জ্বলদর্চি

মারণবীজের আজব ধাঁধা পর্ব ৭ /বাসুদেব গুপ্ত


মারণবীজের আজব ধাঁধা পর্ব ৭

বাসুদেব গুপ্ত


ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে আলপনা দেখে বোঝা গেল এটা পূর্ণিমারই ফ্ল্যাট। অর্চি নভীনকে দেখালো, একবার দেখ কি সুন্দর রংগোলী করেছে। 
-রংগোলী নয়, ওরা বলে কোলম। রংগোলী বা আলপনা হল মুক্ত হাতে আঁকা ফুল লতাপাতা। কোলম আঁকা শুরু হয় নির্দিষ্ট দূরত্বে প্রথমে ছোট ছোট বিন্দু এঁকে। তারপর সেই বিন্দুগুলো জোড়া হতে হতে ফুটে ফুটে ওঠে এক জ্যামিতিক ডিজাইন। একেবারেই আলাদা আলপনার থেকে। যেমন হিন্দুস্থানী গান কর্ণাটকির থেকে মত আলাদা। 
নভীন তফাতটা বুঝিয়ে দেয়।
-দেখা যাক আমাদের পূর্ণিমা কি কি পয়েন্ট খুঁজে পায়। তারপর আমাদের কাজ হবে সেগুলো জুড়ে বার করা এইসব কোলমের পেছনে কোন ভয়ংকর ডিজাইন লুকিয়ে আছে। 
বেল টিপতেই পূর্ণিমা দরজা খুলে অভ্যর্থনা করে। স্নান সেরে একটা রূপালী রঙের কাসাভু শাড়ী পরেছে, তার উজ্জ্বল সোনালী রঙের পাড়ের আভায় তাকে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসা পূজারিণী মনে হয়। চোখ স্নিগ্ধ হয়। তার সংগে হাল্কা চন্দন ধূপের সুবাস। অর্চি ও নভীন চোখ চাওয়া চাওয়ি করে সোফায় বসতে বসতে। নীচু কাঠের সোফা ডান দিকে একটা কাঠের তৈরী লম্বা নৌকো, মনে হয় বোট রেসের। বাঁ দিকে দুটো ল্যাপটপ। একটা আইম্যাকে কিছু একটা চলে যাচ্ছে, পরিবেশের সংগে ঠিক যেন মিলছে না। ফেসবুকে পূর্ণিমার প্রোফাইলের ফেডেড জিনস আর টি শার্টের সংগে মেলানো আরও কঠিন। 

পূর্ণিমা তিনটে জুসের গ্লাস একটা কাঠের ট্রেতে নিয়ে এসে সামনে রেখে বসে। কিছু বলে না। 
-কি ব্যাপার? তোমার কম্পিউটার কোয়ারী কি বলল? নভীন সোজা সুজি কথা পাড়ে। 
-আপনারা যে বলেন find a snake when looking for worms, সেরকম। 
-কেঁচো খুঁড়তে সাপ? মানে?
-মানে বললে বুঝতে পারবেন। গত দুমাসে একসিডেন্ট হয়েছে রোড প্রায় ১ লাখ। ডেথ প্রায় ৩৫০০০। 
-দুমাস আগে এটা ছিল ৮০০০০ একসিডেন্ট। ডেথ ২৪০০০
-তাহলে কি বোঝা যাচ্ছে?
পূর্নিমা ল্যাপটপে গিয়ে কি খটখট করল প্রিন্টার থেকে বেরিয়ে এলো কিছু গ্রাফ। 
-দেখুন। গত ছ মাসের। গ্রাফে দুর্ঘটনার পাশাপাশি আনুমানিক জনসংখ্যার গ্রাফও রয়েছে। চারমাস গ্রাফগুলো প্রায় সমান্তরাল। হঠাৎ গত দুমাসে প্রায় করোনার গ্রাফের মত দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। আর ডেথের সংখ্যা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে। 
-এ থেকে বোঝা যাচ্ছে কোন একটা এক্সটারনাল প্রভাবে দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। কিন্তু মৃত্যুর অনুপাত প্রায় একই। অর্থাৎ ইচ্ছে করে কেউ মানুষ মারার জন্য এটা করাচ্ছে না। যা হচ্ছে তার পেছনে প্রাকৃতিক কারণ আছে। 
-আচ্ছা এতো গেল রোড। ট্রেন বা প্লেন দুর্ঘটনা? 
-প্লেনে একটাই হয়েছে। ট্রেনে চারটে। প্লেনে কো পাইলটের জন্য উর্বীরা বেঁচে গেছে। ট্রেনে সেটা হয় নি। কিন্তু ট্রেনের গতিবেগের তফাত ছিল। তিনটে কেসে স্টেশন থেকে ট্রেন বেরিয়েই দুর্ঘটনা। একটা কেসে ড্রাইভার বদল হবার পর মাঝ রাস্তায়। 

-এ থেকে কি বোঝা যায়?
-ওয়াইল্ড গেস করছি। মনে হয় ট্রেনের ইঞ্জিন বা ড্রাইভারের কেবিনে কোনরকম কেমিক্যাল পয়জনিং হয়েছে। টারমিনাল থেকে গাড়ী ধীরে ধীরে পিক আপ নিয়েছে আর মাঝপথে খুব তাড়াতাড়ি হাই স্পীডে চলে গেছে। সেইজন্য তিনটে ট্রেনে দুর্ঘটনা তেমন ভয়ংকর হয় নি। চার নম্বরটার হয়েছে। 
নভীন হাঁ করে শুনছিল। যা প্রশ্ন করার অর্চিই করছিল। কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। অগত্যা ও পরের মন্তব্যটা যাচাই করতে যায়,
-এগুলো কেঁচো না মনে হয়ে স্নেক মনে হল কেন?
-না এগুলো স্নেক না। স্নেক আলাদা। সেটা আমার অতিরিক্ত কৌতূহলের জন্য দেখা দিয়েছে। আমি দেখলাম এই সময়ে সুইসাইড হয়েছে ২ লাখ। অর্থাৎ দু গুণ। আর পলিটিকাল মার্ডার হয়েছে ৫ লাখ। এরেস্ট হয়েছে অনেক। কিন্তু কোন কেসের কোন কিনারা হয় নি। অর্থাৎ পলিটিকসের ইজ দি বিগেস্ট কিলার। আমরা কেমন দেশে বাস করছি নভীন ভাই, ভয় লাগে। প্রায় ককিয়ে ওঠে পূর্ণিমা। 
-সেটা তো বটেই। পলিটিকস মানেই ওয়ার। আর ওয়ার মানেই সমস্ত যুক্তির মুখে ঝামা ঘষে অকারণ মৃত্যুর মিছিল। অর্চি একটু উত্তেজিত হয়ে বলে আবার গুটিঁয়ে যায়। মনে হয় ভিতরে লুকোন কোন গভীর ক্লান্তি ওর রাশ টেনে ধরে।
আবহাওয়াটা হঠাৎ খুব গম্ভীর। কেউই কি বলবে কিছুক্ষণ ঠিক করতে পারে না। ভিতরের ঘর থেকে চাপা স্বরে ভেসে আসে, হিমাদ্রি সুতে পাহিমাম…
ধূপের গন্ধের মতই এই কণ্ঠস্বর। হাওয়ায় অদৃশ্য শরীরে অধিকার করতে থাকে শ্রবণ। 
-এম বালমুরলী কৃষ্ণা না ? নভীন চিনতে পারে। 
-হ্যাঁ হমসগীতে ছবির গান। বেস্ট প্লেব্যাক সিংগার হয়েছিলেন। 
-কি সুর। আর কি দরাজ melifluous গলা। 
পূর্ণিমা অবাক হয় এরা চিনতে পেরেছে দেখে। ওর মুখের রেখাগুলোও একটু নরম হয়। বলে।
-কফি আনি?
-থ্যাংক ইউ। আচ্ছা মণিকার চ্যানেলটা একটু চালাও তো। শুনি The news কি বলে?

The news কিছুক্ষণ এড দেখায়, নীচের লাইনে রেল দুর্ঘটনার খবর চলতে থাকে। 9-30 এর রোজের প্রোগ্রাম মর্নিং উইথ মণিকা। 
কিন্তু মণিকা আজ নেই। মণিকার জায়গায় দেখা যায় ইন্দারজিত সিং। খুব ছটফটে, প্রাণ শক্তিতে ভরপুর থাকে রোজ। আজ মুখটা একটু অন্যমনস্ক। ও খেলার খবর বলে। এই বিভাগটির সে কোনদিন করে না তাই একটু অস্বস্তি। কিন্তু আশ্চর্য মণিকা আজ কেন আসে নি এ নিয়ে একটাও লাইন চ্যানেল থেকে বলে হয় না। 

- বোধহয় এরেস্ট হয়ে গেছে। আচ্ছা সরকার কি মুখ বন্ধ করে বিপদ বন্ধ করতে পারবে? কিছুদিন নিজের পদে হয়ত টিকে থাকবে তারপর? 
নভীনের খুব চিন্তা হয়। সরকার যত ভালো কাজই করুক একবার নাম খারাপ হলে মানুষের মুখ বন্ধ হলেও, মন তো বন্ধ করা যায় না। সন্দেহ হতে থাকে। 
-মুখ বন্ধ করেই তো চলছে। করোনার সময় অক্সিজেন চাই বলে বিজ্ঞাপন দিলেও এরেস্ট হয়েছে। 
-এরেস্ট হলে নাকি তাদের বাড়ী বুলডোজার দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়?
অর্চি উঠে পড়ে কফিটা কোনমতে শেষ করে। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেছে একটা কথা। এক্ষুনি একবার খোঁজ লাগাতে হবে। মনে হচ্ছে হাতে সময় বেশি নেই। 
পূর্ণিমাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে প্রায় দৌড়েই নভীনকে নিয়ে ওর গাড়ীতে ঢুকে পড়ে। জিজ্ঞাসা করলে বলে হোটেল এখন আর নিরাপদ নয়। তারপর গাড়ীটা নিয়ে দুজনে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ৭০ কিমি গিয়ে একটা চায়ের দোকানে থেমে ফোন লাগায় ডঃ নীল অস্থানাকে। চক্ষু বিশারদ ডঃ অস্থানা, কানপুরের মানুষ কিন্তু কলকাতারই ডাক্তার। এইডস ও চোখের রোগ নিয়ে ওনার গবেষণা নিয়ে কাগজেও রিপোর্ট বেরিয়েছিল একসময়। 
ফোন বেজে যায়। কেউ ধরে না। ডঃ অস্থানার আর একটা গুণ উনি ভালো সেতার বাজাতে পারেন। অর্চি একবার সুযোগ পেয়েছিল চোখের ডাক্তারদের অল ইনডিয়া মিট কভার করার। সেখানেই ওনার সেতার শুনে ইন্টারভিউ করতে গিয়েছিল, একটা ব্লগ করবে বলে। সেখানেই আলাপ। সেই সূত্রে ওর এসিস্ট্যান্ট মীনা পুরোহিতের সংগেও আলাপ হয়। বেশি কথা অবশ্য হয় কলকাতার রসগোল্লা আর মিষ্টি দই নিয়ে। মীনার ফোন নম্বর অনেকগুলো নোটবই খুঁজে অবশেষে বেরোয়। ফোন বাজে। চেনা গলার স্বর বেজে ওঠে। 
-আরে মিঃ অর্চি কি মনে করে?
-সে অনেক কথা। কিন্তু ডঃ অস্থানার ফোনটা কেউ ধরছে না। উনি কোথায়?
-উনি তো একটা সরকারী কনফারেন্স এটেন্ড করতে গেছেন কালকের ফ্লাইটে। ফোন ধরছেন না? আশ্চর্য। কে জানে কোন সিকিউরিটি প্রটোকল আছে, হয়ত বাইরের ফোন জ্যাম করে দেওয়া হয়েছে। 
-কি ব্যাপারে গেছেন, কতদিনের কনফারেন্স কিছু বলেছেন?
-কি ব্যাপারে ঠিক বলেন নি। খালি বললেন একটা নতুন চোখের অসুখ নাকি ডিটেক্ট হয়েছে সেটা খুব সিরিয়াস। হেলথ মিনিসটার তাই আলোচনা ও পরামর্শের জন্য দেশের পাঁচজন আই স্পেসালিস্টকে ডেকেছেন ।

-আপনারা তো রোজ এ নিয়েই কাজ করেন। আপনারা খবর পাননি বা এরকম পেশেন্ট আসে নি আপনাদের চরক নেত্রসেবালয়ে দেখাতে?
-না তো। চোখের অসুখ তো আর ফেটাল কিছু নয়। তাড়াহুড়োর কিছু তেমন নেই। আচ্ছা হ্যাঁ একটা কেস এসেছিল বটে। চোখটা খুব ইনফ্লেমড ছিলো কেমন একটু বেরিয়ে আসছিল। আমরা আই এনটিবায়োটিক দিয়ে আবার আসতে বলেছিলাম। আর আসে নি। 
-নাম বা ডিটেইল মনে আছে। অর্চির পেশি শক্ত হয়ে ওঠে। 
-নাম দেখতে হবে। পেশায় বলেছিল ট্রাক ড্রাইভার। 
-ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ। আমি জানতে চাইছি কারণ আমার মাসখানেক আগে একটা একসিডেন্ট হয়। সেখানে ড্রাইভারের এরকম সমস্যা হয়েছিল। 
-তাই নাকি? আপনার আঘাত লাগে নি তো?
-খুব একটা না। রুচি মানে আমার ওয়াইফ, ওই ওই… ডেড। বলে চুপ করে যায়। 
- সে কি! মীনা কি বলবে বুঝতে পারে না। খানিকটা চুপ করে বলে, আই এম ভেরী সরি। 
- আপনার পেসেন্টের নাম ঠিকানা জোগাড় করতে পারলে আমাকে দেবেন প্লীজ। কি জানি আবার একটা কিছু হয় কিনা। একটা দীর্ঘশ্বাস হজম করে অর্চি। 
সন্ধেবেলা ফোনে খবর আসে। ধীরজ সিং। ১৩১/৪ বাগমারী রোড। ফোন ৯৮….। 
এক নিঃশ্বাসে ফোন লাগায় অর্চি। নভীন তখন ঊর্বীর সংগে ফোনে। মণিকা এখনও কোন ফোন করে নি। 
-হ্যালো ধীরাজ জি? ম্যায় এক পত্রকার। আভি আভি আপকী আঁখোকা ডাক্তার সে বাত কিয়া। কেস কুছ গড়বড় হ্যায়। আপ ফির একবার আ সকতে?
ধীরাজ সিং এরকম অদ্ভুত অনুরোধ শুনে পাত্তা দেয় না। বলে, 
-আভি ম্যায় দিল্লী রোড মে। ফিরে এসে দেখাব দরকার হলে। বলে ফোন কেটে দেয়। 
খাঁচায় পোরা বাঘের মত পায়চারী করে যায় অর্চি। আরো একবার ফোন লাগায়। বেজে উঠে কেটে যায়। নম্বর দেখে কেটে দিয়েছে। 
-ফোন ধরছে না। এক্ষুনি যদি একসিডেন্ট করে? কি করি নভীন বল না কিছু একটা?
নভীন বোঝায়,
-এতটা যখন চালিয়েছে ওর নিশ্চয় এই অসুখ হয় নি। তুই বোস তো ঠাণ্ডা হয়ে। একটা বিয়ার বার কর ফ্রিজ থেকে। কি করা যায় ভেবে লাভ নেই। আমরা চুনোপুঁটি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমাদেরই ধরে পুরে দেবে। 
-তুই বুঝছিস না। আমার মন বলছে আজ একটা ঘটনা ঘটাবে এই সিংজী। আর আমরা জেনেও সেটা আটকাতে পারবো না। হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। আমরা ভাগ্যের হাতে এত অসহায়?
সারা দিন ছটফট করে কাটে। কাজের কাজ হয় না। 
সন্ধে ছটার ব্রেকিং নিউজ। সাংঘাতিক ট্রাক দুর্ঘটনা। কন্ট্রোল হারিয়ে উল্টো দিকের ট্রাফিকে ঢুকে পড়ে ট্রাকের তাণ্ডব। ট্রাক চালকের মৃত্যু। বরযাত্রী দলের দুটি গাড়ী চুরমার। হতাহতের সংখ্যা অজানা। 
দুই বন্ধু দুই মমির মত চুপ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আরো একটা খবর শোনে। নামকরা সাংবাদিক মণিকার মৃতদেহ জংগলে আবিষ্কার। বুকে দুটো গুলির চিহ্ন। মনে করা হচ্ছে উগ্রপন্থীদের ডেরায় তিনি খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিপদে পড়েন। তথ্যমন্ত্রী টুইট করে তাঁর শোকবার্তা জানিয়েছেন। 
অর্চি আর নভীন দুটো হুইস্কির গ্লাস নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে । গ্লাস যেমন কে তেমন। মুখে তুলে নেওয়ার শক্তিটাও যেন কেউ সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে নিয়ে গেছে। 
 -ক্রমশঃ-

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments