জ্বলদর্চি

বন খেজুর বা খুদি খেজুর /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ২৪

বন খেজুর বা খুদি খেজুর

সূর্যকান্ত মাহাতো


রাস্তার গায়ে পড়ে একটা ছোট শাল জঙ্গল। নতুন কচি পাতাগুলো  বৃষ্টির জল পেয়ে বেশ পুষ্ট হয়ে উঠেছে। ভোরের এই নরম আলোতেও বেশ চকচক করছে। সকালের নরম আলোটার সঙ্গে সবুজের এই পরিবেশটা বেশ মানানসই। কিন্তু হেথা হোথা একটা লালচে হলুদ রং বড্ড বেমানান হয়ে বারবার চোখ টেনে নিচ্ছে। লেখা ভর্তি খাতার পাতায় কাটাকুটিগুলি যেমন বারবার চোখ টেনে নেয়, অনেকটা সেইরকম। ঘন সবুজ পাতাগুলোর ফাঁকে ফাঁকেই ইতি উতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মুখ তুলে আছে লালচে হলুদ রঙের ঝোঁকাগুলো। হলুদ ঝোঁকাগুলোর মাঝে মাঝেই কয়েকটা কালো কালো বিন্দু। দূর থেকে অন্তত এরকমটাই মনে হয়। যেন প্রকৃতির বুকে আঁকা কোনও এক রঙিন পটচিত্র। লালচে-হলুদ আর কালো রঙের ঐ স্পটগুলো আর কিছুই নয়। ওগুলো হল, "বন খেজুর"। বাংলাদেশে একে "খুদি খেজুর" নামে ডাকা হয়। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম হল, Phoenix aculis (ফনিক্স অ্যকুলিশ)।

বেশ ছোট ছোট আকারের গাছগুলো। সাধারণ খেজুর গাছের বামন রূপ বলা যেতে পারে। অনেকটা ডিঙ্গি বা নৌকার খোলের মতো পাতাগুলো। সরু সরু। লম্বা লম্বা। ডগাটা কাঁটাযুক্ত। সাধারণ খেজুর গাছের পাতার মতো অতটা দৃঢ় বা শক্ত নয়। বরং অনেকটাই নরম। বন খেজুরের গাছগুলোর তেমন একটা কান্ড হয় না। তাই সচরাচর খাঁজ কাটা খাঁজ কাটা শরীর বলে এদের কিছু নেই।  মাটির কিছুটা উপর থেকেই ফোয়ারার মতো বেরিয়ে আসে ডালগুলো। তাদের মাঝখান দিয়েই লালচে হলুদ রঙের বিশেষ একটা কান্ড বেরিয়ে আসে। যার ডগায় ঝোঁকা হয়ে ফুল ও ফলগুলো ধরে। গাছের ডালগুলোর সঙ্গে ওগুলোও ফোয়ারার মতো গাছের গোড়া থেকেই বাইরে বেরিয়ে আসে। প্রথমে ফলসহ কান্ডটা সবুজ থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ফল যত পরিপক্ব হতে থাকে ততই রঙের পরিবর্তন ঘটে। একটু একটু করে লালচে হলুদ হয়ে ওঠে। মনে হবে কে যেন সূর্যাস্তের গোধূলি রঙ মাখিয়ে দিয়েছে।

পাকা ফলগুলোও দারুণ। একেবারে কুচকুচে কালো। লালচে হলুদ রঙের ডাসালো ফলগুলোর মাঝে মাঝেই পাকা ফলগুলো যেন কালো কালো বিন্দু। আবার সবগুলো পেকে গেলে হলুদের উপর কালো রঙের ফলগুলো তখন একটা আলাদা রকমের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়। খুব ছোট ছোট ফলগুলো দেখতেও বেশ।  অনেকটা ডিমের আকারের। পাতলা খোসা। তেমন একটা শাঁস বা মাংস নেই। তবে আকারে ছোট বলেই হয় তো মাংস কম থাকে।

এবার আসি স্বাদের কথায়। সাধারণত খেজুর কে চিনির বিকল্প  রূপে মানা হয়। এতেই প্রমাণিত হয় এর মিষ্টতা কতখানি। "বন খেজুর" বা "খুদি খেজুর" স্বাদে সত্যিই অতুলনীয়। কাঁচা বা ডাসালো অবস্থায় একটুখানি কষাটে হয় ঠিকই। তবে পাকলে যে কি পরিমাণ মিষ্টি তা না খেলে বলে বোঝানো যাবে না।

জঙ্গলে গোরু ও ছাগল চরাতে গিয়ে বাগালেরা মাঝেমধ্যেই এই খেজুর পাকা খেয়ে থাকে। এতে অনেকক্ষণ ক্ষুধা নিবারণ করা যায়। এমন অনেক দিন গেছে যখন বাগালেরা অধিকাংশ দিন এই খেজুর পাকা খেয়েই কাটিয়ে দিত। কি যে খুশি হত তারা! একথা জানাতে গিয়ে গ্রামের অজিত খুড়ো বেশ নস্টালজিক হয়ে পড়লেন। জঙ্গলের পাতাকুড়ানিরাও পাতা তুলে ক্লান্ত হয়ে পড়লে গাছের ছায়ায় বসে একটুখানি বিশ্রাম নেয়। বসে বসে তখন এই খেজুর পাকা খেয়েই আরাম পায়। শরীর ও মনে একটুখানি বাড়তি বলও পায়।


এই খেজুর পাকা কেবল আমরাই খাই না। অত্যন্ত মিষ্টি বলে এই খেজুর পিঁপড়েদেরও অত্যন্ত প্রিয়। কিছু কিছু পাখিও এই ফল খায়।

পথচলতি মানুষেরাও এই খেজুর পাকা দেখলে দাঁড়িয়ে পড়েন।নিজেরাই হাতে তুলে পাকা পাকা কালো রঙের এই "বন খেজুর" খায়। বাচ্চাদের জন্য বাড়িতে নিয়েও যায়। এই যেমন গ্রামের শ্যামলী বাপের বাড়ি ফিরছিল। জঙ্গলে পাকা বন খেজুর দেখতে পেয়েই বরকে চেঁচিয়ে বলে উঠল, "এই, বাইক থামাও! বাইক থামাও!"
শ্যামলী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে করতে বলল, "বন খেজুর! আহা! কতদিন খাইনি!"

ওর বর "বন খেজুর" ইতিপূর্বে চোখেই দেখেনি। তাই সেও দেখে অবাক। এত ছোট আর এত কালো রঙের খেজুর যে হতে পারে দেখে তো প্রথমটাই বিশ্বাসই করতে পারছিল না। তারপর গাছটা দেখে বিশ্বাস হল। একেবারে বামন আকারের ছোট ছোট খেজুর গাছগুলো। ছোট ছোট শাল গাছের ঝোপের আড়ালেই মাথা তুলে আছে। তবে স্বাদটা বড়ই মিষ্টি। বেশ জিভে লেগে আছে। যেগুলো এখনও পাকেনি তাদের রং বেশ  লালচে হলুদ। কতকগুলো আবার পাকবে বলে সবে রং পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। একটু একটু করে কালো হয়ে উঠছে।

কী আছে এই ফলে? এটা না বলে বোধ হয় বলা যেতেই পারে, কী নেই এই ফলে? ফ্রুকটোজ আর গ্লাইসেব্রিক সমৃদ্ধ বলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি করে। শরীরের দুর্বলতা কাটাতেও এই খেজুর দারুণ উপকারী। তাছাড়া শক্তির উৎস হিসাবে সব ধরনের খেজুরই যে দারুণ উপকারী সে তো কবেই প্রমাণিত হয়েছে। এই "বন খেজুর"ও তার ব্যতিক্রম নয়। সেইসঙ্গে আছে ভিটামিন এ, বি ওয়ান, বি টু, বি থ্রী, বি ফাইভ, বি সিক্স, বি নাইন, সি, ই, কে। আছে বিভিন্ন ধরনের খনিজ। ক্যালরি, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফাইবার এবং জল তো আছেই।

বিশ্বে মোট তিন হাজার প্রজাতির খেজুর রয়েছে। তার মধ্যে কালো রঙের প্রজাতির খেজুর হল স্বাদে ও গুণে সেরার সেরা। যেমন "আজওয়া" প্রজাতির খেজুর হল সব থেকে শ্রেষ্ঠ খেজুর। এই খেজুরের রং অত্যন্ত কালো। আমাদের জঙ্গলমহলের পাকা বন খেজুরের রংও হল কুচকুচে কালো। তাই এর স্বাদ ও গুনাগুন অতুলনীয়।


 শ্রীলঙ্কান খেজুরের সঙ্গে জঙ্গলমহলের এই বন খেজুরের গাছ ও ফলের বেশ কিছুটা মিল লক্ষ্য করা যায়। দুটোই প্রায় একই প্রজাতির। তবে খেজুর ফলের রঙের দিক থেকে দুটোই একেবারে ভিন্ন। শ্রীলঙ্কান খেজুরগুলোর রং পাকা অবস্থায় উজ্জ্বল লাল বর্ণের হয়। আর জঙ্গলমহলের বন খেজুরগুলো চকচকে কালো রঙের। এই যা তফাৎ।


গ্রীষ্মের জৈষ্ঠ্য মাসের ভ্যাপসা গরমে এখন সকলেই রকমারি আম আর লিচুতে মজে আছে। নয় তো আরবিয়ান প্যাকেট খেজুর খেয়ে পরিতৃপ্তি লাভ করছে। এদিকে অপাংক্তেয় হয়ে জঙ্গলে পড়ে আছে অত্যন্ত স্বাদ ও গুণে ভরপুর এই "বন খেজুর"। জঙ্গলমহলের এমন অনেকেই আছেন যারা এখনও এর স্বাদ গ্রহণ করেনি।

২০০৯ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত "উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ" গ্রন্থে এই গাছকে বিপন্ন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশ এই গাছ সংরক্ষণের কথা ভাবছে। কিন্তু আমরা! বড়ই উদাসীন। কারণ অযাচিত ভাবে আমাদের জঙ্গলমহলের জঙ্গলগুলোতে যত্র তত্র গড়ে উঠে এই গাছ। এই জন্যই কি? ওরা নিজেদের মতো করে জন্মায় আবার মারাও যায়। আলাদা করে এই গাছের কথা সেরকম ভাবে কেউ ভাবেই না। কেবল  ফল পাকলে কয়েকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এই যা। এর বেশি কিছু নয়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments