জ্বলদর্চি

খর্জুর বীথির দেশে /পর্ব-১ (প্রথম পর্ব) /মলয় সরকার

খর্জুর বীথির দেশে

পর্ব-১ (প্রথম পর্ব)

মলয় সরকার


তুরস্কে কয়েকদিন ধরে তুর্কী নাচন নেচে ভাবলাম পায়ের এবং মনের একটু স্বাদ বদল করি। সেটা অবশ্য জায়গার বদল, আর সংস্কৃতির বদল হবে, কিন্তু ইতিহাসের ধারা অনেকটাই একরকম।আমি তো ঘুরতে পেলেই খুশী। বন্ধুরা মজা করে বলে, তোমার কি পায়ের তলায় সর্ষে? শুনে হাসি আমি। মনে মনে বলি,  কূপমণ্ডুক হয়ে বসে থাকা আমার কোন দিনই ইচ্ছা নয়। আমার ইচ্ছা হল, ‘ দেখব এবার জগৎটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে-” ।ভূগোল ইতিহাসে যা পড়েছি, তা তো পড়েছি বইএর পাতায়, মুখস্থ করে। সেগুলো নিজে হাত দিয়ে চোখে দেখে, নেড়ে চেড়ে দেখার মজাই আলাদা। সুযোগ যখন পেলাম, দেখেই নিই। 

সাধারণতঃ আমি, কোথাও যাওয়ার আগে, দেশটার ব্যাপারে কিছুটা জেনে নিই।তাতে বেশ সুবিধা হয় নতুন দেশে গিয়ে।এবার আসার আগে খুব বেশি সুযোগ হয় নি । অল্পই দেখে ছিলাম। যাক, কি আর করা যাবে।

এবারের ভ্রমণে আমার ইতিহাসটাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া আছে।তুরস্কে দেখে এলাম, প্রাচীন গ্রীক, রোমান, বাইজান্টাইন সভ্যতার ইতিহাস। এখানেও এসেছি তারই বাকী কিছুটা অংশ খুঁজতে। অতীতের যে গ্রীক বা রোমান সভ্যতা বা তারও আগে সেই প্যালিওলিথিক যুগ কি লৌহ যুগ- ব্রোঞ্জ যুগেরও ছাপ রয়েছে যেখানে, সে দেশের সভ্যতা তো যথেষ্ট  প্রাচীন এবং ইতিহাস যে তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবেই, এর আর আশ্চর্য কি? বর্তমান দিনেও এই অঞ্চল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ , সাম্প্রতিক প্যালেস্টাইন, ইস্রায়েল, ওয়েষ্ট ব্যাঙ্ক ইত্যাদির মধ্যের  যুদ্ধ ও এই অঞ্চলের শান্তি রক্ষার ব্যাপারে। সেই সুদূর অতীতে মেসোপটেমিয়ার যে সভ্যতার  কথা আমরা জানি তারও ছোঁয়া এখানে দেখা গেছে।এখানে ভাষা যা বলা হয় বেশিটাই আরবী তবে এখানে ইংরাজী,ফরাসী ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি ভাষা চলে।

 এখানে রাজত্ব করেছে আসিরীয়, ব্যাবিলনীয়,নাবাতিয়া, পারসীক, রোমান অটোমান রাজারাও। শেষে ব্রিটিশ ও ফরাসীরা।কাজেই আমাদের মত "শক হুনদল পাঠান মোগল" এদের উপরেও রাজত্ব করে এদের সংস্কৃতির উপরে ছাপ রেখে গেছে। ভাষাতেও রয়েছে তার ছাপ। তাই সেইসব খুঁজতেই আমার এখানে আসা।তার সঙ্গে আমার মানুষ খুঁজে বেড়ানোটার ইচ্ছেটাও ভিতরে ভিতরে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতই বয়ে চলে।

প্রায় আমাদের দেশের সঙ্গে সঙ্গেই, ১৯৪৬ সালে এই দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে।এর নাম হয় Hashemite state of Transjordan ।এরাই আরব লীগ প্রতিষ্ঠার মূল হোতা ছিল।১৯৯৪ সালে ইস্রায়েলের সঙ্গে এরা সন্ধি চুক্তি করে।তবে জর্ডন আজকে দেশ হিসাবে খুবই ছোট, আয়তন অনুযায়ী। এদের দেশের বর্তমান নাম Hashemite Kingdom of Jordan.
 
জর্ডনকে অনেক কিছু ব্যাপারেই নির্ভর করতে হয় বিদেশের উপর, কারণ নিজের দেশে অনেক কিছুই হয় না। এমন কি, নিজেদের রোজকার খাওয়ার জলটাও এদের নেই।সেটাও এদের কিনতে হয় বিদেশ থেকে। পৃথিবীর  প্রথম দশটি দেশের যদি নাম করা হয় পানীয় জলের স্বল্পতার ব্যাপারে, তবে জর্ডন তার মধ্যেই পড়বে। তবু, তা সত্বেও এদের অর্থনৈতিক উন্নতি কিন্তু ভীষণ ভাল। সেটা তো ,আমাদের সঙ্গে আর্থিক মূল্যের তুলনাতেই বোঝা যাবে।আর একটা কথা বলে রাখি, শুনেছি এদের স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা ব্যাপারটা নাকি খুব উন্নত। ফলে বিদেশীরা অনেকেই  নাকি এখানে চিকিৎসা করাতে আসেন। সেটাও এদের অর্থনৈতিক উন্নতির একটা বড় কারণ। 

এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, যদিও আমরা দেশের নাম জর্ডন বললাম, বা বলি, দেশের লোক কিন্তু একে বলে ‘জোরদান’। যাক গে, আমরা যাকে যা নামে ডাকি, তাই বলি। আমি এখানে একে ‘জর্ডন’ বলেই বলব।এরা ধর্মে বেশীরভাগই সুন্নী মুসলীম। অথচ একদিন এর আশেপাশেই জন্ম নিয়েছিল খ্রীষ্ট ধর্ম। এখন সেই আরবীয় খ্রীষ্টানরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।হয়ত’ সুদীর্ঘ দিন এখানে মুসলিম রাজত্ব থাকার ফলেই এই অবস্থা।

দেশটির নাম আক্ষরিক অর্থে যাই নাম থাক, এর এই নাম ,সম্ভবত্‌ ইস্রায়েলের যে প্রধান নদী, জর্ডন,  তার থেকেই  এসেছে। অথচ এমনই দেশের কপাল, যে, জলচুক্তির ফলে এই নদীর বেশির ভাগ জলের হকদারই এখন ইস্রায়েল , আর জর্ডন পায় ছিটেফোঁটা। আমাদের গঙ্গার জলচুক্তির মতই ব্যাপারটা, এই আর কি। এই নদীটি ডেড সী তে পড়েছে। শুধু তাই নয়, ডেড সীর মূল জলের উৎসই এই জর্ডন নদী। হিব্রু ভাষায়, জর্ডন (ইয়ারদান) শব্দের অর্থ, নীচু দিকে প্রবাহিত, সেখান থেকেই সম্ভবতঃ এই নামের আমদানী।

এই সেই জর্ডন নদী, যা ক্রীশ্চানদের কাছে আমাদের গঙ্গাজলের মত পবিত্র, কারণ যীশুকে এই জর্ডনের জল দিয়েই ব্যাপ্টিস্ট করেছিলেন ব্যাপ্টিস্ট জন।আর সেই ক্রুসেডরদের যুগে ক্রুসেডরা এর জল সঙ্গে নিয়ে যেত, কাউকে ব্যাপ্টিস্ট করতে। 

আশ্চর্যের কথা, এই নদীর নামটি বহুদিন ধরে নাম বা পদবী হিসাবে ব্যবহার করেছে বহু দেশের মানুষ এবং বহুদিন ধরে। এই সব ব্যবহারকারীদের মধ্যে রয়েছে, স্পেন, জার্মানী, ফ্রান্স, রুমানিয়া, ইংল্যাণ্ড এমন কি আমেরিকার মানুষও; শুধু অতীত কালে নয়, এই বর্তমান যুগেও।
এর থেকেই বুঝতে পারি নামটির মাহাত্ম্য। আমি জানি না আমাদের দেশে বাঙ্গালীদের ‘গঙ্গোপাধ্যায়’ ছাড়া আর কারোর নদী সম্পর্কিত কোন পদবী আছে কি না।

যাই হোক, এক বিকালে আমাদের দুই দেবা দেবী কে নিয়ে পক্ষীরাজ অবতীর্ণ হলে্ন জর্ডনের আম্মান এয়ারপোর্টে (কুইন আলিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট)। আমরাও নতুন দেশের ডাকে সাড়া দিতে গুটি গুটি এগোলাম পাশপোর্ট চেকিং এর জায়গায়। মনে মনে আবার আওড়ালাম “ এলেম নতুন দেশে–”। এনারাই আমাদের, দেশে ঢোকার ছাড়পত্র দেওয়ার হর্তাকর্তা। মুখটিকে যথাসম্ভব ভালমানুষের মত করে গিয়ে দাঁড়ালাম সেই কর্তার সামনে। শুনেছি এবং দেখেওছি , নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, এঁরা পারেন না এমন কিছু নেই। এঁদের না-পসন্দ মনে হলে যাত্রীকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তে এঁদের জুড়ি নেই। সে ব্যাপারে বুড়ো বুড়ী ছোঁড়া- ছুঁড়ি কিছুই বাচবিচার নেই। প্রখ্যাত লেখিকা নবনীতা দেবসেন তাঁর অনেক লেখায়, এবং অনেক লেখক বা প্রখ্যাত মানুষই এঁদের কথা বিভিন্ন ভাবে বলে গেছেন।

আমরা তো গিয়ে পৌঁছালাম কাউন্টারে। বুড়ো আগে, বুড়ী পিছনে। এখানে ‘অন এরাইভাল’ ভিসা দেওয়ার কথা, সব ঠিক ঠাক থাকলে। আমরা তো কাগজপত্র সব ঠিকঠাক গুছিয়ে নিয়ে ‘মালিক’কে দেখালাম, এবং চোখে বিনীত আর্জি ফোটালাম, প্রভু, বেশি ঝামেলা না করে আমাদের ছাড়পত্র দিয়ে দিন, বাইরে আমাদের জন্য লোক অপেক্ষা করছে।

তিনি কয়েকবার আমাদের দিকে খুঁটিয়ে দেখলেন। (কি দেখলেন কে জানে)। এটা সেটা নানা প্রশ্ন করলেন। সাধ্যমত বিশ্বাসযোগ্য উত্তরও দিলাম। আমরা চোরও নই ডাকাত বা স্মাগলারও নই, নিতান্তই ভোলাভালা সিনিয়র সিটিজেন পর্যটক, তোমাদের দেশকে ভালবেসে দেখতে এসেছি। তা, ওনার অভিজ্ঞ (?) চোখ আমাদের অনেক দেখেওও কিছুতেই  বিশ্বাসও করতে পারল না, আবার সন্দেহের দোলায়, হয়ত, পুরো অবিশ্বাসও করতে পারল না। সে শেষ পর্যন্ত, আমাদের পাঠিয়ে দিল, পাশেই তার বড় কর্তার কাছে। ভাবটা এমন যে, কে বাবা দায়িত্ব নেয়! শেষে কিছু অসুবিধা হলে আমি কেন ঝামেলায় পড়ি। যা করে বড়কর্তারা করুক, ঝামেলা হলে ওরা সামলাবে। আমি বাবা একটু ফ্রী থাকি।


জর্ডনের রোমান ধ্বংসাবশেষ


 এই ভাব দেখেছি আমাদের এখানে অনেক ব্যাঙ্কের কাউন্টারের কর্মীদের কাছে। একটু এদিক থেকে ওদিক হল কি না, পাঠিয়ে দিল ম্যানেজারের কাছে, যান ম্যানেজারের কাছে । উনি যদি বলেন হবে। খুব সাধারণ কাজ, একটু নিজের বুদ্ধি লাগালেই হয়, মিথ্যে মিথ্যি হয়রানি করা গ্রাহক এবং ম্যানেজার দুজনকেই। বুঝলাম এই চরিত্র শুধু আমাদের দেশের নয়, সারা পৃথিবীর সর্বস্তরেই আছে, ঐ গা ঝাড়া দেওয়া বা পিঠ বাঁচানোর পদ্ধতি।

উপরওলা আমাদের দেখে কাগজপত্র দেখে হয়ত বুঝলেন ব্যাপারটা, এবং অধস্তনের চরিত্র জানেন। তবু অধস্তনের সম্মান বাঁচানোর জন্য, আমাদের দুটি চেয়ারে বসিয়ে রাখলেন কিছুক্ষণ। বুঝলাম, আমাদের কিছুই খুঁত পান নি । তবু একবার সব কাগজপত্র দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ক’দিন থাকবেন, কোথায় থাকবেন, কি দেখবেন ভাবছেন এইসব। 

যাই হোক সন্তুষ্ট হয়ে, উপযুক্ত ফি নিয়ে , আমাদের ছাড়পত্রে সই করলেন। আমরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এই প্রসঙ্গে বলি, আমাদের ইউরোপ ভ্রমণের সময়ে বেলজিয়ামেও একই কাণ্ড হয়েছিল। বৃথাই আমাদের সময় নষ্ট করে উত্তেজনার পারদ চড়িয়ে দেন এঁরা।

যাই হোক, শেষে, মালপত্র নিয়ে, এয়ারপোর্ট  চত্বরের মধ্যেই আগে এ টি এম থেকে কিছু দিনার তুলে নিলাম, আপাততঃ হাত খরচের মত। জর্ডনের মুদ্রা হল ‘দিনার’ যার বর্তমান মূল্য এক দিনারের সমান ভারতীয় ১১০ টাকা প্রায়। 

একবার আমেরিকায় ঢোকার সময় এক বাংলাদেশী মহিলা কাস্টমস অফিসার, ছেলের জন্য আনা পাঁচ কিলো ভাল গোবিন্দভোগ চাল বের করে নেন। অনেক করে বললাম, আপনি তো জানেন, গোবিন্দভোগ চালের পায়েসের কি স্বাদ! ছেলেটা এখানে খেতে পায় না তো, তাই ওকে একটু করে দেব ওর জন্মদিনে।
তা বেটি, একেবারে সরকারী দায়িত্বশীল অফিসার! আমাকে নাকের ডগায় আমেরিকার নিয়মকানুনের একটা ছাপানো লিফলেট নাড়িয়ে বলল, নিয়ম নেই দাদা।অগত্যা–

আর একবার এই আমেরিকাতেই ঢোকার সময়, এয়ারপোর্টের লাউঞ্জ থেকে তোলা দুটি আপেল, দুজনের জন্য রাখা ছিল, পরে খাব বলে, সে দুটিকেও নিয়ে নিলেন। এঁরা যে কি রকম সাবধানী, তা ওঁরাই জানেন।

বাইরে বেরোলাম সব পাট চুকিয়ে। ভয় হচ্ছিল, এত দেরী দেখে, আমাদের জন্য যার অপেক্ষা করার কথা, সে চলে না যায়, তাহলে আবার মুস্কিলে পড়ব। বাইরে এসে দেখি অপেক্ষা করার জায়গায় আমাদের মত যাত্রীদের জন্য মাত্র দু’ চার জন তখনও অপেক্ষা করছে। আমরা বেরোতেই তারা নাম লেখা বোর্ড গুলো তুলে ধরল। আমার নাম খুঁজে পেতে আর এবার তুরস্কের কায়াসেরি এয়ারপোর্টের মত অসুবিধায় পড়তে হয় নি । যে লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল, সে বেশ হাসিমুখো। আমাদের পেতেই সে একাই সব সুটকেশ আমাদের হাত থেকে নিয়ে একটু দূরেই পার্ক করা গাড়ীতে নিয়ে গিয়ে তুলল। পরিচয় দিয়ে বলল, আমার নাম রিয়াধ। আগামী কয়েকদিন, আমিই আপনাদের বন্ধু, গাইড, ড্রাইভার, চব্বিশ ঘণ্টা আপনাদের সেবায়ই থাকব। যখন যা লাগবে , অসুবিধা হবে , বলবেন, আমি আছি।

ক্রমশঃ পরবর্তী পর্বে–

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. জর্ডান ইমিগ্রেশন এ আমার একই এক্সপেরিয়েন্স। আমার mrs. এর পাসপোর্ট যেহেতু ইউএসএ ভিসা ছিল টাই স্ট্যাম্প মেরে দিল। আমার ক্ষেত্রে যে হেতু ইউএসএ ভিসা এই পাসপোর্ট এ নেই বলে তিন ঘণ্টা বসিয়ে রাখলো। তারপর airport manager এসে মুখটা দেখলেন এবং স্ট্যাম্প মেরে দিলেন।

    ReplyDelete