জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-(৫৫)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-(৫৫)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্ম ও মুক্তচিন্তা


জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাথমিক লক্ষ্য সত্য আবিষ্কার। আর এ লক্ষ্যে পৌঁছোবার জন্য অপরিহার্য মু্ক্তচিন্তা। কারণ জ্ঞানের রাজ্যে চিরসত্য বা অন্তিম সত্য বলে কিছু নেই। জ্ঞান অনন্ত ও অসীম। জ্ঞানের ক্রমবিকাশের মাধ্যমে পুরাতন সত্যকে উত্তরণ করে নূতনতর সত্যের আবিষ্কারই মানব সভ্যতার বিবর্তনের পথে প্রগতির লক্ষণ। আর নবলব্ধ সত্যজ্ঞানের মাধ্যমেই ন্যায়ের ভিত্তিতে, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ভিত্তিতে, মানব সমাজের নিরবিচ্ছিন্ন পুনর্নির্মাণ সম্ভব। মুক্তচিন্তার সহস্রধারা মানুষের সত্যসাধনাকে সঞ্জীবিত রাখে। কিন্তু ইতিহাসের আদিকাল থেকেই ধর্ম মানুষের মুক্তচিন্তাকে স্তব্ধ করে রেখে সেসব কুশিক্ষাই দিয়েছে যা নাকি মানব সমাজের স্থিতাবস্থা বজায় রেখে শাসক শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থকে সুরক্ষিত এবং সমৃদ্ধ করতে পারে। 
একথা সহজেই বোঝা যায় যে জন্মলব্দ্ধ ধর্ম মানুষের মুক্তচিন্তার পরিপন্থী। কারণ শিশুর জ্ঞান হবার আগেই তার একটা ধর্ম লাভ হয়। তার বাবা-মা, আত্মীয় পরিজন তাকে একটা বিশেষ ধর্মের যাঁতাকলে ফেলে ধর্মীয় নাম থেকে শুরু করে অনেকগুলো ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে বড়ো করে তোলে। এক বিশেষ ঈশ্বর, বিশেষ ধর্মগ্রন্থ, বিশেষ পোশাক পরিচ্ছদ, বিশেষ খাদ্যাভাস, বিশেষ প্রার্থনা, এবং একগুচ্ছ বিশেষ অন্ধবিশ্বাসে কুশিক্ষিত হয়ে সে বড় হয়ে ওঠে। সমাজ ও রাষ্ট্র এসবের ভিত্তিতে ব্যাক্তিমানুষকে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সদস্য রূপে চিহ্নিত করে। আর এই সাম্প্রদায়িক অবস্থানের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ফলাফল ব্যক্তিমানুষের জীবনে হয়ে দাঁড়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদুরপ্রসারী। অথচ ধর্মের মতো জীবনের এতো বড়ো একটা মৌলিক বিষয় নির্বাচনে ব্যক্তিমানুষের কোন স্বাধীনতাই নেই। কারণ অতি নগন্য সংখ্যক ক্ষেত্রে ছাড়া মানুষ জন্মলব্দ্ধ ধর্মকে মাতৃদুগ্ধের মতোই আপন করে নেয়। আশৈশব পারিবারিক মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে একগুচ্ছ অন্ধবিশ্বাসকে ভালোবেসে আপন করে এক বিকৃত ব্যক্তিত্ব নিয়ে সে বড়ো হয়ে ওঠে। মুক্তচিন্তার অবর্তমানে গড়ে ওঠা মানুষের এই ধর্মীয় পরিচয় প্রথম থেকেই মানব সমাজে কৃত্রিম বিভাজন সৃষ্টি করে, আর সমাজ ও সভ্যতার গভীরে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় মৌলবাদ সহ অনেক সংকট-সংঘাতের জন্ম দেয়। এভাবে জন্মলব্ধ ধর্ম ও ধর্মান্ধতা মানুষের মুক্তচিন্তার পথে এক বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, আর প্রতিহত করে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্বচ্ছন্দ বিকাশকে। 
পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্মভিত্তিক যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, তার পেছনে অবশ্য ধর্মান্ধতাই একমাত্র কারণ ছিলো না। অনেক ক্ষেত্রেই আর্থিক ও রাজনৈতিক লাভের হিসেব এবং শ্রেণীস্বার্থ কাজ করেছে। কিন্তু ধর্মান্ধতা ও ধর্মদ্বেষ যে এসব সংঘাত ও লোকক্ষয়ের সমর্থনে ব্যবহৃত হয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া রাষ্ট্র এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্ঘবদ্ধ অত্যাচারে অগণিত মানুষ দগ্ধ নিহত নির্যাতিত হয়েছে। মুক্তচিন্তার পরিপন্থী জন্মলব্দ্ধ ধর্মবিশ্বাস এই নরমেধ যজ্ঞে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। তবে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐতিহাসিক সংঘাত এখানে আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় নয়, যদিও এ ইতিহাস পরোক্ষ ভাবে মুক্তচিন্তার প্রতিকূল প্রবাহেরই ইতিহাস। মুক্তচিন্তক মানুষ এবং তাদের যুক্তিধর্মী মতবাদকে স্তব্ধ করে দেবার উদ্দেশ্যে ধর্মের ঐতিহাসিক ব্যবহারই বর্তমান পরিচ্ছদে আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয়। 
প্রাচীন ভারতে যে যুক্তিধর্মী সমাজ দর্শন নিয়ে শাসকশ্রেণী ও রাষ্ট্র বিশেষ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলো, তা ছিল চার্বাকবাদ। বেদ ও ধর্ম বিরোধী, নাস্তিকতাবাদী, যাগ-যজ্ঞ, পূজাপার্বণ এবং শাস্ত্রসহ সমস্ত ক্রিয়া-কলাপ বিরোধী, জাতিবর্ণভেদ বিরোধী এবং স্ত্রী-পুরুষ সাম্যের সমর্থক চার্বাকবাদ বেদ ও চাতুর্বর্ণ্য ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূলে কুঠারাঘাত করতে উদ্যত হয়েছিলো। আর চাতুর্বর্ণ্য ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ছিলো আর্য শাসক শ্রেণীর দমন-পীড়ন-শোষণের আধার অসম আর্থসামাজিক কাঠামোর তাত্ত্বিক মুখোশ। তাই সুংগ যুগ থেকে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম ও চার্বাকবাদ সহ চাতুর্বর্ণ বিরোধী সমস্ত ধর্মীয় এবং  অধর্মীয় মতবাদকে শাসক শ্রেণী রাষ্ট্রশক্তির মাধ্যমে ধ্বংস করতে সুপরিকল্পিত প্রয়াস চালায়। বৌদ্ধ ধর্ম এর পরেও কয়েকশো বছর বেঁচে ছিলো, কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের চেয়ে অনেক বেশি চরমপন্থী চার্বাকবাদ শাসক শ্রেণীর এই আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়। অন্যান্য সমস্ত দর্শনের মূল গ্রন্থগুলো আজও বেঁচে আছে, কিন্তু গুপ্ত যুগের পরে চার্বাকবাদের মূল গ্রন্থগুলোর আর কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। এ অনুমান যুক্তিসম্মত যে রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণী সহ ব্রাহ্মণ্যবাদের উগ্র প্রবক্তারা সব চার্বাকগ্রন্থ ধ্বংস করে ফেলেছিলো। ভগবতগীতা তেও চার্বাকবাদীদের উদ্দেশ্যে শ্রীভগবান চরিত্রের মুখে এই ঘোর সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে যে এসব অবিশ্বাসীদের শ্রীভগবান জন্মে জন্মে বারংবার নরকের নিক্ষেপ করবেন। মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্বে কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরের উপস্থিতিতে এবং সমর্থনে ব্রাহ্মণদের দ্বারা চার্বাকবধের যে কাহিনী আছে, তার মধ্যে সম্ভবত কিছু ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে আছে। এভাবে প্রাচীন ভারতে চার্বাকবাদকে ধ্বংস করার পেছনে শাসক শ্রেণীর এই আশঙ্কাই কাজ করছিলো যে এই সমাজ দর্শনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে প্রচলিত চাতুর্বর্ণ্য ভিত্তিক অসম আর্থসামাজিক কাঠামোই ভেঙ্গে পড়বে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments