জ্বলদর্চি

জাওয়া গান: নারীর দুঃখ গাথা /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব -২৯

জাওয়া গান: নারীর দুঃখ গাথা

সূর্যকান্ত মাহাতো


ভাদ্র মাস। আকাশে এক ফালি চাঁদ। তবুও জ্যোস্নালোকিত চরাচর। পাড়ার রীতা মাহাত, গীতা মাহাত, মামণি মাহাত, চম্পা মাহাত, বৈশাখী মাহাত চাঁদের এই নিয়ন আলো মাখা সন্ধ্যায়  ঘুরে ঘুরে নাচ ও গান করছে। সেখানে পুরুষের কোনও অংশগ্রহণ নেই। জঙ্গলমহলের এমন কিছু গান ও অনুষ্ঠান আছে, যেখানে পুরুষেরা একেবারেই ব্রাত্য। "জাওয়া গান" বা "জাওয়া পরব" হল সেরকমই একটি অনুষ্ঠান। কুড়মি মাহাতোদের একটি শস্য উৎসব। এই গান বা অনুষ্ঠানে পুরুষের অংশগ্রহণে কোন অধিকার নেই। এ গান একান্তই নারীদের। বিশেষ করে কুমারী নারীদের। নারী সমাজের দৈনন্দিন  সুখ দুঃখের কথায় এ গানের ভাষ্য। তবে সুখের চেয়ে দুঃখ বা যন্ত্রণার কথাই গানগুলোতে বেশি বেশি করে প্রকাশিত হয়। একজন নারী বিয়ের সময় কতসব স্বপ্ন দেখে। স্বামীর সোহাগ পাবে। শ্বশুর শাশুড়ির স্নেহ পাবে। ননদ ও দেবরের সঙ্গে খুনসুটি করবে। শ্বশুরবাড়িতে বেশ হাসি খুশিতে সংসার করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। বিয়ের পরই সেই স্বপ্ন ভেঙে যায়। বরং কাটাতে হয় বেশ যন্ত্রণাময় একটা জীবন। শ্বশুরবাড়ি তখন হয়ে ওঠে কারাগারের মতো। স্বামী সহ শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুর, দেবর, ননদের সঙ্গে মধুর সম্পর্কটাও নষ্ট হয়ে খানখান হয়ে যায়। ভেঙে যায় তার মনও। বাবা, মা, দাদা ও ভাইদের কথা তখন খুব খুব মনে পড়ে। অথচ মন চাইলেও ইচ্ছে মতো বাপের বাড়িতে যাওয়ার অধিকার মেলে না। বুকে সেই কষ্ট চেপে রেখে, বাপের বাড়িতে খবর পাঠায়, সে সুখে আছে। এই "সুখে আছি" কথাটির ভিতরে কতখানি যে যন্ত্রনা লুকিয়ে থাকে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জাওয়া গানগুলোতে সেই ব্যথার কথায় ফুটে উঠেছে---

"একদিনকার হলদ বাঁটা তিন দিনকার বাসি গ
মা বাপকে বল্যে দিবে বড় সুখে আছি।
মা শুনল বাপ শুনল, শুনল সাধের ভাই গ
মা বড় সুজাতের বিটি কাঁদিতে লাগিল
একদিনকার হলদ বাঁটা তিন দিনকার বাসি গ
যবুনাকে নাইতে গেলে পথের মাঝে বসি
মা বাপকে বল‍্যে দিবে ভাই বড় সুখে আছি রে
মা শুনল বাপ শুনল শুনল সাধের ভাই গ
আর শুনল জন্মের সঙ্গতি।"

নারীদের যন্ত্রনা মাখা এই জাওয়া গানগুলো আসলে কী? সে কথায় যাওয়ার আগে "জাওয়া" কি সেটা জানা দরকার। "জাওয়া" হল একটি শস্য উৎসব। আবার শস্য বীজের অঙ্কুরোদগমেরও অনুষ্ঠান বলা যেতে পারে। একমাত্র কুমারী মেয়েরাই এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। ভাদ্র মাসের পার্শ্ব একাদশীর এক সপ্তাহ আগে এই অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে। কুমারী মেয়েরা সকালে ঘুম থেকে উঠেই জঙ্গলে চলে যায় শাল কাঠির দাঁতন ভাঙতে। ফিরে এসে স্নান করে নতুন ডালায় পুকুর বা নদীর বালি ভরে নিয়ে আসে। সেই বালিতে ছড়িয়ে দেয় ধান সহ মুগ, কলাই, অড়হর বীজ। এরপর ছিটিয়ে দেওয়া হয় হলুদ গোলা জল। আর বালিতে গুঁজে দেওয়া হয় দাতনের কাঠিগুলো। এভাবেই সম্পূর্ণ হয়, জাওয়া ডালি। এবার জাওয়া ডালিকে সযত্নে তুলে রাখা হয়। গানে গানে ব্যক্ত হয় সেই কথা---

"কাঁসাই নদীর বালি আন‍্যে যাওয়া পাতিব ল
আমাদের যাওয়া উঠবে বাগে তাল গাছের পারা ল
সুরুজ উঠে ধিন ধিন আমার জাওয়া উঠে না
তুমার লাগি দিব এক উপাস
সাত দিন জাওয়ার লাগি নিয়ম পালন করি গ
তবু আমরা জাওয়া তুলিব।"

প্রতিদিন সন্ধ্যায় গান গাইতে গাইতে সেই যাওয়া ডালিকে আঙিনায় বা বাইরে নিয়ে আসা হয়। সেই ডালিকে ঘিরে বৃত্তাকার ভাবে ঘুরে ঘুরে চলে নাচ ও গান। জাওয়া ডালিকে বাইরে ও ভিতরে নিয়ে যাওয়ার সময়ও সকলে গান গেয়ে ওঠে। এটাই হলো জাওয়া গানের অনুষ্ঠান।
"জাওয়া" শব্দটা নাকি "জাত" শব্দ থেকে এসেছে। বীজের অঙ্কুরোদগম বা চারার 'জাত' বা জন্ম থেকেই এমন নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। আবার শব্দটিও "জাওয়া" হবে না "যাওয়া" হবে, তা নিয়েও মতান্তর রয়েছে। তবে "জাওয়া" শব্দটি গমন অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। কারণ জাওয়া ডালির স্থানান্তর প্রসঙ্গেই গানগুলো গাওয়া হয়। আবার ডঃ ধীরেন্দ্রনাথ সাহা যেমন বলেছেন, মেয়েদের পিতৃগৃহ থেকে শ্বশুর গৃহে যাওয়ার প্রসঙ্গও এ গানে থাকে। আবার বঙ্কিমবাবু এর উল্টোটাই বলেছেন, তিনি মনে করেন, শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে যাওয়ার কথা জাওয়া গানে বেশি করে ব্যক্ত হয়েছে।

বিবাহিতা নারী নয়। একমাত্র কুমারী মেয়েরাই জাওয়া গানে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কুমারী মেয়েরাই কেন? এ প্রশ্নের উত্তরও আছে। কারণ কুমারী মেয়েদেরকে উর্বরাশক্তি ও প্রজনন ক্ষমতার অধিকারিণী বলে মনে করা হয়। তাই শস্য উৎসব বা অঙ্কুরোদগমের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের একটা গূঢ় সম্পর্ক আছে। জাওয়া গান তাই কেবল শস্য কামনা নয়। সন্তান কামনাও।

শস্য উৎসব হলেও গানগুলোতে শস্যের কথা তেমন একটা নেই। বরং নারীদের বিশেষ করে বিবাহিত নারীদের যন্ত্রণার কথাই বেশি বেশি করে ফুটে উঠেছে। যে কোনও গান হল, আবেগের একটি স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। জাওয়া গানগুলোও তাই। বিবাহিত নারীদের যন্ত্রণাময় আবেগের বহিঃপ্রকাশের কথায় গানগুলোতে ব্যক্ত হয়েছে।

নারীর শৈশব, যৌবন, বার্ধক্যের দশা এবং জীবনের আশা- আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা- বেদনা, ঘর- গেরস্থালির কথা, তাদের হিংসা-বিদ্বেষ এসব কিছুই জাওয়া গানের চরণে চরণে প্রকাশিত। তাই গানগুলো বেশ বেদনা বিধুর। 

সামনেই ইঁদ করম পরব। তাই বোনকে নিতে এসেছে ভাই। কিন্তু বোনের শ্বশুরবাড়ির কেউ পাঠাতে রাজি নয়। নতুন বউয়ের মনের কষ্টটা তারা কেউ বুঝলই না। গানে গানে তাই তার মনের ক্ষোভ ঝরে পড়েছে---

"ইঁদ করম ল জাকাল‍্য ভাই লিতে আল‍্য গ
আস‍্য ভাই বস‍্য পিঁঢ়ায় বেউনী দলাঁই দিব।
ইঁদ পরব ল জকাল‍্য ভাই আল‍্য লিতে গ
খালভরা নাই দিল যাতে
খালভরাকে খাতে দিলে চুলহাশালে বসে গ
উচিত কথা বলতে গেলে জুমঢ়া কাঠে ধাশে।"

ভাই বোনের গভীর ভালোবাসার কথা জাওয়া গান গুলোতে বারবার ফুটে উঠেছে। দাদা ও ভাইয়ের সঙ্গে কাটানো সুখের মুহূর্তগুলো বোনকে খুবই পীড়া দেয়। তাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলে,  মিথ্যাই সান্ত্বনা দিতে বধূটি বলে ওঠে, "আমারি জনম পরের ঘর।" তখন ভাইয়ের মনও কেঁদে উঠে। সেও তখন সান্ত্বনা দেয়। সে গানও মেয়েরা গেয়ে উঠে---

"আমি কি লিখ‍্যেছি বহিন বিধাতা লিখ‍্যেছে রে
বিধাতা লিখেছে পরের ঘর।
পরেরই ঘরে বহিন খাটি লুটি খাও রে
রাখি দিহ বাপের ভায়ের নাম।"

বোনকে দূরে কোনও নদীর ওপারে বিয়ে দিলেও বোন কষ্ট পায়। তার মনের কথাগুলোও গান হয়ে ওঠে---

"বেহা যে দিলি ভাইরে বড় লদীর পারে রে
আনা লেগা কে করিবে আর।
বাপ যদি মরে মায়ের দিশা হারায় রে
আনা লেগা কে করিবে আর।"

বারে বারেই ভাই বোনকে নিতে এলেও সমস্যা। ভাইয়ের বউ তখন রাগ করে। সে কোথাও জাওয়া গানে প্রস্ফুটিত---

"ভাই যদি আনে লেগে ভাজ থুতুনা ফুলায় রে
ফুলাও ফুলাও ফুলাও ভাজ নাই যাব তব গৃহবাসে গ।"

দূরে বিয়ে হওয়ায় কখনও কখনও বোন হয়তো মায়ের মৃত্যু সংবাদও সময়মতো পায় না। অনেকদিন বাদে দাদা বোনকে নিতে এসে সে সংবাদ দিলে, বোনের মন তখন ডুকরে কেঁদে ওঠে। গানে গানে সেই মর্মস্পর্শী কথাও ব্যক্ত হয়---

"মা অ মরল দাদা খবর অ না দিলি রে
হামি হলি রে দাদা, জনমের টু অর রে।"

সতীন সমস্যা তো মেয়েদের সব থেকে বড় সমস্যা। সে কথাও জাওয়া গানে ব্যক্ত হয়েছে---

"দাদা মোর আনি দেয় ত গাছি গাছি শাঁখা গ
সঁয়া মোর আনি দেয় ত লেড়পী সতীন।
ভাঙিচুরি যাবে ত দুই হাতের শাঁখা গ
জনম যুগ রহি যায় ত লেড়পী সতীন।"

শ্বশুরবাড়ির সকলের কাছেই নানাভাবে লাঞ্ছনা, তিরস্কার ও প্রহার সহ্য করতে হয়। মেয়েদের জীবন সংঘর্ষের জীবন। স্বামীকে উচিত কথাও সব সময় বলা যায় না। সে কথাগুলোও গানে গানে ব্যক্ত হয়েছে---

"বালি ছাতুর তরকারি বাস‍্যাম দিতে যাব ল
খালভরাদের হাল কত ধুরে
খালভরাকে খাতে দিলে চুলহাশালে বসে ল
উচিত কথা বলতে গেলে পয়না নিয়ে উঠে।"

শাশুড়ি তো চিরকালই বধূদের কাছে আতঙ্ক। বধূকে মানসিক ভাবে পীড়নের সেই ছবিও জাওয়া গানে ছড়িয়ে আছে---

"শাসু কা দেশে বাবা ঢাকল ঢাকল পাত গ
শাশুয় বাঁটে মুঠা খানেক ভাত।"

আবার,
         "শাউড়ি খায় ডাল ভাত শাউড়ি খায় ডাল ভাত
হামি খাই তিতা লাউ রে করলা।"

কখনও,
      "শাস পিঁধে লীল শাড়ি, দিদি পিঁধে লাল শাড়ি
হামে গ পিঁধে হামে পিঁধে ছিটল কম্বল।"

শাশুড়ির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে বধূ। তাই তার মন চাই এমন শাশুড়িকে বাঘে খেয়ে নেওয়াই ভালো। সে কথাও গানে ব্যক্ত হয়েছে---

"বনে যে গেলে শাসু বাঘে নাহি খাল‍্য গ
বাঘে খালে হতে আউদান।"

শ্বশুর বাড়ির গালাগালি বধূকে প্রতিনিয়ত সহ্য করতে হয়। বধূর বুকে সেগুলো শেলের মত বিঁধে থাকে---

"শাগ তুললম লতাপাতা, মাছ ধরলম গেঁতা গ
শ্বশুর ঘরে গাল দিঁইছে হিয়ায় আছে গাঁথা।"

ননদও নানা রকমের ইঙ্গিত পূর্ণ কথা বলে---

"পান খাইলি বহু খয়ের কুথায় পালি গ
তকে বহু দেয় পাড়ার লকে।"

নারীর বাৎসল্য রসও ফুটে ওঠে অনেক গানে---

"আঁখ বাড়ির ধারে ধারে কাহার ছেল‍্যা কাঁদে গ
আস ছেল‍্যা, কলে লিব বড় দয়া লাগে।"

নারীর রান্নাবান্নাও উঠে এসেছে জাওয়া গানে---

'মাছ রাঁধেছি চাকা চাকা', 'ছাগল ঠেঙের পিঠাপড়া', 'পস্তু বাঁটি ঘসর ঘসর, মুগ কলাইয়ের ডাল', 'পস্তু দিয়ে রাঁধব গেঁতা মাছ' ইত্যাদি।

"জাওয়া গান" এখন আর তত বেশি দেখা যায় না। জঙ্গলমহল জুড়ে প্রচলিত দারুণ জনপ্রিয় এই লোক সংগীতগুলো একটু একটু করে তার জৌলুস হারিয়ে ফেলছে। সময়ই হয় তো তার জন্য দায়ী।

তথ্যসূত্র: ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য- বঙ্কিম চন্দ্র মাহাতো
ঋণ স্বীকার: নিবন্ধের গানগুলো "ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য" গ্রন্থ থেকে গৃহীত।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments