দিশারী মুখোপাধ্যায়ের কয়েকটি সাম্প্রতিক কবিতা
ঈর্ষা
আমি না থাকলে আলো নিজেকে খুঁজে পেত না
হাতল দেওয়া একটা কাঠের চেয়ারে আমি বসে আছি
কিছু গাছপালা ছাড়া
কোনো মানুষ বা ইতরপ্রাণী
এ ঠিকানাকে আপাতত স্বীকৃতি দিচ্ছে না
অভিধানের ভাষায় নির্জন বললেও ঠিক বলা হয় না
দুর্গের দেওয়ালের অহংকারে একটা ফাটল ছিলো
সেই দুর্বলতাটুকু খুঁজে বার করে
আলো এসেছে আমার কাছে
নিজেকে আবিষ্কার করতে
যে কাঠের চেয়ারে বসে আছি
আসলে সেটা একটা সিংহাসন
আমার সঙ্গে আলোর মাখামাখি তো সে
ভালো চোখে দেখতে চায় না
নির্বিষ চন্দ্রবোড়া
নিজেকে নিজে বেষ্টন করছিল চন্দ্রবোড়া
ঘুরছিল আর কুণ্ডলী পাকাচ্ছিল
নিজের দখল করা জায়গায়
কোথাও একচুল যেন ফাঁক না থাকে, যেন
মেধা, মনন আর হরমোন দিয়ে ইট বানাচ্ছিল
গেঁথে গেঁথে ভরাট করছিল নিজেকে
দংশনের প্রয়োজন এবং পদ্ধতি ভুলে গিয়েছিল
নিজেকে নির্বিষ করার সাধনায়
ভোঁতা করেছে সব ইন্দ্রিয়কে
স্থবির দেহখানি নিয়ে সে এখন দেখে
চারদিকে উঁচু উঁচু গাছ আর প্রচুর শূন্যতা
মাটির নিচে অনেক গভীর পর্যন্ত শেকড় আর
মাঝে মাঝে নির্বাক জল
ঘর
এতকাল কলকে ফুলকে কলকে ফুল বলেই জানতাম
হাঁসের ডিমকে হাঁসের ডিম বলেই ছিল বিশ্বাস
যেমন শিখিয়েছিলেন বেসিক ইস্কুলের দিদিমণি
ষাট বছর বয়স হলেই
প্রবীণ নাগরিক হয়ে যাব বলে নিশ্চিত ছিলাম
উডপেন্সিলের ব্যবহার করতে অসুবিধা হয়নি কখনও
আজ বিশ্বাস শব্দটিকে আঁকার জন্য
প্রয়োজনীয় রঙ খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও
সিঁডি এবং লিফ্টের মধ্যে, কোনটা বেশি নিরাপদ
তর্জমায় পাচ্ছি না
অথচ কতবার তো দেখেছি
একটুকরো থার্মোকল থেকে বেরিয়ে আসছে সেই আশ্রয়টি
যাকে আজও আবিষ্কার করেনি কেউ
ছায়া
অবশিষ্ট বয়সটুকু একদিন
চটিজোড়াকে বলল -
এবার তোমাদের ক্লান্ত হবার সময় হয়েছে
তাই ওরা তখন
দেওয়ালে ঠেস দিয়ে, পাশাপাশি, দাঁড়িয়ে পড়লো
আলো সেসময়ে ,সেখান দিয়েই, যাচ্ছিল
তার কারণেই
চটিজোড়ার ছায়া পড়লো তাদেরই পাশে
আর তারা অবাক হয়ে দেখল -
তাদের ছায়াগুলো হুবহু তাদের মতোই
আমি একদিন এক জানুয়ারির এক তারিখের সকালে
একটা শুকনো কাঠের চেয়ারের ছায়াকে
অনেকটা লম্বা দেখেছিলাম
সময়
ফ্যান ঘুরছে
ক্যালেন্ডার নড়ছে
আলো জ্বলছে
দরজার ছায়া পড়েছে
ঘড়ি চলছে বলে
সূর্য পৃথিবীকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে
আমি চোখ বন্ধ করলেই
এরা সবাই ঘুমিয়ে পড়বে
এরপর
আর যাকিছু বলার বাকি থাকে
তা দিয়ে জাল বুনবে মাকড়সা
গানের লং-প্লেয়িং রেকর্ড
ঠিকানা
তোমার ইশারা পেয়ে
আমি দ্রুত এগুতে থাকি
যে ঘটনাটি ঘটবে
তার দিকে
কিছুদূর যাওয়ার পর
ইশারাটি স্বয়ং আমাকে বলে
তুমি তাকে পাঠাওনি তখন
সেই মুহূর্তে
যে ঘটনাটি ঘটবে না
তাকেই ঘটবে বলে ধরে নিয়ে
গণ্ডারকে পাঠিয়ে দিতে পারি তার দিকে
অথবা একটা মর্মরমূর্তি
স্থাপন করতে পারি সেখানেই
আর নয়তো, নিজেকে
জাইগোট থেকে বিচ্ছিন্ন করে
ফিরে যেতে পারি জন্মদাতার শুক্রাশয়ে
এরমধ্যে কোনোটিই না করে
ইশারাটি যে পথে এসেছিল
সে পথ ধরে পিছতে থাকি
এবং সে পথ আমাকে পেয়ে
নিজেকে তৈরি করে চলেছে অবিরাম
মধ্যবিত্ততা
যে দিনগুলোকে নিয়ে ভয় থাকে, উৎকন্ঠা থাকে
সেগুলো একদিন পিছনে চলে যায়
এবং পিছু ফিরে তাকালে দেখি
সব্জির শুকনো খোসা তারা
উপরের স্তবকে লেখা শব্দগুলোর মধ্যে
দান্তে বা গ্যাটেকে খুঁজে পাওয়া যাবে না
আমাদের পাড়ার ভূতপূর্ব কোনো যুবককে পাওয়া যেতে পারে
পাড়ার ছেলে বা ঘরের মেয়েকে নিয়ে লেখা উপন্যাস
পেঙ্গুইন থেকে ছাপা হয় না
সোনালি চুল, নীল চোখ অথবা
কালো ত্বক, মোটা ঠোঁট
টেস্টস্টেরন বা কর্টিসল ক্ষরণে সাহায্য করে
ঘড়ির কাঁটা নাকি
একই পথে ঘুরে মরছে সারাজীবন
তার বৃত্তাকার রাস্তাকে এবার অন্য কোনো আকার দেওয়া হোক
মিথ ও ইতিহাসের কথা না ভেবে
আশঙ্কা
বসন্তময় পৃথিবীতে আমরা দেখি
প্রতিমুহূর্তে অজস্র শাখার উঁকি ফুটে উঠছে
কাণ্ড ও পাতার তিরিশ ডিগ্রি কোণে
হাজার হাজার সূর্যোদয়
এদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধে ভেঙে পড়ছে
মানুষের সভ্যতার আস্ফালন
সংবাদমাধ্যমের ব্রেকিংনিউজের লালায়
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশার বীজ রোপণ হচ্ছে মহা তৎপরতায়
বিপন্ন হয়ে পড়ছে আশঙ্কা শব্দটির অস্তিত্ব
কিছু মানুষ পূর্বে যাচ্ছে
কিছু পশ্চিমে
এরা কি সূর্য সন্ধানে নাকি হননের বিলাসে? জানে না
একটা অদ্ভুত রকমের স্লোমোশনের ঝড় আসছে পৃথিবীতে
একটু বড় সাইজের কালো ছাতা বা ত্রিপলও বলা যায়
নেমে আসছে
একটা জানালা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ,তো ভেঙে যাচ্ছে অন্য একটা
একদিকে বসন্ত, অন্যদিকে মৃত্যুর নিখুঁত আয়োজন
একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে কুম্ভকর্ণ
এক জি-বি জীবন
বাজার থেকে কিনে আনি দৈনিক এক জি-বি মোবাইল-ডাটা
প্রতিদিনের বাঁচার মেয়াদ ওইটুকুই
সদ্-অসদ্ ,বৈধ-অবৈধ, গোপন-প্রকাশ্য
যেভাবেই তা খরচ করি না কেন
বাঁচিয়ে রাখার চাবি বাজারের হাতেই
তুমি যেভাবে সময় নষ্ট করছ ফেলে ছড়িয়ে
মোবাইল-ডাটার সক্রিয় অপশনে
নিজেকে খরচ করে ফেলছো হু-হু করে
আবার যদি তা নিষ্ক্রিয়ও রাখো
পাল্টে যাওয়া তারিখ তোমাকে মৃত ঘোষণা করবে
আমার এক জি-বি ,তোমার এক জি-বি, যোগ করলে
আমাদের যৌথ বাঁচার মেয়াদ কিন্তু দু জি-বি হবে
প্রেম
এইমাত্র সে ঘুরে গেছে এখান থেকে
ছোটো বড় ছায়াগুলো, এখানে ওখানে, পড়ে আছে এখনও
তার শরীরের গন্ধ আর রঙ সঙ্গে নিয়ে
আমি তখন একটা বড় বটগাছের উল্টোদিকে ছিলাম
সেতারের কণ্ঠে একটা করুণ আর্তনাদ আঁকা হচ্ছিল
ক্ষীণ রেখার অবয়বে
নদী যেমন বহুদূর থেকে মানুষকে ডাকতে পারে
সে রকমই কিছু প্রাকৃতিক নাড়ি-যন্ত্রণা
যা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি
আমন্ত্রণপত্রের বয়ান লিখতে থাকে
তার সঙ্গে দেখা হয়নি যাদের যাদের
তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যাব একদিন তার কাছে
এখন কেবল এটুকু বলে রাখি
নিছক প্রেম নিয়ে আমি কখনও কোনো কবিতা লিখিনি
2 Comments
সুন্দর।
ReplyDeleteএকসঙ্গে অনেকগুলো কবিতা , যা' বহুমাত্রিক বলয় থেকে উৎসারিত, পাঠের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক ভাবে জানানো, অলক্ষুণে কথা ;তবু ভাল লাগল' বলতেই হয়।
ReplyDelete