জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৩২/রোশেনারা খা ন

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খা ন 

পর্ব ৩২

বকুলকে কিছুক্ষণ আগেই চলে যেতে বলেছি। ছেলেটার জন্য মনখারাপ লাগছে। মাকে এত দীর্ঘ সময় ছেড়ে থাকেনা। তবে মামাবাড়িতে ওর খুব আদর, ওখানে থাকতে পছন্দ করে। সেজমামা মনি ছোটমাসি আর নানি ওর খুব প্রিয়জন। মামাবাড়ির সব আবদার এখানে পেয়ে থাকে।

  যথা সময়ে ঘোষণা শুনে আমরা লাইনে দাঁড়ালাম। শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা  লাইনের সামনে রয়েছে, এটাই নিয়ম। এখানেও আর এক প্রস্থ চেক হল। তারপর জাহাজের জেটির মত একটা প্যাসেজ দিয়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাসে উঠলাম। বিমানের কাছে গিয়ে বোডিইং পাশ দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে সিট নাম্বার দেখে জানালার ধারে বসলাম। আমাদের উইন্ডো সাইড সিট ছিল। বেশ অনেকটা সময় পর বিমান রানওয়েতে দৌড়াতে শুরু করল। জানালায় চোখ রেখে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর সব মেঘের আড়ালে চলে গেল। দমদম থেকে হিথরো প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় আকাশে ওড়া, সময় যেন ফুরচ্ছে না। খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, পায়চারি করছি। কিছুক্ষন অন্তর ম্যাপে চোখ রাখছি। কখনো ওপরে উঠছি, কখনো নিচে নামছি। একটা সময় বাইরে বেশ উত্তাপ টের পেলাম। একসময় ডানাগুলো ভিজে যেতেও দেখলাম। সম্পূর্ণ সময়টা দিন পেলাম। হঠাৎ চমকে উঠলাম ওপর থেকে আলো ঝলমলে লন্ডন দেখে। হেলেদুলে কাত হয়ে আমাদের ফ্লাইট হিথরোতে ল্যান্ড করল। তখনো দীপ এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছাতে পারেনি। আমরা ব্যাগপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মাঝে মাঝে নিগ্রো ছেলেগুলো কানের কাছে এসে ট্যাক্সি ট্যাক্সি করছে।  দীপের দেরি হওয়ার কারণ ওরাও নটিংহ্যামে একমাস হল এসেছে। গাড়ি  থাকলেও এখনো লাইসেন্স হয়নি। যে ট্যাক্সি বুক করেছিল, সে ভুল করে অন্য শহরে চলে গেছল। যাক, কিছুক্ষণের মধ্যে দীপ এসে পৌঁছাল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আমরা গিয়ে ট্যাক্সিতে বসলাম। বাবলি শীতের পোশাক আর খাবার পাঠিয়েছে। খাবার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, ঘুমও পাচ্ছে। শীতের জামাকাপড়ের ওপর মাথা দিয়ে শুয়ে পরলাম। তখনি শুনতে পেলাম কে যেন কি বলে চলেছে। ভাবলাম কেউ কি পথের নির্দেশ দিচ্ছে?


      মাঝে মাঝে চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে। বাইরে তাকালে কখনো ঘরবাড়ি, কখনো পাতা ঝরে যাওয়া গাছের কঙ্কাল দেখতে পাচ্ছি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। ঘুম ভাঙ্গল নটিংহামে সিটি চত্তরে পৌঁছে। বাবলি আমাদের অপেক্ষায় বসে ছিল। কতদিন পর মেয়েটাকে দেখলাম। ফ্রেস হয়ে খেতে বসলাম। দেরাদুন চালের ভাত আর চিকেন। খাওয়ার পর মা মেয়ের কথা যেন শেষ হতে চায়না।

    সকালে ঘুম ভাঙতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ঝলমলে রোদ উঠেছে। বাবলিরা প্রথমে অন্য কোয়ার্টারে উঠেছিল। সেটা তিনতলা বিল্ডিং ছিল। এই কোয়ার্টারগুলো সব বাংলো ডিজাইনের। নিচে ডাইনিং ও ড্রয়িংরুম একসাথে।  আর রয়েছে কিচেন ও ওয়াসরুম। দোতলায় দুখানা বেডরুম, একটি স্টাডিরুম ও একটি ওয়াসরুম। আগের কোয়ার্টারে এখনো কিছু জিনিস থেকে গেছে, ল্যান্ডফোনও  ওখানেই। মা মেয়ে কিছু জিনিস নেওয়ার জন্য আর বাড়িতে ফোন করার জন্য বের হতেই, অসম্ভব ঠাণ্ডা বাতাস। মনে হচ্ছে হাতের আঙ্গুলগুলো খসে যাবে।

    মেয়েকে রিলিফ দিয়ে রান্নাবান্নার দায়িত্ব নিলাম। এই শহরে এশিয়ানদের সমস্ত খাবারই পাওয়া যায়। বেশিরভাগটাই আসছে পাকিস্তান ও বাংলাদেস থেকে।  বাংলাদেশের বড় বড় ইলিশ, রান্না করেও সুখ, খেয়েও সুখ। মদিনা, হাফিজ  ইত্যাদি মাল্টি পারপাস স্টোরগুলিতে মাছমাংস, শাকসবজি, তেল মশলা সবই পাওয়া যায়। সিটি সেন্টারে গেলেও সবই পাওয়া যায়, তবে সে সব অন্যান্য  প্রয়জোনিয় জিনিস। কোয়াটারের পিছনেই বাসরাস্তা, বাসে কয়েকবার সিটি সেন্টার গিয়েছি। বাসগুলো খুব আরামদায়ক, ড্রাইভারের কাছেই ভাড়া দিতে বা পাস ছোঁয়াতে হয়। একতলা দোতলা, দুরকম বাসের সামনের দিকটা ফাঁকা রাখা হয়েছে বাচ্চাদের প্র্যাম ও বৃদ্ধদের হুইলচেয়ার রাখার জন্য। হাতের নাগালের মধ্যে বোতাম আছে, গন্তব্যের আগের স্টপেজে বাস রওনা দিলেই বোতাম টিপতে হবে,তাহলেই সামনের স্টপেজে বাস দাঁড়িয়ে যাবে।
    দীপ থাকে সিটি হাসপাতালের কোয়াটারে। কাজ করে কুইন্স হাসপাতালে। দুটি হাসপাতালের মধ্যে যে বাসগুলি যাতায়াত করে, সে বাসগুলির নাম মেডিলিঙ্ক।  হাসপাতালের স্টাফ ছাড়া যে কেউ বিনা টিকিতে এই বাসে যাতায়াত  করতে পারে। ১৪ মার্চ আমাদের ৩৮ তম বিবাহবার্ষিকী। এই দিনেই বাবলিকে সাধ খাওয়ানর আয়োজন করেছি। আয়োজনের কোনও ত্রুটি রাখিনি। সাড়ি, গহনা, কাচেরচুড়ি, মেহেন্দি, টি  পিরের শিরনি, সবই নিয়ে এসেছি।                সকাল থেকে শাশুড়ি জামাই ওর পছন্দের সমস্ত কিছু রান্না করেছি। দীপ খুব সুন্দর করে ঘর সাজিয়েছে। ও জানত না আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। বাবলির থেকে জানার পর পাশের কোয়াটারের সুজিতকে সঙ্গে নিয়ে গুচ্ছের টাকা খরচ করে মা-মেয়ের জন্য ফুল, খান সাহেবের জন্য তিরিশ পাউণ্ড দিয়ে সিগারেট, বাবলির জন্য মাস্কারা আর আমার জন্য হেয়ারড্রায়ার কিনে এনেছে,  আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। 

      যাইহোক বাইরের লোক বলতে সুজিত ছিল। ও জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে মেডিক্যালে ফাস্ট হয়েছিল। ওর ভাই আমেরিকায় থাকে। সে এইচ এস এ রাজ্যে প্রথম হয়েছিল। সুজিত সিটি হাসপাতালের রেজিস্টার। ওর স্ত্রীও ডাক্তার, লন্ডনে কাজ করে। উইকেণ্ডে সুজিতের কাছে আসে।

    বাবলিকে গোলাপি ঢাকাই সাড়িতে খুব সুন্দর লাগছিল। ও তো এখন এখানকার পোশাক পরে। তাই ওর বাপি বলেন, মেয়ে আমার কালো মেমসাহেব হয়ে গেছে। খুব আনন্দের সঙ্গে সাধের অনুষ্ঠানটি হল।
    আগে এদেশে চুরি হত না। ইদানিং চোরের উপদ্রব বেড়েছে। এর কারণ ড্রাগের নেশা। দীপকে ওর এক অস্ট্রেলিয়ান বন্ধু দেশে ফেরার সময় একটা সাইকেল দিয়ে গেছল। ওরা সেটা কোয়ার্টারের সামনে তার দিয়ে একটা পাইপের সঙ্গে বেঁধে রাখত। খান সাহেব বললেন সাইকেলটা এখানে না রেখে পিছনের লনে রাখিস না কেন? চুরি হয়ে যেতে পারে তো! মেয়ে বলল, কিছু হবে না। দীপ একদিন হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় দ্যেখে সাইকেলটা কোয়ার্টারের সামনের  রাস্তায় পড়ে আছে। তবুও ওরা সাইকেলটা ওখানেই রাখল। একদিন সকালে দেখা গেল সাইকেলটা নেই। একেবারে পাশে একটি ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি থাকে, তাঁদের কিশোর ছেলেটি বলল, আমি সাবধান করব ভেবেছিলাম, আজকাল জিপ্সিরা অসতর্ক হলেই এটা সেটা চুরি করে নেয়। আসলে বাবলিরাও কয়েকদিন মাত্র এসেছে, সবার সঙ্গে আলাপের সুযোগ হয়নি।

    ব্রিটিশ সরকার এই জিপ্সিদের বাড়িঘর বানিয়ে দিয়ে, কাজ দিয়ে স্থায়ি বাসিন্দা বানানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওদের স্বভাব, ওদের জীবনযাত্রা বদলাতে পারেনি। ওরা সাধারণত চুরি করে একলা থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বাড়িতে। এরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে যাতে ডাক্তার, এ্যাম্বুলেন্স তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারে তারজন্য দরজা লক করা থাকেনা। চোর এই সুযোগকে কাজে লাগায়। ছোট ছোট চোরায় জিনিস‌, পুরনো জিনিস বিক্রি করার বাজারও রয়েছে এখানে। সপ্তাহে দুদিন এই  বাজার বসে। মেডিলিংকের বাসে চড়ে যাওয়া যায়। দীপ কীভাবে যেন এই বাজারের খোঁজ পেয়েছিল। আমি আর খান সাহেব মাঝে মাঝে যেতাম। এখান থেকেই গ্রীসে তৈরি সোনার জলে কাজ করা অপূর্ব সুন্দর দুটি প্লেট কিনেছিলাম মাত্র ২ পেনি দিয়ে। অ্যাণ্টিক হিসেবে যার মুল্য অনেক।

      আগেই বলেছি এখানে যে জের মত ধর্ম পালন করেন, কিন্তু অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি কোন হিংসা বিদ্বেষ নেই। কোয়ার্টারগুলো শুধু সারিবদ্ধভাবে  সাজানোই নয়, সবগুলো একইরকম দেখতে। এটাই এখানকার নিয়ম।বিভিন্ন সারিতে বিভিন্ন সংখ্যার কোয়াটার রয়েছে। বাবলিদের সারির দুইপ্রান্তে দুটি মুসলিম পরিবার রয়েছেন। একদিন সন্ধ্যাবেলা কলিংবেল বাজতে দরজা খুলে দেখি দুজন হিজাবপরা ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। ওনারা খোঁজ নিতে এসেছেন, আমাদের কোনকিছু প্রয়োজন কিনা। এখানে সবাই ঐরকমই সজ্জন ও উপকারি। আর একদিন একটি মেয়ে এসে বলল, ওরা পাশেই থাকে। আজ ওর বাচ্চার জন্মদিন, তাই খোঁজ নিতে এসেছে এবাড়িতে কোন বাচ্চা আছে কিনা। কথা বলে জানলাম। ও শর্মিলা, মহারাষ্ট্রে বাড়ি। ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার। তবে এখন শুধু ও একা চাকরি করে।
                                      ক্রমশ 

পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments