জ্বলদর্চি

বিলুপ্তির পথে জীবিকাশ্রয়ী গান /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ২৫

বিলুপ্তির পথে জীবিকাশ্রয়ী গান

সূর্যকান্ত মাহাতো

জোর কদমে বেজে চলেছে একটা ডুগডুগি। বেশ তালে তালে। ছন্দে ছন্দে। ডুগডুগ সেই শব্দ, গ্রামের মাটির দেওয়ালগুলো ভেদ করে পৌঁছে যাচ্ছে গৃহস্থদের কানে। তাই সকলে ভিড় ভিড় করে ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসছে। তাদের মনে তখন অসীম কৌতুহল। কী এসেছে সেটা দেখার জন্য! এমনিতেই গ্রামের মানুষের কৌতুহল সাধারণত একটু বেশিই থাকে। সহজ সরল মানুষগুলোর উৎসাহও থাকে অফুরন্ত। তাই সকলেই ডুগডুগির শব্দের উৎস সন্ধানে জমায়েত হতে শুরু করল।

একটি লোক ডান হাতে জোর কদমে বাজিয়ে চলেছে তার হাতের সেই ডুগডুগি। বাম হাতে ধরা আছে লম্বা একটা লাঠি। কাঁধের উপরে বসে আছে একটি বাঁদর। উপস্থিত জনতার দিকে কেমন মিটিমিটি করে তাকাচ্ছে। লোকটির বাম কাঁধে আছে একটি বড় ঝোলা।

গোল করে ঘিরে আছে সেই ভিড়। বেশ ভালো মতোই ভিড় জমে গেল। ছোট থেকে বড় সকলেই প্রায় উপস্থিত হয়েছে। ডুগডুগি বাজানো থামিয়ে লোকটি বাঁদর খেলা দেখানোর প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিল। লোকটি মাটিতে বসতেই বাঁদরটি কাঁধ থেকে নেমে একটি জায়গায় চুপ করে বসে পড়ল। তার গলায় একটা লম্বা শিকল। শিকলের অন্য প্রান্তটা বাঁধা আছে লোকটির বাম হাতে।

সব প্রস্তুতি সেরে নিয়ে লোকটি একটি গান ধরল---

উড়কি ধানের মুড়কি বাদাম ধানের খই
বদ্ধমান এ দেখ্যে আল্যম গামছা বাঁধা দই।

লোকটির হাতে লম্বা একটা লাঠি। গানের সঙ্গে সঙ্গে লাঠিটা মাটিতে ঠুকে ঠুকে তাল দিচ্ছে। আর বাম হাতের শিকলে টান মেরে মেরে বাঁদরটাকে নাচাচ্ছে ও খেলাচ্ছে। বাঁদরটিও গান ও লাঠির ছন্দে ছন্দে ডিগবাজি দিয়ে দিয়ে আনন্দের সঙ্গে নানান রকমের ভেলকি দেখাতে শুরু করেছে।

উপস্থিত উৎসাহী দর্শকেরা বাঁদরের খেলা দেখে হাততালিতে ফেটে পড়তে লাগল। সেইসঙ্গে বাঁদরের অদ্ভুত কৌশলে মজা পেয়ে কেউ কেউ তো হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল।

অবশেষে খেলা দেখানো শেষ হল। খেলা শেষ হতেই উপস্থিত গ্রামবাসীরা তাকে চাল ও পয়সা দান করল। খেলা দেখানো লোকটির এটাই একমাত্র রোজগার। এভাবেই সে গ্রামে গ্রামে খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এরা সম্ভবত বীরহোড় উপজাতির মানুষ। একশ্রেণীর যাযাবরও। তাই এরা 'বাজিকর' নামেও পরিচিত। বাঁদর নিয়ে এভাবেই ওরা খেলা দেখিয়ে গান গেয়ে গেয়ে জীবিকা উপার্জন করে।

জঙ্গলমহলে বাঁদর খেলা, সাপ খেলা, পুতুল নাচ, পটগান দারুণ ভাবে প্রচলিত ছিল। এখন আর এসব তেমন একটা চোখে পড়ে না। এই ধরণের গানগুলোকে "জীবিকাশ্রয়ী" গান বলা হয়। জঙ্গলমহলে প্রচলিত করম নাচের গান, জাওয়া গান, জাঁত গান, ভাদু গান, টুসু গান, কাঁঠি নাচের গান, অহিরা গান, ছৌ নাচের গান, বিহা গান, ঝুমুর গান, সখি গান, ঢুয়া গান ইত্যাদি যেমন ছিল বা আছে, তেমনি জীবিকাশ্রয়ী এইসব গানগুলোও কম বেশী প্রচলিত ছিল। কিন্তু এখন আর সেরকমভাবে দেখা যায় না।

এবার আসি গানের কথায়। কেন এগুলো "জীবিকাশ্রয়ী" গান? অন্য গানগুলো গেয়ে কি তবে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয়? অন্য গানগুলো গেয়ে জীবিকা নির্বাহ অন্তত জঙ্গলমহলে সম্ভব নয়। পাশাপাশি অন্য কিছু উপার্জন থাকতেই হয়। এই ধরনের গানগুলো (সাপ খেলার গান, পুতুল নাচের গান, বাঁদর খেলার গান)  জীবিকার ক্ষেত্র ছাড়া অন্যত্র ব্যবহৃত হয় না। এমনকি স্বাধীনভাবে ও এ গান কখনও ব্যবহৃত হয় না। তাই এগুলোকে জীবিকাশ্রয়ী গান বলা হয়ে থাকে।

বাঁদর নাচের গানগুলোও বেশ। একেবারে ছড়ার ছন্দে রচিত। হাতের লাঠি মাটিতে ঠুকে ঠুকে তাল রক্ষা করতে হয়। কোনওরকম অসঙ্গতি বা অর্থহীন বিষয় এখানে থাকেনা। নির্দিষ্ট ছন্দে তালে তালে কেবল গীত হয়। এগানের একটা নির্দিষ্ট বিষয় বস্তু থাকে। সেগুলো বেশিরভাগই 'লোকজীবন' সম্পর্কিত। বিশেষ করে লোকজীবনের কৌতুককর দিকগুলোকেই ফুটিয়ে তোলা হয়। দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে তাই সেটা বেশ হাস্যরসের উদ্রেক করে। তবে বাঁদর নাচের গানের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, এ ধরনের গানের প্রায় প্রতিটি গানেই খাদ্য প্রসঙ্গ একটু হলেও থাকবেই। এ ধরণের গানগুলো হল----

১) আধন কুঁটা ছাঁটা চাল ফাগুন মাসে বিহা।
চৎ মাসে বাউ পড়ল নাই হল্য বিহা।।

২) আল ধানের মাড় রাঁধ্যেছি কানা শাগের বেসাতি
সাঁজের বেলা দেঅর শালা লুচকাঁই খায় বেসাতি।।

৩) থালে থালে চাল ভিজাবি গালে গালে খাবি।
কাছে আছে শ্বশুর বাড়ি কন গাড়িটাই যাবি।।

৪) আসনা পাতের বাসনা করল্যা পাতের দনা।
দনায় দনায় মদ পরশে হিলে কানের সনা।।

৫) উড়কি ধানের মুড়কি বাদাম ধানের খই।
বদ্ধমানে দেখ্যে আল্যম গামছা বাঁধা দই।।

৬) আম ফলে ধকা ধকা তেঁতুল ধরে বাঁকা।
নামাল দেশে দেখ্যে আল্যম রাঁড়ির হাতে শাঁখা।।

৭) নাগপুর কা ছাতা চাল বুঁচা ডাডিরপানি।
বৈঠলল বৈঠল ভাত রাঁইধছে কেঁউঝর কা রানী।।

৮) চাঁইবাসার সরু চিড়া শিশিরে নাই ভিজে চিড়া।
পানীর বড় টানাটানি অহ জিহল খানার পানী।।

৯) বাঁগা বাঁগা খেজাড়ি কাকাডচাং পিঠা।
ঝঁট বিদায় দে আমায় ঘর কাঁইরাকচা।।

সাপ খেলানোর গানগুলোও বেশ। উচ্চাঙ্গ সুরে গান ও ঢাকি বাজিয়ে সাপ খেলোয়াড়েরা লোক জড়ো করে। কখনও বীন বাজিয়েও লোক জড়ো করে। তারপর বিষধর ফণা যুক্ত সাপের সঙ্গে নানান কসরত করে খেলা দেখায়। কোনও কোনও সাহসী খেলোয়াড় তো সাপের ঠোঁটে চুমু পর্যন্ত খায়। পরে খেলা শেষে চাল পয়সা আদায় করে। তবে কিছু কিছু জায়গায় এখনও এই খেলা দেখানো হয়। খেলা দেখানোর পাশাপাশি এখন তারা নানারকম তাবিজ কবজও বিক্রি করা শুরু করেছে। সহজ সরল গ্রামের মানুষকে ভয় ধরিয়ে নয় তো তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা নানা ভাবে ঠকায়। তবে আশার কথা এটাই যে মানুষ এখন আর এই সব বুজরুকি বিশ্বাস করছে না। ধীরে ধীরে তারাও সচেতন হয়ে উঠছে।

সাপ খেলানোর গানগুলো হল সব মনসামঙ্গলের গান। ছোট ছোট ভাগে ভেঙে গানগুলো তারা গেয়ে থাকে। গানের মাঝে মাঝে দু-চারটে ভাষণও দেয়। সাপ খেলানোর এরকম কতকগুলো গান হল---

১) জয় জয় মা মনসা জয় বিষহরি
পদ্ম পাতায় জন্ম মায়ের মনসা সুন্দরী।।

২) লাগের হল্য খাট পালঙ্খ লাগের সিংহাসন
মঙ্গলা বড়ার পিষ্ঠে দেবীর আসন।।

৩) উড়িল অঙ্গারের গুঁড়ি কালির নিঃশ্বাসে
জয় জয় বলি কালি বাসরে প্রবেশে।।
সুতার সঞ্চারে কালি বাসরে সামাল্য
এতদিনে লখিন্দরের বিধিবাম হল্য।।

এছাড়াও পাটি গীত বা পট গানগুলোও এই শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। জঙ্গলমহলের ঘরে ঘরে একশ্রেণীর 'পাটিকার' অনেকটাই বৈষ্ণবদের মতো করে গান শুনিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করত। আর এভাবেই তারা জীবিকা অর্জন করত। বৈষ্ণবদের মতো গলায় তুলসীর মালা এবং নাক জুড়ে তিলক কাটা থাকে। পদাবলীর সুরে গান গেয়ে থাকে। বাড়ি বাড়ি গান শুনিয়েই তাদের একমাত্র উপার্জন। এদের গানগুলো একান্তভাবেই পট নির্ভর। তাদের গানের বিষয় হল কৃষ্ণ লীলা, রাম লীলা, নহব রাজা, দাতা কর্ণ হরিশচন্দ্র ইত্যাদি।

এর কিছু পালাগানও আছে। যেমন "জগন্নাথ দর্শন পালা" গানের প্রথম চারটি স্তবক হল---

অপূর্ব কৌতুক কথা শুনে সর্বজনে
নীলাচলে অবতার অমৃত কথনে
এড়াবে শমন দায় চিত্ত দেহ যদি
কলিযুগে তরিবে নিস্তার ভবনদী।।

আবার "দুর্গাকালি পালা"-র গানের শুরুটা হল এইরকম---

ভাবিনি ভৈরবী মাতা দুঃখ বিনাশিনী
এক মেঘে চলে মা দসর মেঘে পানী
তুমি জারে দোয়া কর মা তার কিবা দুখ
সুমের উঠ্যে লিতে পারে হেলাইয়া বুক।।

এখন আর পাটিকারদের গান গেয়ে ভিক্ষা করতে দেখা যায় না। তারা বিকল্প রোজগারে নিজেদের নিযুক্ত করেছে। পুতুল নাচও তাই। তখন জঙ্গলমহলের গ্রামে কিংবা মেলায় পুতুল নাচের আসর বসতই বসত। টিভি সিরিয়াল সিনেমা মানুষের কাছে পৌঁছে যেতেই মানুষ পুতুল নাচের মতো বিনোদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। অথচ এটাই ছিল তখনকার এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিনোদন। সামাজিক, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক পালাগুলো গান ও কথায় অসাধারণ হয়ে উঠত। ওটাই ছিল শিল্পীদের একমাত্র রোজগার। পরে পরে সময়ের অগ্রগতিই এই পুতুল নাচের বিলোপ ঘটিয়ে দিল। শিল্পীরাও বিকল্প জীবিকা অনুসন্ধানে একরকম বাধ্য হল। 

তথ্যসূত্র: ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য- বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments