জ্বলদর্চি

সামাজিকতা: মানুষ বনাম জীবজগত /নিশান চ্যাটার্জী

জীবনের গভীরে বিজ্ঞান- ৪

সামাজিকতা: মানুষ বনাম জীবজগত

নিশান চ্যাটার্জী

সামাজিকতা যেমন মানুষের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি পশুপাখিদের জীবনেও সামাজিকতা অতন্ত্য গুরুত্বপূর্ণ। দিনে দিনে মানবজীবনে এই বিশেষ বিষয়টি ক্ষয়িষ্ণু। মানুষ বর্তমানে নিজেকে সামাজিক জীব বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলেও, একাকীত্বেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নিজস্ব সুখস্বাচ্ছন্দ্য মানুষ সবথেকে গুরুত্ব দিয়ে বর্তমানে বিবেচনা করছে। ফলস্বরূপ তার প্রভাব প্রকৃতির ওপরেও পড়ছে। নিজস্ব সুখস্বাচ্ছন্দ্য কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে জেনে বা অজান্তেই উদাসীন থাকছে। তাই তো রাস্তায় কোনো মানুষ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে, তা না দেখার ভান করে চলে যাওয়াটাই  বর্তমানে স্বাভাবিক আচরণ। কিংবা কোনো প্রতিবেশী যদি তার অন্ন জোটাতে ব্যর্থ হন, অনান্যরা তার দিকে ফিরেও তাকান না। সৃষ্টির আদি থেকে মানুষ কিন্তু সমাজবদ্ধ জীবই ছিল। 

কিন্তু কালক্রমে অন্যান্য জীবেরা সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চললেও মানুষ তার থেকে বহু ক্রোশ দূরে সরে যাচ্ছে। মৌমাছি, পিঁপড়ে সহ বহু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীরা কিন্তু এই সামাজিকতা কে আজও সযত্নে পালন করে চলেছে। বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা যাকে বলি "অলট্রুইজম" ("Altruism") অর্থাৎ একে অপরের খেয়াল রাখা। বিজ্ঞানী উইলসন তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন ভ্যাম্পায়ার বাদুড় যারা রক্তকেই প্রধান খাদ্য উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছে, তারা একটানা ৭০ ঘন্টা যদি রক্তপান না করে, তাহলে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সেক্ষেত্রে কোনো আহত ভ্যাম্পায়ার যদি খাদ্য সংগ্রহে ব্যর্থ হয়, তাহলে অন্য সুস্থ ভ্যাম্পায়ার দ্বারা সংগৃহীত খাদ্য এরা ভাগ করে খায়। একথা মনে রাখা প্রয়োজন, শ্রেণীগত অবস্থানের দিক থেকে বাদুড় এবং আমরা কিন্তু একই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু চেতনায় কতটা ফারাক! যদি ক্ষুদ্র প্রাণী মৌমাছির দিকে তাকাই তাহলে লক্ষ্য করবো যে একটা মৌচাকে বিভিন্ন শ্রেণীর মৌমাছি থাকে- রাণী, পুরুষ, কর্মী। প্রত্যেকের নিজস্ব কাজ বা ভূমিকা রয়েছে যার মাধ্যমে তারা একত্রিত ভাবে অবস্থান করে। কেউ কিন্তু কারোর ভূমিকাকে অবহেলা করেনা। বিজ্ঞানী কার্ল ভন ফ্রিশ তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছিলেন, কর্মী মৌমাছিরা যখন খাদ্য সংগ্রহে বেরিয়ে খাদ্যের উৎস সন্ধান করে ফিরে আসে তখন অনান্য কর্মীদেরও সেই বার্তা তারা দায়িত্ব সহকারে পৌঁছে দেয়। মানুষ কিন্তু সীমিত খাদ্যের সন্ধান অন্যদের জানিয়ে সেই সামাজিক ভূমিকা পালন করেনা। এক্ষেত্রে মৌমাছিরা এক বিশেষ নৃত্য প্রদর্শন করে এবং চাকের অন্য মৌমাছিদের সেই নৃত্যের মাধ্যমে খাদ্য উৎসের দূরত্ব ও দিক সম্পর্কে স্বচ্ছ বার্তা দেয়। ফলে অনান্যরাও তা সংগ্রহ করে মৌচাকে আনতে পারে এবং সকলে ভাগ করে তা ব্যবহার করতে পারে। 

এই গবেষণার জন্য বিজ্ঞানী কার্ল ভন ফ্রিশ নোবেল পুরস্কার পান। একে বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি " Bee Language" বা " Bee Dance"। আসুন বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আমাদের নিকটবর্তী পূর্বপুরুষের দিকে একবার তাকাই। ভারভেট(Vervet) প্রজাতির বানরেরা যদি, তাদের ক্ষতি করতে পারে এমন কিছুর হদিস পায়, তাহলে এক বিশেষ ডাক সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের প্রজাতির অন্যান্যদের সাবধান করে দেয়। অন্যদিকে আমরা একে অন্যকে বিপদে পড়তে দেখলে বাড়ির জানালাটি পর্যন্ত লাগিয়ে নিজেদের নিরাপদ রাখার চেষ্টা করি। আবার মৌমাছি, পিঁপড়ে বা বোলতা এদের মধ্যে যারা বন্ধ্যা হয়, তারা কিন্তু রাণীদের সাহায্য করে চলে বংশবিস্তারের জন্য সামগ্রিকভাবে। এক্ষেত্রে তারা যদি স্বার্থপর হতো তাহলে যৌথ পরিবারের মতো মৌচাকও আর দেখা যেতো না। মাকড়সার এরকম একাধিক প্রজাতি রয়েছে যারা একসাথে অনেকে মিলে তাদের জাল বোনে এবং একত্রে শিকার সংগ্রহ করে। এই ধরনের জাল বোনা কে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় "Communal Web Construction"। বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল তার গবেষণাপত্রে ১৯৭৯ সালে প্রকাশ করেছেন যে - আন্টার্টিক মাছেদের একটি বিশেষ প্রজাতির স্ত্রী প্রাণীরা ডিম পাড়ার পর যদি কোনো কারণে মারা যায় সেক্ষেত্রে পুরুষ মাছই তার সন্তানদের দেখভাল করে। 

       আমরা অনেক সময় কোনো ধূর্ত ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপ বোঝাতে কোকিলের, কাকের বাসায় ডিম পাড়ার উদাহরণ দিয়ে থাকি। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানি না বিজ্ঞানী ডেভিস ১৯৪২ সালে প্রমাণ করেন কোকিলের বিশেষ কিছু প্রজাতির স্ত্রী পাখিরা একসাথে মিলে বাসা তৈরি করে ও ডিম পাড়ে। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় "Communal Nest"। অন্যদিকে বিশেষ কিছু পাখিদের প্রজাতিতে দেখা গেছে, যখন স্ত্রী পাখির অনুপস্থিতিতে কোনো খাদক তার বাসার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে তখন অনান্য পাখিদের সম্মিলিত বিশেষ ডাক, স্ত্রী পাখিটিকে সচেতন করে এবং সে যদি অন্যত্র থাকে তবে তক্ষুনি তার বাসায় ফিরে আসে।

       বেশীরভাগ এই উদাহরণ গুলি থেকে একথা স্পষ্ট যে, এই একত্রিত থাকার প্রধান সুবিধা হলো শত্রুর হাত থেকে রক্ষা এবং নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা। এই তাগিদটাই এদের সমাজবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে এবং একই সঙ্গে আমাদেরও এই শিক্ষা দিচ্ছে যে সমাজে সকলকে নিয়েই চলতে হবে। এ সমাজে একজন ঝাড়ুদারের যা মূল্য একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির ও সেই মূল্য হওয়া উচিত কারণ প্রত্যেকেরই প্রত্যেককে প্রয়োজন। খাদ্যশৃঙ্খলের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রতিনিধি ক্ষতিগ্রস্ত হলে যেমন গোটা বাস্তুতন্ত্র তথা পরিবেশটাই ভেঙে পড়ে তেমনি সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে যদি সাহায্যের মনোভাব না থাকে, তাহলে একদিন না একদিন তার প্রভাব প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনেই পড়তে বাধ্য যা সামগ্রিক ভাবে আমাদের সামাজিক জীব হিসেবে গর্বটাকে চূর্ণ করতে পারে। যদি আমরা একে অপরের মূল্য সঠিক ভাবে নির্ধারণ করতে পারি তাহলেই সামগ্রিক ভাবে এই সমাজের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments