জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা -৩১/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৩১

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত 

 ঘটনাচক্রে তারকনাথের বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু বৈরাগ্যবান তারকের মনে আলোড়ন চলছে, বিশেষ করে শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসার পর। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা একদিন ঠাকুরকে নিবেদন করলেন। ঠাকুর বললেন, “ভয় কিরে -- আমি আছি। স্ত্রী যতদিন বেঁচে থাকবে তাকে দেখাশুনা করতে হবে বই কি। একটু ধৈর্য ধর -- মা সব ঠিক করে দেবেন। বাড়িতে মাঝে মাঝে যাবি, আর যেমনটি বলে দিচ্ছি তেমনটি করবি -- তাঁর কৃপায় স্ত্রী সঙ্গে থাকলেও কোন ক্ষতি হবে না।” এই কথা বলে তিনি তারকের বুক ও মাথায় হাত দিয়ে খুব আশীর্বাদ করেন। তারক ঠাকুরের কথা মেনে প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়িতে যেতেন। স্ত্রী অসুস্থ হলে তাঁর সেবাশুশ্রূষার ব্যবস্থা করতেন। সবই করতেন অনাসক্ত হয়ে। 

পরবর্তী কালে প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক রোমাঁ রোলাঁকে লিখেছিলেন, জীবনে তিনি কখনও স্ত্রীর সঙ্গে এক শয্যায় শয়ন করেননি। অত্যাশ্চর্য ত্যাগ! পরবর্তী কালে তাঁর স্ত্রী নিত্যকালী দেবী রোগে ভুগে ইহলোক ত্যাগ করেন। তারক সংসার-বন্ধন থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হন। এরপর পিতার আশীর্বাদ নিয়ে সংসার ত্যাগ করেন। পিতা রামকানাই ঘোষাল বলেছিলেন --“তোমার ভগবানলাভ হোক। আমি নিজে অনেক চেষ্টা করেছি -- সংসার ছাড়বারও চেষ্টা করেছিলাম; কিন্তু পারি নি। তাই তোমাকে আশীর্বাদ করছি -- তোমার ভগবানলাভ হোক।” ঠাকুর একথা শুনে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। এই ঘটনা ঘটেছিল আনুমানিক ১৮৮৩ সালের শেষভাগে।

 বস্তুতপক্ষে এই সময় থেকেই শুরু হয় তারকনাথের সন্ন্যাস জীবন। গৃহত্যাগের পর কিছুদিন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে বাস করেন। এরপর ভক্তপ্রবর রামচন্দ্র দত্তকে ঠাকুর বলেন, “দেখ, রাম, এই তারক তোমাদের বাড়িতে থাকবে। ও সর্বদা এখানকার ভক্তদের সঙ্গে বাস করতে বড়ই উৎসুক হয়েছে।” অন্যদিকে তারককে বললেন, “দ্যাখ, তুই ব্রাহ্মণের ছেলে -- তাদের অন্নটা খাসনি, আর সব খাবি।” এই সময়ের প্রাঞ্জল বর্ণনা ভক্তমালিকায় এইরকম -- “তারক রামবাবুর বাড়িতে স্বপাক খাইয়া ভগবানের স্মরণ-মননে কালাতিপাত করিতেন। ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে ভূমিশয্যায় একাহারে সেই কঠোর তপস্যা লিখিয়া বুঝাইবার নহে। তিনি নিজে বলিয়াছিলেন, ‘অধিকাংশ দিনই একাহার, তাও হবিষ্যান্ন। কখনও বা আলুবেগুন বা যা হয় কিছু পুড়িয়ে তা দিয়ে দুটি পুড়িয়ে খেয়ে নিতাম। দেহের আরামের জন্য সময় দিতে আদৌ ইচ্ছা  হত না।’ ‘কথামৃতে’ আছে, ‘তারকের অবস্থা এখন অন্তর্মুখ। তিনি লোকের সঙ্গে বেশী কথা কন না’(৫ম ভাগ, ৮১ পৃষ্ঠা)। পথ চলিতে তাঁহার দৃষ্টি পদাঙ্গুষ্ঠনিবদ্ধ থাকিত।... তাঁহার নিজের কথায় জানা যায়, ‘এমন অনেক সময় গেছে, যখন বিডনস্কোয়ারে ও হেদোয় রাতভর ধ্যানভজন করে কাটিয়ে দেওয়া যেত।  কখনও বা কালীঘাট এবং কেওড়াতলায়ও ধ্যানভজন করেছি।’ রামবাবুর বাড়ি হইতে তিনি কাঁকুড়গাছি গমন করেন। তখন ঐ অঞ্চল জঙ্গলাকীর্ণ, লোকজনের যাতায়াত বিশেষ ছিল না।

 বাগানে একটি মালী মাত্র থাকিত। সেখানে আমগাছ-তলায় ধুনি জ্বালাইয়া তিনি দিনরাত ধ্যানেজপে কাটাইতেন; দিনে একবার বাহি‌র হইয়া যাহা পাইতেন তাহাতেই ক্ষুন্নিবৃত্তি করিতেন; পরিধানে একমাত্র কাপড় ছাড়া শরীরে অন্য আবরণ থাকিত না; আর দেহ, কেশ প্রভৃতির পরিপাটি মোটেই ছিল না।”
  ভাবতে বিস্ময় জাগে যে ঊনবিংশ শতাব্দীর এক বড় অংশ জুড়ে এই কলকাতা মহানগরী যেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সাধকগণের সাধনপীঠ হয়ে উঠেছে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব সাধনপীঠ হিসেবে একে জাগিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণেশ্বরকে উপলক্ষ করে অভূতপূর্ব তপস্যায় জাগিয়েছিলেন ভারতাত্মাকে। তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানেরাও সম্পন্ন করেছেন এই কাজ। তাঁদের পুণ্য স্পর্শে কলকাতা পরিণত হয়েছে এক মহা তীর্থভূমিতে।

 এই বিষয়ে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ভক্তমালিকা অনুসরণ করে উল্লেখ করা যেতে পারে। এর থেকে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারা যায় যে, কলকাতা মহানগরী ও শ্রীরামকৃষ্ণ কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন! ঘটনাটি এইরকম -- “১৮৮৬ অব্দে ঠাকুর চিকিৎসার্থে কাশীপুরে আসিলে তারকও তাঁহার সেবার জন্য তথায় বাস করিতে লাগিলেন। সেবার অবসরে নরেন্দ্রর নেতৃত্বে তখন ধ্যান ভজন ও শাস্ত্রালোচনা চলিত। বৌদ্ধধর্মের এবং নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মের চিন্তাও যথেষ্ট হইত।... তথাগতের চিন্তায় বিভোর নরেন্দ্র একদিন তারক ও কালীকে বলিলেন যে, বুদ্ধগয়ায় গিয়া তপস্যা করিতে হইবে। উভয়েই তাঁহার সঙ্গে চলিলেন; প্রত্যেকের সম্বল -- গায়ে গেরুয়া বহির্বাস ও স্কন্ধে একখানি কম্বল। বুদ্ধগয়ায় পৌঁছিয়া, যে বোধিদ্রুমমূলে ধ্যানমগ্ন তথাগত বুদ্ধত্ব লাভ করিয়াছিলেন,  তাঁহারা তাহার নিম্নে ধ্যানে রত হইলেন। যে বজ্রাসনে শাক্যসিংহ বসিয়াছিলেন, নরেন্দ্র তাহাতে উপবিষ্ট হইলেন।

 তিনজনে পাশাপাশি ধ্যানে রত আছেন, এমন সময় নরেন্দ্রনাথ হঠাৎ ভাবাবস্থায় কাঁদিতে কাঁদিতে তারকনাথকে জড়াইয়া ধরিলেন। মুহূর্তমধ্যে আবার সহজাবস্থা লাভ করিয়া ধ্যানে বসিলেন। পরে তারক কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া নরেন্দ্র বলিয়াছিলেন, ‘মনে একটা গভীর বেদনা অনুভব করেছিলুম।... সবই তো রয়েছে -- তিনি কোথায়?... বুদ্ধদেবের বিরহ এত তীব্র বোধ হতে লাগল যে, আর সামলাতে পারলুম না -- কেঁদে উঠে আপনাকে জড়িয়ে ধরলুম।’ ( স্বামী অভেদানন্দের বিবরণ একটু অন্যরূপ। তাঁহার মতে এই ঘটনা হইয়াছিল পরদিন প্রত্যূষে ৮ বা ৯ই এপ্রিল, ১৮৮৬ -- যখন তিনজনে সারা রাত্রি বোধিদ্রুমের নীচে ধ্যান করিয়া পুনর্বার প্রত্যূষে মন্দিরমধ্যে ধ্যানে বসিয়াছিলেন। নরেন্দ্রর বামে ছিলেন কালী-অভেদানন্দ ও কালীর বামে তারক। এই ঘটনা সম্বন্ধে নরেন্দ্র কালীকে বলিয়াছিলেন,  ‘বুদ্ধমূর্তি থেকে তোমার পাশে তারকদার দিক দিয়ে একটা জ্যোতি pass বা বের হয়ে গেল। সম্ভবতঃ এই বিবরণ শুনিয়াই স্বামী অদ্ভুতানন্দ পরে বলিয়াছিলেন, ‘বুদ্ধগয়া-তে তো লোরেন ভাই তারকদাদার দেহে একটা জ্যোতি প্রবেশ করতে দেখেছিল।’ কে জানে নিরাকারের চিন্তায় নিমগ্ন তারকের সহিত নির্বাণমার্গী বৌদ্ধগণের কোন অলৌকিক সম্বন্ধ ছিল কিনা ) সেই রাত্রি ধ্যানেই কাটিয়া গেল। তাঁহাদের ইচ্ছা ছিল বুদ্ধগয়ায় কিছুদিন থাকেন, কিন্তু ভিক্ষালব্ধ মড়ুয়ার রুটি নরেন্দ্রর পেটে সহ্য হইল না। আবার শীতবস্ত্রের অভাবে রাত্রিতে নিদ্রার ব্যাঘাত হইতে লাগিল। সুতরাং তিন-চারদিন পরেই তাঁহারা গয়া হইয়া পুনর্বার কাশীপুরে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদিগকে দেখিয়া ঠাকুর সকৌতুকে একটি অঙ্গুলি চারিদিকে ঘুরাইয়া পরে বৃদ্ধাঙ্গুল নাড়িয়া বলিলেন, ‘এবার সব এখানে; আর যেখানেই যাও না কেন কোথাও কিছু পাবে না।”

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments