জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। ছাব্বিশ /শুভঙ্কর দাস

 
 মাটিমাখা মহাপ্রাণ। ছাব্বিশ 

শুভঙ্কর দাস 

"প্রবাহের পটে
মহাকাল দুই রূপ ধরে
পরে পরে
কালো আর সাদা ।
কেবলি দক্ষিণে বামে প্রকাশ ও প্রকাশের বাধা
অধরার প্রতিবিম্ব গতিভঙ্গে যায় এঁকে এঁকে,
গতিভঙ্গে যায় ঢেকে ঢেকে.."

গৃহ থেকে কুমারচন্দ্র সুতাহাটায় হরতাল করার জন্য বেরিয়ে গেছিলেন ভোররাতে,তারপর পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পৌঁছে গেছিলেন আমেদাবাদ। ফিরলেন গৃহে মাঝরাতে।

দরজাটা ঠেলতেই একটা আলোর বিন্দু বারান্দায় দেখতে পেলেন।এই আলোর বিন্দু তিনি সুতাহাটা যাওয়ার সময় দেখে গিয়েছিলেন। একটা দেশি মিলের শাড়ি পরে বসে আছেন চারুশীলা।সামনে অল্প আলোর হ্যারিকেন।

কী সর্বনাশ,তুমি জানলে কী করে আমি আজ এইসময় ফিরব?

চারুশীলা দেবী মৃদু হেসে বললেন,যে অপেক্ষা করতে জানে,সে যার জন্য অপেক্ষা করছে,তার পদধ্বনি শুনতে পায়।

কিন্তু, এটা কি জানো,ট্রেনটা অনেক ভাগ্যে পেয়েছি, ওটা না পেলে হয়তো আরও দুটো দিন পরে আসতে পারতাম!

আচ্ছা, সব শুনছি,আগে ভাত খেয়ে নাও,তারপর সব শুনছি

বলেই চারুশীলা উঠে গিয়ে রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকলেন। 

হ্যাঁ,বড্ড খিদে পেয়েছে, এমন ভাব হচ্ছে, গোটা গোলাঘর খেয়ে ফেলতে পারি,গতকাল থেকে ভালো করে খাওয়া হয়নি!

বারান্দায় কাছে যেতে কুমারচন্দ্র দেখলেন, আলনার মতো করে রাখা বাঁশের ওপর গামছা, কাচা ধূতি ও ফতুয়া সব পরিপাটি করে সাজানো। এবং একটি ছোট্ট বাটিতে রাখা সর্ষে তেল।
কুমারচন্দ্র একটু অবাক হলেন।মুখে কিছু না বলে,সেগুলো নিয়ে পুকুরঘাটে চলে গেলেন।

ফিরে এসে আসনে বসতেই চারুশীলা দেবী ভাতের থালা সাজিয়ে দিলেন।ডাল,শুক্তো এবং সবচেয়ে আশ্চর্য তাঁর প্রিয় ছানার তরকারিও রয়েছে। 

আরে বাপ্ এতো রহস্যময় আয়োজন, তুমি এসব করলে কী করে?

চারুশীলা দেবী নীরব।

প্রায় প্রতিদিন একই রকম পাগলামি আয়োজন চলছে,ভাই,তুই খেয়ে নে,মেয়েদের মন  স্বয়ং ঈশ্বরেও দুর্বোধ্য, তুই তো মানুষের ব্যাটা,খেয়ে নে,আর পারলে,তোর পাগলা বউকে কোঁচড়ে বেঁধে যুদ্ধ কর, হাঃ হাঃ হাঃ 

সহসা অনতি দূরের কক্ষ থেকে কুমারচন্দ্রের দিদির কৌতুককণ্ঠ শোনা গেল।

চারুশীলা মুখ নিচু করে বসে ছিলেন। এসব শুনে রান্নাঘরের ঘরের দিকে ছুটলেন।
কুমারচন্দ্র সেদিকে একটু সময় স্থিরভাবে চেয়ে রইলেন।
তারপর ক্ষুধাতুর মানুষ দীর্ঘদিন পরে খাদ্য-পানীয় পেলে যেমন করে খায়,তেমনি কুমারচন্দ্র নিমেষে অন্নগ্রহণ শুরু করলেন।

সত্যি তাঁর ভীষণ খিদে পেয়েছিল।সেই সুতাহাটা থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসেছেন। মনে মনে ভেবেছিলেন,এতো রাতে কাউকে বিরক্ত না করে,নিজেই এক ধামা মুড়ি জল দিয়ে খেয়ে বারান্দায় শুয়ে পড়বেন।
কিন্তু এখানে যে ঈশ্বর ন জানন্তি কাণ্ড হবে,তিনি বুঝবেন কী করে!
তারপর জানলেন,মা-দাদা পাশের গ্রামে এক আত্মীয়ের গৃহে গেছেন।তখন সরাসরি কুমারচন্দ্র নিজের শোবার ঘরে এসে নিজের পুঁটলিটি খুললেন।
চারুশীলা এলেন।
কুমারচন্দ্র তাঁকে বিছানার ওপর বসতে বললেন। ঝুলি থেকে একটি  মোড়া-কাগজ বের করে বললেন,চারু,অনেকে নানা তীর্থের মাটি এনে গৃহের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়,আমিও এক তীর্থ গেছিলাম,তার নাম জালিওয়ানাবাগ। সেখান থেকে এনেছি জালিওয়ানাবাগের মাঠের মাটি,জালিওয়ানাবাগের ঘটনা জানো তো?

চারুশীলা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।

এই দেখো

বলে কুমারচন্দ্র কাগজটি খুলে চারুশীলা হাতের ওপর রাখলেন।তা দেখে চারুশীলা সঙ্গে সঙ্গে মাথায় ঠেকালেন।
মুখে বললেন,আমাদের ভাই-বোনের বুকের রক্ত মাটিতে মিশেছে, এ মাটিতে কোনো কাজ বিফলে যাবে না,দেখে নিও।

এই একটি কথা কুমারচন্দ্রের কাছে এই মধ্যরাতে চারুশীলাকে নতুন করে তুলল।

চারুশীলা বললেন,এই পবিত্র মাটি কী করবে?

কাল সকালে অনন্তপুর যাব,জাতীয় বিদ্যালয়ের সামনে ছড়িয়ে দেব।

এই মাটি একটু দেবে?

কেন? কী করবে?

উঠোনে একটা শিউলি ফুলের গাছ লাগাব,সেই সময় এই মাটি ছড়িয়ে দেবো,যখন সুগন্ধি সাদা সাদা ফুলে গাছটি ভরে যাবে,তখন বুঝব আমাদের ভাইবোনেরা আবার জন্মগ্রহণ করেছে এবং মাটিকে সার্থক করেছে।

কী সুন্দর ভাবনা, বেশ বেশ, কাল সকালে উঠে আমিও তোমার সঙ্গে এই কাজ করব,খুব সুন্দর করে তো ভাবতে পারো চারু।

আমি কী ভাবলাম, তুমি যখনই মাটির কথা বললে,তখনই মাথায় এলো কথাটি,আর কিছু নয়,আমি নিজে কী আর জানি!

তোমার ফুলভরা গাছ যেদিন বড় হবে,সেদিন আশা করছি,দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে,তার আগে এই পরাধীনতার অন্ধকার ঘোচাতে তুমি আমাকে এইভাবে সাহায্য করবে তো?

চারুশীলা নীরব।

দ্যাখো,এই পথে কষ্ট-দুঃখ এবং বিচ্ছেদ হল সোনালি সুতো,যা আমাদের বেঁধে বেঁধে রাখবে।তুমি জানো না,এই দেশের মানুষের কী করুণ অবস্থা!  

আমার না জানলেও চলবে,আমি শুধু তোমাকে জানছি,এতেই আমি খুশি।

সে কি কথা! আমি কে?মেদিনীপুরের গোঁয়ার চাষা! বীরেনদা,গান্ধিজি এঁরাই তো মানুষের চোখ খুলে দিচ্ছেন,এঁরাই সব,এঁদের পথই পথ। আমার জীবন এঁদের জন্য উৎসর্গীকৃত। 

আর আমার তোমার জন্য...

মানে?

তুমি ওঁদের মধ্যে দিয়ে দেশকে বোঝো,জানো,দেশের কাজ করো,আর আমি তোমার মধ্যে দিয়ে দেশকে জানছি,দেশের কাজ করছি,তোমাকে কথা দিচ্ছি, তুমি বাইরেটা সামলাও,আমি ঘরটা দেখছি... একদিন ঘর ও বাহির মিলেই এই দেশ সোনার দেশ হয়ে উঠবে,তাই না!

কুমারচন্দ্র এগিয়ে গিয়ে চারুশীলা হাত দুটো আবেগে চেপে ধরে বললেন,চারু,তুমি কত কঠিন কথাকে সহজ করে বলতে পারো,আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি।
কাল দুজনে মিলে গাছ লাগাব,চারা কি আছে?

আছে,বাবা দিয়ে গেছেন,তুমি তখন ছিলে না!

কতদিন আগে

তিন-চার দিন হবে

তাহলে রোপন করনি কেন?

এই যে একসঙ্গে রোপন করব বলে!

ওহ্ বেশ বেশ, চারু সকাল হোক, সকালে আমাদের প্রথম কাজ শিউলিবরণ।

সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কুমারচন্দ্রের ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় চারুশীলাকে দেখতে পেলেন না! অর্থাৎ তিনি আরও আগে শয্যা ত্যাগ করেছেন।
পুকুরধারে এসে দেখলেন,চারুশীলা বালতি করে জল তুলছেন।

কী হল?

উঠোনের মাটিটা একটু নরম করে নিচ্ছি। 

আচ্ছা, আমাকে দাও, তুমি ওদিকটায় দেখো,
বলেই কুমারচন্দ্র জল বয়ে নিয়ে গিয়ে উঠোনের জায়গাটি চারা-রোপনের উপযুক্ত করে তুলল।
তারপর জালিওয়ানাবাগ থেকে আনা পবিত্র ধূলি ছড়িয়ে দিল।চারুশীলার জীবনে আজ একটি আশ্চর্য দিন। একসঙ্গে একটি গাছ তো শুধু লাগানো নয়,এটি যেন ভালোবাসার সূর্যালোক চিহ্ন। যখন গাছটি বড় হবে,ফুলে ফুলে ভরে উঠবে,তখন স্বামীর অনুপস্থিতিতে চারুশীলা সেই গাছের কাছে এসে স্বামীর সঙ্গ অনুভব করবেন। কারণ চারুশীলা মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছেন,তাঁর স্বামী যে পথের পথিক,তাঁকে কাছে বেঁধে রেখে কোনো লাভ নেই। সংসারের যাঁরা গুপ্ত সন্ন্যাসী, তাঁদের পথরেখা তো দৈনন্দিন সংসারের গৃহকোণ নয়, তাঁদের জন্য ফকিরের একতারার মতো তো বাইরে পথের সুর সর্বদা বাজে।বাজতেই থাকে।চারুশীলা যাদেরকে চরকা কাটা শিখিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজনের কাছে রবি ঠাকুরের কয়েকটি কবিতা শুনে শুনে মনে রেখেছে, চারুশীলার এই সময় তার মধ্যে একটি কবিতার চরণগুচ্ছ খুব মনে পড়ছে,কুমারচন্দ্র আগাছা পরিষ্কার করে তখন মাটি কুপোনোর কাজ করছেন,সেই দিকে তাকিয়ে চারুশীলা মনে মনে উচ্চারণ করলেন,

"হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে,যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে 
নাই নাই ভয়,সে শুধু আমারই,নিশিদিন কাঁদি তাই।
অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই।"

ঠিক যে মুহূর্তে চারুশীলা চারাগাছটি নিয়ে রোপনের জন্য কুমারচন্দ্রের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল,সেই সময় সদর দরজার সামনে বুটের শব্দ পাওয়া গেল।

সুতাহাটা থানার দুইজন পুলিশ এসে উপস্থিত হলেন।
একজন একটি সরকারি কাগজ নিয়ে কুমারচন্দ্রের মুখের সামনে তুলে ধরলেন।
কুমারচন্দ্র ইংরেজিতে লেখা নির্দেশনামাাটি পড়লেন।তারপর ধীরেসুস্থে হাত ধুয়ে গৃহের ভেতরে প্রবেশ করলেন।
ধুতি-ফতুয়া পরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগের মুহূর্তে চারুশীলার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললেন,আকাশের পাখিকে অনেক কষ্টে ধরতে পেরেছে,একটু শুধু ডাল বদল হল,তুমি কিন্তু সেই পাখিটির বসার জন্য গাছটিকে দেখো,রোপন করে যত্ন করো,আমি আসছি...

কুমারচন্দ্রকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসাল।
গাড়িটি চলে যাচ্ছিল।
সেই সময় দরজার কাছে চারুশীলা চারাগাছটি হাতে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
কুমারচন্দ্রকে যখন পুলিশ কুকড়াহাটি নদী পেরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি জানতেই পারলেন না,
তাঁর উঠোনে সেই চারাগাছটি রোপিত হয়েছে। এবং তার গোড়ায় শুধু জালিওনায়াবাগের মাটি নয়, একজন পতিব্রতা নারীর চোখের জল মিশে আছে!
ডায়মন্ড হারাবারে এসে পৌঁছাতে সহসা সমবেত কণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল।
বন্দেমাতরম্, গান্ধিজি কি জয়, কুমারবাবু আপনাকে প্রণাম জানাই,কুমারবাবু আপনার সঙ্গে আমরা আছি...
সেখানকার কংগ্রেসী নেতারা কুমারচন্দ্রকে সামনে পেয়ে গলায় মালা পরিয়ে দিলেন।
যিনি পরালেন, তিনি বলে উঠলেন,এইবার কুমারবাবু, লৌহ কপাটের বুক চিরে পথ করে এগিয়ে চলুন... আপনার জয় হোক
কোনো ভয় পাবেন না,আমরা সঙ্গে আছি...
কুমারচন্দ্র হাসিমুখে সকলের দিকে তাকিয়ে নিলেন।তারপর জোর গলায় বলে উঠলেন,
"ওদের গারদের লোহার চেয়ে আমার বুকের পাটা অনেক শক্ত"

এ কথা শুনে জড়ো হওয়া লোকজনদের মধ্যে একজন গেয়ে উঠলেন,

"ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে,ততই বাঁধন টুটবে,
মোদের ততই বাঁধন টুটবে
ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে,মোদের আঁখি ফুটবে---
ততই মোদের আঁখি ফুটবে। "

অসহযোগ আন্দোলনের অবিরাম স্রোত যে এমনভাবে বৃটিশ সরকারের ভিত নড়িয়ে দেবে,এই সত্যিটি প্রথমে বৃটিশ সরকার বুঝতে পারেননি। তারা ভেবেছিল,এসব কংগ্রেসী বাবু নেতাদের নেহাতই মঞ্চ গরম করা আর পাঁচটা বুলির মতো। কিছুদিন সম্মেলন-টম্মলেন করে খানাপিনা করে,ইংরেজিতে আগুন ঝরিয়ে যে যার গর্তে ঢুকে যাবে।
আর এম. কে. গান্ধি লোকটা যতই হাঁকডাক দিক,ঐ শহরে-হুজুগে কিছু বাবুনেতা মিছিল-ফিছিল করে কিছু কাপড়চোপড় পোড়াবে,পিকেটিং করবে, তারপর আবার সেই বৃটিশ-মালপত্র সুড়সুড় করে ব্যবহার করতে শুরু করবে।
ওরা মুখে খাদি খাদি এবং খেতের ফসল বলে, আসলে সবই লোকদেখানো নেতাগিরি!
এমন ভাবনায় বেশ নিশ্চিতে হাত গুটিয়ে বসে বসে বৃটিশ শাসকরা  সিংহাসনে চুরুট টানছিল।
সহসা তাদের টনক নড়ল, যখন দেখল,অজপাড়াগাঁয়ের মোটামাথা, গরীবগুর্বো,পেটরোগা, কলেরার জীবাণুবাহক লোকগুলো কোন্ এক আশ্চর্য শক্তিবলে বৃটিশ সরকারের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে রাশি রাশি কাপড়চোপড় পুড়িয়ে ফেলছে।এবং যখন দাউ দাউ করে কাপড়ের পাহাড়প্রমাণ স্তুপ জ্বলছে,তার লেলিহান শিখার আভায় আগুনের চারিপাশে মানুষগুলোর মুখে একটা অসীম সাহস ও জাগ্রত শক্তি কাজ করছে।
কলকাতা নয়, দিল্লি নয়, পঞ্জাব নয়,একেবারে নিতান্ত পাড়াগাঁয়ের ভেতর এই বিলাতি বস্ত্র বর্জনের চিত্র দেখে বৃটিশ সরকারের ঘুম ছুটে গেল।
তখন তারা কলকাতা ছেড়ে নজর ঘোরালো গ্রামের দিকে।
এবং চোখে পড়ল নিতান্ত সাধারণ খদ্দের পরা এক একটা সিংহের, যাদের গর্জনে গ্রামের পর গ্রাম জেগে ওঠে আন্দোলনের জন্য। বিলাতি কাপড় তো তুচ্ছ, এইসব সিংহের আহ্বানে প্রাণ পর্যন্ত বলিদান করে দিতে পারে।এম. কে. গান্ধির একক ডাক এইসব গ্রাম্যসিংহের গর্জনে ঝড় হয়ে বইছে...গ্রামের পর গ্রামে... 
এমন একজন বাসুদেবপুর নামক অজপাড়াগাঁয়ের কুমারচন্দ্র জানা।তাঁকে কি বাইরে ছেড়ে রাখা যায়?
 
মেদিনীপুরের মুকুটহীন রাজা বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে তমলুক শহরের রাজময়দানে বিদেশি কাপড়ের বিরাট স্তূপে আগুন ধরানো হয়। জনতার সেকি উল্লাস!
মহিষাদলের রথতলায় প্রখ্যাত বাগ্মী প্রতাপচন্দ্র গুহরায়ের উপস্থিতিতে বিলাতি কাপড়ের এক   বিরাট স্তূপে আগুন দেওয়া হয়। এমন কি,মহিষাদল রাজ পরিবারের এক সদস্য অর্জুন পাণ্ডে কেবল তাঁর অন্তর্বাস ছাড়া গায়ের সবকিছু সেই আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিলেন।
এই ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সুতাহাটার লোকজন আবার আগুন দেওয়ার পাশাপাশি বৃটিশ সরকারের বিলাতি কাপড়ের বিকল্প আয়োজন করে ফেলে। তারা যেমন আগুন দিয়েছে,তেমনি দ্বারিবেড়্যার সতীশচন্দ্র মাইতি এবং চৈতন্যপুরের ভগবতীচরণ মাইতি বাড়িতে দেশি কাপড়ের দোকান খুলেছিলেন।
এসব কি বৃটিশ সরকারের সহ্য হয়! 
তাই জেলার প্রায় সকল নেতাকে তারা বন্দী করে নিজেদের শক্তি প্রদশর্ন করতে চাইছে।

কুমারচন্দ্রকে জেলের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। একটি হলঘরে গিয়ে দাঁড় করানো হল। সেখানে কুঞ্জবিহারী, জনার্দন,রাসবিহারী, বিল্বপদ,বিধূভূষণ, বিরাজমোহন,ভবতারণ, লক্ষ্মীপদ, সতীশচন্দ্র, পশুপতি, কানাইলাল প্রমুখ সহকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল।

কুমারচন্দ্রকে দেখে তাঁরা অন্তরে শক্তি পেলেন। তাঁদের মুখোজ্জ্বল হল।বলে উঠলেন,কুমারদা, এসে গেছেন,বেশ, তাহলে এইবার দেখবেন,এক মাসে কত সুতো কেটে ফেলি,এমন চরকা ঘোরাব না,বৃটিশ সরকারের দেওয়াল পর্যন্ত ফেটে যাবে! 
সবাই হেসে উঠল।
কুমারচন্দ্র হেসে উঠলেন।জিজ্ঞেস করলেন,তোমরা সবাই চরকায় সুতো কাটতে জানো তো?
এবার কিছুজনের নীরবতা।
কুমারচন্দ্র তা লক্ষ্য করলেন।বলে উঠলেন, ওরে ভাইসব, চিন্তা নেই, এই মেদিনীপুরের চাষার ব্যাটা চাষা এসে গেছে,তোমাদের সুতো কাটা এমন  শিখিয়ে দেবো,তখন তুলো কি লোহা, সব সোজা হয়ে যাবে।
একথা শুনে রাজবন্দীদের খুশিতে চোখমুখ নেচে উঠল।
রাজবন্দীরা যখন নিজেদের মধ্যে এইসব কথোপকথন করছিলেন,তখন দূর থেকে তাঁদের ওপর নজর রাখছিলেন এই জেলের সুপার। তিনি বন্দীদের কথাবার্তার দৃশ্য দেখেই বুঝে ফেললেন, যাঁরা বন্দী হয়েছে,এঁদের মধ্যে ঐ স্বাস্থ্যবান,বড় মাথার,পাথুরে বুকের গাঁইয়া টাইপের লোকটি আলাদা। 
জেল-সুপার হলঘরে এলেন।
এবং চোখের ইশারা করলেন সেপাইদের।
তারা প্রত্যেক কয়েদিকে একটি লোহার ডিস,ছোট গামলা,দুটি মোটা কম্বল,দুটি হাফপ্যান্ট ও কুর্তা এবং একটি গামছা।পোশাকগুলো সবই মোটা সুতোর ও মজবুত বুনন।প্যান্টগুলোতে লম্বালম্বি চার ইঞ্চি ব্যবধানে সিকি ইঞ্চি কালো সুতোর ডোরা কাটা দাগ রয়েছে। 
প্রত্যকে জিনিসগুলো নিচ্ছে এবং নির্দেশ মতো পাশের সেলগুলোতে ঢুকে যাচ্ছে। এক-একটায় পাঁচ-ছয় জন করে।
কিন্তু যখন সেপাই কুমারচন্দ্রের সামনে এলো,তিনি সেই জিনিসগুলো নিতে অস্বীকার করলেন।
বলে উঠলেন,আমার জিনিসগুলো  ফিরিয়ে দিন
সুপার দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন,কোন্ জিনিসগুলো?

চরকা এবং গীতা 

কেন? এখানে কি সুতো কেটে গীতাপাঠ করবেন?

করব 

আইন নেই 

আইন বলে কোনো অস্ত্র-সস্ত্র কয়েদির কাছে থাকবে না,কিন্তু বই বা চরকা কোনো অস্ত্র নয়

আইন! মৃদু হাসলেন জেল-সুপার।বৃটিশ সরকার আপনার কাছে আইন শিখবে,এতো দুর্দিন আসেনি! 

দুর্দিন না সুদিন! একথা কে বলবে? কে বিচার করবে?

বিচার! বৃটিশ সরকারের হাইকমান্ড ছাড়া বিচারের ক্ষমতা এই পোড়া দেশে কারও আছে?

আছে,বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নাম শুনেছেন?শান্ত স্বরে বললেন,কুমারচন্দ্র।

কী? রাগান্বিত হয়ে সুপার চেঁচিয়ে উঠলেন, সেপাই, এঁকে ধরে নিয়ে চলো,গো টু টুয়েন্টি ডিগ্রি.. 

দুইজন সেপাই কুমারচন্দ্রকে ধরে নিয়ে গেল।অন্য বন্দিরা এই দৃশ্য দেখে থ মেরে গেল!

কুড়ি ডিগ্রি সেল অর্থাৎ যেখানে সাধারণ মানের চোর-চ্যাঁচড়,ডাকাত-খুনি,লুন্ঠনকারীদের রাখা হয়।কুমারচন্দ্রের মনোবল ভেঙে দেওয়ার একটা গোপন চেষ্টা। 
সেলের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হল।কুমারচন্দ্র অন্যান্য বন্দীদের দিকে এক ঝলক দেখে নিলেন।

অদূরে একটি কয়েদি অর্ধভাবে শুয়ে বিড়ি টানছিল।তার পদসেবাতে নিযুক্ত হয়েছে দুইজন অপর কয়েদি।
একজন বলল,গুরু তোমার পা-টেপার আরও একজন এসে গেছে!
অন্যজন চোখ কুঞ্চিত করে বলে উঠল,কী কেস বলতো?

মনে হয় কোনো জমিদারের সিন্দুক ভেঙেছে অথবা কোনো রাজারাজড়ার বউ নিয়ে পালিয়েছে!

বলেই নিজেদের কথায় নিজেরাই আমোদে হেসে গড়িয়ে পড়ল।

বিড়িখোরটি নাক কুঁচকে বলল,নারে, না,এতো সাধারণ জিনিস নয়,দেখছিস না,সুপারসাহেব খোদ উপস্থিত। এ গভীর জলের মাছ!

জেল-সুপার মৃদুহেসে উঠলেন।তারপর গলার স্বর অযথা গম্ভীর করে বলে উঠলেন,এইবার বুঝে যাবেন বৃটিশ সরকার কী? আর তার আইন কী?

কুমারচন্দ্রের সামনে একজন সেপাই বন্দীর প্রাপ্ত জিনিসপত্র শব্দ করে রেখে দিল।কুমারচন্দ্র সেই সব জিনিসপত্রের দিকে তাকালেন না!

আমার জেলের প্রতিটি বন্দী, আমার কথায় উঠে-বসে,আপনিও তাই করবেন।যা বলা হবে,ভদ্রভাবে মেনে চলুন।

একজন রাজবন্দীকে এই সেলে রেখে আপনি নিজের ক্ষমতা জাহির করছেন,বেশ,আমিও ভদ্রতার সঙ্গে আপনাকে এই ব্যবস্থার উত্তর দেবো,স্থিরকণ্ঠে বললেন কুমারচন্দ্র।

উত্তর নয়, দুদিন এখানে থাকার পর,আপনি ও আপনার শক্তি দুই উবে যাবে। বলেই গারদের লোহার বেড়িতে লাথি কষালেন।
ঝনঝন করে শব্দ উঠল।

কুমারচন্দ্র মৃদুহেসে পকেট থেকে একটি কাগজ বের করলেন,তারপর তার ভেতর থেকে কিছুটা ধুলো নিয়ে নিজের বসার জায়গায় ছড়িয়ে দিলেন।তারপর বসে পড়লেন।
এই ধুলো হল,সেই জালিওয়ানাবাগ মাঠের ধুলো।

এই মেঝেতে বসে পড়ার ভঙ্গিটি একেবারে কোনো সন্নাসীর মতো।শুধু গায়ে গেরুয়ার বদলে সাদা ফতুয়া বর্তমান। 
আবার বলছি,কুমারচন্দ্র বলে উঠলেন, আমার বইটি ও চরকা ফিরিয়ে দিন,না হলে আমি সেই সত্যাগ্রহ করব,যা গান্ধিজি আমাদের শিখিয়েছেন। 

ওসব কথায় ভবি ভোলে না,আর আপনাদের নেতা এম. কে.গান্ধি তো, তিনি তো আপনার মতো জেলের ঘানি টানছেন। তাঁর কথায় কী এসে যায়!এই নিয়মই চলবে,দেখব আপনি কী করতে পারেন!

বলেই জেল-সুপার সেপাইকে পাহারায় রেখে চলে আসছিলেন,তখন কুমারচন্দ্র চোখ বন্ধ করে উচ্চারণ করলেন,

"ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শ্বাশতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।"

এমন উচ্চারণ জেলের মধ্যে গমগম করে উঠল।সুপার বুট দিয়ে যে শব্দ তুলছিলেন,এ যেন তার থেকে দশগুণ বেশি।
বিড়িখোর কয়েদিটির মুখ থেকে বিড়ি পড়ে গেছে। সে উঠে বসে একদৃষ্টিতে কুমারচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।কারণ এই জেলের সুপার ভয়ংকর কড়া এবং মারমুখী। তাই এর সামনে অনেকেই ভয়ে কথা বলতে পারে না।কিন্তু এই সাদামাটা চেহারার লোকটি তো অন্য রকম।কথা বলার সময় একটুও কণ্ঠ কাঁপেনি এবং সুপারের চোখে চোখ রেখে কথা বলে গেছে।
কয়েদিটি সিমেন্টের বেদি ছেড়ে মেঝেতে এসে বসল।তার দুই সাগরেদ ব্যাপারটি দেখে অবাক! 

তাদের অবাক হওয়ার আরও ঘটনা অপেক্ষা করছিল। 
তিনদিন পরের ঘটনা।
সেপাইসহ জেল-সুপার হন্তদন্ত হয়ে কুমারচন্দ্রের সেলে এলেন।চারিপাশে দেখে অবস্থাটা বুঝতে পারলেন।
যথারীতি যে স্থানে তিনদিন আগে কুমারচন্দ্রকে বসে থাকতে দেখেছিলেন,সেই স্থানে স্থির ভাবে বসে আছেন।
সামান্য চোর-ডাকাতগুলো বলে আহৃত কয়েদিরা তাঁর সামনে বসে কী সব বলে অনুরোধ করছে।
গত তিনদিন ধরে সকালের লাপসী ( নিকৃষ্টমানের চাল ও ডাল সেদ্ধ করে একটু নুন-লঙ্কা  সহযোহে খিচুড়ি), দুপুরের ভাত-ডাল-তরকারী এবং রাতের মোটা মোটা রুটি-ডাল পড়েই আছে।তাতে মাছি ভনভন করছে।
একটুও মুখে তোলেননি কুমারচন্দ্র।
অন্যরা একটু খাওয়ার জন্য অনুরোধ ও উপরোধ করেই চলেছে।

জেল-সুপার চেঁচিয়ে বললেন,এসবের মানে কী? আপনি নিজেকে বিশাল স্বদেশী মনে করেন!  এসব করলে আপনাকে নিয়ে একটা তুলকালাম পড়ে যাবে!সেসব গুড়ে বালি!
আমি এইসব ভণ্ডামি জেলের দেওয়ালের বাইরে যেতেই দেবো না!

কুমারচন্দ্র নীরব।

মাত্র তো তিনদিন,কতদিন না খেয়ে থাকতে পারেন,আমিও দেখছি,স্বদেশী করা হচ্ছে! বৃটিশ সরকার সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার,ধরলে হাড়গোড় পর্যন্ত সেঁধিয়ে যায়!

কুমারচন্দ্রের ঠোঁটের কোণে হাসি। বলে উঠলেন

"নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুত।।"

জেল-সুপার রেগেমেগে সেখান হতে চলে এলেন।
চতুর্থদিন।

একইরকম অবস্থা। খাবারের কোণা তো দূর, সেইদিন থেকে জলবিন্দু মুখে তোলেননি! সবচেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত সেই বিড়িখোর কয়েদি,কারণ তার কাছে এই ধরণের ব্যাপার-স্যাপার নতুন। সে কুমারচন্দ্রকে প্রথমে তারই মতো কোনো এলেবেলে চোর-চট্টা ভেবেছিল। তারপর এইরকম দৃঢ়তা এবং সাহস দেখে তার অবস্থা করুন। সে বুঝতে পেরেছে, এই সেলে একজন ভয়ংকর লোক এসে গেছে এবং এখানে ভয়ংকর কিছু হতে চলছে।
দেখা গেল,সেই কয়েদি শুধু নয়, এই জেলের সুপারও ভেতরে ভয় পেতে শুরু করেছে!
না হলে মাঝরাতে চারজন সেপাই ও ডাক্তারসহ উপস্থিত হয়! 
কুমারচন্দ্রকে চারজন সেপাই ধরল।তারপর তার মুখে জোর করে খাবার গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা চলল।
কিছুতেই সম্ভব হল না! 
কুমারচন্দ্রের মুখ যেন পাথুরে খোদাই। তা ফাঁক করার চেষ্টা করতে গিয়ে সেপাইরা গলদঘর্ম হয়ে বসে পড়ল সেলের ভেতর। 
তারপর জল খাওয়ার চেষ্টা। এক সময় সুপার নিজেই এগিয়ে এলেন,হাতে চাবুক। 
কিন্তু কুমারচন্দ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
এমন স্থির অগ্নিময় এবং তীরবিদ্ধকারী চক্ষু তিনি এর আগে দেখেননি! 
মুখে শুধু উচ্চারণ করলেন,ডাক্তার 

আবার সেপাইরা কুমারচন্দ্রকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরলেন।ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে গ্লুকোজ ইনজেকশন দিয়ে দিল।
কুমারচন্দ্র মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,গান্ধিজি কি জয়,বীরেন শাসমলের জয়! বন্দেমাতরম। বন্দেমাতরম। বন্দেমাতরম! 

জেল-সুপার অবাক হয়ে গেলেন।
এইসব যখন হচ্ছিল, সেই বিড়িখোর কয়েদি সিমেন্টের বেদির পাশে লুকিয়ে গেছিল।তার হাত-পা কাঁপছিল,সে শুধু ভাবছে,এ কাকে তাদের সঙ্গে রাখতে এসেছে! সে জীবনে অনেক ডেঞ্জারাস লোক দেখেছে,এ লোকটি তো একেবারে আলাদা, বাপরে, না হাত তুলে,না ছুরি ধরে বা না জোরে কথা বলে,এতো জেলের দেওয়ালে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে! 
পঞ্চমদিন।
ষষ্ঠদিন।
সপ্তমদিন।
অষ্টমদিন।
নবমদিন।
দশমদিন।
এগরোদিন।

এগারোদিন নিরম্বু অনশন করতে লাগলেন কুমারচন্দ্র জানা।
বারোদিনের মাথায় ছয়-সাতজন সেপাইসহ ছুটলেন জেল-সুপার।তাঁর হাতে একটি চিঠি। তা পড়ে তাঁর মুখ শুকিয়ে গেছে।
যথারীতি কুমারচন্দ্রের অনশনের সংবাদ জেলের বাইরে রাষ্ট্র হয়ে যায়।বীরেন্দ্রনাথ শাসমল সঙ্গে সঙ্গে সেই সময়ের বাংলা সরকারের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলর আবদুল্লা সুরাবর্দীকে সমস্ত বিষয় জানান।অভিযোগ করেন সেই জেল-সুপারের বিরুদ্ধে। আবদুল্লা সাহেব নিজে তদন্ত করবেন বলে জানান।
তিনি জেলে আসছেন শুনে মাথায় বাজ পড়ে জেল-সুপারের।
তিনি নিজে ছুটে এলেন।হাতে সেই গীতা ও চরকা।
দুইজন সেপাই কুমারচন্দ্রকে তুলে ধরলেন।তিনি তাদের কাঁধে হাত রেখে সেল থেকে বেরিয়ে এলেন।তখন সেই বিড়িখোর কয়েদি ও তার চ্যালাচামুণ্ডরা হাত জোড় দাঁড়িয়েছিল।
হলঘরে উপস্থিত হলেন।
দৃশ্যটি অনুপম। 
কুমারচন্দ্র আগে আগে হেঁটে চলেছেন। জেল-সুপার গীতা ও চরকা হাতে পেছন পেছন আসছেন।
হলঘরে অন্যান্য রাজবন্দিরাও উপস্থিত ছিল।তাঁরা কুমারচন্দ্রকে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েন।চেঁচিয়ে কুমারচন্দ্রের নামে জয়ধ্বনি দিতে থাকে।
কিন্তু কুমারচন্দ্র হাত তুলে থামালেন।এবং তিনি মৃদুকণ্ঠে বলে উঠলেন,গান্ধিজি কি জয়!  বীরেন শাসমলের জয়... 
সঙ্গে সঙ্গে এই উচ্চারণ ধ্বনিত হল।
এগারোদিন নিরম্বু অনশন করে কুমারচন্দ্র স্বদেশীদের মনোবল এতখানি বাড়িয়ে দিয়েছেন,যে তাঁরা জেলের নিয়ম-কানুন এক মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হলেন।সেই সময় একজন ছোকরাগোছের স্বদেশী এগিয়ে এসে কুমারচন্দ্রকে প্রণাম করলেন। 
বললেন,কুমারবাবু,আপনি জেলে অনশন করে মনের শক্তিতে আগুন ধরালেন,আর বাইরে এক হাবিলদার নবীন কবি একটা কবিতা লিখে সারা বাংলায় দেশপ্রেমের আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন,তাঁর নাম নজরুল ইসলাম। তাঁর লেখা 'বিদ্রোহী' কবিতা আপনাকে শুনিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, 

"বল বীর 
বল উন্নত মম শির,
শির নেহারি আমারি নত-শির শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যূলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া 
উঠিয়াছি চিরবিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!...

মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত 
আমি সেই দিন হব শান্ত 
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না---
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত 

আমি সেই দিন হব শান্ত.... 

ক্রমশ....
 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments