জ্বলদর্চি

কানীন /শ্রীজিৎ জানা

কানীন

শ্রীজিৎ জানা


বাজার পাড়ার সকলেই প্রায় হকচকিয়ে ওঠে মেয়েটিকে দেখে। মেয়ে বললে খানিকটা সমাদর করার মতো শোনায়। সে তো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার পাত্রী ।  তাকে দেখে কারো কারো চোখ থেকে ঠিকরে বেরোয় অন্য খিদে।যেই খিদের আগুন শুধু রাক্ষসের মতো ঝিঁড়েখুঁড়ে খেতে জানে। আগুনের প্রাণে কোন দয়ামায়া থাকে না। কোন ভালোমন্দের বাছবিচার নেই আগুনে লালসার কাছে। বাজারে এমন ক্ষুধার্ত লোকের অভাব নেই। দিনের ফর্সা আলোর সাথে মিশে থাকে তারা। আর রাতে ইলেকট্রিক তারে বসে থাকা নিশাচরের মতো শান্ত অথচ দানবীয় লালসা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাল বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়নার মতো।

মেয়েটা কোথাকার এক পাগলী। বোধহয় আট-নয় মাস আগে তাকে বাজারে দেখা গিয়েছিল। এমন অদ্ভুত পাগলী আগে কেউ দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। বাজারে মাঝেসাঝেই খেপি -হাউড়ির আবির্ভাব ঘটে।নাক সিঁটকানো চেহারা সব তাদের। উদ্ভট তাদের হাবভাব। জট পাকানো চুল,গায়ে নেংরা-ছেঁড়া কাপড়, ময়লা চিটচিটে কম্বল কারো গায়ে জড়ানো,কারো আবার গায়ে ফিনফিনে একটা ধুলচট নাইটি। চোখের কোণে পিচুটি। গা-মাথা থেকে ভুরভুর করে বেরোচ্ছে বিটকেলে গন্ধ।হাড় জিরজিরে চেহারা। শুকনো তোবড়ানো খটখটে মুখ। স্তন শুকিয়ে চ্যাপ্টে মিশে গেছে পাঁজরের হাড়ে। পাছা-পোঁদ সরু নারকেল মালার মতো। 
সবার আটিগুটি সমান নয়। কেউ বিড়বিড় করে বকে যায়। কেউ হাতের কাছে যাই পায় কুড়িয়ে বেড়ায়। কেউ লাঠি ঠুকে ঠুকে আনমনে হেঁটে যায়।

কিন্তু এই পাগলী তো  সবার থেকে আলাদা। অদ্ভূত তার ধরণধারণ। চেহারা দেখে অনেক পুরুষের লিঙ্গ শক্ত হয়ে উঠে। স্ফীত স্তন। ভারী পাছা।চুলে জট নেই। একটা ভাঙা চিরুনি দিয়ে মুহুর্মুহু চুল আঁচড়ায়। ঘনঘন মুখ ধোয়। দোষের মধ্যে সারাক্ষণ বকে যায়। একে ওকে খাবার চেয়ে ফেরে। এমন কোরে তাকিয়ে থাকে যেন কত না জানি আপনি তার আপনজন। উল্টোদিকে মনে হবে মেয়েটিকে আপনি কোথাও যেন দেখেছেন কখনো।
মেয়েটি বাজারের দক্ষিণে পিচ সড়কের পাশে যে যাত্রী প্রতিক্ষালয় সেখানেই আস্তানা পাতে। সঙ্গে থাকা সম্বল বলতে একটা পুঁটলি। এমন করে আগলে রাখে যেন কোন গুপ্তধন তাতে লুকানো। জলের একটা বোতল আছে সাথে।যার ভেতরটায় পুরু আয়রনের এমন আস্তরণ পড়েছে মনে হবে কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে কুড়িয়ে পেয়েছিল সে। এমনতর  বহুমূল্য জলের পাত্রটি সে আর কখনো পাবেনা বলেই আগলে রেখেছে সম্পত্তি ভেবে। পুঁটলিতে আরো একটা জিনিস লুকানো আছে বলে বাজারে প্রচার। বড় একটা হাঁসুয়া। ধারালো নাকি মরচে পড়া কেউ স্বচক্ষে দেখেনি। হাঁসুয়াটা ব্যবহার হয়েছে কিনা সেকথাও অজ্ঞাত। শুধু কয়েক হাত দূর থেকে রাতের অন্ধকারে দেখেছে বাজার পাড়ার ঘঁগা আর  পৈতন্য।দুজনেই বাজারের এর ওর দোকানের ফাইফরমাশ খাটে। মজুরি হিসেবে পঞ্চাশ -একশ টাকা যদিবা পায়,তার বেশিরভাগটাই দিযে আসে গোটপাতার দেশি চুল্লুর ঠেকে। সংসারপাতি নেই কারো। হালদারদের গুদাম ঘরের কোনায় বলেকয়ে টিন ঘিরে খুপরি একটা থাকার জাযগা বানিয়েছে দুজনে। পৈতন্যর ডান পা'টা জন্ম থেকেই খোঁড়া।  ঈষৎ বেঁকে বেঁকে চলে। তাতে পৈতন্য কোন অসুবিধা বোধ করে না। ভোর হতে না হতেই দুজনেই হাজির হয় গোটপাতার ঠেকে। সকলে বলে ওরা নাকি মদে বাসিমুখ ধোয়।দেশি খেয়ে খেয়ে দুজনের হাত-পা-পোঁদ সরু হয়ে পেটটা সামনের দিকে ফুলে থাকে বেলুনের মতো। বাজারের সকলেই জানে ঘঁগা আর পৈতন্য হরিহর আত্মা।কোন কোন দিন রাতে শরীরের খিদে চাগাড় দিলে,দুজনে দুজনের লিঙ্গ ধরে টানাটানি করে। কিছুক্ষণ পর যখন তরল পদার্থ ছিটকে বেরোয় তখন লুঙ্গিতে মুছে কেতরে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে যায়। সেদিন ঘুম ভাঙে সকাল আটটায়।
মেয়েদের শরীরের স্বাদ ওরা কখনো পায়নি। বাজারে হঠাৎ অমন পাগলীকে আসতে দেখে ঘঁগার জিভ লকপক করতে থাকে। পৈতন্যও তাল বুঝে ওৎ পাতে।

 সেদিন রাতে ঘঁগার চোখে ঘুম নেই। ওলটপালট খেতে থাকে অনেক রাত অব্দি। দড়ি পাকানো শরীরে সব শুকিয়ে গেলেও এখনো পুরুষাঙ্গ তার সটান হতে পারে। পৈতন্য ঘুমিয়ে গ্যাছে দেখে প্রতীক্ষালয়ের দিকে হাঁটা দেয় ঘঁগা।  পাগলীর সামনে গিয়ে কাপড় ধরে টান মারতেই বিদ্যুৎবেগে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। ঘঁগা ভয়ে পিছিয়ে পড়ে। আর দেখে পাগলীর হাতে একটা হাঁসুয়া।  টেনে দৌড় দেয় ঘঁগা। পৈতন্যও ঘঁগার পিছু পিছু গিয়েছিল। কিন্তু দূর থেকে পাগলীর অমন মূর্তি দেখে সেও পা টেনে টেনে ছুট লাগায়।বাসু হালদারকে পৈতন্যদের এক প্রকার মনিব বলা চলে। পরের দিন সকালে ঘঁগার কথা হালদারকে শোনায় পৈতন্য। ঘঁগা রাগে ও লজ্জায় কদিন ঘাড় নিচু করে থাকে। আর পৈতন্যকে উদোম খিস্তি-খেউড় করে। হাঁসুয়ার কথা সেই থেকেই সবার কানে আসে।

বাজারে হালদারের বড় ভূষিমাল দোকান। খুচরোর চেয়ে পাইকারি বেচাকেনা তাতে বেশি। পাঁচজন কর্মচারী তার। বাসু হালদার বসেন ক্যাশে। থলথলে মাংসের গোলগাল শরীর। দু'হাতের বুড়ো আঙুল বাদে সবেতেই সোনায় মোড়া দামী পাথরের আঙটি। ভাগ্যে তার অর্থসুখ ছাড়া আর কোন সুখই লেখেননি বিধাতা। তা নিয়ে হালদারের মনস্তাপের অন্ত নেই। প্রকাশ্যে কেউ এই নিয়ে আসর জমায় না ঠিকই তবে আড়ালে আবডালে বলতে ছাড়ে না।

---হালদার না ঝালদার। মালটা পুরো ওর আগের স্ত্রীর বাপের সব ঝেড়ে করেছে।
---ধূর শালা ওকে তো বাসু হালদার বলে না। বলে জাসু হালদার। বৌটা বিনা চিকিৎসায় পটকে গেল।
---লে ইবার চুল ছিঁড়। এই পক্ষের স্ত্রী জুটেছে বাঁজা।তার উপরে বিয়ার দুবছর থেকেই প্যারালাইস হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।
---অর টাকা সব ভূতেই খাবে। আর ঝড়ি মেছানিও কিছুটা খায়ঠে।
---বলু কি রে!
---তবে আজকাল দেখিঠি দানধ্যান করেঠে। বাজারে পুজায় পুরা খাওন দ্যায়।
---যাই বল বয়সে পাক পড়েঠে ত।

অনেক কথা পৈতন্য-ঘঁগার মুখ হয়ে হালদারের কানে আসে। কিন্তু কোনভাবেই তার সংসারের দশা ফেরে না। এত টাকাকড়ি,জমিজমা শেষমেষ কীহবে তা ভেবেই অর্ধেক রাত ঘুমোতে পারে না হালদার। জ্যোতিষরা পয়া খদ্দের পেয়ে ভুজুংভাজুং আউড়ে চড়া দামে পাথর গতিয়ে দ্যায়। কিন্তু তার জীবনের উপর যে কালাপাহাড় চেপে বসে আছে তাকে সরাবার সাধ্যি নেই কারো। 
ইদানীং এক গুরুদেবের কথামতো দয়াদানে মন দিয়েছে সে। পাগলীটাকে দেখেও তার বড় মায়া হয়। দুবেলা তার খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বাবলুর হোটেল থেকে খাবার আসে। বাসু হালদারকে বাজারে সবাই সমীহ করে। বাজার কমিটির সভাপতি বলে কথা। পাগলীর এমন খাতিরদারি করা দেখে সবাই হালদারের সুনাম করে। হালদার সব শুনে কাঁচুমাচু হয়ে বলে,
---আরে আমি কী খাওযাচ্ছি। ওসব উপরবালার দয়া।

উপরওয়ালা সত্যিই কত রকমভাবে কতজনকে  দয়া করে তা মানুষের বোধগম্যের বাইরে। সমস্ত চিত্রনাট্য যেন  আগে থেকেই প্রস্তুত। শুধু তাঁর অদৃশ্য ইশারায় অভিনয় করে যাওয়া। বাসু হালদার তার বর্তমান গুরুদেবকে দেবতার মতো মানে। কেবল মনের বিরক্তিটাকে সামলাতে পারে না। দোকান থেকে বাড়ি ফিরে চেল্লাচিল্লি শুরু করে। আজকাল মাঝেমধ্যে দোকানেই রাতে থেকে যায়। বাড়িতে একজন কাজের মেয়ে হালদারের স্ত্রী নিভার দেখভাল করে। 
কদিন ধরে কতরকম চিন্তা হালদারকে ভেতরে ভেতরে কামড়াচ্ছে।  কাউকে বলতে পারছে না। বলার মতো নয়। নিভা জীবিত থাকতে আর সে বিয়ে করবে না। অনেকেই তাকে বলেছে,
---হালদার মশাই হোম থেকে একটা ছেলে দত্তক নিন। আজকাল তো অনেকেই নিচ্ছে।
নিভার আপত্তি নেই এই ব্যাপারে। কিন্তু হালদার মন থেকে মেনে নিতে পারে না। নিজের রক্তের না হলে কী হয়। আম গাছের ছাল জাম গাছের গায়ে মেলে না। দোকানে বসে কখনোসখনো আনমনা হয়ে যায় সে।

সেদিন বিকেল থেকেই তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু। গতিক দেখে কর্মচারীরা একে একে পালিয়েছে। হালদার আজ দোকানেই রাত কাটাবে বলে স্থির করে নেয়। রাতে মুড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে সাথে হাল্কা একটু গলা ভেজাবে প্রতিদিনের অভ্যাস মতো। এমন দিনে হালদার একটু অন্যমানুষ হয়ে যায়। পৈতন্য -ঘঁগা কাউকেউ দেখতে পায় না সে এই আকাল ঝড়ঝাপটায়।থাকলে ঝড়ি মেছানিকে একটা খবর পাঠাতো। অগত্যা গ্লাস আর বোতল নিয়ে বসে পড়ে। দু'তিন ঢোক দেওয়ার পরই হাল্কা ঝিমুনি আসে চোখ। হঠাৎ পাগলীর কথা হালদারের মনে পড়ে। বৃষ্টিতে বেচারা কী করছে কে জানে! দরজা খুলে বাইরে চোখ রাখতেই দেখে পাগলী তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ভিজে নেয়ে একসা। তড়িঘড়ি ঘরের ভিতর নিয়ে আসে পাগলীকে। একটা ধূতি পাগলীর দিকে এগিয়ে দেয়। পাগলী নির্বিকার। বাধ্য হয়ে গামছা দিয়ে গা-মাথা মোছাতে থাকে নিজেই। ঘরের ভিতরে এমারজেন্সী লাইটের আলো। ভিজে শরীরে দাঁড়িয়ে আছে পাগলী মেয়েটি হালদারের সামনে। ধুতি গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে হালদার দেখে তার স্ফীত স্তনের আহ্বান। অনুভব করে অনেকদিনের খিদেটা যেন হুহু করে আঙরার মতো জ্বলে উঠছে। তপ্ত লৌহশলাকা যেন ক্ষেপে উঠেছে শিকারের নেশায়। হালদার পাগলীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। পাগলী কোন বাধা দেয় না। বাইরে তখন রাক্ষুসে দুর্যোগ। ভিতরে তখন দীর্ঘতর এক যুদ্ধপর্ব। যেই যুদ্ধে এক পক্ষের কোন রণোন্মাদনা নেই,চরম উত্তেজনা নেই,জিজীবিষা নেই,কেবল আছে নীরবে আঘাত সয়ে নেবার নিঃসাড় নীরবতা।

অনেক রাত অব্দি দুর্যোগ চলার পর শান্ত হয়ে উঠে প্রকৃতি। ভোরের আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাইরের ধ্বংসের চেহারা। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হোলো পাগলীকে  খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে অনেকেরই দোকানপাটের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ঠিকই। সবাই যে যার দোকান গুছাতে বাস্ত। পঞ্চায়েতের লোকজন ঝড়ে পড়ে যাওয়া গাছহুলো কেটে সরাতে তৎপর।  কিন্তু এত সবের মাঝে পাগলীটার খোঁজ নিচ্ছে অনেকেই। কাউকে না জানিয়ে আগেই বাজার ছাড়িয়ে আরো আশপাশের এলাকাও খোঁজ নিতে  হালদার পাঠিয়েছে ঘঁগা আর পৈতন্যকে। হালদার গুম মেরে বসে থাকে। আজকে ক্যাশে বসতে পারবে না সে। বাজারে খবর চাউর হয়,
--- পাগলীটার জন্যে হালদার খুব ভেঙে পড়েছে।
---আরে এই কদিনে কম করেছে খেপিটার জন্যে
হালদার কোন কথাই বলে না। শুধু ভাবে পাগলীরাও কী বুঝতে পারে যৌনতার স্বাদ। মেয়েটার কী নিভার মতো মেন্স হোতো। ঝড়ি তো নিয়ম করে বাচ্চা বন্ধের ট্যাবলেট খায়। কত ভাবনা হালদারকে ফ্যাকাশে করে দেয় কিছু দিন। তারপর বন্যার জল  থিতোলে যেমন সবের উপর একটা পলির আস্তরণ পড়ে। সেইরকম  সকলের মন থেকে পাগলী পর্বের আপাতত ইতি ঘটে।

বাজারে হঠাৎ এতদিন পর পাগলীকে দেখে তাই সকলের চোখ হুড়মুড়িয়ে পড়ে তার উপর। অবিকল সেই পাগলীটা!  কেউ কেউ একেবারে নিশ্চিত করে বলে,
---আরে এ তো সেই মাল
---কিন্তু একে পোয়াতি কোরলো কে?
খবর পেয়ে ছুটে আসে ঘঁগা আর পৈতন্য। ভিড়ের পিছনে দাঁড়ায় হালদার। চোখেমুখে তার অদ্ভূত অভিব্যক্তি।  হালদারকে দেখেই ভিড় থেকে কেউ বলে উঠে,
---আসুন হালদার বাবু।দেখুন তো আপনি চিনতে পারেন কিনা?
---উনি ঠিকই চিনবেন। কী আর বোলবো এক প্রকার নিজের হাতে করে অর দেখভাল করেছেন।
হালদার ভিড় কেঠে ইতস্ততভাবে কাছে যায়। পাগলীর চোখ তখন মাটির দিকে পাতা। শরীর অনেকটাই ভেঙে গিয়েছে। হালদারের বুকের ভিতরটা ক্যামন যেন করতে থাকে। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বলে,
---এই অবস্থায় আমাদের উচিত ওকে হাসপাতালে পাঠানো। যত হোক একটা পেগনেন্টের ব্যাপার।
---তার আগে বাজারের রায় ডাক্তারবাবুকে একটা কল দেওয়া হোক।

ভিড় থেকে কথা ছিটকে আসে। সবাই সহমত পোষণ করে। সেই সাথে বাজার কমিটি ঠিক করে কালই হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। এদিকে সারা বাজার,বাজার ছাড়িয়ে দু'চারটে গ্রাম অব্দি পাগলীর কথা চাউর হয়ে যায়। স্থানীয় কয়েকটা নিউজ চ্যানেল পাগলীর গর্ভাবস্থার দৃশ্য লাইভ টেলিকাস্ট করে। হালদার সবাইকে অনুরোধ করে সরিয়ে দ্যায়। আর আগের মতো থাকা-খাওযার ব্যবস্থা করে।

 কিন্তু রাতে ঘঁগার চোখের পাতা বুজে না। ভাবে পাগলীর হাঁসুয়াটা কী তাহলে খেলনা ছিল। কার এমন বুকের পাটা! পৈতন্য শুয়ে শুয়ে বলে,
---জানু ঘঁগি খেপির ব্যাটাছ্যানাই হবে?
---তুই কী করে বুঝলু
---আরে ঠাগমারা বোলতো পেট রগা মানেই ব্যাটা আর পেট ধামাপরা মানেই মেইছ্যানা।
---শুধু জেনেইছু মরা। কিছু তো জীবনে কত্তে পারুনু
---তুই কী ছিঁড়েছু। তুই যে গ্যান দিচ্ছু।
দুজনে অনেক রাততক তর্কাতর্কি করে কখন ঘুমিয়েছে জানে না। 
ওদিকে হালদারের চোখেও ঘুম নেই। নিভার যখন পেটে বাচ্চা আসছে না হালদার কতবার করে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। কত ডাক্তারি বিদ্যার কথা শুনেছে। সঙ্গমের সময় লাখ লাখ শুক্রানু ছুটে যায় ডিম্বানুর দিকে। সেদিক থেকে মিলন মুহুর্তে ধেয়ে আসে একটি ডিম্বানু। আটদিনে আটখানা ডিম্বানু। তারপর মুহুর্তে  মিলন। একবার দুজনের মিলন হলে আর কারুর শুক্রানু নেবে না গর্ভদেশ। কী আশ্চর্য সৃষ্টি রহস্য। সন্তান কার শুক্রাণুর ফল তা বলা বড় মুশকিল। কিন্তু ওই সৃষ্টি রহস্যের বাইরে কী হবে পাগলীটার দশা, তাই হালদার ভাবে। একটা মেঘ-রোদের খেলা চলতে থাকে তার মনের ভিতর। নিভা পাগলীটার কথা জানতে চাইলে সেভাবে উৎসাহ দেখায় না।

ভোরে পৈতন্যর ঘুম ভাঙে আগে। কিন্তু আজ দুজনেই
একসাথে ধড়ফড় করে উঠে। সবেমাত্র ভোরের পাখিরা ডাকতে শুরু করছে। কিন্তু তাদের ডাক ছাপিয়ে আরেকটা ডাক তাদেরকে জাগিয়ে দ্যায়। প্রতীক্ষালয় আর হালদারের গুদাম পিঠোপিঠি।  স্পষ্ট শুনতে পায় সদ্যজাতের কান্না। ছুটে বেরিয়ে আসে তারা। দেখে রক্তজলে মাখা একটা ফুটফুটে ছেলে। পাশে অচেতন পাগলীটা।  ঘঁগা দৌড়ে যায় হালদারের বাড়ির দিকে। পৈতন্য জোরে জোরে চেঁচাতে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে ভীড় জমে বাজারে। ডাক্তার আসে। পাগলীর নাড়ি দেখে মৃত বলে জানায়। ছেলেটিকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে থানার বড়বাবু এসে সব ব্যবস্থা করেন। লাশ পুলিশের গাড়ি উঠিয়ে নিয়ে যায়। ছোট্ট একটা আলোচনা বসে বাজারে। ছেলেটার কীহবে তা নিয়ে উদ্বেগ ব্যক্ত করে হালদার। তাকে সমর্থন করে বাজারের সব দোকানদার। কেউ একজন বলে উঠে, ---হালদারবাবু আপনি ছেলেটাকে দত্তক নিন।
হঠাৎ এমন প্রস্তাবে সবাই পরস্পরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। হালদার কী বলবে ভেবে উঠতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে তাকায়। বড়বাবু বলেন,
---ভেবে দেখতে পারেন হালদারবাবু। প্রস্তাবটা ফেলে দেবার মতো না। আইনি যা সব করার তা আমি নিজে থেকে করে দেব। ডোন্ট ওরি। একটা গ্রেট ডিসিশন হবে আপনার লাইফে। আফটার অল ছেলেটা একটা ফ্যামিলি পাবে।
 সভা ভেঙে গেলে যে যার বাড়িমুখো হয়। হালদারও আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে। খেতে ইচ্ছে করছে না তার। বিছানায় স্ত্রীর পাশে অনেকদিন পর শোয়। নিভা কোনক্রমে বাঁ'হাতটা দিয়ে তাকে ছোঁয়। হালদার অনুভব করে যেন একান্ত ভরসার একটা স্পর্শ তাকে সাহস যোগাচ্ছে ভিতরে ভিতরে বড় কোন সিদ্ধান্ত নেবার।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments