জ্বলদর্চি

‘ইনার আই’/ অর্ণব মিত্র

‘ইনার আই’ 

অর্ণব মিত্র 


বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক সত্যজিৎ রায় কর্মজীবনে সিনেমা বা কাহিনীচিত্র বানিয়ে সফল ও জনপ্রিয় হলেও ছাত্রজীবনে স্নাতকস্তরে পড়াশুনা করেছিলেন ‘পেনটিং’ বা চিত্রকলা নিয়ে।কারণ তিনি ছোটবেলা থেকেই ভাল ছবি আঁকতে পারতেন। তাই তিনি কিশোরে বয়সে তার মায়ের কথামত শান্তিনিকেতনে কবিগুরু প্রতিষ্ঠিত শিল্প শিক্ষার কেন্দ্র ‘কলাভবন’ –এ চিত্রকলা নিয়ে ভর্তি হন। তখন কলাভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন নন্দলাল বসু। ভাস্কর্য বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন রামকিঙ্কর ও অধ্যক্ষ নন্দলাল বসু ছাড়া চিত্রকলা বিষয়ের অন্য আর একজন শিক্ষক ছিলেন চিত্রশিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। এই মাস্টারমশাই –দের মধ্যে তার সব থেকে মনে ধরল বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় –কে। তার সমন্ধে সত্যজিৎ রায় তার ‘বিনোদদা’ প্রবন্ধে লিখছেন ‘শান্তিনিকেতনে আশ্রমে পৌঁছানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে যার ছবি চোখে পড়ল তিনি হলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়।কলাভবনের হস্টেলে একটি তিন –কামরা বিশিষ্ট নতুন ছাত্রাবাসে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। তিনধাপ সিঁড়ি উঠে বাড়ির সামনের বারান্দায় পা দিতেই দৃষ্টি আপনা থেকে উপর দিকে চলে গেল। সারা সিলিং জুড়ে একটি ছবি।গাছপালা, মাঠ,মানুষ,পাখি জানোয়ারে পরিপূর্ণ একটি স্নিগ্ধ অথচ বর্ণোজ্জল গ্রাম্যদৃশ্য। বীরভূমের গ্রাম।দৃশ্য না বলে ট্যপেস্ট্রি বলাই ভাল। অথবা এনসাইক্লোপিডিয়া’।

তার এই প্রিয় মাস্টারমশাইকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানান ১৯৭২ সালে।নাম দেন ‘ইনার আই’।ততদিনে সিনেমা পরিচালক হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন ভারতবর্ষে ও ভারতবর্ষের বাইরেও।১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ বানানোর পর পনেরো বছর ধরে আরও বেশকিছু চলচ্ছিত্র পরিচালনা করেন তিনি।সমগ্র ভারতীয় দর্শকের কথা মাথায় রেখে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একটি প্রকল্প হিসেবে এই তথ্যচিত্র বানান হয়। তাই তার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন ‘ইংরেজি’ কে।তথ্যচিত্রের ধারাভাষ্যকার তিনি নিজেই।১৯৭১ সালে নভেম্বরে তিনি শান্তিনিকেতনে চলে আসেন লোকেশন দেখতে। ছাত্রজীবনে শান্তিনিকেতনের নিসর্গ,গ্রাম ও প্রকৃতির প্রতি যে টান তৈরী হয়েছিল তা ত ছিলই। সঙ্গে যোগ হল বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও মুরালশিল্পী তথা তার প্রিয় মাস্টারমশাই এঁর জীবন ও কাজ কে সেলুলয়েডে ধরা ও ভারত তথা বিশ্ব শিল্পরসিকদের সামনে তুলে ধরা। 


বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়-এঁর জন্ম হয়েছিল ১৯০৩ সালে কলকাতার বেহালাতে একটি বড় পরিবারে। তারা ছিলেন ছয় ভাই ও এক বোন।ছয় ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সব থেকে ছোট। জন্ম অবস্থা থেকেই তিনি ছিলেন একটি চোখে অন্ধ। হয়ত সেই কারণেই স্বাভাবিক খেলাধুলা ও তার বয়সী বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা থেকে দূরে সরে আসেন ও প্রকৃতির সাথে তার ক্রমস্য একাত্মতা তৈরী হয়। শিল্পীসুলভ পর্যবেক্ষণ গুণ তার মধ্যে জেগে ওঠে।খাতার পাতার ড্রয়িং শুরু হয়। স্কেচ করতে থাকেন।শেষে চিত্রকলা চর্চার জন্য তিনি শান্তিনিকেতনের কলাভবনে আসেন। তখন কলাভবন সবে শুরু হয়েছে।শিক্ষক ছিলেন নন্দলাল বসু ।

শান্তিনিকেতনে এসে খোলামেলা প্রকৃতির মধ্যে সেই লাজুক কিশোরটির শিল্পীমন আরও বিকশিত হয়।শান্তিনিকেতন তথা বীরভূম-এর নিসর্গ দৃশ্য ও আশেপাশের গ্রামগুলিতে সাঁওতালদের জীবনযাত্রা তাকে বেশী আকৃষ্ট করে।তিনি সেই সীমাহীন প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার স্কেচ করতে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, লতাপাতা –গুল্ম ইত্যাদির স্কেচের মধ্যে দিয়ে তাদের ধরন ও ছন্দ ফুটিয়ে তোলেন। পশুপাখীদের অঙ্গভঙ্গী ড্রয়িং করতে থাকেন। তার ছাত্রাঅবস্থা থেকেই তার প্রতিটি রেখাধর্মী স্কেচের মধ্যে এক ভারতীয় ধরণ ও বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। তথ্যচিত্রে এই স্কেচগুলি দেখান হয়।পরে কলাভবনের নতুন ছাত্রাবাসের সিলিং জুড়ে যে বর্ণময় মুরালটি দেখান হয় তার উপাদান হিসেবে এই গাছ,লতাপাতা, পশুপাখীর স্কেচগুলি ব্যবহার করেন।তথ্যচিত্রে দেখান হয় এই মুরালটির মূল ভাবনা আসে একটি মিশরীয় খণ্ডচিত্র দেখার পর।মিশরীয় চিত্রের মাঝখানে একটি পুকুর ও চারিদিকে গাছপালা দেখান হয়েছে।বিনোদবিহারী তার মুরালে এই গাছপালাগুলির মধ্যে বৈচিত্র্য আনলেন ও তার মধ্যে মানুষের ও পশুপাখীর অবস্থান দেখালেন ও তাকে আরও প্রাণবন্ত ও শান্তিনিকেতন তথা বীরভূম-এর মত করে তুললেন।এছাড়া এর রঙ এর মোটা প্রলেপ ও তার প্রয়োগের মধ্যে এক নিজস্বতা ছিল যা খুবিই ভারতীয়।  তার রঙ খুবই স্নিগ্ধ ও অনেকটা অজন্তা গুহার দেওয়াল চিত্রের রঙের মত। হলুদ, সেঁওলা সবুজ, মাটি রঙ, বাদামী রঙ,ও বাদামী গাঁড় লাল রঙের ব্যবহার খুবই নিজস্বতা ফুটে উঠেছে ও প্রাণবন্ত ও স্নিগ্ধ করেছে তার কাজগুলিকে। 


কলাভবন থেকে চিত্রকলা শিখে নন্দলাল বসুর পরামর্শে কলাভবনেই শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করলেন। এরপর ১৯৩৭ সালে তার জাপান যাওয়ার সুযোগ আসে। জাপানী শিল্পী সাতাৎশু ও চৌবাশোচর কাজের দ্বারা প্রভাবিত হন। সেই প্রভাব তার পরের মুরালগুলিতে দেখা যায়।তাতে তিনি মুরাল-এর স্থান বা চিত্রপট-কে সরলীকরণ করেছেন কিছু বিভাগ করে।তা হাল্কা ও গাঢ় রঙ দিয়ে ভরেছেন মুরাল –এর বিষয় অনুসারে।আর তার ভিতর রেখাচিত্রময় মানুষের অবয়ব দেখিয়েছেন যা নন্দলাল বসু বা শান্তিনিকেতনের অন্যান্য শিল্পীদের করা কাজেও দেখা যায় তবে তার ক্ষেত্রে তা কিছুটা ঘনভাবে সংবদ্ধ।যা সংরচনায় একটি মানুষের অবয়বের মধ্যে পারস্পরিক টেনশন তৈরি করে।

এরপর তিনি বেনারস যান। বেনারস থেকে ফিরে এসে শান্তিনিকেতনের চীনাভবনে আর একটি মুরাল করেন। সেই সময় চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর –এঁর প্রভাবে যে ‘বেঙ্গল স্কুল’ বা বাংলা ঘরানা তৈরি হয়েছিল তার অন্তর্গত শিল্পীদের মধ্যে মুরাল আঁকার প্রতিভা ও আগ্রহ তাঁর মধ্যেই দেখা গেছে বেশী। 

মানুষের জীবনযাত্রার যে সামগ্রিক রুপ তা মুরালের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলা যায়। একটি ছোট একক পেনটিং-এঁর পরিসরে তা কখনই সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে  মুরালের সাথে মিল পাওয়া যায় সিনেমার সাথে। সিনেমাতেও একটি কাহিনি বলার জন্য দরকার হয় অনেকটা জায়গা।আর তার জন্য দরকার হয় অনেকটা ফিল্ম।কাহিনির বর্ণনার জন্য দরকার হয় অভিনীত দৃশ্যগুলিকে জোড়া।তার মধ্যে থাকে চরিত্র- চিত্রণ। ঘটনার ঘাত প্রতিঘাত। এভাবে আলোছায়াময় ছোট ছোট কাহিনি – অংশ জুড়ে একটি বড় গল্প বলেন সিনেমা পরিচালক। মুরাল –এঁর ক্ষেত্রেও তাই।তার মধ্যেও কাহিনি থাকে।থাকে সেই কাহিনির বর্ণনা। তার মধ্যে দেখান হয় কোন বিশেষ চরিত্রকে। থাকে আলোছায়া ও রঙের প্রয়োগ। 

বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন সত্যিকারের প্রতিভাবান মুরাল শিল্পী। চীনাভবনের পর শান্তিনিকেতনের হিন্দীভবনে যে মুরালটি করেন তাতে তার সেরা কাজটি বেরিয়ে আসে। বিষয়টি হল মধ্যযুগের ভারতে সাধুসন্তদের জীবন। সেন্ট্রাল

হলের তিন দেওয়াল জুড়ে মুরালটির বিস্তার। মুরালটির বিস্তৃত পটজুড়ে তিনি মধ্যযুগের ভারতের আবহ তৈরি করেন। তাতে বিভিন্ন মানুষের অবয়ব।ছোট ও বড় আকারে।একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।বাদামী ও হলুদাভ মাটি রঙের প্রয়োগ ও প্রলেপের মধ্যে তার একান্ত নিজস্ব সুললিত ধরন। বাদামী রঙের গাঢ় ও হাল্কা রেখার মধ্যে ধরাছোঁয়ার খেলা। চারকোনা,লম্বা ও আয়তাকার বাক্সের মধ্যে দিয়ে ঘরবাড়ীর আভাস অনেকটাই ভারতীয় মিনিয়েচার চিত্রের কথা মনে করায়। ছোট ছোট বাড়ীগুলির মধ্যে একটি দুটি রেখার টানে মানুষের অবয়ব দেখিয়েছেন।তাতে প্রাচীন জীবনের চলমানতার সুদূর রহস্য ফুটে উঠেছে। এই প্রকৃতির, সৃষ্টি, মানুষের জীবন ও তার অস্তিত্বকে ঘিরে যে রহস্যময়তা আছে তা তার কাজের এক অন্তর্নিহিত মানে হয়ে যায়। 

তার গুণমুগ্ধ ছাত্র সত্যজিৎ রায় এই শিল্পকর্মটি সম্বন্ধে লিখছেন ‘১৯৫০ সালের সাতই পৌষের মেলা দেখতে গিয়ে বিনোদদার সাম্প্রতিকতম শিল্পকীর্তির সঙ্গে পরিচয় হয়।‘ভারতের’ মধ্যযুগীয় সাধুসন্তদের জীবনকে কেন্দ্র করে হিন্দিভবনের তিনটি দেয়ালে আঁকা মুরাল,বর্তমান শতাব্দীতে আমাদের দেশে এরচেয়ে মহৎ ও সার্থক কোন শিল্পকীর্তি রচিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই’।


৩ 
বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় জন্ম থেকেই একটি চোখে অন্ধ ছিলেন।তাই তিনি একটি চোখ দিয়ে দেখতেন।সারাজীবন তিনি শিল্পসৃষ্টির কাজে মগ্ন থেকেছেন।কলাভবনে  শিক্ষকতা ও আরও বিভিন্ন কাজে তিনি ব্যস্ত থেকেছেন।তাই বয়সের সাথে সাথে তার চোখের উপর চাপ পড়ে ও দৃষ্টি কমতে থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা গুরুতর আকার ধারণ করে।১৯৫৭ সালে তার চোখের ছানির অপারেশন হয়।কিন্তু তা সফল হয়নি।তিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান।তবে অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তার রঙ-তুলি থেমে থাকে না। তথ্যচিত্রে তা দেখান হয়। তিনি মোটা ও ভারী কাগজকে ভাজ করে মানুষের বিভিন্ন আকার তৈরি করেন ও সেগুলি বসিয়ে বসিয়ে মানুষের কাজকর্মের বিভিন্ন ভঙ্গি মুরালে ফুটিয়ে তোলেন।কাগজকে ভাঁজ করে হাত-পা’র বিন্যাস তৈরি করেন ও বসবার ও দাঁড়াবার ভঙ্গিতে বৈচিত্র্য নিয়ে আসেন।কোলাজ করেন রঙ্গিন কাগজ কেটে।একটি হাল্কা রঙের চিত্রপটে মানুষের অবয়ব বাদামী বা মাটি রঙের দেখান। মানুষের সাথে অন্যান্য বস্তু যা দেখান সেগুলি উজ্জ্বল রঙের ও মানুষের অবয়বের আশেপাশে তাদের অবস্থান এক সুন্দর সৌন্দর্যময় সমন্বয় তৈরি করে।যেহেতু তিনি দু-চোখেই অন্ধ তাই তাকে সাহায্যের জন্য একজন থাকতেন। 

খুব ছোট বয়স থেকেই তার চিত্রকলার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। পুরোপুরি দু-চোখে অন্ধ হয়ে যাওয়া অবধি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তিনি চিত্রকলার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তার এই চর্চা থেমে থাকেনি।কারণ এত বছর ধরে তিনি প্রকৃতি ও মানুষকে পর্যবেক্ষণ করেছেন ও শিল্পে তা  উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন তার মত করে। অবিরাম শিল্পচর্চার ফলে মনের মধ্যে যে অভিজ্ঞতা জড়ো করেছেন তার আলোতে তার অন্তরের চোখ জাগরিত হয়েছে ও আলো পেয়েছে। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের শিল্পী।মানুষের জীবনকে সহানুভূতি দিয়ে দেখেছেন। অন্ধ হয়েছেন কিন্তু শিল্পচর্চা করে গেছেন তার অন্তরের চোখ বা ‘ইনার আই’ দিয়ে। তার গুনমুগ্ধ ছাত্র সত্যজিৎ রায় তার তথ্যচিত্র ‘ইনার আই’-তে এই কথাটাই তুলে ধরেছেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments