জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-২৮/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ২৮

অনন্যাদি একথা বলার পর আমি আনন্দবাজার পত্রিকা, আজকাল, সংবাদ  প্রতিদিন, ইত্যাদি সংবাদপত্রে প্রকাশিত আমার চিঠির মধ্য থেকে কয়েকটি চিঠির  জেরক্স কপির সঙ্গে একটি চিঠি লিখে স্টুডিওর ঠিকানায় ওনার নামে পাঠিয়ে  দিলাম। এর কয়েকদিন পর তারার স্টুডিও থেকে ফোন এল, বলা হল ওনারা এই বিতর্কে আমাকেই চান। আমার বিপক্ষে কাকে বসানো যায়, সেটাই ভাবছেন। শুটিং এর ডেট ঠিক করে আমাকে জানানো হল। মনে আছে সেপ্টেম্বর মাসে শুটিং হয়েছিল এবং অনুষ্ঠানটি প্রচারিতও হয়ে ছিল সেপ্টেম্বরে। এর মাঝের কয়েকদিনের মধ্যে, মানে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চারটি যাত্রী বোঝাই বিমান ছিনতাই করে সন্ত্রাসবাদীরা মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তিন  হাজারের মত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এই হামলার জন্য আল কায়দার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে শাস্তি দিতে গিয়ে, আমেরিকা প্রায় সম্পূর্ণ আফগানিস্থানকে ধবংস করে দিয়ে ছিল। 

    যাইহোক, মেয়ে তখনো ইস্লামিয়া হাসপাতালের চাকরিটা ছাড়েনি। ডেট  জানাতে আমি আগের দিন কলকাতা গিয়ে মেয়ের কাছে থেকে বিকেলে ওকে সঙ্গে নিয়ে ক্যামাক স্ট্রিটে তারা বাংলার স্টুডিও গিয়ে পৌঁছালাম। ভেতরে ঢোকার পর অনেকে মিলে আমাকে ঘিরে ধরলেন। এঁদেরও কৌতূহলের সীমা নেই। এখানে এসে জানলাম, আমার বিপক্ষে বলার জন্য কোনো মোল্লা-মৌলবি রাজি হননি। শেষপর্যন্ত আলিপুর কোর্টের একজন সিনিয়র উকিল রাজি হয়েছেন। ছন্দা গুহ, রেশমিও আরও কয়েক জন মুসলিম মহিলা হয়ে আমি মিডিয়াতে শরিয়তি আইনের বিরোধিতা করতে চলেছি, এটাতে ওনারা যেমন আশ্চর্য হয়েছেন তেমন ভয়ও  পেয়েছেন। সবাই মিলে আমাকে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগলেন। এইসময় শুনলাম  স্টুডিওতে চিন্ময় রায় এসেছেন। আমি আলাপ করার ইচ্ছে প্রকাশ করলে কিছুক্ষণ পর কেউ একজন ডেকে নিয়ে গেলেন। উনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আমাদের মা-মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভাবছিলাম আমার মত অভিনেতার সঙ্গে কার আবার আলাপ করার ইচ্ছে হল! তবে সুন্দরী মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করতে আমার ভালই লাগে’। কথার মধ্যে এও বললেন, ‘আমার স্ত্রীও খুব সুন্দরী’। চিন্ময় রায় নিজেও এখন বেশ সুপুরুষ। ‘গল্প হলেও সত্যি’ বা ‘হাটেবাজারে’ সিনেমায় দেখা চিন্ময় রায় ও আজকের চিন্ময় রায়ের চেহারার মধ্যে অনেক পার্থক্য। তাই ওনাকে ওনাকে বললাম, ‘একটা কথা বলার ছিল, যদি কিছু না মনে করেন’। উনি বললেন, ‘না না আপনি বলুন’। - জুঁই ব্যানারজি যখন আপনাকে বিয়ে  করেছিলেন, আমি আশ্চর্য হয়ে ভেবেছিলাম, ‘জুঁই এর মত সুন্দরী চিন্ময় রায়কে কী দেখে বিয়ে করলেন’? শুনে উনি হাসতে হাসতে পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন, ‘আপনি অবশ্যই আমাকে ফোন করবেন। আপনার কথায় মনে করার কিছু নেই, আমার ছেলেমেয়েরাও এই একই কথা বলে’।
    পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার মেয়ে বাবলি আমাদের কথা শেষ হতে বলল, ‘আমার একটা কথা জানার ছিল।উনি মুচকি হেসে বললেন, বল কী জানতে  চাও’?- ‘শুনেছি ‘সাগিনা মাহাত’ সিনেমায় আপনি সায়রাবানুর স্বামীর চরিত্রে  অভিনয়  করবেন শুনে উনি নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছলেন, এটা কি সত্যি’?- ‘সত্যি মিথ্যে জানিনা, তবে উনি উল্টে পড়ে গেছলেন’।      
     
    আমাদের আবার আলোচনা শুরু হল। ছন্দাদি বললেন, ‘আপনাকে নিয়ে আমরা ‘তারা সুন্দরী’ অনুষ্ঠান করতে চাই। কলকাতা থেকে আপনার বাড়ি কত দূরে’? দূরত্ব শুনে একটু চমকে উঠলেন মনে হল। তবে কথা ফ্যাইনাল হল, এক সপ্তাহ পরে ওনারা আমার বাড়ি যাবেন স্যুট করতে। কিছু পরে একে একে অনন্যাদি, সামাদ সাহেব(আইনজীবী) এসে আলোচনায় যোগ দিলেন। আমার কবিতা শুনে অনন্যাদি বললেন, শুটিঙের মধ্যে আমি যেন দুটি কবিতা শোনাই। সামাদ সাহেবে মুসলিম আইনে নারীর বঞ্চনার বিষয়ে আমার যুক্তিগুলি শুনে সবগুলিই স্বীকার করলেন। তাই দুজনের মধ্যে কোনও বিতর্ক হলনা। সব মিলিয়ে বেশ ভালই হল। পরদিন ছেলে মেদিনীপুর ষ্টেশনে আমাকে নিতে এসে হাসি হাসি মুখ করে বেশ গর্বিতভাবে বলল, ‘মা আজ পর্যন্ত এই শহরের কেউ যা পারেননি, তুমি তা করে দেখিয়েছ’। আসলে তখন আজকের দিনের মত টিভিতে সুযোগ  পাওয়া এত সহজ ছিল না। অনুষ্ঠানটি প্রচারের দিন দেখা গেল, চ্যানেলের পক্ষ থেকে কয়েকজন উর্দুভাষীকে এবিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে তারা বলেছে, ‘ওই মহিলা ঠিক বলছেন না। শরিয়ত যদি আগুনে ঝাঁপ দিতে বলে আমরা তাই দেব’। এই কারণে কিনা জানিনা অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হওয়ার কিছু দিন আগে থেকে  অনুষ্ঠানটির অংশ বিশেষের সঙ্গে প্রচার করা হচ্ছিল, ‘অতিথির বক্তব্যের জন্য চ্যানেল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে দায়ি নয়’। অনুষ্ঠান শেষে স্টুডিওতে যাঁদের  ফোন  এসেছিল তারমধ্যে  উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন শিক্ষাবিদ হোসেনুর রহমান। ফোনে উনি অনুষ্ঠানটির এবং আমার বক্তব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। এছাড়া ‘ভলেন্টারি ব্লাড  ডোনার এ্যাসোসিয়েশন’ তারার স্টুডিও থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, আমাকে ওনাদের তিনদিনের একটি ক্যাম্পে যোগ  দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিল। অনেক পেপারসও পাঠিয়ে ছিল। ফোনে বলেছিল, ‘ম্যাডাম, আপনাকে ‘ফাইভ স্টার’ হোটেলে রাখতে পারব না, কিন্তু আপনার কোনও অসুবিধা হতে দেবনা’। কিন্তু সেইসময় আমার পক্ষে বাইরে একা থাকা সম্ভব ছিল না। এই অনুষ্ঠান দেখে আমার বহু পরিচিত জনও ফোন করেছিলেন। তবে ‘তারা সুন্দরী’ হয়ে ওঠা হয়নি। কারণ আমার বিশেষ অসুবিধা থাকায় ডেট চেঞ্জ করতে বলেছিলাম। ওদের এতদূরে টীম পাঠানোতেও সমস্যা থাকায় ওটা বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তী কালে কলকাতার বাইরে এতদূরে থাকার কারণে অনেক সুযোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। প্রসঙ্গত জানাই এরাজ্যে  আমিই প্রথম  শরিয়তি আইনে মুসলিম মহিলারা যে বৈষম্যের শিকার, তা মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেছিলাম।          
 
      সেইসময় রমেশ গান্ধির ‘রেনবো প্রডাকশন’ বেশকিছু অনুষ্ঠান কলকাতা দূরদর্শন, তারা বাংলা, আলফা বাংলায়(বর্তমানে জি বাংলা) স্লট কিনে খাস খবর, খাসকথা, মুখোমুখি, একদিন প্রতিদিন’ অঙ্গনা লাইভ, নামে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান  প্রচার করত। দূরদর্শনে বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়ে ‘মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানে আমিই য়াসিনদার(পাঠান) যোগাযোগ করে দিয়েছিলাম। খাস কথা অনুষ্ঠানজগাসঞ্চালক শুভজিতৎ বাগচির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হয়ার পর উনি আমাকে ডেকে পাঠালে  একদিন নবীনা সিনেমাহলের পেছনে রাজলক্ষ্মী স্টুডিওতে গিয়ে ওনার সঙ্গে কথা বললাম। মুসলিম ব্যক্তিগত আইননের ওপর কিছুক্ষণ আলোচনা করার পর উনি এক সপ্তাহ পরে শুটিঙের জন্য একটা ডেট দিলেন। আমার পরিচিত একজন প্রবলভাবে আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। আমি তাঁর কথা শুনতে বাধ্য ছিলাম না।  শুটিং এর আগেরদিন মেয়েকে নিয়ে আইনজীবী সামাদ সাহেবের বাড়িতে উঠলাম। ওনাদের আন্তরিকতার তুলনা হয়না। ওনার ছোটমেয়ে (আইনের  ছাত্রী) আর আমরা মা মেয়ে পরদিন দুপুরে রাজলক্ষ্মী স্টুডিওতে গিয়ে হাজির হলাম। যারা সেইসময় এই অনুষ্ঠান দেখেছেন তাদের নিশ্চয় মনে থাকবে এখানে ১০/১২ জনের অডিয়েন্স থাকত। তাঁরাও প্রশ্ন করতে পারতেন। সেদিনের অডিয়েন্সে আমার ও সামাদ সাহেবের মেয়ে, আয়েশা খাতুন ও আরকিচ্ছু ইসলামি ড্রেসপরা যুবক ছিল। আয়েশা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুললেও ওই যুবকেরা আমার যুক্তির সঙ্গে না পেরে আমাকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক (সাম্প্রদায়িকদল হিসেবেও পরিচিত)দলের হয়ে কাজ করছি বলে দোষারোপ করতে থাকে। পরে জেনেছিলাম  ওদের পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন সংখ্যালঘু কমিসনের চ্যায়ারম্যান। তবে অনুষ্ঠান খুব যুক্তিপূর্ণ হয়েছে বলে পরিচিত দর্শকরা জানিয়েছিলেন। ভালো যে হয়েছিল  তার প্রমাণ পেলাম, যখন মেয়েদের অনুষ্ঠান ‘অঙ্গনা লাইভ’ এ ডাক পেলাম।

      প্রসঙ্গত জানাই, এই অনুষ্ঠানের মাসদুই পূর্বে  মেদিনীপুরের জেলাশাসকের  চিঠি পেয়েছিলাম।।০৯/১০/২০০১ এ  মেদিনীপুর সার্কিট হাউসে মাইনরিটি  কমিশনের মিটিংএ যোগদানের জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। মিটিং এ মাইনরিটি কমিসনের চ্যায়ারম্যান কে এম ইউসুফ, জ্ঞান সিং সোভন পাল ও মন্ত্রী  ওমর আলি ও আরও অনেকে ছিলেন। আমি পিছিয়ে থাকা মুসলিম পরিবারের সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে সামগ্রিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলে ছিলাম, আমরা ওদের বোঝাতে গেলে হয়ত ওরা মানবেনা, কিন্তু যারা বাড়িবাড়ি গিয়ে নামাজ পড়তে, রোজা রাখতে উপদেশ  দেন(তারা বোঝেন না ভুখাপেটে ধর্মের বাণী কেউ শোনেনা),তারা যদি ওই উপদেশের সঙ্গে ওদের সমাজ ও পারিবারিক বিষয়েও ওদের সচেতন করার চেষ্টা করেন,  যেমন- পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, খাবার আগে ভালভাবে হাতমুখ ধোওয়া, পুষ্টিকর খাবারের জন্য বাড়িতে পশুপাখি পালন করা, জন্ম নিয়ন্ত্রন করা, নিয়মিত গর্ভবতী মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো,  ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানো, তাদের জন্য কোথায় কী সরকারি সুযোগ সুবিধা রয়েছে, সে বিষয়ে তাদের জানানো ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে অনেকটাই সুফল  মিলবে বলে মনে হয়।  আমার এই পরামর্শকে চ্যায়ারম্যান সাহেব, ওমর আলি, জ্ঞান সিং শোভনপাল সমর্থন করলেও তবলীগ জামাতের লোকেরা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। 
                                        ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments