জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোককথা—ব্রাজিল-- ৯২/হনুমান, কলা খাবি?/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোককথা—ব্রাজিল-- ৯২

হনুমান, কলা খাবি?

চিন্ময় দাশ

বহু বহু কাল আগের গল্প এটি। সবে তখন পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। তৈরি হয়েছে কলাগাছ। তবে কিনা, মাত্র একটা জাতেরই কলা। এবং সংখ্যায়ও বেশি নয়। একটাই মাত্র কলার খেত। বানিয়েছিল এক বুড়িমানুষ। কিন্তু হনুমান সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে সংখ্যায় অনেক। 
কলার বাগানটা বেশ বড়সড় মাপের। যত্ন করেই করেছে বুড়ি। বাগানখানারও বেশ বাড়বাড়ন্ত।
দেখতে দেখতে একদিন মোচা এলো গাছগুলোতে। কলাও ধরল গাছে। বুড়ির তো আনন্দ ধরে না মনে। নিজের মেহনতের বাগানে ফলন হতে দেখলে, কার না আনন্দ হয়। 
কিন্তু সে আনন্দ বেশি দিন টিকল না বুড়ির। কলায় যেই হলুদ রঙ ধরল, সব আনন্দ উধাও হয়ে গেল তার। কলায় পাক ধরলেই তুলে নিতে হয়। দেরি হলেই ক্ষতি। তখন বাজারে বিকোবে না ।
কিন্তু সমস্যা হোল, বুড়ি একা মানুষ। এতবড় বাগান। একার হাতে এতো কলা তুলবে কী করে? মহা ভাবনায় পড়ে গেল বেচারি। 
অনেক ভেবে,  হনুমানদের কথা মনে এল বুড়ির। চারদিকে পালে পালে হনুমান। তার মধ্যে কাকে লাগানো যায়? 
তখন মনে হোল, একটা করে সর্দার থাকে সব দলেই। তাগড়া চেহারার একটা সর্দারকে ডেকে আনল বুড়ি। 
বুড়ির বাগানে কলা পাকতে শুরু করেছে, হনুমানের সর্দারও সেটা ভালোই জানে। কিন্তু অন্যের জিনিষ। জেনেই বা কী হবে?
আসলে হয়েছে কী, তখন পৃথিবী তৈরি হয়েছে বেশি দিন নয়। নিয়ম-কানুন মেনে চলত সবাই। অন্যের জিনিষে হাত দিত না কেউ। বুড়ির বাগানে কলা পাকলেও হনুমানের দল হামলে পড়ে না বাগানে। 
সে যাই হোক, আমরা বুড়ি আর হনুমান সর্দারের বৈঠকের ব্যাপারটা জেনে নিই বরং।
বুড়ি বলল—আমার একটা কাজ করে দেবে, বাপু? বাগানের কলা তুলে দেবে আমাকে? 
হনুমান কত বড় ধূর্ত, বুড়ি তো জানে না। বুড়ির কথা শুনে,  হনুমান তেমন আগ্রহ দেখাল না। হনুমান মাথা নেড়ে বলল—নাগো, বুড়ি। সে বড় মেহনতের কাজ। আমার দ্বারা হবে না।
বুড়ি ইঙ্গিতটা ভালোই বুঝল। হেসে বলল—আরে বাপু, এমনি এমনি করতে বলছি নাকি তোমাকে? মেহনতের দাম তুমি পাবে। যতো কলা তুলবে, আদ্ধেক তুমি নেবে, আদ্ধেক আমাকে দেবে।
হনুমান বলল— আসলে কী জানো, কাজটা ভারি ঝকমারির। তা, কী আর করা যাবে? কখনও কিছু বলোনি। এই প্রথমবার একটু উপকার করে দিতে বলছো। ফেলি কী করে তোমার কথা? ঠিক আছে,  করেই দেব তোমার কাজটা।
আসলে তো হনুমানের তখন তর সইছে না। পাকা কলার নামেই জল এসে যায় জিভে। আর, বুড়ি তো বলেছে, আদ্ধেক আদ্ধেক ভাগ। তার মানে, এতো বড়ো বাগানের অর্ধেক কলা সে পেয়ে যাবে। আনন্দ ধরে না তার মনে। 
বাগানের হলুদ হয়ে যাওয়া যত কাঁদি, সব কেটে ফেলল হনুমান। এইবার এক কাণ্ড করল সে। কলার কাঁদিতে বড় আর পুরুষ্টু কলাগুলো থাকে উপরের দিকে। হনুমান করল কী,  সব কাঁদিরই উপরের অর্ধেক নিজের ভাগে নিয়ে, নীচের ভাগ ধরিয়ে দিল বুড়িকে, সে ভাগে ছোট, সরু আর টেরা-বাঁকা সব কলা। 
মাথা গরম হয়ে গেল বুড়ির। কিন্তু করার কিছু নাই। মনে মনে উপায় খুঁজতে লাগল, কী করে বদমাসটাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া যায়। 
শেষমেশ একটা ফন্দি এল বুড়ির মাথায়। 
গালা দিয়ে একটা ছোট ছেলের মূর্তি বানাল বুড়ি।  সকাল না হতেই, গাঁয়ের শেষ দিকের চৌমাথায় দাঁড় করিয়ে দিল মূর্তিটাকে। বড় সাইজের একটা ঝুড়ি চাপিয়ে দিল মূর্তির মাথায়।  নিজের ভাগের পাকা কলায় ভর্তি ঝুড়িটা। যে কেউ দেখবে, তারই লোভ জাগবে।
কিছুক্ষণ বাদে সর্দার হনুমান যাচ্ছিল সেই পথে। যেই না কলার ঝুড়িটা চোখে পড়েছে, তার তো ফূর্তির সীমা নাই।
এরকম একটা বাচ্চার কাছ থেকে কলা কেড়ে খাওয়া তার পক্ষে কোন সমস্যার ব্যাপারই নয়। লাফ দিয়ে পড়লেই হোল ঝুড়িটার ওপর। তাতে বাচ্চা আর ঝুড়ি—দুটোই যাবে উলটে। কয়েকটা কলা নিয়ে, কেটে পড়লেই হোল।
কিন্তু আজ এই সবেমাত্র সকাল হয়েছে। মেজাজও ফুরফুরে। একটু ভালো মানুষিই করতে চাইল হনুমান। সে তো জানে না, এটা একটা পুতুল। মানুষের বাচ্চা নয়। হাসি মুখ করে সামনে গিয়ে বলল—হ্যাঁগো, ছেলে। একটা কলা দেবে আমাকে? 
কিন্তু গালার পুতুল কি আর জবাব দেয় নাকি? কোন উত্তরই এলো না। 
এবার একটু গলা তুলে, হনুমান আবার বলল—দয়া করে একটা কলা দাও আমাকে। একটাই দাও। ছোট হোক, তাতেও ক্ষতি নাই। পাকা আর মিষ্টি হলেই হোল। পুতুল এবারেও বোবা হয়েই রইল। 
এবার মাথা গরম হয়ে গেল হনুমানের। চেঁচিয়ে উঠল—ভালো কথায় দিচ্ছো না। এমন এক ধাক্কা দেবো না এবার, সব কলাই তোমার উলটে যাবে। 
পুতুল তাতেও বোবা। আর ধৈর্য সইল না হনুমানের। ডান হাত বাড়িয়ে, জোর এক ধাক্কা লাগাল পুতুলকে। আর, তাতেই হয়ে গেল, যা হবার।
গালার তৈরি পুতুল। তার উপর পড়েছে রোদ। ডান হাত দিয়ে ধাক্কা মেরেছিল পুতুলকে। সাথে সাথেই তার হাত গেল গালায় আটকে।
হনুমান তো অতশত জানে না। ভয়ানক রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল— আরে এই দোকানি!  আমার হাত ধরলে কেন? ভালোয় ভালোয় হাত ছেড়ে দাও। হাত ছেড়ে দাও, আর কলাও দাও একটা। নইলে, জানো তো, আরও একটা হাত আছে আমার। দেব এমন এক রাম-ধাক্কা। মজা বুঝবে তখন।
পুতুল জবাব দিল না দেখে, আগুন জ্বলে গেল হনুমানের মাথায়। বেদম জোরে এক ধাক্কা লাগাল তার বাম হাতটা দিয়ে। এবার তার বাম হাতটাও গালায় আটকে গেল।
এবার হনুমান চেঁচিয়ে উঠল— ওহে দোকানি। এখনও বলছি, হাত দুটো ছেড়ে দাও আমার। একটা কলা দিলেই চলবে। নইলে জানো তো, দুটো পা-ও আছে আমার। সেগুলো কি ঘরে রেখে এসেছি নাকি? ঝেড়ে এমন এক লাথি কষাবো যে, সারা জীবনেও ভুলবে না।
পুতুলের সাড়া নাই। হনুমান জোর এক লাথি কষাল ডান পা দিয়ে। পা-টা গেল আটকে।
--ভালো কথা বলছি তোমাকে। হনুমান বল—আমার পা ছেড়ে দাও। হাত দুটোও ছেড়ে দাও। আর ঐ যে বললাম, একটা কলা দিলেই চলবে। আর যদি কথা না শোন তো, বাম পায়ের লাথি জুটবে তোমার কপালে, বলে দিচ্ছি কিন্তু। 
পুতুলের সাড়া না পেয়ে, রাগ বাড়ল হনুমানের। বাম পা দিয়ে জোর এক লাথি কষাল পুতুলে। তাতে সেই পা-টাও আটকে গেল পুতুলের গালায়। 
তখনও কিছুই মাথায় ঢোকেনি হনুমানের। একই ভাবে বলল— এখনও বলছি, আমার দুটো হাত ছেড়ে দাও। পা দুটোও ছেড়ে দাও। আর ঐ যে বলেছি, একটা কলা দিলেই চলবে। নইলে কী হবে জানো না? জানো না, আমার গায়ে কতো জোর ?
পুতুল তাতেও কোন জবাব দিল না দেখে, এবার নিজের পুরো শরীর দিয়ে দিল এক ধাক্কা। যাকে বলে, একেবারে রামধাক্কা। 
তাতে পুতুলের তো কিছুই হোল না। উলটে নিজেই পুরো ফেঁসে গেল সে। দুটো হাত আর দুটো পা আটকে গিয়েছিল আগেই। এবার পেট আর বুকও আটকে গেল। একেবারেই বাঁধা পড়ে গেল হনুমান বেচারা।
নড়তে পারছে না, চড়তে পারছে না। এবার একটু ঘাবড়ে গেল হনুমান। কিন্তু তেজ হারালে চলবে না। খেঁকিয়ে উঠে বলল— এই শেষ বার বলছি, ছেড়ে দে আমাকে। আর একটা কলাই দে। কিচ্ছুটি বলব না তোকে। নইলে, তুই জানিস না, কী দুর্দশাটাই না হবে তোর। কতো বড় বাহিনী আছে আমার, সে ধারণা আছে তোর? একবার হাঁক দেবো। সবাই এসে হাজির হয়ে যাবে, আর ঘিরে ধরবে তোকে। নাজেহাল করে ছাড়বে একেবারে, বলে রাখলাম কিন্তু। 
পুতুল কি আর উত্তর দেয়? সাড়া না পেয়ে, বিশাল এক গর্জন করে উঠল হনুমান। সারা এলাকায় ছড়িয়ে গেল শব্দটা।
খানিক না যেতেই, চারদিক থেকে শত শত হনুমান এসে জড়ো হতে লাগল সেই চৌরাস্তার মোড়ে। ছোট বড় মাঝারি—নানা বয়সের, নানা চেহারার হনুমান সব। সর্দারের ডাকে এসে জড়ো হয়ে গেল পুরো বাহিনী।
সর্দারকে এই অবস্থায় দেখে, সবাই হতভম্ব। কারও মাথায় ঢুকছে না, ব্যাপারটা কী? একটা বাচ্চা কলাদোকানি ছেলেকে এভাবে জড়িয়ে আছে কেন তাদের সর্দার? 
এক্কেবারে বুড়ো একটা হনুমান ছিল সেই দলটায়। আগে, এই দলের সর্দারও ছিল সে। সে এগিয়ে এসে, একবার চারদিকে ঘুরে ঘুরে জরিপ করল ব্যাপারটা। প্রবীন বয়স। জীবনে দেখেছে শুনেছেও অনেক। বুঝতে বাকি রইল না কী ঘটেছে। বোকার বেহদ্দ হতভাগা! একেবারে বেকুবের মতো কাজ করে বাঁধা পড়ে গেছে। 
দলের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করলো বুড়ো। বুঝিয়ে দিল,কী হয়েছে ব্যাপারটা। এখন সর্দারকে উদ্ধারের জন্য, কী করতে হবে সবাইকে। 
এবার সবচেয়ে উঁচু একটা গাছ বেছে নেওয়া হোল। গাছটার একেবারে মগডালের কাছাকাছি উঠে গেল হনুমানের বড় একটা দল। গাছের মাথায় চড়ে, সার দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল দলটা। তাদের মাথায় চড়ল একটা দল। এইভাবে চড়তে চড়তে, তিন কোণা একটা পিরামিডের মতো তৈরি হোল হনুমানদের। বুড়ো হনুমান একজনকে বেছে রেখেছিল আলাদা করে। যার গলার জোর সবার চেয়ে বেশি। 
তাকে পাঠানো হোল এবার। সে তরতরিয়ে উঠে গেল উপরে। পিরামিডের একেবারে চুড়ায় উঠে, উপর দিকে মুখ তুলে চেয়ে দেখল হনুমানটা। 
সূর্যদেবতা ঝুলে আছে ওপরের আকাশে। হনুমানটা চেঁচিয়ে বলল— ঠাকুর, আমাদের সর্দার বিপদে পড়েছে। তাকে উদ্ধার করে দাও তুমি।
বাকি হনুমানগুলোও চেঁচিয়ে উঠল—আমাদের সর্দার মরতে বসেছে। ঠাকুর, দয়া করে এ যাত্রা তাকে বাঁচিয়ে দাও।
সে এক গুরু গম্ভীর গর্জন। আকাশ বাতাস সব কেঁপে উঠল সেই শব্দে। 
তাতেই কাজ হয়ে গেল। ঝুপ করে অনেকটা নীচে নেমে এলেন সূর্যদেব। রোদের তাতে শরীর পুড়ে যাওয়ার দাখিল। সেই তেজে গলে গলে যেতে লাগল পুতুলের গালার শরীর। তাতেই ছাড়া পেয়ে গেল সর্দার হনুমানটা। 
এদিকে হয়েছে কী, চৌরাস্তায় পুতুল আর তার মাথায় কলাভর্তি ঝুড়ি চাপিয়ে দিয়ে, বুড়ি আড়ালে বসে ছিল। মজা দেখছিল বসে বসে। তাকে ঠকাবার সাজা কেমন ভোগ করে হতভাগা সর্দারটা।
বেশ চলছিল প্রথম থেকে। ভালোই লাগছিল বুড়ির। মজাও লাগছিল বেশ। আচ্ছা জব্দ করা গেছে শয়তানটাকে। ঠকাবার ফল দেওয়া গেছে হাতে নাতে। 
কিন্তু এখন হনুমানটা ছাড়া পেয়ে যেতে, হতাশ হয়ে গেল বুড়ি। মন ভেঙে গেল তার। অনেক হয়েছে, আর নয়। এ দেশে থাকতেই মন চাইলো না আর তার।
এতোদিনের ঘরবসত। সব ছেড়ে, দূরের কোন এলাকা খুঁজতে চলে গেল বুড়ি। একলা মানুষ। ছোট্ট একটা পেট। কতটুকু আর চাই? কোথাও গিয়ে শাক-সব্জির ছোট্ট একটা খেত করলে, চলে যাবে বাকি দিনগুলো।
পিছনে পড়ে রইল বুড়ির ছোট কুঁড়েঘরটা। সেটা নিয়ে হনুমানদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু এতবড় একখানা বাগান। গাছে গাছে পুরুষ্টু কলার কাঁদি! কোনটা পাকা। কোনটা পাকতে চলেছে। পরে পাকবে কোনওটা বা। সব ফেলে গেছে বুড়ি। 
আনন্দ ধরে না হনুমানের দলটার। এই বাগান এখন তাদের। একমাত্র তাদের। আর কারও নয়। এখন থেকে কলার বাগানের মালিক তারাই। দুনিয়ার আর কেউ নয়। 
সেদিন থেকে হাজার হাজার বছর ধরে, কলার চাষ বেড়েছে। বাগান বেড়েছে দুনিয়া জুড়ে। সেই সাথে বেড়েছে হনুমানদের বিশ্বাসও। তারা ভাবে, কলার মালিক কেবল তারাই। সারা দুনিয়ায় যেখানে যত কলার বাগান বা গাছ, মালিকানা একমাত্র হনুমানদেরই। যেখানেই কলা চোখে পড়ে, হামলে পড়ে হনুমানের দল। কারও বাধা দেওয়ার অধিকার আছে, হনুমানেরা সেটা মানেই না।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments