জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-৩৩ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-৩৩

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
শেষ মূল্য পায় যেন তাই !!


কি পেলাম আর কি পেলাম না হিসাব করতে বসলে-কিছু হবে না। শুধু সব অংকের খাতায় লিখেই যাওয়া হবে। সমাধান আর হবে না।

তাই তোমার কথায় লিখতে চেষ্টা করি। কিন্তু লেখার টেবিলময় অগণিত অক্ষর হেলাফেলা হয়ে ছড়িয়ে থাকে। ব্যক্তিগত বিষাদ ও ভালোলাগাগুলো যে শব্দবন্ধন ঘিরে অপ্রাসঙ্গিকতার একটা প্রাচীর তুলে রেখেছে, সেগুলোকে এক তারে বাঁধা খুব মুশকিল।

তাও ভাবি লিখব...লিখি...লিখতে চাই। সব...উজাড় করে দিতে চাই। মাথাটা দপদপ করে... চিন্তারা কুণ্ডলী পাকিয়ে ছুটে যায় বাঁ দিকের বুকে... একটা তীব্র বেদনা, একটা অসহনীয় উসখুস দাপাদাপি করে।

অবচেতনা স্বাভাবিক পরিসর ছাপিয়ে কখনও পাড়ি দেয় মিসিসিপি নদের পার বরাবর। উথালপাথাল করে নদীর জল কখনও কখনও। কখনও বা অ্যারিজোনার ঘন জঙ্গলে রোদ পোহানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টায় ডানা মেলে। আবার কখনও ওকলাহোমার অচেনা সবুজাভ পাহাড়ের বুকে ঝর্ণা হয়ে নিরন্তর বয়ে চলতে চায়।

প্রসূত কল্পনাতে সোহাগী জল রং ঢেলে ব্যতিক্রমী আমি লিখতে বসেছি বহুবার, গোপনে, অন্তরালে। বিশ্বাস করো... কিন্তু, উপেক্ষিত কিছু নাছোড়বান্দা অনুভূতি সবকিছু ওলট পালট করে দিয়ে কেবলই অট্টহাস্য হেসে উঠে।

অগত্যা, আবারও কলমটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে ভাবতে বসেছি, তবে কি 'আমাকে' নিয়ে লেখা হয়ে উঠবে না এজন্মে? ব্যর্থ প্রচেষ্টায় মাথা খুঁড়তে বসি যখন, হৃদয়পটের আঙিনায় সযত্নে নিহিত কিছু আবেগের দয়া হয় বুঝি হঠাৎ।

বিষাদের কঠিন প্রাচীরটা ভেঙে কল্পনা ও ব্যক্তিগত দহন-ব্যথা একাকার করে মেলে ধরে আমার আপাত শূন্য হৃদয়ের ক্যানভাসের গায়ে। পঙক্তির পর পঙক্তি সাজিয়ে বহু প্রতীক্ষিত জীবনখাতার ক্যানভাসে জলছবি এঁকে ফেললেও আবারও ভাবতে বসি- আমার আকাশের বুকে যতটুকু মেঘ জমেছে, সবটা আদৌ ঝরাতে পারব কি?

আমার নবাঙ্কুরের শিকড়টি মাটি ভেদ করে যথাস্থানে পৌঁছোতে পারবে কি, নাকি খানিকটা দূরত্ব অতিক্রম করা এখনও বাকি রয়ে গেল?

এ চলার বা লেখার কিন্তু বিরাম নেই। ফেসবুকে বেশ দু তিনজন আমার জীবন নিয়ে লিখবে বলে আবদার করেছিল, কিন্তু জীবনের সব কথা কী অন্য কাউকে বলে তৃপ্তি পাওয়া যায়? তোমার কি ধারণা? আমার তো মনে হয়, না, কখনই না।

ডালাসে এসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডির অ্যাসাসিনেশন এর জায়গাটা যেদিন প্রথম দেখলাম-অজান্তে চোখে জল এসে গেছিল কত কত মানুষের ভালোবাসাকে ধুলিষ্যাৎ করে দিয়েছিল এক সাধারণ মানুষ।

দিনটা ছিল ২২ শে নভেম্বর, ১৯৬৩ সাল। ঠিক দুপুর সাড়ে বারোটা তখন। ডালাস ডাউনটাউন-এর ডিলে প্লাজায়(Dealey Plaza) মোটরকেডে আমেরিকার পঁয়ত্রিশ নম্বর প্রেসিডেন্ট মাত্র ছেচল্লিশ বছরের জন এফ কেনেডি যাচ্ছিলেন। এই ডিলে প্লাজাকে বলে ডালাসের জন্মস্থান(Birthplace Of Dallas)।

একটা ছোট্ট ঘুলঘুলির মতো জায়গা থেকে সে নিঁখুত টিপ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিয়েছিল সেই মরণঘাতী তীর।

পরিশেষে কি মনে হয় জানো, আমাদের জীবনের সবটাই আদতে বোধহয় আপেক্ষিক। বোধগুলো আপেক্ষিক, সেতুটা আপেক্ষিক, ক্যানভাসটা আপেক্ষিক, এমন কি জীবনের পঙক্তিগুলোও আপেক্ষিকতার বেড়াজালেই প্রত্যহ ভেঙে যায়। আবার নতুন করে গড়েও ওঠে।

তবু কলম নিয়ে ভাবি, আগামী লেখনীর ক্ষেত্রে শিকড়টা আরও একটু গভীরে পৌঁছে দিতে পারব হয়ত।

মেঘ ছুঁয়ে ঝরাতে পারব আরও একটু … একটু বিদ্যুৎ-এর ঝলকানিও থাকবে। বেশ কয়েক ফোঁটা ঝিরঝির বৃষ্টি..... ঝরাতে পারলে হয়ত জীবনখাতার প্রতি পাতায় হিসাব নিকাশের ফসল বোনা সার্থক হবে।

যদিও জানি দুঃখ সর্বত্র! সহজ-অসহজ ভাবে আছে, নিঃশ্বাস হয়ে আছে।

--শিমুল! সম্পর্কের মাঝখানে কোনও সময়ই ইগো বা অহং এর বরফ জমতে দাওনি তুমি। অনেক চেষ্টা করেছ একটা যন্ত্রণায় ছটফট করা মানুষকে নিরাময় করতে, কিন্তু এক তরফা হয় না শিমুল। এখানেই তুমি কিন্তু এক সফল ঘরণী। যোগ্য সহধর্মিণী।

“ছেলেরা দাঁড়িয়ে গেছে। তুমি পাশে না থাকলে ওরা হয়ত মানুষের মত মানুষ হত না শিমুল। তোমার আদর্শকে ওরা সম্মান করে। তাই তো ওরা তোমায় এত ভালোবাসে। ব্রায়ান পাঞ্জাবী মেয়ে রবিন (নার্স) কে বিয়ে করে সুখে আছে। রায়ান ডাঃ লিপিকে বিয়ে করবে।”

“ তা ঠিক, তবে ওদের জীবনটা সুখের হলেই ভালো লাগবে সব চেয়ে বেশি। সেদিন যখন ব্রায়ান-রবিন এসেছিল-

রবিন বলছিল, “ ব্রায়ান কারুর সাথে মিশতে চায় না-সে সেটা পছন্দ করে না। আমি আমার একটা ছোট গ্রুপ করেছি-নিজেদের মধ্যেই থাকি। আমি আমার মেয়েদের তাদের গ্র্যানির কাছে যেতে দিই না, কারণ তারা কি শিখবে তার কাছে?” চুপ করে গেলাম। উত্তর আমার জানা ছিল না। পলাশ উঠে গেল-হয়ত ওরও উত্তর জানা নেই। তবে খারাপ লাগে বৈ কি!

খালি ভাবি কেন এরকম মানুষের জীবন?

রাতের স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে এবার ঝরঝরে ইংলিশে পলাশ জিজ্ঞেস করল। ইংরাজিটা বড্ড ভালো জানে পলাশ, বিশ্বাস করতেই হয়।

জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছো জানি। অফিস থেকে পেয়েছো বেস্ট 'পারমিট রাইটার সম্মান'। কলকাতা ও আমেরিকার সান্তা ক্লারা আর লুইজিয়ানার ব্যটনরুজ থেকে বাংলা সাহিত্যে “বেস্ট অ্যাচিভমেন্ট এওয়ার্ড” ও পেয়েছো।

একদম ছোটবেলা থেকে তোমার চরিত্রে যে বৈশিষ্ট্যগুলো নানা ভাবে-নানা রঙে প্রতিফলিত হয়েছে, সেকারণেই পাহাড়ি ঝরনার মতোই সব সময় প্রাণচঞ্চল তুমি। আবার দেখি নদী হয়ে বয়ে যাবার সংকল্পেও অটল। তাই তুমি হলে সেই আমার, 'বাসা-বাসাইয়া ঘর”।

খাড়াই পাহাড়ের চড়াই ভাঙার মতোই কি কষ্টকর সেই জীবনের আরোহণ- অবরোহণের পথ। সে পথে চলতে চলতে কেঁদেছো। একাই। কিন্তু ভেঙে পড়োনি। বুঝতে দাও নি কাউকেও। সংকল্পে দৃঢ় থেকেছো। সবাইকে বিশ্বাস করেছো। 'পার হতেই হবে এ পথ'-এই ছিল তোমার পণ।

মেয়েরা পারে। সঅঅব পারে। সেই তুমি শিমুল আমার। যার স্মাইলিং ফেস ইজ মাই হাফ দ্য মিল। জানো জীবনটা আসলে খুব সুন্দর একটা দিনলিপি। শুধু পালিয়ে যেতে নেই। রুখে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। দেখবে, জীবন ও তোমাকে কিন্তু খালি হাতে ফেরাবে না। মূল্য দেবে জীবন-যুদ্ধের। তুমি এমন এক চরিত্র যে চরিত্রের কূল-কিনারা খুঁজে পাওয়া বড়ই কষ্টকর। তুমি কিছু মূল্য পেয়েছো, স্বীকার করতেই হবে তোমায়।

আচ্ছা, তুমি এতক্ষণ কি দেখে গল্প শোনাচ্ছিলে, বলবে না? মনে হলো পর্দা নেমে এলো। আমার তো মনে হচ্ছিল আমি সিরিয়াল দেখছিলাম। ফুল ফোটে ভোরবেলা। নক্ষত্র শুকিয়ে যায় কিন্তু প্রতিচ্ছায়া জেগে থাকে সেই ম্যাগ্নোলিয়া বাগানে। হাসি-কান্না-উল্লাসে মেশা এক বিচিত্র পান্থ -সুর। ক্ল্যাপ দিলে সেটা কম পড়বে। স্বামীরা স্ত্রীদের সম্পর্কে বলে থাকেন-একসঙ্গে ঘর করলে বোঝা যায় আমার স্ত্রীরত্নটি কত রঙিন... তাই বোধহয় তুমি ম্যাগ্নোলিয়া। আমি তো নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিলাম। আমি বই পড়ার চেয়ে মুখে শুনতে বেশি ভালবাসি। পৃথিবীর কোণে কোণের গল্পগুলো আশ্চর্য সুন্দর। সব কিছু কি করে মনে রেখেছো। এত জায়গায় থেকেছো...তাও।

এই প্রেক্ষাপটে কিন্তু এই গল্পের স্রোতের ভেতরে সরলতা মিশে আছে। সেই সারল্য মাছের মতো খেলা করে, প্রাণস্পন্দনে জেগে ওঠে জলস্রোত। কিছু হয়তো নিষ্ঠুর, বর্বর। শিমুলের বাঁ হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে তুলে নিল পলাশ। ওর মুখে তৃপ্তি আর সুখের স্পর্শ। এখন আর পৃথিবীর প্রতি কোনও অভিযোগ নেই আমার...পলাশ শিমুলের হাত ছেড়ে উঠে পড়ল।

--না মশাই তুমি ভুল করছো। আমার দোষ আছে-হ্যাঁ আমার দোষ। বলবে কী দোষ? আজকালকার দিনে একটু চালাক চতুর হতে হয়। আমি বোকা। বোকার হদ্দ। মনে চেপে রাখতে পারি না কিছু। হরহরিয়ে বলে ফেলি। দিদিয়া বলত, “ভেঁদুয়া।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই বলেছেন, “মেয়েদের সম্মান মেয়েদের কাছেই সবচেয়ে কম।” মেয়ে হয়ে বুঝেছি একশো পারসেন্ট সত্যি। ঠাকুর বলেছেন-” সরল হও কিন্তু বোকা নয়।” কিন্তু “বোকামি” আমার রক্তে যে মিশে আছে।

এখানে এসে 'আমি' নামে একটা ছোট্ট পাখি সেজে পোড়াতাম নিজেকে রোজ। দহন যেখানে যতটা, পোড়াবেই তো। আগে সারা রাত মনের আঁধারের বারান্দা জুড়ে, আগুন বড় আর ছোট হত ক্রমশঃ।

তার ধোঁয়া যা প্রকৃত অমোঘ অনিশ্চয়তাকে নির্দেশ করে, উবে যেত বেমালুম। তাই তো এতবছর ধরে জোগাড় করেছি একটা লম্বা দড়ি আর সাহস। যুদ্ধের পাহাড় পেরোতে লাগে দড়ি। আর একটা কাঁটা দেওয়া মন। মনে কাঁটা নিয়েই তো জীবন তোমার, আমার, সবার। জীবন যার যতটা অনতিক্রম্যতা তা পাহাড়ই তো।

সাহস রেখেছি বুকে। দেখি কেমন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছি। না, না কোন নৌকা নয়। আমি তুমি একাই পার হয়ে যাব সেই নৌকায়। স্লিপিং ব্যাগও লাগবে না। ঘুমনো সভ্যতায় ঘুমহীনতা জরুরী যে ভীষণ।

থাকুক কিছুটা মানবতাও। কোন ছোট করাত না। আর কর্তিত হতে চাই না জীবন এর বেলাশেষে! তাই মনটাকে আর বড় হতে দি নি। তাকে শিশুর সারল্যে লালন পালন করেছি। কে বলল আমার সন্তান নেই। মনই তো আমার সন্তান। তাকে সেই আবরণে ঢেকে রেখেছি। এই জগতে কে ভালো বলো তো?

--সংসারে যে যাকে প্রিয় জ্ঞান করে সেই তাকে ভাল দেখে, অন্যের পক্ষে নয় শিমুল। এটাকেই বলে “ভিন্নরুচিহি লোকঃ”।

রাত নেমে এসেছে। যাই ব্রাশ করে ড্রেস চেঞ্জ করে আসি। আজ তো অনেক বল্লে-এবার আর কোন কিছুর জন্য চিন্তা না। যিনি চিন্তা দিয়েছেন তিনিই তো সেই চিন্তাহরণ...বলেই পলাশ হাহা করে হেসে উঠল।

শিমুল এর আগেই হয়ে গেছিল। ও একফাঁকে গিয়ে সব কাজ সেরে এসেছে। পলাশের আসতে দেরি দেখে বিছানায় বসে বেডের সাইড ল্যাম্প টা জ্বেলে পেন নিয়ে বসল। এখনও যে অনেক লেখা বাকি।

টুকরো টুকরো সংলাপ? না টুকরো টুকরো হতাশা? তবে কর্পূর এর মত ভোলাটাইল কনসেন্স হতে চাই না জীবনে আর। মনে মনে বলে উঠল শিমুল।
(চলবে)

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments