে ও খ্রীষ্টানগণ দক্ষিণ ভারতের সর্বত্র চার্চের অস্তিত্ব প্রমাণ করে খ্রিস্টানদের এই আধিপত্য। 

ভাস্কো ডা গামার (খ্রিঃ ১৪৯৮)  কালিকটে আগমন পাশ্চাত্যের সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্পর্ক স্থাপনের প্রধান সাক্ষী হয়ে আছে। এই পর্তুগিজ জননায়ক ষোড়শ শতাব্দে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে গোয়ায় বিপুল আধিপত্য নিয়ে অবস্থান করেন। এই সময়ে ভারতবর্ষে রোমান ক্যাথলিক মিশনের আধিপত্যও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। গোয়া কোচি তিউতিকোরিনকে কেন্দ্র করে পর্তুগিজগণ সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে মৎস্যজীবীদের মধ্যে চার্চের প্রভাব বাড়িয়ে তোলে এবং পরে ধীরে ধীরে দেশের অভ্যন্তরেও  বিস্তার লাভ করে। প্রথম জেসুট মিশনারি ফ্রান্সিস জেভিয়ার (খ্রিঃ ১৫০৬-১৫৫২) এবং ইতালীয় রবার্ট ডে নোবিলি (খ্রিঃ ১৫৫৭-১৬৫৬) দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের বাণী প্রচার করেন।

 প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী খ্রীষ্টানগণ ষোড়শ শতাব্দে ত্রিচিনোপল্লির সন্নিকটে টাঙ্কুভারে প্রটেস্টান্ট ধর্মের ভিত্তি রচনা করেন। দুই শত শতাব্দ ধরে খ্রিস্টান  মিশনারিগণ দক্ষিণ ভারতের তাদের ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে থাকেন এবং ভারতীয় ভাষায়, বিশেষত তেলেগু, কন্নড় ও মালায়ালাম- এই তিনটি দ্রাবিড় ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করে জনজীবনে খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও অনুশীলন অব্যাহত রাখতে থাকার ফলে সমাজজীবনে নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। উত্তর ভারতে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব প্রথমাংশে উইলিয়াম কেরির সময় পর্যন্ত (খ্রিঃ ১৭৯৩) এবং দ্বিতীয়াংশে আধুনিক কাল পর্যন্ত বর্তমান। অনুমান করা যায়, সেন্ট থমাস উত্তর ভারত পরিভ্রমণ করেছিলেন এবং তিনি নিজে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেছিলেন। 

খ্রিঃ ত্রয়োদশ শতাব্দে মার্কো পোলো ভারত পরিভ্রমণ করেছিলেন এবং সেই সময় যে ছয়জন রাজা মধ্যভারত শাসন করেছিলেন তাদের মধ্যে তিনজন খ্রিস্টান ছিলেন। মহম্মদ বিন তুঘলক, তইমুর সহ অন্যান্য মুসলিম সম্রাটগণের রাজত্বকালে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব স্তিমিত হয়। সম্রাট আকবরের (খ্রিঃ ১৫৫৬-১৬০৫) রাজত্বকালে তারই আমন্ত্রণে গোয়া থেকে যাত্রা শুরু করে যে জেসুট মিশন ১৫৭৯ খ্রিঃ নভেম্বর মাসে সুরাত মান্ডু উজ্জয়িনী সুরজ মাড়োয়ার গোয়ালিয়র ঢোলপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ঘুরে ফতেপুর সিক্রিতে আসেন এবং সম্রাট আকবরের রাজসভায় খ্রিষ্টধর্মের বিশেষত্বগুলি বিশ্লেষণ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পক্ষে গোলটেবিল কনফারেন্স করে মতামত ব্যক্ত করেন, সম্রাট আকবর সে বিষয়ে সম্মতি দেন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচারে তাদের অধিকারের কোনোভাবে যাতে হস্তক্ষেপ না করা হয়, সে বিষয়ে যথাযথ নির্দেশ দেন। এই মিশন ১৫৮৩ খ্রিঃ গোয়ায় প্রত্যাবর্তন করে ও পরবর্তীকালে সম্রাট আকবরের আমন্ত্রণে এই মিশনের কাজ ১৫৯১ খ্রিঃ লাহোরে শুরু করতে নির্দেশ দেন। লাহোরে চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীকালে আগ্রাতেও চার্চ স্থাপিত হয়। ১৬০৫ খ্রিঃ জাহাঙ্গীর সম্রাট হলেও খ্রিষ্টানদের ধর্মপ্রচারে বাধা সৃষ্টি করেননি। খ্রিঃ অষ্টাদশ শতাব্দ পর্যন্ত চার্চের প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments