জ্বলদর্চি

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী/দ্বিতীয় পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী                                       
দ্বিতীয় পর্ব        
                                 
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী          

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। যমুনার মৃদুমন্দ সমীরণে তানসেনের দেহমন সিক্ত হল। দূরে তাকিয়ে দেখলেন যমুনার বুকে কয়েকটি বজরা বাঁধা আছে। মাঝে মাঝে সম্রাটের ইচ্ছে হলে মিঞাকে সঙ্গে করে বজরাতে যেয়ে যমুনাতে নৌকাবিহার করেন। উন্মুক্ত চন্দ্রালোকে যমুনার নীল জলে বিহার করতে করতে তানসেনের কন্ঠে মালকোষ রাগ ছন্দিত হয়। এক একদিন গান শেষ করে মধ্যরাত্রিতে ফিরেআসেন।    
              
দেখতে দেখতে এক সময়ে পশ্চিম দিগন্তে যমুনার জলকে আবিরের লাল রঙে রাঙিয়ে দিয়ে সূর্যদেব অস্ত গেলেন। কেল্লার বাসিন্দারা এই সময়ে পথে নেমে আসেন। কেল্লার অভ্যন্তরে একটি চকে বাইরে থেকে আসা বিক্রেতারা খেজুর, তরমুজ, আখরোট, বাদাম, কিসমিস, মোনাকা, বিভিন্ন ফুল ও শাকসবজি নিয়ে এসে বসেন। চারিদিকে ক্রেতা-বিক্রেতার ব্যস্ততা, কোলাহল। কেল্লার ভিতরে রাস্তার স্থানে স্থানে মশাল জ্বলছে। কোতোয়ালের নির্দেশে এই সময়ে কেল্লার পাহারাদারেরা সদা সতর্ক থাকে কারণ পশরা নিয়ে আসা ব্যাপারীদের ছদ্মবেশে যেকোনও বর্হিশত্রু কেল্লার ভিতরের রাস্তাঘাট, কোথায় কোন উজীর, ওমরাহেরা থাকেন জানার জন্য। এই সময়ে মিঞা তানসেন একবার স্নান করে দেহমন শুদ্ধ করে পট্টবস্ত্র পরিধান করে তাঁর সংগীত রেওয়াজের কক্ষে যেয়ে মা সরস্বতীর পটে ফুল-মালা পরিয়ে ধুপ দেখিয়ে প্রণাম করে রেওয়াজ শুরু করেন। 

সেদিনও তিনি স্নান করতে যাবার সময় দেখলেন তাঁর হাভেলির প্রধান পরিচারিকা আয়েশা একটি রেকাবীতে করে ফুলমালা ধূপ নিয়ে তাঁর কক্ষের দ্বারপ্রান্তে নামিয়ে রাখল। দুপুর থেকে তাঁর মনে যে কৌতুহলের উদ্রেক ঘটেছে তা নিরসনের উদ্দেশ্যে তিনি আয়েশাকে প্রশ্ন করলেন "এই হাভেলিতে কি সম্রাট গৌরবর্ণা, দীর্ঘাঙ্গী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কোন নূতন বাঁদীকে পাঠিয়েছেন, যাকে আমি কোনদিন দেখিনি?" আয়েশা উত্তরে বলল "মালিক, আপনি সারাদিন তো সঙ্গীতে বুঁদ হয়ে থাকেন যার ফলে নতুন কে আসছে সে সম্বন্ধে আপনার কোনো স্মরণ হচ্ছেনা। আপনার মনে নেই জাহাঁপনাকে নিয়ে আপনি বৃন্দাবনে যেয়ে ফেরার সময় এই রাজস্থানী যুবতী রূপোয়াতীকে নিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কেন মালিক, তার কি কোন গুনাহ  হয়েছে"? তানসেন বললেন "না কোন গুনাহ হয়নি, কিন্তু আমি জানতে চাইছি সে কি কাজ করে"? আয়েশা মাথা নিচু করে বলল "মালিক আপনিতো শুধু আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন কিন্তু সে কি কাজ করবে জিজ্ঞেস করাতে আপনি বলেছিলেন পরে বলবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত আপনি কিছুই বলেননি।" আয়েশা বলার পরে সমস্ত ঘটনার কথা তানসেনের মনে পড়ল। বৃন্দাবনে গুরুজী তাঁকে একান্তে বলেছিলেন যে “একটি যুবতী রাজস্থান থেকে কয়েকজন বিধবা রমণীর সাথে পদব্রজে ঘুরতে ঘুরতে বৃন্দাবনে এসে তাঁর আশ্রমে আশ্রয়প্রার্থী হয়। যুবতীটি অনূঢ়া, রূপসী, যুদ্ধে তার পিতা-মাতা মারা গেছেন। নিরাশ্রয় যুবতীকে দেখে আমার অনুকম্পা হলো। বৃন্দাবনে হয়তবা কোথাও থাকার আশ্রয় পাবে নতুবা কোন লম্পট প্রতারকের পাল্লায় পড়ে তার সতীত্ব নষ্ট হবে। সাত-পাঁচ ভেবে তাকে আমি থাকতে দিয়েছি। কিন্তু আমারওতো বয়স হচ্ছে। কোন দিন বংশীধারী গোবিন্দ আমাকে নিয়ে চলে যাবেন তখন এই মেয়েটির কি হবে? তার কোন অনিষ্ট হলে আমিতো পরোক্ষে দায়ী হবো। তার থেকে ভালো তুই ওকে নিয়ে যেয়ে তোর গৃহে দাসীর কাজ দিলে অন্তত নিরাপদে থাকবে”। তানসেন চিন্তায় পড়লেন কিভাবে নিয়ে যেয়ে ওকে রাখবেন। তাছাড়া সম্রাটের সাথে ওকে বা কিভাবে নিয়েই যাবেন। এদিকে গুরুজীর অনুরোধ মানে ঈশ্বরের আদেশ। সব কথা শুনে গুরুজী বললেন "আমার আশ্রমে এক রইস আদমী একটি অশ্ব ভেট দিয়ে গেছেন। অশ্বের তো আমার কোন প্রয়োজন নেই। ছদ্মবেশে মেয়েটি ওই অশ্বপৃষ্ঠে চেপে তোদের পিছনে চলে যাবে"। সমস্ত পরিকল্পনা করে হরিদাস স্বামী যুবতীকে ডেকে বললেন "মা রূপবতী, তুমি তানসেনের সাথে ওর হাভেলিতে চলে যাও। তোমার কোনো চিন্তা নেই। তোমার কোন রূপ সন্মান হানি হবে না, অথচ তুমি নিশ্চিন্তে থাকবে।" গুরুজীর আদেশ শুনে তানসেন অবগুণ্ঠনবতী রূপবতী বা রূপোয়াতীকে নিয়ে আগ্রা দুর্গের ভিতরে নিজের হাভেলীতে এসে প্রধানা বাঁদী আয়েশার হাতে তাকে তুলে দিয়েছিলেন। তিনি তার মুখ কোনদিন দেখেননি, যার ফলে আজ দুপুরে তাকে দেখে তিনি চিনতে পারেন নি। সব কথা স্মরণে আসার পরে তিনি আয়েশাকে বললেন "তুমি ওকে আমার কাছে আগামীকাল পাঠাবে, দেখি ওকে কি কাজ দেওয়া যায়।"                      

পরের দিনে যথারীতি স্নান করে তানসেন তাঁর কক্ষে প্রবেশ করার কিছু সময় পরে তাঁর কন্যা সরস্বতী রেওয়াজের জন্য তাঁর কক্ষের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে তাঁর অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার পরে তানসেন তাকে নিয়ে রেওয়াজে বসলেন। নির্দিষ্ট সময় রেওয়াজ করে সরস্বতী চলে যাবার পরে তানসেন অনুভব করলেন তাঁর কক্ষের দ্বারপ্রান্তে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। তিনি দ্বারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন অবগুণ্ঠনবতী এক কন্যা দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর মনে পড়ে গেল গতকাল প্রধান বাঁদী আয়েশাকে তিনি হাভেলিতে আগত রাজস্থানী কন্যাকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। কণ্যাকে ভিতরে আসার অনুমতি দেওয়ার পরে সে ভিতরে অবগুণ্ঠন মুক্ত করে তানসেনকে প্রণাম করে বলল "প্রভু, আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন"। তানসেন এই প্রথম অবগুণ্ঠন মুক্ত যুবতীকে সম্পূর্ণভাবে নিরীক্ষণ করে ভাবলেন এ তো মর্ত্যের কোন নারী নয়, এ তো স্বর্গের কোন অপ্সরা ঊর্বশী, রম্ভা অথবা ঘৃতাচী। ধনুকের মতো বাঁকানো তার ভ্রূযুগল, ডিম্বাকৃতি মুখাবয়ব, গোলাপি রঙের গাল দুটিতে সামান্য টোল, ঠোঁটটি বেদনার মতো রক্তবর্ণ, সর্বাঙ্গ শ্বেতবসনে আচ্ছাদিত তথাপি তার উদ্ধত বক্ষ শ্বেতবসনের অন্তরালে পরিস্ফুট। ভয়ে বা কোনো অজানা আশঙ্কায় তার বক্ষদেশ ওঠানামা করছে। শরীরের গঠন দেখে মনে হয় যুবতীর বয়ঃক্রম ২৫ অথবা ২৬ বৎসর। তিনি তাকে সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন তার পরিচয়।         

যুবতী মৃদু স্বরে বলল "আমি রাজপুতানার রাঠোরাজের সৈন্যবাহিনীর এক সৈনিকের কন্যা। রাঠোর রাজের সঙ্গে আকবর বাদশার যুদ্ধে রাঠোরাজ পরাজিত হন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে আমার পিতা নিহত হবার পরে আমার মা জহরব্রত পালন করেন। সেই থেকে আমি নিরাশ্রয়। বিধর্মী শত্রুর ভয়ে আমি রাঠোর ত্যাগ করে একদল বিধবা রমণীর সাথে পাহাড়-জঙ্গল অতিক্রম করে বৃন্দাবনে যেয়ে হরিদাস স্বামীর আশ্রমে পৌঁছাই। সেখান থেকে আপনি দয়া পরবশ হয়ে আমাকে নিয়ে এসেছেন"। তার কথা শুনে তানসেন বললেন "তুমি পিতার কাছে থাকাকালীন কোন গুরুজীর কাছে কি সংগীতের পাঠ গ্রহণ করতে"? রূপবতী বলল "না প্রভু, পিতার কাছে থাকাকালীন আমার সংগীত শিক্ষার কোনো সুযোগ ঘটে নি। ওখানে এক কৃষ্ণ মন্দিরে প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় যেয়ে সমবেত কন্ঠে ভজন গান শুনে শুনে আমি গানের সুর রপ্ত করেছি"। "তুমি কারো কাছে সঙ্গীতের তালিম না নিয়ে কিভাবে নিখুঁতভাবে আজ দুপুরে ভীমপলশ্রী রাগ গাইছিলে"। তানসেন এই কথা বলতে রূপবতী বলল "প্রভু, আপনার কাছ থেকে"। তানসেন বললেন "কিভাবে"? রূপবতী বলল প্রত্যহ সকালে আপনি যখন আপনার কন্যাকে গানের তালিম দেন এবং নিজে এক একটি রাগের রেওয়াজ করেন আমি সেগুলি শুনে এই রাগগুলি শিখেছি"। তানসেন বিস্মিত হয়ে বললেন "এতো বড়ী তাজ্জব কি বাত? তুমি আর একটা গান গাও তো"? তাঁর কথা শুনে রূপবতী সকালের রাগ টোরী নিখুঁতভাবে গেয়ে শোনাল সংগীত সম্রাটকে। তার গান শুনে তানসেনের যেন বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। নিজেই নিজেকে মনে মনে বললেন ' এ মেয়ের কন্ঠে তো স্বয়ং মা সরস্বতী বসে আছেন। একে একটু ঘষামাজা করলে ভবিষ্যতে এ একদিন হিন্দুস্থানের  বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী হয়ে উঠবে'। মনের ভাব গোপন রেখে তিনি বললেন "ঠিক আছে বললে ভুল হবে তুমি নিখুঁতভাবে রাগ দুটি গেয়ে আমাকে শুনিয়েছো। তোমাকে কি কাজ দেওয়া যায় তা আমি ভেবে তোমাকে নির্দেশ দেবো"। এই কথা শোনার পরে রূপবতী যাবার পূর্বে পুনরায় তানসেনকে প্রণাম করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। এদিকে দরবারের সময় আগতপ্রায়। তানসেন তাঁর পোশাক পরিবর্তন করে দরবারের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।                                            
                                                                   ক্রমশঃ

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. বাহ্... দারুণ দাদা। অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বের।

    ReplyDelete