আষাঢ়ে গল্পের আল ধরে
পর্ব ছয়
অনুভবে আমি
তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য
ভ্রমণ মানেই সেই তো অকারণ ছুটে যাওয়া, অজানা হৃদয়ে অজানা পরিসরে।ছড়িয়ে দেওয়া হৃদয়ের ব্যাপ্তি।চেনা পথ চেনা মানুষ,পরিচিত সুবাস কে নতুন করে আপন করার নাম ও কিন্তু ভ্রমণ। সেই তো বৃদ্ধ বটের গায়ে কেমন উপচে পড়ছে মাধবীলতা, ফুলে ফুলে ভরিয়েছে অকৃপণ চুম্বন।তার মাতাল সৌরভে টেনে এনেছে হাজার যৌবন কে।হারিয়ে যাওয়া প্রেমের আবিষ্কারের নেশায় প্রেমিক পাখিরা দেশান্তরি হয়েছে।বৃদ্ধ বটের ছায়ার তলে কতো মানুষের দীর্ঘশ্বাস পড়ে..শীতল বাতাসে হয়তো কিছুটা শান্তি পায়।একটু উষ্ণতার জন্য মাধবীলতা প্রেম উল্মাসে নাচিয়ে তোলে আপন মহিমার সুগন্ধ।হৃদয়ের ভেতরের সেই মুসাফির বেরিয়ে পড়ে ভ্রমণে। বৃদ্ধ বট কি প্রমে বিশ্বাসী নাকি শান্তিতে? শান্তিতে থাকে আলস্য একটা নেতানো ঝিমানো ভাব।ওতে কি খুব একটা লাভ হয়? নাকি বুড়ো যুগ যুগান্তের ইতিহাসের কেচ্ছা ঘেঁটে মরে।মাধবীলতার উষ্ণ আলিঙ্গনের সুখ তো বেশ চেটে পুটে খায় ... দুজন দুজন কে ছেড়ে যেতে পারেনা তো। নিত্য পাওয়ার মধ্যে প্রেম যদি উবে যায় তবুও একটা অভ্যেস থেকেই যায়। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে... সূর্য এবেলার মতো গুটিয়েছে তার সংসার । গৃহস্থের সংসারে অন্ধকারের নাটক শুরু হবে। সাঁঝের আজান এবং সন্ধ্যা আরতি শেষে বেঁচে থাকার বাণিজ্যে প্রবল সংগ্ৰাম।আপন পাঠে কিশোর দুলে দুলে পড়ে সাম্রাজ্যের ভাঙা গড়ার কথা। কিংবা নব্য কবির কোনো প্রেমের কবিতা পাঠ " কি জানি কখন এসেছিলে তুমি/ জানি কি না জানি, সে কথা থাক/যদি উপবাসী ফুল ...সে কি ফুলেরই ভুল? / পিচ্ছিল পথের পরে মাধবীলতা থরে থরে"... অনেক নিঃশব্দের আওয়াজ এ কান পাতা দায়। বার বার সেই মুখ ফেলে চলে যাই বহু দূর।কোথাও কোনো মন কাঁদে না!হাহাকার করেনা মরমে মরে।বৃদ্ধ বটেরা কিছুই জানেনা। সুদূরের নৌকার পানে চেয়ে থাকে আনমনে। দিন শেষে পসরা গুটিয়ে যেতে হবে। কাজ নেই আর কোনো হৃদয়ের কথা ভেবে।
এই যে হৃদয় বোধ অনুভবের কথা বল্লাম …। কখন যে আমি পরিণত হলাম বুঝতেই পারলাম না। ফুল ফোটার শব্দের মতো নীরবে বেড়ে উঠলাম।
যে বয়সটা ফড়িং এর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলতাম সেই সময়টা একটা সাদা কাগজের মতো সময়। শুধু খেলা ছাড়া বিশেষ চিন্তা ছিলনা। খাওয়ার চিন্তাও নিজেকে করতে হতো হতো না কারণ মা খাইয়ে দিত। স্কুলে পড়াশোনা ছিল কিন্তু তখনকার দিনের বাবা মা রাও ঠিক আছে গোছের ছিল অতএব সন্তানেরও কোনো চাপ নেই । ব্যাপারটা হচ্ছে ঐ পুচকি বয়সে বোধ হয়নি আমি মানুষটা কী আসলে? নারী,পুরুষ, বড়োলোক, গরিব, অহংকার, সরল, গরল নাহ্ এ শব্দ এর বিস্তার অস্তিত্ব আমি জানিনা।মাঠ, ঘাট, আগান বাগান, চেনা পথ এই আমার জাতীয় ঠিকানা। আমি তো বই এ এসবই পড়ি "রাম বনে ফুল পাড়ে,গায়ে তার লাল শাল হাতে তার সাজি".. আমিও রোজ সকালে মায়ের জন্য কাড়াকাড়ি করে ফুল তুলি সাজি ভরে। গোপা,মহেশ্বরী,বুলা,পিলু সবাই মিলে আমরা ফুল তুলি। ফানেলের ফুলহাতা জামা কিংবা সুতির হলুদ ছাপা ছাপা চাদর বাবা ভালো করে পেছনে গিঁট দিয়ে বেঁধে দেয়।বই এর পড়া গুলো আমার চেনা চেনা গল্প। গাছ থেকে তারের মতো লম্বা লম্বা কী যেন ঝোলে তাই ছিঁড়ে আমরা বকুল তলায় মালা গাঁথি।স্কুল ফেরত আমরা যদি দেখি একটি আঁখের গাড়ি যাচ্ছে সেটা গরু বা মোষের গাড়ি।খুব সন্তর্পণে দুটো টানলেই মোটামুটি হয়ে যাবে।এ আনন্দের সত্যিই ভাগ হয়না। আস্তে আস্তে কখন যে বড়ো হলাম! শরীরের পরিবর্তন মনের পরিবর্তন। একদিন এমনই শ্রাবণ দিনে ঋতুমতী হলাম। মা কত পুজো টুজো করল।
বিশ্বাস করুন ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। মনে হলো আমি কোনো এলিয়ান নই তো?তারপর বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করলাম বললো ওদেরও হয়েছে, ওদের মা কাউকে বলতে না করছে।তারপর মেয়েদের সব লক্ষণগুলো আমার ভেতর আস্তে আস্তে প্রকাশ পেতে শুরু করল। এত লজ্জা লাগত খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতাম। সবাই মাকে বলতে শুরু করল ও ওরকম করে চললে কুঁজো হয়ে যাবে তো! আমার মনে আছে আমার অদ্ভুত স্বভাবের জন্য মা নিজে সেলাই করে সামনে বড় বড় কুঁচি দেওয়া ফ্রক বানিয়ে দিত।তখনকার দোকানেও কিনতে পাওয়া যেত সে সবও কেনা হতো।
মাঝে মাঝে চুপ করে আয়নার সামনে দাঁড়াতাম অচেনা আমিকে নতুন আমি কে চিনতে চেষ্টা করতাম। সবসময়ই মনে হতো আমাকে দেখতে ভালো লাগছে তো? আমার সব সমবয়সী বা পাড়াতুতো কাউকে বা কোনো ছেলেদের দেখলে লজ্জায় তাকাতে পাতামনা। ফড়িং ফড়িং স্বভাবটা কখন যে রঙিন প্রজাপতি হলো কে জানে? কোথাও একটা আফসোশ হতো আমি বড় হলাম অথচ সবাই বাচ্চাদের মতো ট্রিট করছে। নাহ্ ছোট চুল রাখলে হবেনা। মা কে বল্লাম মা আমি বড় চুল করবো। মা বললো নিজে তো মাথা মুছতে পারিসনা। ক্লাস নাইনে উঠলাম 1988 এ, সে বছর বেনারস বেড়াতে গেছিলাম।স্কুল খুললেই কী আনন্দ শাড়ি পরবো।কদিন টেপজামার উপর শাড়ি পরে গেছি বেশ খানিকটা উঁচু করে মা পরিয়ে দিয়েছে। দীপালি দিদিমণি বললেন তুই তো স্কার্টের মতো করে পরেছিস। আসলে তুই তো ভীষণ চঞ্চল দৌড়ে বেড়াস,মা সেই ভয়েই হয়তো! তারপর মা একদিন ব্রা কিনে আনলো কী লজ্জার কথা!জোর করে পরিয়ে দিল আমার গায়ে কিছুই হয়না খুলে বেরিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। আমাদের কাজের অণিমা পিসি আর মা হেসেই অস্থির। অণিমা পিসি বলে বৌদি ফেনাভাত আর ঘি,আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ ঠুসে ঠুসে খাওয়াও।
ওর যা পাখির আহার শরীর কী করে হবে?
আমার শাড়ি পরা দেখে পাড়ার লোকের কী হাসি সবাই ভিড় করে দেখছে। ইংরেজি দাদু বলে উঠলো মাকে নাহ্ আর দেরী করা যাবেনা এই মাঘেই আমাদের বিয়েটা পাকা কর বৌমা। ওদিকে সোনার মা, বুলুর মা,উলু দিতে শুরু করেছে। এ যেন এক অনুষ্ঠান চলছে। জানি আমি বড় হয়েছি বিশ্বাস করুন ভুলে যেতাম। ধরুন মা বললো একটু হলুদ নিয়ে আসবি অথবা আমি খেলে ফিরছি বাড়ির একটু কাছে এসেই লাফাতে লাফাতে আসতাম। একদিন এক কাকিমা বললো তুই হাঁটতে শিখিসনি?
পরে বুঝলাম আমি মেয়ে স্বাভাবিক চলা টা আমার জন্য অস্বাভাবিক। তারপর ধিরে ধিরে খেলতে যাওয়া বন্ধ হলো কখনও ছাদে কখনো বাড়ির সামনে গল্প করা বন্ধুরা মিলে । গল্প মানেই এই দাদা দারুণ পড়াশোনায়, ঐ দাদাটা কী দেখতে মাইরি রবীন্দ্র সঙ্গীত যা গায় শুনলে অবাক হয়ে যাবি। টুলা বললো আমার সঙ্গে কথা বলেছে বললো কোন ক্লাস রে তোর? তারপর ধিরে ধিরে সফলতা,ব্যর্থতা,পড়াশোনা, পাওয়া, না পাওয়া সব জীবন দিয়ে জীবন বুঝিয়ে দিল।
0 Comments