জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় পর্ব - ১৫ /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 
পর্ব - ১৫                                

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

সারা জীবন যে মানুষটি বিভিন্ন মামলা ও ঝামেলাতে অহেতুক ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন মৃত্যুর পরেও তিনি সেখান থেকে রেহাই পাননি। যে গওহরজান জীবিতকালে কারও ভালবাসার স্পর্শ পাননি, তাঁর জন্য সামান্য এক ফোটা চোখের জল কেউ ফেলেন নি, বিপদের সময়ে সামান্যতম সমবেদনাও কেউ জানায়নি। তাঁর মৃত্যুর পরে তার অগণিত আত্মীয় এসে মামুলী শোক প্রকাশ করে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দিয়ে তাঁর সম্পত্তির বা গচ্ছিত টাকার দাবীদার বলে নিজেদের প্রতিপন্ন করতে শুরু করলেন। প্রথম যে আত্মীয় তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে মহীশূরের মহারাজের কাছে দাবী জানান তিনি হলেন ব্যক্তিগত জীবনে গওহরজানের জন্মদাতা আর্মেনীয় রবার্ট উইলিয়াম ইয়েওয়ার্ড, যিনি গওহরের পাঁচ বৎসর বয়সে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার জন্ম বৃত্তান্ত অস্বীকার করে তার মাকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে গওহরের জন্মপরিচয় আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য গওহরের কাছে ন' হাজার টাকা দাবী করেছিলেন। ১৯৩০ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী অর্থাৎ গওহরের মৃত্যুর ১৭ দিন পরে তার লিখিত চিঠিতে তিনি নিজেকে গওহরজানের একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকারী বলে জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়জন হলেন সৈয়দ গোলাম আব্বাস সওযোয়ারি যার সাথে গওহরের 'মুটা ম্যারেজ' হয়েছিল এবং বহু তিক্ততার ফলে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল। তার আইনজীবী  কলকাতার এন সি বোস অ্যান্ড কোম্পানীর অফিস থেকে একই দিনে তার চিঠিটিও এসেছিল এবং চিঠিতে গওহরজানের স্বামী বলে আব্বাসকে উল্লেখ করা হয়েছিল। তৃতীয় চিঠিটি মহীশূর রাজ্য সরকারের কাছে এসে পৌঁছে ছিল মহীশূর শহরের জনৈক কুম্ভরহালের আইনজীবী মহম্মদ ওয়ালিউল্লাহের কাছ থেকে যেখানে দাবী করা হয়েছিল গওহরজান তার বিবাহিত স্ত্রী এবং চিঠিতে উল্লেখ হয়েছিল সম্ভবত জানুয়ারী মাসের ১৭ তারিখে তার স্ত্রী মারা গেছেন। মজার ব্যাপার হল মৃতার স্বামী মৃত্যুর সঠিক তারিখ জানেনা যার জন্য তার আইনজীবী সম্ভবত কথাটি উল্লেখ করেছিলেন। চতুর্থ ও শেষ চিঠিটি এসেছিল মহীশূরে থাকাকালীন গওহরজানের পরিচারক আব্দুল রহমানের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের জন্য যে নিজেকে উল্লেখ করেছিল গওহরজানের শেষ জীবনের পরিচারক হিসেবে বর্তমানে কলকাতায় কর্মহীন। সংসারের গ্রাসাচ্ছাদন এবং গওহরের মৃত্যুতে বিভিন্ন ধর্মীয় ক্রিয়া কর্ম সম্পাদনের জন্য সে কেবলমাত্র আর্থিক সাহায্যের আবেদন করেছিল, অবশ্য সম্পত্তির কোন দাবি-দাওয়া জানায় নি। মহীশূর সরকার এইভাবে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে অজস্র চিঠি পেয়ে মহীশূরের সিটি ম্যাজিস্ট্রেট এম চেন্নারাজ উরসের হাতে সমস্ত পত্রগুলি অর্পণ করেছিলেন সে ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির দুরভিসন্ধিমূলক ও মিথ্যা দাবি-দাওয়া সমন্বিত চিঠিগুলির আইন সম্মত ভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে বিষয়টির মীমাংসা করেছিলেন এবং সেইসঙ্গে এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটান।   

গওহরজানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে মিস ইন্দুবালার কথাতে ফিরে আসি। "গওহরজান এমনই এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাঁর সম্বন্ধে মানুষের প্রতিক্রিয়া তীব্র ছিল। যারা তাঁকে পছন্দ করতেন তাঁরা গভীরভাবে তাকে ভালবাসতেন, কিন্তু যারা তাঁকে পছন্দ করতেন না তাঁরা তাঁর খুঁটিনাটি প্রত্যেক ব্যাপারে তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করতেন। কিন্তু গওহরজান তাঁর নিজস্ব মতে জীবন-যাপন করে গেছেন। সময়ের সাথে  সাথে তিনি ব্যক্তিগত জীবনে একের পর এক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন।"
এই বিস্মৃতপ্রায় শিল্পীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বর্তমান যুগের স্বনামধন্য গায়ক শ্রী রাম কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দের শারদীয়া বর্তমান পত্রিকায় তাঁর লেখা বিশেষ রচনা 'জলসাঘর'-এ গওহরজানের সম্বন্ধে যে মূল্যায়ন করেছেন সেটি পাঠকের উপলব্ধির জন্য এখানে উল্লেখ করছি।                    
"মালকাজানের মেয়ে গওহরজান। ওই রূপ আর ওই কোকিল কন্ঠ তখন গোটা কলকাতাকে মাতিয়ে রাখতো। তাঁর এক রাতের মুজরো ছিল পনেরশো টাকা তখনকার দিনে। এই গওহরজানকে নিয়ে কম ঘটনা আছে নাকি? তার কিছু কিছু তো আমার নিজের চোখে দেখা। এখনো মনে আছে বৃন্দাবন বসু লেনের বিখ্যাত গুহবাড়ির জলসাঘরে ঐরকম একটি গানের আসর বসেছে। গোটা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছেন সঙ্গীতসাধক বিজয়লাল মুখোপাধ্যায়। তিনি আবার গান শিখতেন গওহরজানের কাছে। আসর শুরু হলো রাত করে। জমাট আসরে গান ধরলেন গওহরজান। তখন বেশ বয়স হয়ে গেছে তাঁর, ঘুরে ঘুরে আসরের নাচ বন্ধ করে দিয়েছেন। হাঁফিয়ে যেতেন তাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মুদ্রা করে শুধু গাইছেন। কি অপরুপ কন্ঠ তখনো পর্যন্ত। বেনারসী ঘরানায় কি সপাট তান। শ্রোতারা সব মন্ত্রমুগ্ধ। এমন সময়ে গওহরজান ধরলেন এক খাম্বাজ ঠুমরি। আরোহন অবরোহনের সঙ্গে সঙ্গে ভাও। ওই বয়সে ভাও করে গাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? এখনও মনে আছে গানের কলি ছিল- ' কৌন গলি যায়ে মোরে শ্যাম'।   
এতো অনেক পরের কথা। যাঁরা প্রবীণ ব্যক্তি তাঁরা গওহরজানের আরো অনেক কথাই জানতেন।      নিজের ইংরেজি ভাষা ছাড়াও সাত-আটটি ভারতীয় ভাষায় তিনি গান গাইতে পারতেন। খেয়াল, ঠুমরি, দাদরার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা আগমনী শ্যামাসঙ্গীত এমনকি লোকসংগীতও তিনি গাইতেন। গওহরজানের মা মালকাজান উর্দু শায়েরীও রচনা করতে পারতেন। তাঁর কাছ থেকে শিখে অসংখ্য উর্দু শায়েরী গওহরজান নিজে রচনা করেছিলেন। গওহরজানের রচনা করা সেসব খেয়াল, ঠুমরি বহু বিজ্ঞ ওস্তাদ পরবর্তীকালে গেয়েছেনও। কিন্তু গওহরের নাম উচ্চারণ করতে তাদের বুঝি বাধতো, কারণ ওস্তাদদের মুখ যে কতবার চূণ করে দিয়েছেন গওহর তার ইয়ত্তা নেই।             
সেবারে ঝামাপুকুরে মহারাজা দিগম্বর মিত্তিরের বাড়িতে আসর বসলো তাঁর বিরাট বৈঠকখানায়। বহু মানুষ এসে হাজির হলেন সেখানে, কিছু জানকর ওস্তাদও। গহরজান একে একে গেয়ে চলেন। 'আজ কাঁহা মেরি হৃদয় কি রাজা' কখনো বিশুদ্ধ ঠুমরি - ' ও ঘাটে যাব না সই লো পানিয়া ভরণ'। আসর মাৎ ততক্ষণে। ডুগি তবলায় কানির কাজ চলতে চলতে তেহাই পড়ে, শ্রোতারা হাঁ হাঁ করে উঠে। সারেঙ্গীর ছড় সুরকে টেনে বার করে আনছে যেন। এরপরে গওহরজান ধরলেন তাঁর বহু সাধের দাদরা গান - 'ফাঁকি দিয়ে প্রানের পাখি উড়ে গেল আর এলো না বুঝি, কে প্রেমের ডোরে বেঁধে রাখলে প্রাণ ময়না'। গওহরজান ভাও করেন তো, মহারাজা 'আহা' 'আহা' করে ওঠেন। থেকে থেকে ঝাড়লন্ঠনের আলোয় ঝলসে ওঠে গওহরজানের হাতের সেই হীরের আংটি, কোহিনুরের মতোই যার গড়ন, তবে ছোট। প্রত্যেক আসরেই ওটা পরে আসতেন গওহরজান। হাত তুলে গান শুরু করলেই ওতে ঝাড়লন্ঠনের আলো লেগে ঝলসে উঠত, আর তাই না দেখে নাচ ঘরের বড় বড় রইস আদমিরা তাদের হীরের আংটিগুলো পাঞ্জাবি, শেরওয়ানির পকেটে ঢুকিয়ে ফেলতেন। কি লজ্জা! তবায়েফ গওহরজনের আংটির হীরের পাশে আর সবই যেন ঝুটো পাথর।
                                                               ক্রমশঃ…….

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments