জ্বলদর্চি

প্রথম মহিলা বাঙালি-বৈজ্ঞানিক ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায় ― ০৯/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৬৪


প্রথম মহিলা বাঙালি-বৈজ্ঞানিক ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায় ― ০৯

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

(১)
'আয়ু' শব্দের অর্থ 'জীবন' আর 'বেদ' শব্দের অর্থ 'জ্ঞান' বা 'বিদ্যা'। 'আয়ুর্বেদ' শব্দের সম্পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় 'জীবনজ্ঞান' বা 'জীববিদ্যা'। যে-জ্ঞানের দ্বারা জীবের কল্যাণ সাধন ঘটে, তা-ই আয়ুর্বেদ বা জীববিদ্যা। ভেষজ কিংবা উদ্ভিদের মাধ্যমে চিকিৎসার অপর নাম আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা। পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো এই চিকিৎসা শাস্ত্র। পবিত্র বেদ-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের নাম 'অথর্ববেদ'। অথর্ববেদ-এর যে অংশে চিকিৎসা বিদ্যা বর্ণিত রয়েছে, তার নাম আয়ুর্বেদ। আদি যুগে প্রাচীন ভারতবর্ষের বনেবাদাড়ে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন গাছগাছড়া দিয়ে মানুষ তার রোগের চিকিৎসা করত। সেজন্য প্রাচীন কালে দারুণ প্রসিদ্ধি লাভ করে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা। কালের গড্ডালিকা প্রবাহে, যদিও প্রচারের অভাবে ক্রমবর্ধমান হোমিওপ্যাথি আর এলোপ্যাথি ওষুধপত্রের খ্যাতির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় আয়ুর্বেদ চিকিৎসা।  

অথচ, আয়ুর্বেদিক ওষুধ সম্পূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত। বর্তমানে এটি হার্বাল চিকিৎসা নামে বহুল আলোচিত এবং প্রচলিত। এ হেন ওষুধপত্রের দারুণ চাহিদা আজকাল। অথচ স্বাধীনতার পূর্বে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের রমরমা অপরিচিত ছিল। আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে যে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা হতে পারে, তার ন্যূনতম ধারণা ছিল না দেশের অধিকাংশ মানুষের মনে। হাতে গোনা অল্প ক'জন বৈজ্ঞানিক তখন দেশে আয়ুর্বেদ গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন। এদের অন্যতম রসায়ন বিজ্ঞানী অধ্যাপিকা অসীমা চ্যাটার্জি মহাশয়া। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের সঙ্গে দেশের মানুষ আর ক্ষমতাসীন সরকারকে নতুনভাবে পরিচয় করালেন তিনি। মারসিলিন, আয়ুষ-৫৬ আর আয়ুষ-৬৪ এই তিনটি আয়ুর্বেদ ওষুধ উদ্ভাবন নিঃসন্দেহে দেশের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আমজনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওষুধ তিনটি আবিষ্কারের সৌজন্যে রাতারাতি খ্যাতির শিখরে পৌঁছে যান অসীমা দেবী। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করে ― আয়ুর্বেদ শাস্ত্র। দেশে আয়ুর্বেদের নতুন নতুন শাখার শুভ সূচনা ঘটে। তৎকালীন ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব রিসার্চ ইন আয়ুর্বেদ অ্যান্ড সিদ্ধা এবং জাতীয় গবেষণা উন্নয়ন পর্ষদ (NRDC) শ্রীমতী চ্যাটার্জির আবিষ্কৃত ওষুধগুলির পেটেন্ট গ্রহণ করে। দেশবিদেশের ওষুধের অনেক ব্যাপারী, বহুজাতিক কোম্পানি কিংবা সংস্থা আয়ুর্বেদের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
        

সরকার বাহাদুরের সদিচ্ছার প্রতি আস্থা রেখেই অসীমা দেবী আয়ুর্বেদ সংস্থা প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দিলেন; যেখানে আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা জারি থাকবে এবং রাজ্যের মানুষ আয়ুর্বেদ ওষুধপত্রের সাহায্যে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার সুফল ভোগ করবে। শ্রীমতী চ্যাটার্জির উদ্দেশ্য অত্যন্ত মহৎ এবং সুদূরপ্রসারী, কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু নিজের ভাবনা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সাহসিকতার প্রশ্ন এখানে নয়। লাখ টাকার প্রশ্ন হল, কীভাবে সম্ভব হবে এর বাস্তবায়ন? সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ বিনা বাস্তবে অসম্ভব এ হেন পরিকল্পনার সফল রূপায়ণ! তবে আশার কথা― এগিয়ে এল সরকার।

সময়টা ১৯৭৪ সাল। ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলের পিছনে জগন্নাথ দত্ত লেন। সেখানে একটি বাড়ি অধিগ্রহণ করে রাজ্য সরকার। অধিকৃত বাড়িটির অর্ধেকটা জুড়ে আয়ুর্বেদ সংস্থা গড়ে ওঠে। মনঃপুত হল না অসীমা দেবীর। গবেষণার মুক্ত পরিসরের বড্ড আকাল। সংস্থা গড়ে তোলার জন্য যতটা জায়গার প্রয়োজন ছিল, তার তুলনায় অধিকৃত বাড়ির অর্ধেকাংশ নিতান্তই সংকীর্ণ। এখানে অধ্যাপিকার পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত একপ্রকারে অসম্ভব। অগত্যা উপায় কী? এরই মধ্যে গঙ্গায় অনেক জল গড়িয়ে গেছে বহুদূর। রাজনীতির পট পরিবর্তন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে তখন মাননীয় জ্যোতি বসু বিরাজমান। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর এজলাসে জমির জন্য আবেদন করে বসলেন শ্রীমতী অসীমা চ্যাটার্জি।

মিলল সম্মতি। চিহ্নিত হল জমি। ঝোপঝাড়ে ভর্তি সল্টলেক এলাকার সেক্টর ফাইভ অঞ্চলে সাড়ে তিন একর জমি বরাদ্দ হয়েছে আয়ুর্বেদ সংস্থা গড়ে তোলার জন্য। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক থেকে বরাদ্দ হল বিশাল অঙ্কের টাকা। চার কোটি টাকা! ভবন নির্মাণের জন্য বিরাট অঙ্কের টাকা অনুমোদন হয়ে এল। কেন্দ্র-রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠল আয়ুর্বেদ গবেষণা কেন্দ্র। বর্তমানে এটি 'ন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব আয়ুর্বেদ ফর ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট'-এ পর্যবসিত। এখানে আয়ুর্বেদ হাসপাতাল আর গবেষণা ব্যতীত রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা এবং ভারতের ভেষজ গাছপালা থেকে ওষুধপত্র তৈরির গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে।

(২)
গবেষণায় নিরলস কাজের স্বীকৃতি হিসাবে মিলেছে একগুচ্ছ সম্মাননা-পুরস্কার। বেড়েছে খ্যাতি। ১৯৬০ সালে  ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন ড. অসীমা চ্যাটার্জি। ১৯৬১ সালে তাঁর সাফল্যের পালকে বড় সংযোজন― সি এস আই আর কর্তৃক ভারতের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক সম্মান শান্তিস্বরূপ ভাটনাগর পুরস্কার লাভ। ১৯৭৪ সালে ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির স্যার পি সি রায় পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ১৯৭৫-এ দিল্লিতে ৬২তম ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সাধারণ সভাপতি নির্বাচিত হন। একই বছরে তিনি বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স-এর উইমেন অব দ্য ইয়ার (Women of the Year) নির্বাচিত হন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি, কল্যাণী ইউনিভার্সিটি আর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ১৯৭৬, ১৯৮২, ১৯৯৯ ও ২০০৬ সালে সাম্মানিক ডি এস সি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে ভারত সরকার তাঁকে 'পদ্মভূষণ' উপাধিতে সম্মানিত করে। ১৯৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবনমোহিনী দাস স্বর্ণপদক (বাংলার ভারতীয় বনৌষধি লেখার জন্য) লাভ করেন তিনি। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে তাঁকে মনোনীত করেন স্বয়ং ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি। 
           


এছাড়াও, ইউ জি সি থেকে 'সি ভি রামন' পুরস্কার, ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সর্বোত্তম পুরস্কার 'স্যার আশুতোষ মুখার্জি স্মারক স্বর্ণপদক', অল ইন্ডিয়া ইউনিট থেকে 'ইন্দিরা গান্ধী প্রিয়দর্শিনী' পুরস্কার, সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন আয়ুর্বেদ ও সিদ্ধার সিলভার জুবিলী পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'এমিনেন্ট টিচার' পুরস্কার, ওয়েস্ট বেঙ্গল একাডেমি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির একাডেমি পুরস্কার সহ একগুচ্ছ পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। ১৯৯২ সালে রসায়ন বৈজ্ঞানিক হিসাবে লাভ করেন কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক এবং গোয়েল পুরস্কার। ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি তাদের প্লাটিনাম জুবিলী উদযাপন উপলক্ষে ১৯৯৯তে জৈব রসায়ন গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার জন্য তাঁকে বিশেষ সম্মানে সম্মানিত করে। একই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান গবেষণায় তাঁর অবদানের জন্য স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৯৯তে কলকাতা সংস্কৃত কলেজের ১৭৫তম বর্ষপূর্তিতে তাঁকে বিশেষ 'বিজ্ঞান ভারতী' পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০১ সালে পি সি চন্দ্র গ্রুপের পক্ষ থেকে পি সি চন্দ্র পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০০৬ সালে কলকাতা পুরসভার পক্ষ থেকে বিজ্ঞানী অসীমা চ্যাটার্জির বাড়িতে গিয়ে সম্মানীয় মেয়র শ্রী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য 'সম্মানিত নাগরিক পুরস্কার' প্রদান করেন তাঁকে।

মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার দিকে তাঁর বিশেষ নজর ছিল। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম পীঠস্থান বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে নানান পদে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আগ্রহে ও অনুপ্রেরণায় বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সঙ্গে অসীমা দেবীর যোগসূত্র গড়ে ওঠে। ১৯৫৮ সালে তিনি পরিষদের কার্যকরী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। পরের বছর থেকে সভাপতি, পরিষদের বিভিন্ন সভা, অধিবেশন, পুস্তক প্রকাশ, 'জ্ঞান বিজ্ঞান' পত্রিকার উপদেষ্টা, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য প্রভৃতি কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সহসভাপতি ছিলেন তিনি। এরপর তাঁর জীবনে হঠাৎ দুর্যোগ নেমে এল। অল্প দিনের ব্যবধানে পর পর বাবা আর স্বামীকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন তিনি। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সঙ্গে সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৭১-৭২ সালে কার্যকরী সমিতির সহসভাপতি হিসাবে পুনরায় পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হলেন। ১৯৭২-৭৩ সালে কার্যকরী সমিতিতে তিনি ছিলেন না। ১৯৭৪ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রয়ানের পর ১৯৭৪ সালের ৭ই মার্চ তিনি কার্যকরী সমিতির সদস্যরূপে মনোনীত হন। ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ অসীমা দেবীকে সর্বসম্মতিক্রমে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু পরবর্তী বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত করা হল। 
         


অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন অধ্যাপিকা অসীমা চ্যাটার্জি। মাধ্যমিক স্তরের স্টুডেন্টদের জন্য বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাপিকা অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'মাধ্যমিক রসায়নবিদ্যা' পুস্তকখানি। সারাজীবনে তিনি একটি মাত্র পাঠ্যপুস্তক বাংলায় লিখেছেন। মাধ্যমিক রসায়নবিদ্যা প্রথম ভাগ নবম শ্রেণির পাঠ্য আর মাধ্যমিক রসায়নবিদ্যা দ্বিতীয় ভাগ দশম শ্রেণীর পাঠ্য। 

বিজ্ঞান সাধনার পাশাপাশি সঙ্গীতের প্রতি তাঁর তীব্র অনুরাগ ছিল। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, বিশেষত ধ্রুপদ আর খেয়ালে দীর্ঘ চোদ্দো বছরেরও বেশি সময় তালিম নিয়েছেন। সারা বাংলা সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় তিনি একবার দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভাবাদর্শ এবং স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। বাড়িতে বইয়ের র‍্যাকে স্বামী বিবেকানন্দের বইপত্রাদি সাজানো গোছানো থাকত।

(৩)
আশ্বিনের পূজার রেস সদ্য কেটে গেছে। মাঠের থেকে, খালপাড়ের জমি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে কাশফুল। ঘন নীল আকাশ থেকে সাদা পেঁজা মেঘ গায়েব। বাতাসে অল্প শীতের হালকা আমেজ। আশ্বিন, কার্তিক পেরিয়ে পৌষের আগমনে ঘন কুয়াশায় ঢাকছে সাঁঝের বাতি। রাত বাড়লে কনকনে হিমেল হাওয়ায় শরীরে-হাতে-পায়ে খসখস। অস্থির বাতাসে আর্দ্রতার নামগন্ধ নেই। দিনের নরম কোমল আলো মেখে খাঁ খাঁ করছে নিঃসঙ্গ মাঠ-ঘাট-আলপথ। হু হু বাতাস বইছে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে ধান-ওঠা ক্ষেতের জমি। নাড়া পোড়ানো মাঠের ভেতরে খেলা করে মেঠো-ইঁদুর। ছোট ছোট গম্বুজ তোলা মাঠের অল্প ফাটলে ছড়ানো ছেটানো ধানের শীষ আর বীজ। আগন্তুক দেখলে আলের গর্তে ধানের শীষ সমেত ঢুকে পড়ে মেঠো ইঁদুরের দল। আমড়া-নিম-শিমুলের পাতা ঝরে পড়ে। পাতা খসা শালের বনে কেউ যেন আগুন জ্বেলে দিয়েছে। দূর থেকে নিঃসঙ্গ মনে হয় জঙ্গলটাকে। পড়ন্ত শীতের বেলায় ডাংগুলি খেলতে ছুটে যায় অশান্ত এক পল্লী বালক। একটা বড় দুর্যোগ ওৎ পেতে থাকে।

কার্তিকের নবান্নের সে-দেশে অকস্মাৎ ঘনিয়ে আসে এক দুর্যোগ। ঘোরতর দুঃসময়। তাড়া করে বেড়ায় দুঃস্বপ্ন। তারিখটা ছিল বাইশে নভেম্বর। ২০০৬ সাল। কলকাতার নর্থ সিটি নার্সিংহোমে ভর্তি আছেন অশীতিপর এক বৃদ্ধা। শ্রীমতী অসীমা চ্যাটার্জি। বয়স ৮৯ বছর দুই মাস উত্তীর্ণ। সে-দিনটা ছিল বুধবার। রাত্রির চাপ চাপ অন্ধকার গ্রাস করেছে কলকাতার রাজপথ, অলিতে-গলিতে-মোড়ে সর্বত্র। বড্ড নির্জন, নিস্তব্ধ আর মায়াবী সে-রাত। ঘড়িতে তখন ভোর আড়াইটা বাজে। সে-ক্ষণেই নিভে গেল বর্ষীয়ান বৈজ্ঞানিকের জীবনবাতি। নার্সিংহোমের চৌহদ্দিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন শ্রদ্ধেয়া অসীমা চ্যাটার্জি। কাকপক্ষীও টের পেল না। নিঝুম রাত্রি আর কনকনে ঠাণ্ডা একমাত্র সঙ্গী তখন। সারাজীবন হই-হট্টগোলের আড়ালে নিজেকে গবেষণায় ব্যস্ত রাখা এক মহিলা বৈজ্ঞানিকের এভাবে চলে যাওয়া বাঙালির অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর অভাব কোনও দিন পূরণ হবার নয়। 
          


অথচ, তাঁর আত্মা অমৃতলোকে পাড়ি দেওয়ার পর সেদিন সকাল থেকে কলকাতা-সহ গোটা দেশ বাকহারা। রেডিও-টেলিভিশন-কাগজে কেবল ব্রেকিং নিউজ। বাঙালি আবারও একবার অভিভাবকশূন্য। বাঙালি বিজ্ঞান চিন্তার মুক্ত আকাশ আজ বিমর্ষ। কালো মেঘে ঢাকা। এতদিন তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি নারী বিজ্ঞান-চিন্তনের সরু সোনালী আলোর দিশায় উদ্ভাসিত হচ্ছিল। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে বাঙালি নারীমুক্তির আকাশ ঈষৎ মেঘাচ্ছন্ন, কিংকর্তব্যবিমূঢ়!

বিগত কিছু দিন যাবৎ তাঁর ভগ্ন স্বাস্থ্য ছিল। বয়সের ভারে ন্যুব্জ তিনি। দীর্ঘদিন হৃদযন্ত্রের গভীর সমস্যায় ভুগছেন। অ্যামোলোগার্ড (Amplified), সাইক্লোস্পাসমল (Cyclospasmol) জাতীয় ওষুধ খাচ্ছেন নিয়মিত। হার্টের পাম্পিং ঠিক মতো হচ্ছে না। রাতে ঘুম আসে না। চোখে ছানি পড়েছে। খালি চোখে দেখার বিস্তর সমস্যা। বয়সজনিত কারণের দোহাই দিয়ে ডাক্তারবাবুরা অপারেশন করে চোখের ছানি কাটাতে ভীত, সন্ত্রস্ত। এত বেশি বয়সে চোখের ছানি কাটাতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। অযথা রিস্ক নিতে এত গড়িমসি!

এত অসুবিধা সত্ত্বেও থেমে নেই তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম― গবেষণার কাজ। রাতে ঘুম না-এলে অন্যকে শুষনি শাক আর ব্রাহ্মী শাক সেদ্ধ করে অল্প খাওয়ার বিধান দিতে দরাজহস্ত ছিলেন তিনি। অথচ কখনও তাঁর গবেষণার কাজ বন্ধ হয়নি। সেজন্যই তিনি মহান। তিনি মহীয়সী। তিনি-ই আদর্শ।

সাফল্যের সঙ্গে গবেষণার কঠিন কাজ সামলে সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন সুন্দর ভাবে, শক্ত হাতে। কাজের জায়গা আর সংসার― দুটোই তাঁর প্রায়োরিটি ছিল। সেসব সমান তালে সামলেছেন তিনি। প্রফেশন আর ফ্যামিলির দু'নৌকায় পা দিয়ে স্বচ্ছন্দে জীবনতরী দিব্বি পার করে দিলেন তিনি। এখানেই তাঁর মহত্ত্ব, কৃতিত্ব। তাঁর বর্ণময় জীবনে কষ্টার্জিত পরিশ্রমের ফসল এক গুঢ় রহস্যের বিষয় বৈকি! সর্বদা মানবের সেবায় নিয়োজিত এক প্রাণ তিনি। তাঁর চরণে শত কোটি প্রণাম, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। (সমাপ্ত)

তথ্যসূত্র :
●'বারোজন বাঙালি রসায়নবিজ্ঞানী'―ড. রবীন্দ্রনাথ পাত্র
●'অর্ধশত বিজ্ঞানী-কথা'― ড. সন্তোষকুমার ঘোড়ই
●'জৈবরসায়নবিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায়'― দীপককুমার দাঁ
●বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, দৈনিক সংবাদপত্র
●উইকিপিডিয়া, সায়েন্টিফিক উইমেন পেজ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments