জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৩৪ /প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৩৪

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

  ১৮৬৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর, শনিবার ( ৯ই পৌষ, ১২৭২ সাল, শুক্লা ষষ্ঠীতিথি ) ধর্মপ্রাণ দম্পতির জ্যেষ্ঠপুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন সারদানন্দজী অর্থাৎ শরৎ মহারাজ। পিতা গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তী ও মাতা নীলমণি দেবী। সঙ্গতিসম্পন্ন হলেও গিরিশচন্দ্র অত্যন্ত ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। সাংসারিক কাজ সামলিয়ে নিয়মিত সন্ধ্যা উপাসনা, পূজা-পাঠ ও জপধ্যানের কোনও ঘাটতি থাকত না। শরৎচন্দ্র শনিবার ভূমিষ্ঠ হওয়ার কারণে পরিবারের সকলে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর পিতামহ ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। হুগলি জেলার জনাই গ্রামে বসতিস্থাপন ও টোল প্রতিষ্ঠা করেন। এই সবই তিনি করেন পত্নীবিয়োগের পর। শরৎচন্দ্রের পিতা অবশ্য গ্রাম পরিত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন। ঈশ্বরচন্দ্র জ্যোতির্বিদ্যাতেও সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি কোষ্ঠীবিচার করে জানান, এই শিশু ভবিষ্যতে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে। 

 শৈশবাবস্থা থেকেই শরৎচন্দ্র অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের ছিলেন। বয়সোচিত স্বাভাবিক চঞ্চলতা তাঁর মধ্যে একেবারেই দেখা যেত না। বিদ্যালয়ের পরীক্ষাতে অত্যন্ত ভালো ফল করতেন। সচরাচর প্রথম কিংবা দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হতেন। কৃতিত্ব প্রদর্শন করতেন ছাত্রদের আলোচনাসভাতেও। নিয়মিত ব্যায়াম করার ফলে শরীর ছিল সুগঠিত। পূজাপাঠে সেই বাল্যাবস্থা থেকেই বিষম আগ্রহ দেখা যায় তাঁর ভিতর। এই আগ্রহ পরিলক্ষণ করে স্নেহময়ী জননী পূজার যাবতীয় উপকরণ  সংগ্রহ করে দেন। শরৎ ওই সমস্ত পেয়ে মহানন্দে দেবোপাসনায় নিমগ্ন হন। ত্রয়োদশ বর্ষে উপনয়ন সমাপনান্তে গৃহদেবতার পূজার অধিকার অর্জন করেন। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও আগ্রহ সহকারে বিধিসম্মতভাবে নিয়মিত পূজাপাঠ ও জপ-ধ্যানে নিমগ্ন হন। যুবাবস্থায় তিনি ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে আসেন। প্রকৃতপক্ষে স্বামী সারদানন্দজীর মতো এক মহাপুরুষের শৈশব বা বাল্য জীবন সম্পর্কে অবগত হওয়া একান্তভাবে প্রয়োজন। নতুবা এমন এক মহাজীবনের মর্ম সঠিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। 

 এদিকে আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারের ক্ষেত্রে তিনি যখন অপরিহার্য হয়ে উঠছেন, ঠিক তখনই ভারতে ফিরে আসার ডাক পেলেন। স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড়ে স্থাপিত মঠকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ নির্মাণের কাজে তাঁকে নিয়োজিত করতে চাইলেন। ১৮৯৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করলেন। সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করলেন সেই কাজে যার জন্য স্বামীজী তাঁকে ভারতে ফিরিয়ে আনেন। তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন, যা আমৃত্যু বহন করেন। আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর কলকাতায় অ্যালবার্ট হলে বেশ কয়েকটি বক্তৃতা প্রদান করেন বেদান্ত ধর্মের বিষয়ে। কলকাতার মানুষের কাছে ভীষণভাবে সমাদৃত হয় এই বক্তৃতাসমূহ। গীতা এবং বেদের উপরেও কথোপকথনের ঢং-এ বেশ কিছু বক্তৃতা প্রদান করেন। এগুলিও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। এই সময় কাটিহার ও পূর্ববঙ্গে বক্তৃতা প্রদানের জন্য সফর করেন। এরপর ১৯০২ সালে স্বামীজীর আকস্মিক মহাপ্রয়াণে প্রায় সদ্য গড়ে ওঠা সঙ্ঘের প্রসারের ভার মূলত তাঁর উপর এসে পড়ে। স্বামীজীর স্বপ্নের ‘উদ্বোধন’ পত্রিকা’র গুরুদায়িত্বও খুব শীঘ্রই এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। কলকাতায় বাগবাজার মঠে থেকে সঙ্ঘের বহুবিধ কাজ চরম নিষ্ঠা, ভক্তি ও শ্রমের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে সঙ্ঘ সচিবের দায়িত্ব পালন, বক্তৃতা প্রদান, শিষ্যদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রদান ও লেখালেখির কাজ চলতে থাকে।

 স্বামী সারদানন্দজীর জীবন অনুধ্যানে গীতায় বর্ণিত স্থিতপ্রজ্ঞ মহামানবের কথা স্মরণে আসে। তিনি ছিলেন যথার্থভাবেই স্থিতপ্রজ্ঞ মহাপুরুষ। তাঁর মধ্যে মূলত চারটি গুণের সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়, যেগুলি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের নির্ণায়কতুল্য। এগুলি হল -- বিপুল আধ্যাত্মিকতা, প্রবল মানবিকতাবোধ, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবৃত্তি এবং তাঁর মহান অধিনায়ক ও গুরুভ্রাতা স্বামী বিবেকানন্দ নির্দেশিত কাজে নিজেকে বিশ্বস্তভাবে নিয়োজিত করা। একবার কতিপয় তরুণ সন্ন্যাসী তাঁর কাছে জানতে চান যে তিনি পরম সত্য উপলব্ধি করেছেন কিনা। তিনি রসিকতা করে এর উত্তর দেন। বলেন, দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সঙ্গে দিনগুলি ‘ঘাস কেটে’ কাটান নি। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ নামক আকর গ্রন্থটিতে ( যার প্রণেতা তিনি ) যেসব আধ্যাত্মিক অনুভূতি বিষয়ে তিনি লিখেছেন সেগুলি সবই তাঁর উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতাজাত। চরম আধ্যাত্মিক উপলব্ধি বিষয়ে তিনি যা যা এই মহাগ্রন্থটিতে উল্লেখ করেছেন সেগুলির সম্যক বিকাশ নিশ্চিতভাবে তাঁর মধ্যে দেখা গিয়েছিল। তাঁর মন সর্বদাই তপস্যাভিমুখী থাকত। ধ্যান ও চিন্তনের মধ্যে অবস্থান করতেন মনের স্বাভাবিক গতি অনুযায়ী। ‘ভারতে শক্তিপূজা’ নামক ক্ষুদ্র গ্রন্থটি রচনার সূত্রে তিনি অনুমোদন করেন যে সমস্ত নারীজাতির ভিতর তিনি মহামায়ার অস্তিত্ব অনুভব করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন নিরন্তর ধ্যানরত থাকার ও ঈশ্বরাভিমুখী হওয়ার প্রচেষ্টা বজায় না রাখলে ব্যক্তিবিশেষ এই সাংসারিক ঘূর্ণাবর্তে নিশ্চিতভাবে পতিত হয়। সমগ্র রাত্রব্যাপী ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। কোনও ক্লান্তি ছিল না। এমনকী শরীর যখন বেশ ভেঙে পড়েছে, চিকিৎসকদের নিষেধ সত্ত্বেও এই অভ্যাস বজায় রেখেছিলেন। দীর্ঘ সময় ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। এই বিষয়ে বিরত থাকতে আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানালে মিষ্ট স্মিত হাসতেন। জীবনের শেষদিনগুলিতে এই ধ্যানমগ্নতা আরও বৃদ্ধি পায়। তপস্যাপূত জীবনই ছিল তাঁর সমস্ত কর্ম নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করার চাবিকাঠি! অনেক সময় দেখা গিয়েছে মঠে অসুস্থ ব্যক্তির পাশে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সেবা করে চলেছেন! তাঁর সস্নেহ স্পর্শ ও মিষ্ট কথায় অসুস্থ ব্যক্তির কষ্ট ‌লাঘব হচ্ছে। একবার মঠের এক চাকর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সারা রাত তার পাশে কাটান পাখায় হাওয়া করে ও মাথায় জল ঢেলে। অসুস্থ ব্যক্তির কক্ষে অন্ধকার অবস্থায় প্রবেশ করতেন যাতে সেই ব্যক্তি তাঁকে সেবারত দেখে বিব্রত বোধ না করেন।
 মানবের অন্তর্নিহিত দেবত্ব তাঁর সংস্পর্শে এসে অকল্পনীয়ভাবে প্রকাশিত হত। যারা তাঁর সংস্পর্শে আসতেন তারা স্পষ্টত অনুভব করতেন  যে, যতই হতাশাজনক হোক না কেন ব্যক্তিবিশেষের বর্তমান পরিস্থিতি, তার মধ্যে সুপ্ত দেবত্ব চিরায়তভাবে অবস্থান করছে। হতাশাগ্রস্ত মানবমনে আশার সঞ্চার করতেন সারদানন্দজী। ফিরে আসত হৃত আত্মবিশ্বাস। এই আত্মবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে ব্যক্তিবিশেষ বিশ্বাস ও শরণাগতির রাস্তায় গমন করেছেন। স্বদেশী আন্দোলনের পরবর্তী ভাগে বেশ কিছু বিপ্লবী তরুণ অনুভব করেছিলেন রামকৃষ্ণ মি‌শনের আদর্শ ও কার্যপদ্ধতি ব্যক্তির উপলব্ধি ও দেশের উন্নয়নের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ পথ। তাঁরা সঙ্ঘে যোগদান করতে এলে তাঁদের পূর্বকৃত রাজনৈতিক কার্যকলাপের কারণে স্বভাবতই সংশয় ও জটিলতা দেখা দিত। কিন্তু এই তরুণদের আন্তরিকতায় সারদানন্দজী তাঁদের পাশে দাঁড়াতেন এবং সঙ্ঘে নেওয়া হত তাঁদের। এঁদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস পোষণ করতেন। বিন্দুমাত্র সন্দেহের চোখে দেখতেন না। যদিও কোনও কোনও সময় উদ্বেগের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কিন্তু সর্বদা সদয় থেকেছেন। অন্তত একবার এঁদের জন্য প্রবল অপমান সহ্য করতে হয়। কিন্তু এই মহাপুরুষ নীলকণ্ঠ শিবের ন্যায় সমস্ত ‘গরল’ স্বভাবসুলভ ধীরতায় ধারণ করেছিলেন।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments