জ্বলদর্চি

জয়দেব মালাকার ( জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গবেষক, পত্রিকা সম্পাদক, তমলুক )/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৬

জয়দেব মালাকার ( জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গবেষক, পত্রিকা সম্পাদক, তমলুক )

ভাস্করব্রত পতি


এই মানুষটা ইতিহাস ভালোবাসেন। লুকিয়ে থাকা ঐতিহাসিক মণিকনাকে ঘসে মেজে উজ্জ্বলতর করে তোলেন। তাঁর কাছে গেলে মিলবে এই জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা তথ্য। জাতীয়তাবাদী ভাবনা তাঁর রক্তে। বাবা ধীরেন্দ্রনাথ মালাকার ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯৩০ সালে কোর্ট বয়কটের অপরাধে ৪ দিনের সিভিল জেল হয়েছিল তাঁর। তাই বাবার স্মৃতি গায়ে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন ঐতিহাসিক তমলুক শহরে। আর এজন্যই জাতীয়তাবাদী নেশা তাঁর মননে।

জীবনের নানা সময়ে পেয়েছেন সুশীল কুমার ধাড়া, গোপীনন্দন গোস্বামী, কুমুদিনী ডাকুয়া, অজয় মুখোপাধ্যায়, সতীশ সামন্ত, ক্ষুদিরাম ডাকুয়া, বিশ্বনাথ মুখার্জি, গীতা মুখার্জি, বিরাজমোহন দাশ, কৃষ্ণচৈতন্য মহাপাত্র, রমেশ বেরা, কানাই ভৌমিক, ফুলরেণু গুহ, রাধাকৃষ্ণ বাড়িদের সান্নিধ্য ও সাহচর্য। এঁদের জীবনাদর্শ তাঁকে উৎসাহিত করেছে জাতীয় আন্দোলন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে, গবেষনা করতে।

স্বাধীনতা আন্দোলনে অসংখ্য অজানা তথ্য আজ তাঁর নিরাপদ জিম্মায়। তমলুক তথা মেদিনীপুরের বুকে ঘটে যাওয়া ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে বাংলার বিপ্লবীদের স্মরণীয় কাহিনী তিনি উদ্ধার করেছেন। প্রকাশ করেছেন ধারাবাহিকভাবে তাঁর পত্রিকা “তাম্রলিপ্ত'-তে। সেই ১৯৭৮ থেকেই এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটির সম্পাদক পদে আসীন। তিনি জয়দেব মালাকার। 

পেশায় বিদ্যুৎ দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিলেন। এখন অবসর। ১৯৫০-এর ৮ ই মার্চ জন্ম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা পাশ করেছেন। ১৯৭৩-৭৮ পর্যন্ত দৈনিক বসুমতিতে সাংবাদিকতা করেছেন। আজ জয়দেব মালাকার নামটি যেন একটি প্রতিষ্ঠান। অসংখ্য অজানা তথ্য তিনি খুঁজে বের করেছেন নিবিড় অনুসন্ধানের মাধ্যমে। 

আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে মেদিনীপুরের যে ১১ জন সাজাপ্রাপ্ত বিপ্লবীকে রাখা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে নতুন করে দু'জনের নাম তিনি খুঁজেছেন। বাকি ৯ জনের নাম সবাই জানতো। এজন্য ২০০২ সালে ১৫ দিন ধরে আন্দামানে থেকে চালিয়েছিলেন অনুসন্ধান। ময়নার দোবাঁধি এলাকার গোবিন্দ প্রসাদ বেরা এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের অনন্ত কুমার মুখার্জীদের নাম তিনিই প্রকাশ করেন। তিনি প্রচুর পরিশ্রম করে বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার শেষ আট প্রহরের বিবরণ খুঁজে পেয়েছেন। 

তাঁর প্রকাশিত ‘তাম্রলিপ্ত' সত্যিকারই মুক তাম্রলিপ্তের মুখর ছবি প্রকাশ করে চলেছে নিয়মিতভাবে দীর্ঘ ৪৯ বছর ধরে। বিশেষ করে শারদীয়া সংখ্যাগুলি যেন এক একটি আকর গ্রন্থ। আসলে তিনি চান স্বাধীনতা আন্দোলন সহ সংস্কৃতির পীঠস্থান এই মেদিনীপুরের গৌরবগাথাকে তুলে ধরতে। বর্তমানে তিনি চুয়াড় বিদ্রোহ ও সাঁওতাল বিদ্রোহের পরবর্তী অধ্যায়ে ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত মেদিনীপুরের ২০৫ জন শহীদ বিপ্লবীর জীবনালেখ্য লেখার কাজ করছেন অক্লান্তভাবে। সেইসাথে তাঁর কাজের পরিধিতে রয়েছে লবন সত্যাগ্রহতে সেসময় কারা কারা অংশগ্রহণ করেছিল এবং তাঁদের ভূমিকা কি ছিল তা নিয়ে গবেষণা করা। ১৯৪২ সালে শহীদদের কিভাবে দাহ করা হয়েছিল তা নিয়ে বিস্তারিত কাহিনী লেখার কাজ করে চলেছেন তিনি। কিভাবে সেলুলার জেলের বন্দীরা কমিউনিস্ট আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই ইতিহাস তিনি লিখেছেন। লবণ আইন আন্দোলনে কোন কোনটি ব্যক্তি অংশ নিয়েছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ নামগুলি তিনি লিখেছেন। খুঁজে পেতে সংগ্রহ করেছেন প্রতিটি নাম। তাঁর লক্ষ্য নিজের বাড়িতে জাতীয় আন্দোলন বিষয়ে যাবতীয় তথ্য নিয়ে একটি গ্রন্থাগার নির্মাণ করা।

তাঁর জিম্মায় রয়েছে সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে লেখা চিঠি। ১৯২০ এর ২২ এপ্রিল এই চিঠি লিখেছিলেন তমলুক বার লাইব্রেরির সম্পাদককে। কোর্ট বয়কট করার অপরাধে এক আইনজীবীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে মহামান্য কোর্টের নোটিশ এবং অভিযোগ ছিল। সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকের প্রশাসনিক ভূমিকা ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন, স্বরাজ ও স্বায়ত্ত শাসন প্রতিষ্ঠার নিবেদন। এই চিঠির গুরুত্ব আজ অপরিসীম। এই চিঠিই প্রমাণ করে দেয়। ১৯৩৮-এর ১১ এপ্রিল তমলুকে সুভাষচন্দ্র প্রথম পা দিলেও তার অনেক আগেই তমলুকের সাথে সুভাষচন্দ্রের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল।
১৯৪৬ সালের ১৮ অক্টোবর তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দি একটি হ্যাণ্ডবিল প্রচার করেছিলেন হিন্দু মুসলমান জনগণের উদ্দেশ্যে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় প্রচারিত সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রচারপত্রটি আজ জয়দেববাবুর সংগ্রহে। নকশাল আন্দোলনের বহু প্রচারপত্র সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছেন তিনি। ১৯২৯ সালে ডমিনিয়াল স্ট্যাটাস পেয়েছিল যাতে কংগ্রেস কে সমর্থন করে তার আবেদনপত্র নেতাজী ও জে এম সেনগুপ্ত দের সাক্ষরিত আসল চিঠি রয়েছে জয়দেব মালাকারের কাছে। ১৯৩০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা তমলুক, হলদিয়া ও কাথির লবণ আন্দোলনের ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। সেই দুষ্প্রাপ্য সংখ্যাটি রয়েছে তাঁরই জিম্মায়। তিনি স্বাধীনতা পূর্বোত্তর সময়ে জাতীয় বিদ্যালয়গুলি কিভাবে গড়ে উঠেছিল, কারা শিক্ষক ছিল তা নিয়ে নিবিড় খোঁজ চালিয়ে লিখেছেন অসংখ্য তথ্য। বিভিন্ন সংবাদপত্রের বিশেষ বিশেষ দিনের বিশেষ বিশেষ ক্রোড়পত্র সংগ্রহ করে রেখেছেন ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য। এ এক অসামান্য সংগ্রহ তাঁর। ১৯৪৭ এর ১৫ ই আগস্ট প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকাটিও সযতনে রক্ষা করে রেখেছেন এই লোকসংস্কৃতিবিদ সম্পাদক তথা জাতীয় আন্দোলনের গবেষক মানুষটি।

বর্ষীয়ান এই মানুষটা সত্যিই 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'। একটা অজানা কাহিনী জানতে তিনি যেভাবে পরিশ্রম করেন তা দুষ্কর। এখন নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের ইতিহাস লেখা শুরু করেছেন। তাঁর কাছে 'অলসতা' ভিন্ন গ্রহের প্রাণী। 'পরিশ্রম' তার মাথার মুকুট। এই বয়সেও নিয়মিত প্রকাশ করেন 'তাম্রলিপ্ত'। 'ক্লান্তি নেই। গবেষক থেকে শুরু করে ছাত্র যে কেউ এলেই হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। সরবরাহ করেন প্রয়োজনীয় তথ্য। আসলে বিপ্লবের মাটি তাম্রলিপ্ততে জয়দেব মালাকার হয়ে উঠছেন বিপ্লবের রচনাকার।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments