জ্বলদর্চি

পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৯

পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ

ভাস্করব্রত পতি

মাটির উপর চাটাই পাতা। তার উপর মাদুর আর বিছানার চাদর। দুখানা মাথার বালিশ। নিজে নিজেই খেলতেন লুডো, বাঘবন্দী কিংবা গোলোকধাম গুটি। অসম্ভব দানশীল মানসিকতার এই মানুষটি কিন্তু 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' হিসেবেই সম্মানিত! তিনি পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ।

"স্বদেশের সমুন্নতি সাধনে সূচির প্রতি
পরহিতে সদাব্রতী সতীশ ধরায়।
ভবানী ছোটপো তারনন্দকন্যা গাথাকার
জৈষ্ঠ্য পঞ্চু পুত্র যার শ্রী প্রনব রায়" --
এভাবেই তিনি তাঁর নিজের বংশ পরিচয় দিয়েছেন কাব্যাকারে। ১৯০২ এর ১৩ ই সেপ্টেম্বর ঘাটালের বাসুদেবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সতীশচন্দ্র রায় এবং যাজ্ঞসেনী দেবীর পুত্র পঞ্চানন রায়। তাঁরা ছিলেন সামবেদীয় ভরদ্বাজ গোত্রের বিখ্যাত ফুলিয়া মুখুটি বংশের প্রতিনিধি। যে বংশের একজন মহাকবি কৃত্তিবাস (সেইখানে বংশে তাঁর হৈলা বঙ্গ অলঙ্কার / কবি কৃত্তিবাস যার গ্রন্থ রামায়ণ) ছিলেন রামায়ণকার। আর একজন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় (সেই বংশে কালক্রমে বিধাতার সুনিয়মে / পূত করি স্বজনমে রায় গুণাকর / অন্নদামঙ্গল গীতি রচিলেন মহামতি / ভারতচন্দ্রের খ্যাতি দেশ দেশান্তর) ছিলেন 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যের লেখক। এছাড়া এই বংশের কৃতি সন্তান ছিলেন গড়ভবানীপুরের রাজা কৃষ্ণরাম, পেঁড়োর রাজা শ্রীমন্তরাম, সদানন্দ, নৃসিংহ প্রমুখ। এহেন বংশের জনৈক রাজচন্দ্র দয়াময়ী দেবীকে বিয়ে করে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের বাসুদেবপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। সেই বিখ্যাত বংশের একজন প্রতিনিধি হয়ে তুলে ধরেছেন নিজেকে। আর গর্বিত করেছেন মেদিনীপুরকে। তাঁর লেখনীতে পাই -- "পৃথিবীর ক্ষুদ্র রূপ / মেদিনীমণ্ডলে ভূপ / ধন্য জেলা এ মেদিনীপুর! // পর্ব্বতে প্রান্তরে বনে / সমুদ্র মরুর সনে / শোভা যার অপূর্ব্ব প্রচুর।"

কর্মজীবন শুরু করেছিলেন চাকদহ রামলাল একাডেমী থেকে। বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বাসুদেবপুর হাইস্কুলেও পড়িয়েছেন। এরপর বহু বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে করতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন 'পণ্ডিতমশাই'। শিক্ষার আলো জ্বালাতে বহু ছাত্র ছাত্রীদের বিনা পয়সায় পড়াতেন বাড়িতে ডেকে এনে। একসময় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন 'দেশসেবী' সংঘ। যে সংঘ যুবসমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি নানা কর্মসূচিতে এবং সমাজমনস্ক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। সেই 'পণ্ডিতমশাই' পঞ্চানন রায়ের কথায়, "একদিন গ্রামের কয়েকজন যুবককে লইয়া দেশসেবী সংঘ স্থাপন করি। উহাতে সাধারণ সেবা ও গ্রন্থাগার, দরিদ্র ভাণ্ডার প্রভৃতিরও ব্যবস্থা ছিল"।

একাধারে তিনি ছিলেন স্বদেশ সেবক। নিজের অর্থ খরচ করে স্বদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির গৌরব প্রচারে সচেষ্ট ছিলেন। দেশের ইতিহাস জানার তুমুল আগ্রহ ছিল মননে এবং চিন্তনে। তাঁর অসাধারণ অনুসন্ধিৎসু মন সম্পর্কে জানা যায় ডেভিড ম্যাকাচ্চিয়ানের LATE MEDIEVAL TEMPLES OF BENGAL বইতে। ডেভিড ম্যাকাচ্চিয়ান পঞ্চানন রায় সম্পর্কে লিখেছিলেন, "Of these I must single out for special gratitude two local scholars who have done much to preserve and creat understanding of the culture of their home areas Sri Panchanan Ray Kavyatirtha in the Daspur। বিনয় ঘোষ লিখেছেন, "আপনাকে মেদিনীপুর জেলার একটি জীবন্ত গেজেটিয়ার বলে আমি মনে করি। আপনার 'দাসপুরের ইতিহাস' পড়তে পড়তে এই কথাই মনে হচ্ছিল। দেশ এখন বিভ্রান্ত এবং দেশের লোকেরাও বেশ কিছুটা মতিভ্রম ও রুচিবিকার হয়েছে। তাই -- তা না হলে আপনার মতো মানুষের আরও অনেক বেশি সম্মান পাওয়া উচিত ছিল। অবশ্য একথাও ঠিক যে যাঁরা প্রকৃত দেশীয় সংস্কৃতি কর্মী তাঁরা কাজ করেন নিঃস্বার্থভাবে"।

তিনি ছিলেন আঞ্চলিক ইতিহাসের সৃজনশীল গবেষক। তাঁর নামের সাথে প্রত্নতাত্বিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, গীতিকার, কবি, প্রবন্ধকার, ঐতিহাসিক ইত্যাদি শিরোপা দেওয়া যায়। ১৩২৫ বঙ্গাব্দে বিখ্যাত 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকায় তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তি লাভ করে 'কাব্যতীর্থ' উপাধি এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে 'জ্যোতির্বিনোদ' উপাধি পান। কিন্তু তিনি মন্দির, মসজিদ, স্থাপত্য, পুরাতত্ত্ব, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাসের প্রতি মনপ্রাণ নিবেদিত করেছিলেন।

কেন তাঁকে 'পরিব্রাজক' বলা হয়? আসলে পূর্ব থেকে পশ্চিম, হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা -- ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন খালি পায়ে। আর এই ভ্রমনের সময় সংগ্রহ করেছেন অজস্র পুঁথি, নথিপত্র, প্রত্নতাত্বিক সামগ্রী ইত্যাদি। তিনি ১৩২৯ এ নিজের গ্রামেই বানিয়েছিলেন 'ভারতচন্দ্র কৃষ্টিকেন্দ্র' নামে সংগ্রহশালা। পরবর্তীতে এর অধীনে গড়ে ওঠে 'সুরনাথ সংগ্রহশালা' এবং 'ন্যায়ভূষণ পুঁথিঘর' নামে আরো দুটি সংগ্রহশালা। যেখানে তুলে ধরা হয়েছিল মেদিনীপুরের লুপ্তপ্রায় ইতিহাসকে। ১৯৭৬ এর ৩ রা ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর বাসুদেবপুর গ্রামেই এই পরিব্রাজকের স্মৃতিরক্ষায় নতুন করে তৈরি হয় 'পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ সংগ্রহশালা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র'। দুই পুত্র ড. প্রনব রায় (সদ্য প্রয়াত) এবং ড. পুলক রায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটি আজ জেলার গর্ব‌। কামানের গোলা থেকে নব্যপ্রস্তর যুগের অস্ত্র, ফসিল, বর্গীর বাঁটুল, টেরাকোটা মন্দিরলিপি, অসংখ্য পুঁথি সহ প্রাণবল্লভ ঘোষের অপ্রকাশিত 'জাহ্ণবীমঙ্গল' পুঁথি, ভাগবতের পুঁথি ইত্যাদি সংরক্ষিত এখানে। আজ থেকে বহু বছর আগে বিজ্ঞানের এতো রমরমা না থাকা সত্ত্বেও যেভাবে নানা বিষয়ের অন্বেষনে কীর্তিমান ছিলেন তা এক কথায় অনবদ্য। তথ্যের সন্ধানে এবং জ্ঞানের আহরণে ঘুরে বেড়িয়েছেন আসমুদ্রহিমাচল।

সেই ১৩৬৫ বঙ্গাব্দে তিনি লিখেছিলেন "দাসপুরের ইতিহাস"। 'মন্দিরনগরী' বলা যায় দাসপুরকে। একটা বর্ধিষ্ণু জনপদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখে গৌরবান্বিত করেছিলেন দাসপুরকে। তথা মেদিনীপুরকে। আরো বেশি করে আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় অন্যদের অনুপ্রেরণা ছিল এই বইটি। এ প্রসঙ্গে রোহিণীনাথ মঙ্গলের উক্তি প্রণিধানযোগ্য -- "গ্রন্থটির আকার মাত্র নব্বুই পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ হলেও এটি লেখকের এক পরিব্যাপী ও গভীর বিস্তারী অনুসন্ধান। এ অনুসন্ধান শুধু তথ্যের নয়, তারিখের নয়, শুধু ঘটনার বা রটনার। এ অনুসন্ধান প্রাণের, রসের, মানবিকতার পুঙ্খানুপুঙ্খ থেকে তুঙ্গাতিতুঙ্গ পর্যন্ত। এক কথায় বলা যায় এও এক বিশাল ব্রম্ভের সন্ধান। এই সন্ধানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠা। এ রচনা নিষ্ঠার নির্মান, সংগ্রহের সৃষ্টি।"

১৩৮১ বঙ্গাব্দে লিখেছেন 'বাংলার মন্দির'। আর ১৯৭৭ সালে পুত্র ড. প্রনব রায়ের সাথে যৌথভাবে লিখেছেন 'ঘাটালের কথা'। ৭৪ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন আঞ্চলিক ইতিহাসের সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে। কোনো পুরস্কারের আশায় নয়, মাতৃভূমিকে ভালোবেসে আর আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রতি অমোঘ টানে তাঁর লেখনী সচল ছিল দীর্ঘদিন।

এছাড়াও লিখেছেন দুর্গায়ণ (১৩৫৯), শীতলায়ণ (১৩৫৬), রমায়ণ, তাতায়ণ, নামায়ণ, সত্যায়ণ, ভগবন্নামশতক (১৩৩৪), সংসপ্তক সতীশচন্দ্র (১৩৭৫), রতিমঞ্জরী (১৩৫৬), প্রাতঃস্মরণীয় তারকনাথ প্রামাণিক (১৩৪৪), কর্মযোগী ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৩৪৪), গঙ্গাসাগর পদ্ধতি (১৩৬৪), ভারতভ্রমণ, চেতুয়া বৈকুন্ঠপুর অস্থল (১৪১৬) ইত্যাদি। বাংলা, সংস্কৃত এবং ইংরেজিতে তিনি সাহিত্য চর্চা করে গিয়েছেন নিরলসভাবে। সাহিত্যের প্রতি টান ছিল বরাবরই। তাঁর বংশধারায় যুক্ত ছিলেন বাংলার দুই প্রোথিতযশা কবি। ফলে পঞ্চানন রায় সেই ধারায় স্নাত হয়ে গৌরবান্বিত করেছেন তাঁর বংশকে। মহিমান্বিত করেছেন মেদিনীপুরের মাটিকে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments