জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে --২৭/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ২৭

১৯৯৭ এর ডিসেম্বরে সোনারতরী পত্রিকার বার্ষিক অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে যোগ দিলাম। বক্তব্য রাখার সময় প্রচুর করতালি শুনতে পেলাম। খুব উৎসাহ বোধ করলাম। এই অনুষ্ঠানে জ্যোতিপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হয়। উনি প্রচুর লেখালিখি করেন। ওনার লেখা নাটক আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত হয়।  সম্ভবত ১৯৯৮ এ মেদিনীপুর বইমেলায় ছোটদের ‘নয়ন’ পত্রিকার সম্পাদক বিদ্যুৎ পালের সঙ্গে আলাপ হয় এবং ওনার পত্রিকার জন্য একটি গল্প পাঠায়, ছাপাও হয়।শহরের দৈনিক সংবাদপত্র ‘বিপ্লবী সব্যসাচী’ পত্রিকার অফিসে গিয়ে শারদ সংখ্যার জন্য একটি কবিতা দিয়ে আসি। সেটি ছাপা হলেও সম্পাদক আমাকে কোনো কপি পাঠালেন না ।  আমার ছেলে স্টল থেকে কিনে নিয়ে আসে। এই বছরই জ্যোতিপ্রকাশ বাবুর উৎসাহে সোনার তরী পত্রিকায় ‘স্মৃতি তুমি বেদনার’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখলাম। আজকাল সংবাদপত্রের রিভিউতে আমার লেখাটি প্রশংসিত হল। এই সময় থেকে আমি আমার ‘বেবি’ নামের সঙ্গে ‘রোশেনারা খান’ নামটিও ব্যবহার করতে করি করি। ১/৪/১৯৯৮ এ আনন্দবাজার পত্রিকায় বেবি খান নামে প্রথম আমার লেখ চিঠি প্রকাশিত হল। সে কী আনন্দ আমার। বিষয় ছিল ‘নারীর অত্যাচারে’। পরের চিঠি ৫/১১/১৯৯৮ সালে, বিষয় ‘শুধু মেয়ে বলে?’ নিবন্ধটির চেয়েও আমার চিঠি আকারে বড় ছিল। ১৯৯৮ এ আজকাল এ  প্রথম চিঠি প্রকাশিত হল তালাকের ওপর। এর পর থেকে মাঝে মধ্যেই চিঠি লিখতে থাকি। 
                          ১৯৯৮ এর জুন মাস থেকে শ্রীরাম ‘মানবকণ্ঠ’ নামে চার পৃষ্ঠার একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ  শুরু করলেন। আমাকে সহসম্পাদক আর  জ্যোতিপ্রকাশ বাবুকে কার্যনির্বাহী সম্পাদক করলেন।  এখানে আমি ছোট ছোট নিবন্ধ লেখা শুরু করি, লেখাগুলি প্রশংসা পেতে থাকে। বিশেষ করে অদ্রীশদার(অদ্রীশ বর্ধন)প্রশংসা আমাকে ভীষণভাবে লেখায় উৎসাহিত করে। ২২/০২/১৯৯৯ এ মেদিনীপুর কলেজে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের মেদিনীপুরে পদার্পণ স্মরণে কবি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। কলকাতা থেকেও কবিরা এসেছিলেন। আমিও কবিতা পাঠের সুযোগ পাই এবং এখানেও আমার কবিতা  প্রশংসিত হয়। তখন থেকেই নয়ন পত্রিকার সম্পাদক বিদ্যুৎ পাল গর্ব করে বলতে শুরু করেন, আমি বেবি খানকে আবিষ্কার করেছি। সে যাইহোক এই বছরেই কবি এবং সোনার তরী পত্রিকার সভাপতি হিসেবে ‘ময়না নজরুল জন্ম শতবর্ষ উদযাপন কমিটি’র তরফ থেকে মানপত্র দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ময়না কলেজের অধ্যক্ষ্য ডঃ অমরেন্দ্রনাথ বর্মণ। উনি নিজেও একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। যেহেতু ওনাদের অনুষ্ঠানগুলি বেশিরভাগই রবীন্দ্রসদন চত্বরে বাংলা একেডেমি বা জীবনানন্দ সভাঘরে অনুষ্ঠিত হত, তাই আশেপাশের জেলাগুলির কবি ও সম্পাদকেরা যোগ দিতেন। অনেকেই লেখা চাইতেন। এভাবেই সুদূর পুরুলিয়া থেকে উত্তরবঙ্গের লিটিল ম্যাগাজিনে আমার লেখা প্রকাশিত হতে থাকল। বেশিরভাগ লেখা পত্রিকার সম্পাদক নিজেই চেয়ে পাঠাতেন। আসলে আমি তো বাচ্চা মেয়ে নই, তাই অনুরোধ করতে লজ্জাবোধ করতাম।
    ২০০১ এ মেয়ে শাহিনের বিয়ে দেওয়া হল তার নিজের পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে। জামাই ডাক্তার। আত্মীয়, প্রতিবেশীরা আড়ালে সমালোচনা করলেও, সামনে কিছু বলার সাহস ছিল না। খান সাহেব মেয়ের বিয়ে প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আমি একজন মানুষের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।কোনো ধরমের সঙ্গে নয়। বিয়ের সময় মেয়ে ইস্লামিয়া হাসপাতালে নার্সিংস্কুলে শিক্ষকতা করত। ওখানে চাকরিতে যোগ দেবার সময়ই বলা হয়েছিল কয়েক মাসের মধ্যে মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু বার বার বলা সত্বেও হাসপাতালের সর্বেসর্বা সুলতান আহমেদ সেকথায় কর্ণপাত করতেন না। বিয়ের পর ও যখন চাকরি ছাড়ার কথা জানাল, তখন সুলতান আহমেদ ওকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, চাকরিটা ছেড়োনা। সামনের মাস থেকেই মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া হবে। মেয়ে তাঁর মুখের ওপর বলে ছিল, এতদিন যখন সিধান্ত নেননি্‌, তখন আমার সিধান্ত বদল হবে না।                    একটা কথা লেখা হয়নি। মানব কণ্ঠ প্রকাশিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে পত্রিকার সম্পাদক শ্রীরামের সঙ্গে জ্যোতিপ্রকাশবাবুর কোনো কারণে মনোমালিন্য  হওয়াতে উনি মানবকণ্ঠ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে ‘প্রগতি’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৯৯ এ প্রথম প্রকাশিত প্রগতি পত্রিকায় আমার ‘মন্দিরময় পাথরার ইয়াসিন’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই লেখাটি পড়ে ইয়াসিনদা  বলেছিলেন, দিদি, আমাকে নিয়ে অনেকেই তো লিখেছেন। কিন্তু এমন কাব্য করে কেউ লেখেননি। অক্টোবরে শারদ সংখ্যায় ‘পরাজিত সৈনিক’ নামে একটি গল্প ছাপা হয়। এই সংখ্যায় আই পি এস নজরুল ইসলামের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়।উনি  তখন সাহিত্যজগতে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এরমধ্যে রায়টারসে গিয়ে ওনার সঙ্গে দেখা করে এসেছ। ‘পথিক’ নামে আগেই একটি পত্রিকা থাকায় পরে এই পত্রিকার নাম হয় ‘পথিক প্রগতি’।
    এখন মেদিনীপুরের প্রায় সব সাহিত্যানুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাই। সেইসব  অনুষ্ঠানে শ্যামলকান্তি দাস, রতনতনু ঘাটি, দীপ মুখোপাধ্যায় ও আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়। ওনারা অনেকেই আমাদের বাড়িতেও এসেছেন। আমাদের বাড়িতে  বসেই  শ্যামলকান্তি দাস আমার একটি কবিতা পড়ে বলেছিলেন, আপনাদের মত কবিদের বাদ দিয়ে কেন যে হলদিয়া উৎসবে আমাদের ডাকেন! এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বইদ্যুতিন মাধ্যমে মুখ দেখানো হয়ে গেছে। এসব ব্যপারে শ্রীরাম খুব ওস্তাদ ছিলেন। ওনার সংগঠনটি অন্য ধরণের হওয়ার কারণে মাঝে মধ্যে খবরে তার ঝলক দেখা যেত। কখনো টকশো তে ডাক পেতেন। এ নিয়ে তাঁর গর্বেরও সীমা ছিলনা। আমি যা ভেবে ওনার সংগঠনে যোগ দিয়েছিলাম, কিছু দিনের মধ্যেই বুঝলাম তা হওয়ার নয়। ওনার মতে মহিলাদের কোন সমস্যা নেই। পুরুষরাই মহিলাদের দ্বারা নির্যাতিত। তবুও ওদের জন্যই ৪৯৮(ক) ধারার আইন তৈরি হয়েছে। ওনার সঙ্গঠনে থেকে যা জেনেছি বা চারপাশে দেখছি, দুরকম  ঘটনাই ঘটছে। বধূ নির্যাতন তো হয়েই থাকে, পাশাপাশি মিথ্যে অভিযোগে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের জেল খাটাচ্ছে, হাজতবাস করাচ্ছে, বৃদ্ধা শ্বশুর-শাশুড়িকে বাড়িছাড়া করছে, আমন ঘটনাও ঘটছে। ৪৯৮(ক)ধারার জামিন অযোগ্য  আইনটির অপব্যবহার করার অভিযোগ ওঠায় পরে তার সংস্কার করা হয়েছে।  সেইসময় আইনটি এতটায় কঠোর ছিল যে কোন স্ত্রী স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের নামে থানায় অভিযোগ জানালে সত্য মিথ্যে যাচাই না করেই তাঁদের গ্রেফতার করা হত। জামিন অযোগ্য হওয়াতে স্বামী তিনমাসের আগে জামিন পেতেন না। চাকরি থেকে সাসপেন্ড হয়ে যেতেন। বর্তমানে এই আইন কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।
        ৩০/১১/২০০০ সালে আজকাল সংবাদপত্রে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল এক অভিশাপ’ শিরোনামে প্রথম চিঠি প্রকাশিত হল। এভাবেই আমার গদ্য লেখা শুরু হয়। জীবনানন্দ সভাঘরে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে লেখালিখি নিয়ে অদ্রীশ দার সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। আমার একটি লেখা প্রসঙ্গে বললেন, হিমাচল প্রদেশে একজন মহিলা এক পরিবারের একাধিক ভাইকে বিয়ে করে সংসার করে আগে জানতাম না। তোমার লেখা পড়ে জানলাম। আরও কিছু পর বিষয়ান্তরে গিয়ে বললেন, তোমাকে দেখে কলকাতার মেয়েদের সেখা উচিৎ একটা সাধারণ তাঁতের সাড়িতে একটি মেয়ে কতখানি আকর্ষণীয়া হতে পারে। আসলে আমি কখনোই উগ্র মেকআপ করা ও আধুনিকাদের রুজ-লিপ লিপস্টিক, ভ্রুপ্লাক করা, চোখে কাজল, লক্সকাটা চুল এসব অনুকরণ করার চেষ্টা করিনা। এগুলো আমি বহন করতে পারবনা বলেই চেষ্টা করিনা। আমার নিজস্ব স্টাইল হল, লম্বা চুলে হাতখোঁপা, আঁচল ছেড়ে তাঁত বা সিল্কসাড়ি, কপালে বড় টিপ। সাজপোশাকে আলাদা বলে কিনা জানিনা, এই সব অনুষ্ঠানে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতাম।
    ১৭/১২/২০০০ সালে সংবাদ প্রতিদিনে আমার ছড়া প্রকাশিত হল। পরবর্তীতে  ছোটদের পৃষ্ঠায় আরও  ছড়া, গল্প প্রকাশিত হয়। এখন আমার শহরে ও শহরের আশেপাশে লেখালিখির জগতে রোশেনারা খান বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। যে সব্যসাচী সংবাদপত্রে লেখা পাঠিয়ে শারদ সংখ্যার পত্রিকা কিনে পড়তে হয়েছিল, সেই পত্রিকার সম্পাদক নিশীথদা(দাস)নিজে আমার বাড়ি এসে ওনার পত্রিকায় লেখার জন্য অনুরোধ করেন। লেখা পাঠানো শুরু করলে প্রতিদিন বিনামূল্যে আমাকে কাগজ পাঠাতে শুরু করেন। এই বছরই আমার জীবনে একটা নতুন দিক  খুলে যায়। তখন আজকের মত এত বেসরকারি টিভি চ্যানেল ছিলনা। সেইসময় ‘তারা বাংলা’ বেশকিছু জনপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রচার করত। এর মধ্যে একটি বিতর্কমূলক অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘এই মুহূর্তে’ বিভিন্ন ধরণের সমস্যা নিয়ে এই অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করতেন অনন্যাদি, মানে সাংবাদিক অনন্যা চট্টোপাধ্যায় (চক্রবর্তী)। ইনি সেই সাংবাদিক যিনি রবীন্দ্রসদন মেট্রো ষ্টেশনে একটি মেয়েকে সমাজবিরোধীদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। পরে এই ঘটনা অবলম্বন করে সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য একটি উপন্যাস লিখেছিলেন এবং সেই উপন্যাস নিয়ে ‘দহন’ সিনেমাটি তৈরি হয়েছিল। একদিন তারার ষ্টুডিওতে ফোন করে অনন্যাদিকে পেয়ে বললাম, আপনারা এতসব সমস্যা নিয়ে প্রোগ্রাহ করেন আমাদের সমস্যা নিয়ে করেন না কেন? উনি তখন বললেন, আপনাদের সমস্যাগুলো কী? আমি তো জানিনা। আপনি যদি সমস্যাগুলি লিখে পাঠান, তবে আমরা নিশ্চয় অনুষ্ঠান করার কথা ভেবে দেখব।
                                    ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments