জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে- ২৪/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ২৪


মেদিনীপুরে নিজের বাড়িতে এলাম ঠিকই, কিন্তু একটুকুও ভাল লাগছে না। তার ওপর নানান অসুবিধা। কাজেরলোক পাচ্ছি না, জলের অভাব, গ্যাসের কানেকশন পাইনি। পাড়ার পরিবেশ জঘন্য। ছেলেমেয়েরা কারো সঙ্গে মিশতে পারছে না। কী করে এখানে বাস করব? আমরা আসার একমাসের মধ্যে খান সাহেবও বদলি নিয়ে গড়বেতার খড়কুশমা ব্রাঞ্চে চলে এলেন। খড়কুশমা ব্রাঞ্চ নাম হলেও ওটা আমাদের স্কুলের পাশে আমার এক কাকার বাড়িতে। সুবিধা হল উনি একদিন করে আমার বাপেরবাড়িতে থেকে যেতেন, রোজ যাতায়াত করতে হতনা। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থাও এখনকার মত এত ভাল ছিলনা।

      উনি বদলি হয়ে এসেই দোতলার কাজ শুরু করলেন। আমাকেই কাজ দেখতে হচ্ছে।প্রয়োজনে এটা সেটা কিনতেও যেতে হচ্ছে। বাড়িঘর নোংরা হচ্ছে, সেটাও পরিস্কার আমাকেই করতে হচ্ছে। ফলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। চিকিৎসায় জ্বর সারল, কিন্তু আমি ডিপ্রেসনে ভুগতে শুরু করলাম। কী ভয়ঙ্কর মানসিক যন্ত্রণা। কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেললাম, সবসময় কান্না পায়।একা থাকলেই কাঁদি।ভাবলাম বাইরে কোথাও ঘুরে এলে ভাল লাগবে, কিন্তু তাতেও কিছু হল না। সবসময় মৃত্যুভয় তাড়া করছে। ভূতপ্রেত, তুকতাকে বিশ্বাস নেই, তবুও সকলের পরামর্শ শুনে বাড়িতে হাফিজ সাহেবকে ডেকে সান্তি-সন্তয়নের ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু কিছু কাজ হল না। আমাকে কোনো মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা কেউ বললেন না। আসলে ওঁদের ধারণা পাগল মানুষকেই মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আর আমি তো জানতামই না আমার এটা একটা অসুখ, এরও চিকিৎসা আছে। এইভাবে ভুগতে ভুগতে প্রায় ৫ মাস পর হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায়  বুঝতে পারলাম আমি সুস্থ হয়ে গেছি।

    মায়েদের চার বোনের মধ্যে ছোটমাসি আতেফার  কথা বলা হয়নি। মাসির  বিয়ে হয়েছিল আনন্দপুরে। মেসো সবে সবে ম্যাট্রিক পাশ করেছেন। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। মামারা মেসোকে কলেজে পড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাসির সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের পর মাসি মেসো মামাদের বাড়িতেই থাকতেন। মেদিনীপুর ডে কলেজে পড়তে পড়তে মেসো পোষ্ট অফিসে ক্লার্কের পোস্টে চাকরি পেয়ে যান। পড়া এবং চাকরি একসঙ্গে চলে। ইতিমধ্যে মাসির বড়ছেলে আজিজের জন্ম হয়েছে। কিছুদিন পর মাসিরা মামাবাড়িতে থাকলেও হাড়ি  আলাদা করে নেয়। এক শবেবরাতের দিন আমাদের বাড়িতে মেদিনীপুর থেকে বাসে চিঠি এল, দাদুর শরীর খুব খারাপ। মা কাঁদতে শুরু করলে সবাই বোঝাল আজ এইসময় না গিয়ে ভোরে যাওয়ার জন্য। রাতে মা কোনরকমে পোলাও আর মাংস রান্না করল। রাতে রিক্সা বলা ছিল। এই প্রথমবার মা আমাকে রেখে ছোটভাইকে নিয়ে বাবার সঙ্গে মামাবাড়ি গেল। বাড়িতে আমি আর বড়দা মেজদা আছি। গতকাল একটা বড় মোরগ জবাই হয়েছিল। কিছুটা মাংস মা নুন,তেল,হলুদ দিয়ে গরম করে রেখে গেছল। প্রথমবার আমি মাংস রান্না করলাম। আদা একটু বেশি হয়ে গেছল বা আমি কসাতে পারিনি ভাল করে। মাংসে আদার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। সন্ধ্যায় বাবা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করলাম, দাদু কেমন আছে? বাবা বললেন, ভাল আছে। ভোরের বেলা জানলা দিয়ে শুনতে পেলাম সেজঠাকুমা কাকে যেন বলছেন, বড় বৌয়ের বাবা মারা গেছে। আমি তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে জানলা দিয়ে ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করলাম, কে বলল তোমাকে? দাদু মারা গেছে! ঠাকুমা বাবার নাম বলাতে বুঝলাম কষ্ট পাব বলে বাবা আমাকে মিথ্যে বলেছে। কথাটা শোনার পর আমার ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল। লুকিয়ে লুকিয়ে  কাঁদতে লাগলাম মায়ের কষ্টের কথা ভেবে, মা যে জীবন্ত অবস্থায় বাবাকে দেখতে পেলনা। মায়ের কষ্টটা ভীষণভাবে অনুভব করতে পারছিলাম। ছোট থেকেই আমি খুবই অনুভূতিপ্রবণ ছিলাম।

    মামাদের বাড়িতে থাকাকালে মাসির বড়মেয়ে আজরার জন্ম হয়। এর কিছুদিন পরেই মাসিরা ভাড়াবাড়িতে উঠে যায়। আরও কিছুদিন পর সিপাইবাজারের কাছে বাড়ি করার জন্য মেসো অনেকখানি জমি কেনেন। আমার বিয়ের আগেই মেসো বাড়ি করে নিজের বাড়িতে উঠে যান। মেদিনীপুরে আসার পর মনখারাপ হলে মাসির বাড়ি যেতাম। মেসো আমাকে খুবই স্নেহ করতেন,  এখনও করেন।
      আগেই বলেছি মেয়েরা জলের মত। জল যেমন যে পাত্রে রাখা হয়, তারই আকার ধারণ করে, মেয়েরাও পরিবেশ অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। আমিও সেই চেষ্টাই করছি। মাসিরবাড়ি ছাড়াও এই  সহরে আমার সেজকাকা এবং মুক্তারকাকা ও আফতাবকাকা থাকেন। এই দুইকাকা বাবাদের সৎভাই হলেও তা দুই  পক্ষের আচরণে বোঝা যেত না। বিশেষ করে মুক্তারকাকার তো তুলনা হয় না। ভীষণ আন্তরিক। সেজকাকার বাড়ি মিয়া বাজারে। মুক্তারকাকারা থাকতেন অলিগঞ্জে। মুক্তারকাকা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখানেই আলাপ হয় কাকিমার সঙ্গে।আসল নাম অনিতা রায়চৌধুরী। আমরা কাজল কাকিমা বলি। কাকিমা কলেজ জীবন থেকেই রাজনীতি করতেন। কার কাছে যেন শুনেছি, কাকা ঠাকুমাকে বিয়ের কথা বললে, ঠাকুমা মেয়ে কেমন জানতে চান। কাকা তখন মজা করে বলেছিলেন, কাজল তো কাজলই হ্যায়(ঠাকুমা হিন্দি ভাষায় কথা বলতেন)। তবে কাকিমার গায়ের রং কালো হলেও ব্যবহার ভাল। কাকারা প্রায় আসেন, আমিও মাঝে মধ্যে যাই।

 সেজকাকিমা আমাকে খুব স্নেহ করতেন, তাই মনে হয় আমার সেলাই, রান্না, ইত্যাদি সব কিছুর প্রশংসা করতেন। মনে আছে সেজকাকার নাতি মিঠুর(জুনুদির বড়ছেলে)বিয়েতে বরযাত্রী যাবনা বলাতে সেজকাকিমা বলে ছিলেন, তুই, ডলি(কাকিমার বোনঝি, আমার প্রিয় ডলিদি)না গেলে আমরা কাদের দেখাতে নিয়ে যাব?

    বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে ভারতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্ঘটনা ঘটে ছিল বা বলা যায় ঘটানো হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ২১ মে শ্রীপেরাম্বুদুর কাঞ্চিপুরম জেলায় একটি নির্বাচনী সভায় ভারতের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এলটিটিই জঙ্গিদের হাতে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে খুন হন। মা ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়ে ছিলেন। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও আরো কয়েকটি ওদের অনুগামি দল বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে। দীর্ঘ ৪০ বছর বন্ধ থাকার পর রাজীব গান্ধীর সময়েই এই রাম লালার পুজোর জন্য এই বিতর্কিত মসজিদের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। মসজিদ ভাঙ্গার পর  সারা দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এই দাঙ্গায় ২,০০০ এরও বেশি মানুষ খুন হয়েছিলেন।

      ১৯৭১ এর মার্চ থেকে ১৯৯৫ এর মার্চ পর্যন্ত আড়াই দশক আমি সংসার জীবনে থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় করেই কাটিয়ে দিয়েছি, নতুন  কিছু সৃষ্টির জন্য একটি বারও কলম ধরিনি। ১৯৯৫ এ পাড়ার কয়েকজন ইদ উপলক্ষে একটি সুভেনির প্রকাশ করার উদ্যোগ নিলেন। আজহারুদ্দিন খান পত্রিকার নাম রাখলেন ‘হিলাল’।একজন কেউ আমার মেয়েকে পত্রিকার জন্য লেখা দিতে বললে, ও বলে, আমি লিখতে পারিনা, মা পারে। ছোটবেলায় ওদের মুখে মুখে ছড়া  বানিয়ে শোনাতাম। তাতেই ওর ধারনা হয়েছে, মা লিখতে পারে। আমি ওদের চাপে ‘কালের স্রোতে’ শিরোনামে হিলালের জন্য একটি কবিতা দিলাম বেবি খান নামে। পত্রিকায় প্রভাকর মাঝি ছাড়াও কয়েকজন নামী কবির কবিতা ছাপা  হল। এঁদের মধ্যে একজন হলেন ব্যোমকেশ চন্দ। বহু যুগ পরে ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা ও নাম দেখে এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে গেল। হিলাল প্রকাশিত হওয়ার বেস কিছুদিন পর আজহার সাহেবের স্ত্রী বানুমাসির সঙ্গে দেখা হতে বললেন, ব্যোমকেশবাবু তোমার কবিতার খুব প্রশংসা করছিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, বেবি কি বাচ্চামেয়ে? আমি বললাম, বাচ্চামেয়ে নয়, দুই বাচ্চার মা। পরের বছর ইদের আগে ওনার কাছে লেখা চাইতে গিয়েছিলেন যিনি তাঁর মারফৎ উনি আমাকে একটি চিঠি ও তাতে একটি কবিতা লিখে পাঠান। 

কবিতার সারমর্ম হল,চাঁদ যেমন মিছেই মেঘের ওড়নায় মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করে, একসময় তার আলো পৃথিবীর বুকে জ্যোৎস্না হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, তেমন তুমিও যতই নিজের নাম  ও প্রতিভা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা কর, একদিন তা সবার মধ্যে ঠিকিই প্রকাশ পাবে। এবার আমি ‘রোশেনারা খান’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে আমার ছোটভাই পাপুর  হাত দিয়ে আজহার সাহেবকে দিয়ে পাঠাই। আমার ‘রোশেনারা খান’ নাম না জানায় উনি সবাইকে বলেন, পাপুর  বান্ধবী একটি ভাল প্রবন্ধ দিয়েছে। পরে অবশ্য সবাই জেনে যান। যাইহোক যথা সময়ে ‘হিলাল’ প্রকাশিত হলে বিভিন্ন মহলে আমার  লেখা প্রবন্ধ ‘আমাদের কথা’ প্রশংসিত হয়। এর ফলে লেখায় আমি ভীষণই উৎসাহ বোধ করি। মনের মধ্যে জমে থাকা কথা গুলো যেন আমার  ঝর্ণাকলমের আগা দিয়ে ঝর্ণার মত বেরিয়ে আসতে চায়।
                                        ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments