জ্বলদর্চি

ডম্বরুধারী ( সাহিত্যিক ) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৮

ডম্বরুধারী ( সাহিত্যিক )

ভাস্করব্রত পতি

"মিছিল মিছিল জাতীয় মিছিল / দীপ্তিময় মুখর হয় / প্রতিশোধ আর প্রতিরোধ বাণী / আগুন ছড়ায় বাংলা ময়।"

মুখময় অসংখ্য বলিরেখা। লুলে যাওয়া চামড়া। কানে শুনতে পেতেন না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। শেষ জীবনে এভাবেই কাটাতে হয়েছে ডম্বরুধারীকে। কোনো দিনই তেমনভাবে প্রচারের পাদপ্রদীপে আসেননি। প্রচারের জন্যে হামলেও পড়েননি কোনোভাবেই। অথচ এই মানুষটিই লিখেছিলেন এরকম বহু লেখা। নীরবে নিভৃতে থেকে উজ্জ্বল করেছেন মেদিনীপুরের নাম। নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'।

এহেন মানুষটির নাম আজ অনেকেই জানেননা। হারিয়ে গিয়েছে তাঁর কীর্তি কলাপ। জীবদ্দশায় কেউ কোনও খোঁজখবরটুকুও নিতেন না। অনাদরে অবহেলায় কেটে গিয়েছে ৯৪ টা বসন্ত। কখনও 'ডম্বরুধারী', কখনও বা 'মহামূর্খ', কখনও বা 'আনাড়ি' ছদ্মনামে লিখেছেন সম্পূর্ণ অন্য স্বাদের প্রবন্ধ৷ ঋদ্ধ করেছেন মেদিনীপুরের মাটি। তাঁরই লেখনীতে বেরিয়ে এসেছিল নানা স্বাদের লেখনীর সম্ভার। 

ভালো নাম রমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও প্রকৃত নাম 'রমেন্দ্রকিশোর'। ভারতের প্রথম এফ সি এস পাস করা রসায়নের অধ্যাপক প্রমোদকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে তিনি। তাই পিতৃসূত্রেই রক্তে লুকিয়ে ছিল দুর্দমনীয় শিক্ষার বীজ। রসায়নের কৃতি ছাত্র হয়ে রসায়নের শিক্ষক হলেও ইংরাজী, ইতিহাস এবং সাইকোলজিও পড়াতেন। বাবা ছিলেন বাঁকুড়া ক্রিষ্টান কলেজের অধ্যাপক। আর তিনি ছিলেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অসংখ্য স্কুলে পড়িয়েছেন। শুধু পড়ানোতে নয়, তাঁর মন প্রাণ ছিল সাহিত্যসেবাতেও।

১৯১৮ এর ২৫ ডিসেম্বর। বড়দিনের মৌতাতে বিশ্বময় ব্যাপৃত। ঠিক সেইদিন বাঙলার বুকে জন্ম নিলেন এক অন্য যীশু। আদি বাড়ি বাঁকুড়ার নতুন চটি এলাকায় হলেও প্রথম থেকেই পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুর শহরের রামকৃষ্ণ পল্লীতে বসবাস। ২০১২ তে প্রয়াত হয়েছেন অবিভক্ত মেদিনীপুরের এই সাহিত্যরসিক মানুষটি। 

একসময় ইণ্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সহ সম্পাদক ছিলেন। এ পর্যন্ত ১২ খানি বই প্রকাশিত হয়েছে বাংলা এবং ইংরাজী ভাষাতে। ১৯৭০ থেকে শুরু স্বাভাবিক লেখালেখি। সারা জীবনে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে ২৫০০ র বেশি প্রবন্ধ। বিভিন্ন ধরনের এবং আঙ্গিকের লেখা লিখতেন তিনি। বেশিরভাগই মেদিনীপুর কেন্দ্রিক। ত্রিপুরার 'জাগরণ' পত্রিকাতে সবচেয়ে বেশি লেখা বেরিয়েছে তাঁর।

১৯৭০ এ প্রথম বই 'ভারতের অন্যতম উপনিবেশন পশ্চিম বাংলা'। এরপর তিনি প্রকাশ করেছেন 'একটুখানি হাসো', 'সুরাসাধক ও সাহিত্য', 'অতীতের গৌরবোজ্জ্বল মেদিনীপুর', 'যুগে যুগে দেশে দেশে', 'ভারত আত্মা ইন্দিরা গান্ধী', 'অক্টোপাস', 'রহস্য পুরুষ নেতাজী', 'নেশার জগৎ', 'মেদিনীপুরের রাজবংশ ও জমিদার বংশ' (প্রথম খণ্ড), 'চিরন্তন প্রহেলিকা' ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে নাম পেয়োছিলেন 'রহস্য পুরুষ নেতাজী' বইটিতে। 'অক্টোপাস' বইটি বাজারে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর ফাঁসি চেয়ে লেখার জন্য।

স্বামীর প্রতি বোদ্ধা সমাজের অবহেলায় অভিমানের সুর ছিল তাঁর স্ত্রী সাধনা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। হাহুতাশ ছিল -- এই মানুষটি যোগ্য মর্যাদা পেলেননা বলে। প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন ডম্বরুধারীর লেখা ‘রক্তে রাঙা মেদিনীপুর।' তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কিংবা বসন্তের সুবাস আর কোনোদিনই আসবেনা ডম্বরুধারীর জীবনে। 

শেষ বয়সে তাঁর রক্তে মিশেছিল ক্যানসারের বীজ। দুরারোগ্য মারণ কর্কট রোগকে তিনি দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। জীবন যুদ্ধে হার মানতেই হল রমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। একসময়কার ‘ডম্বুরধারী' নাম আজ বিস্মৃতির অতলতলে। যদিও তা কখনো জানতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। আসলে মৃত্যুটা তাড়াতাড়ি গ্রাস করুক তা চায়নি বাড়ির লোকজন। কিন্তু পৃথিবীতো থেমে থাকবে না। নীরবে ঘাতককে জড়িয়ে ধরেই সব মায়ার বাঁধন অবশ্য ছিঁড়ে গিয়েছিল অবশেষে। একরাশ অভিমান আর না পাওয়ার বেদনা কখনো তিনি বুঝতে দেননি জীবদ্দশায়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments