জ্বলদর্চি

জীবজগতে স্বয়ম্বর.../নিশান চ্যাটার্জী

জীবনের গভীরে বিজ্ঞান- ৩

জীবজগতে স্বয়ম্বর....

নিশান চ্যাটার্জী

মানব জীবনের সাথে অনান্য প্রাণীকূলের জীবন যাত্রার যে কতটা মিল তা একমাত্র বিজ্ঞান ই প্রকাশ করতে পারে তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে। মানুষের রঙিন জীবন যাত্রার বর্ণচ্ছটা যে সমস্ত জীবজগতেই ছড়িয়ে রয়েছে তা জানলে অবাক হতে হয় মানুষকেই। আজ থেকে বহু বছর আগে প্রথিতযশা বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের যুগান্তকারী তত্ত্ব "ন্যাচারাল সিলেকশান্"  ("Natural Selection") আজও জীবনের বহু ক্ষেত্রেই ছাপ ফেলে যায়। ডারউইনের বক্তব্যের মূল সারমর্ম ছিল এই যে-
 "প্রকৃতি  যদি তোমাকে তার বুকে বসবাসের জন্য ফিট সার্টিফিকেট দিয়ে চিহ্নিত করে তবেই তুমি এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে। নাহলে ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করতে তুমি বাধ্য"। 

কবি মাইকেলের ভাষায় আমরা সকলেই জানি- "জন্মিলে মরিতে হবে//অমর কে কোথা কবে"। 

 কিন্তু জন্ম থেকে মৃত্যু এবং তার সাথে নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি তখনই সম্ভব যখন সেই জীব প্রজননের মাধ্যমে অপত্য সৃষ্টি করে। প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য যেমন জীবকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যেতে হয় তেমনি তার প্রজন্ম সৃষ্টি তথা প্রজননের জন্য ও নানান কৌশল অবলম্বন করতে হয়। আজকে আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্যই হলো এই সংগ্রামের পথে জীবের কৌশল গুলো সম্পর্কে একটু কৌতূহল মেটানো। সঙ্গীহীন ব্যক্তি যেমন একাকীত্বের আবহাওয়ায় থাকার কারণে তার জিনের উত্তরাধিকার প্রকৃতিকে দান করতে পারেনা, তেমনি প্রকৃতির সকল জীবই সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। মানুষ এই সঙ্গী নির্বাচনে, ব্যক্তি বিশেষে বিভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসী যেমন কেউ কেউ মনে করেন "প্রথমে দর্শন ও পরে গুন"। অর্থাৎ দেখতে ভালো সঙ্গী পেতে চান। আবার কেউ কেউ হয়তো মনে করেন "রুপের বাঁধন নাই বা পেলাম//গুনেই আমি খুশি"।

 একইভাবে প্রাণীরাও এই রকম নানান মতামতে বিশ্বাসী। ডারউইন যে "Natural Selection"এর কথা বলেছিলেন তার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হলো "সেক্সুয়াল সিলেকশান্" ("Sexual Selection")। অর্থাৎ প্রত্যেক জীব তার সঙ্গী নির্বাচনে যথেষ্ট যত্নশীল। যেমন উত্তর পশ্চিম আমেরিকার একটি স্থানীয় পাখি (ফিঞ্চ বা হাউস ফিঞ্চ) এর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এদের পুরুষ পাখিদের দেহের রঙ অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়। সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল বর্ণের পুরুষ পাখিটি স্ত্রী পাখিদের কাছে পছন্দের হয়। কারণ তারা মনে করে উজ্জ্বল বর্ণের পুরুষ পাখিটি তাদের বাসায় বেশি করে খাদ্য আনতে সক্ষম। বিজ্ঞানী হিল ১৯৯১ সালে এই বিশেষ তথ্যটি তার গবেষণাপত্রে তুলে ধরেছেন। আবার মানুষ যেমন তার পছন্দের সঙ্গিনীকে নিয়ে নিভৃতে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ বা ডিনার করতে যেতে পছন্দ করে, ঠিক তাদেরই মতো একটি সন্ধিপদ প্রাণী "স্করপিওন ফ্লি"( scorpion flea) প্রজাতি রয়েছে। যাদের পুরুষ প্রাণীরা তাদের পছন্দের সঙ্গিনী কে বিশেষ লালা মিশ্রিত খাদ্য শিকার করে উপহার হিসেবে তুলে দেয়।এর ফলে তার সঙ্গিনী সন্তুষ্ট হয়। এই বিশেষ খাদ্য প্রদানের রীতিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় "ন্যুপশিয়াল গিফট" ("nuptial gift")।

 অন্যদিকে সিনেমায় যেমন দেখানো হয় নায়ক যে হয়, সে অন্যান্যদের থেকে নায়িকা কে মারপিট করে প্রায় ট্রফি জেতার মতো জিতে আনে। কিছুটা সেরকমই দেখা যায় পশ্চিম এশিয়ার ও ইউরোপের এক অন্যতম হরিণের প্রজাতির ক্ষেত্রে। এদের স্ত্রী প্রাণীরা এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে তাদের সঙ্গী নির্বাচন করে। যে পুরুষ প্রাণীর শিং যতটা বড়ো এবং শাখা যুক্ত হয়, তার প্রতি স্ত্রী হরিণীরা ততোটাই আকৃষ্ট হয়। আবার কখনো কখনো একটি স্ত্রী প্রাণীর জন্য একাধিক পুরুষ প্রাণী লড়াই করতেও পিছপা হয়না এবং লড়াই তে যে জেতে সেইই সিনেমার নায়কের মতো স্ত্রী প্রাণীর যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। জীবজগতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পুরুষ প্রাণীর তুলনায় স্ত্রী প্রাণীর সংখ্যা কম তাই আগেকার স্বয়ম্বর সভার মতো স্ত্রী প্রাণীরাই সঙ্গী নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেয়েদের সাজগোজের ইচ্ছে সর্বজনবিদিত। কিন্তু যদি আমাদের পরিচিত পাখি ময়ূরের দিকে তাকাই তাহলে দেখব পুরুষেরাও কিন্তু সাজগোজের ব্যাপারে খুব একটা পিছিয়ে নেই। যদিও এই সাজ প্রকৃতি সৃষ্ট এবং এতে বিন্দুমাত্র কৃত্রিমতা নেই। ময়ূরের পেখমের ব্যবহার কিন্তু ময়ূরীদের পাত্র নির্বাচনের প্রধান বিচার্য বিষয়। এবং এটাও প্রমাণিত যে ময়ূরের পেখমের দৈর্ঘ্যের ওপরে তার প্রজনন ক্ষমতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। যার পেখমের দৈর্ঘ্য সর্বাধিক তার প্রজনন ক্ষমতাও সর্বাধিক,তাই প্রমিলা মহলে তার গুরুত্বও অধিক।  ডারউইন তার sexual selection তত্ত্বে উল্লেখ করেছিলেন- যে সব প্রজাতির প্রজনন নির্ভর করে স্ত্রী প্রাণীর পছন্দের ওপর, সেই সব প্রজাতির পুরুষ প্রাণীদের সাজগোজ একটু বেশিই হয়।

 সেই জন্য দেখা যায় অধিকাংশ পাখিদের মধ্যে পুরুষ পাখিরাই তুলনামূলক বেশি সুন্দর, পুরুষ পাখিদের কণ্ঠস্বর অপেক্ষাকৃত মিষ্টি, পুরুষ হরিণের শিং লম্বা ও শাখা প্রশাখা যুক্ত ইত্যাদি। গোলাপেও যেমন কাঁটা থাকে ঠিক তেমনি এই অতি সৌন্দর্য অনেকসময় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মধ্য আমেরিকার একটি বিশেষ ব্যাঙের প্রজাতি, আকারে আমাদের দেখা ব্যাঙের তুলনায় ছোট, নাম "টুঙ্গারা"(" Tungara Frog")।  এই প্রজাতির পুরুষ ব্যাঙেরা তাদের স্বরযন্ত্রের বিশেষ পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিচিত্র শব্দ সৃষ্টি করে। তাদের স্ত্রী প্রাণীদের আকৃষ্ট করার জন্যেও এরকম বিশেষ শব্দ তারা সৃষ্টি করে, যা কিন্তু তাদের জীবনে ঘোর বিপদ ডেকে আনে। কারণ এই বিশেষ শব্দের ডাকটি যেমন তার সঙ্গিনী কে আকৃষ্ট করে তেমনি একই সঙ্গে একটি বিশেষ প্রজাতির বাদুড়কেও আকৃষ্ট করে এবং তারা ঐ শব্দ অনুসরণ করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে পুরুষ ব্যাঙটিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। 

       স্ত্রী প্রাণীদের এই সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ওয়ার মূল কারণ হলো, তারা মনে করে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য সমূহ যা পুরুষ প্রাণীদের রয়েছে তা তাদের সন্তানদের মধ্যেও সঞ্চারিত হবে এবং তাদের সন্তান ও ঐ সকল বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। তাই সবচেয়ে সুন্দর পুরুষটিকেই তারা তাদের সঙ্গী হিসেবে নির্বাচিত করে থাকে। একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় " Sexy son hypothesis"। তবে পাখিদের রঙের ঔজ্জ্বল্য, সুরেলা কণ্ঠ কিংবা পেখমের বাহার এই সবই এক একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা স্ত্রী প্রাণীদের স্নায়ুতন্ত্রকে বিশেষ ভাবে উদ্দীপিত করে। ফলস্বরূপ তারা আকৃষ্ট হয়। 

পরিশেষে একথা বলা যায় যে মানুষ যদি রুপের বা গুণের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার সঙ্গী নির্বাচন করে তাহলে তাকে বোকা বলে প্রতিপন্ন না করে বলা যায় যে অর্থের তুলনায় গুণের বা কখনো কখনো রুপের কদর সমগ্র জীব জগতেই স্বীকৃত। প্রাচীন আমলের ধারণা যা মানবজীবনে আজ ও ক্ষেত্র বিশেষে রয়ে গেছে তা হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষেরাই পাত্রী নির্বাচন করবে, তার বাড়িতে গিয়ে পেটপূজা সেরে পাত্রী কে দেখে তার বিশেষ দোষ-গুণ বিচার করতে বসবে। সমগ্র জীবজগত এই ব্যবস্থার মূলে অতন্ত্য যুক্তির সাথে যেমন কুঠারাঘাত করেছে তেমনি নারী পুরুষের সমানাধিকারের বার্তাও বহন করে চলেছে সযত্নে।।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments