কবিতা অ্যাভিনিউ
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
পর্ব -২১
‘নিজের মুখ আমি প্রথম দেখেছি ভেসে যেতে যেতে
জলের ভিতর এই ব্যথিত মুখ
অপমৃত্যুর মতো স্থির হয়ে আছে
স্রোতের ধাক্কায় এক এক করে খসে যাচ্ছে
আমার মিথ্যে সাজপোশাক মিথ্যে অহংকার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি’
কবি অমিতেশ মাইতি সম্পর্কে আগের পর্বে অনেক কথাই বলেছি। কীভাবে কবিতা ও জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টির ভেতর। বৃষ্টি থেকে তিনি খুঁজে নিয়েছিলেন বর্ণমালা।নদী থেকে চিনেছিলেন পঙক্তির বিন্যাস। তাঁর কবিতার অন্তঃস্থলে আমরা দেখতে পাই তারই উজ্জ্বল প্রকাশ।
‘বৃষ্টি থেকে তুমি একদিন অক্ষর খুঁজে পেয়েছিলে
নদী থেকে চিনেছিলে পঙক্তির বিন্যাস।
আমাদের অপমান বেদনার কাছাকাছি এসে
থমকে আছে যে সমুদ্র
সেখান থেকে আর কিছুই শুরু করা যায় না,
সেই অতলান্তে আমাদের খণ্ডিত বহু মুখ
ভাঙা জাহাজের টুকরোর মতো ছড়িয়ে আছে
এখন আত্মহনন ছাড়া শেখা যায় না কিছুই।
অথবা তিনি যখন বলেন-
আজ বৃষ্টি কিংবা নদী কেউ আমার সঙ্গে
একপা হাঁটে না
শরীর বেয়ে ঘাম নামে, পথশ্রমের ক্লান্তি
আকাশে আকাশে ডেকে যায় বিরহী মেঘ।’
তাঁর কবিতার শুরু হচ্ছে বৃষ্টি দিয়ে, বারবার সেখানে ফিরে এসেছে নদী ঢেউ সমুদ্রের গান। কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কথামতো-‘ তার কবিতায় একও ধরণের বিষাদযোগ অনুরণিত হয়ে চলেছিল যেন। সংবাদপত্রে সপ্রতিভ কর্মযোগে সে ছিল সর্বাগ্রণী কিন্তু স্বরচিত কবিতার চর্চায় কেমন যেন একা।’
‘আমিও কি তোমার সমুদ্রে যাব ?
এসব কি তারই প্রস্তুতি?’ ( জলের ভিতর মুখ ... ঝরাপাতা )
হ্যাঁ । সমুদ্রেই গিয়েছেন কবি । সমুদ্রের জলের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে পেয়েছেন , পেয়েছেন এক পূর্ণতার স্বাদ । জলের মধ্যেই বেছে নিয়েছেন তাঁর আশ্রয় । কেন বেছে নিয়েছেন তিনি এই আশ্রয় এই অনুসন্ধানও আমরা পেয়ে যাই তার একটি কবিতায় –
সবই আছে যেখানে যা ছিল । শুধু কার
মগ্ন হাহাকার সর্বস্বে লতিয়ে উঠে পাকেপাকে পিষছে স্মৃতি
রোমকূপ থেকে উঠে আসা আগুনকে বলছে –
“ঐ শোনো ধরিত্রীর গর্ভে
বাজছে তোমারই আর্তনাদ ” ( বিষাদ যাপন /২ )
অথচ চুপচাপ কবি জানেন কেউ কোন কথা বলছে না, শুধু এক বিষণ্ণতা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে কীর্তিনাশার দিকে ।পথের ভেতর পাতা থাকে আরও এক অন্তহীন পথের ঠিকানা সেই আহবান একমাত্র কবি ছাড়া আর কেই বা শুনতে পান । গভীর গভীরতর শূন্যদেশ থেকে তিমিরবিদারী নক্ষত্রের দল হেসে ওঠে । তার ডাইনে বামে শুধু মাত্রাতিরিক্ত অন্ধকার । মানুষের রক্তাক্ত পদছাপ, ঘাম আর ঘৃণার গন্ধক । চিন্তারুগ্ন মরুভূমি হয়তো এভাবেই অতিক্রম করে যেতে চান কবি । মানুষের স্বত্বা প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও মুখোমুখি হচ্ছে এক গভীরতম অস্তিত্বের শেকড়ে । অসুখের জাগরণকে বিশ্রামচিহ্নের নীচে পাঠানোর নিবিড় আয়োজনে । ক্লান্তি ক্ষয় আর বিষাদের বিপরীতে এও এক জীবন মন্থন । এক পরিত্রানের তাঁতঘর । এই মন-অবশ চলমানতার ভেতর কবি শুনতে পান বিদায়ের ছলছল ধ্বনি –
পথের ভিতর আরো এক পথ পাতা ছিল
তোমার ভিতর আরো এক তুমি ছিলে
একা মুঢ় আমি বুঝতে পারিনি । ( আরো এক পথ, আরো এক তুমি )
বুঝতে পেরেছিলেন অমিতেশ । এবং বুঝতে পেরেছিলেন বলেই সঃশূন্যতাবোধের ভিতর সৃষ্টিশীল মেঘ উড়তে দেখেছেন বারবার । এই মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরবে । বর্নময় গোলকের অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছুরিত আলো ও শ্রাবণ । অথচ কিছুই শাশ্বত নয় , অবিনশ্বরতার ভান , ক্রিয়ার বিপরীতে এক প্রতিক্রিয়া বা শিল্পতৃষ্ণার আড়ালে যৌনক্ষুৎকাতর প্রানেরই বেদনাবিলাস । মৃত্যু কখনোই প্রাণহীন জড়ত্বের বিলাস নয় । বরং এক আশ্রয় সম্পাদনের ইচ্ছা ।
অমিতেশের এই মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয় জার্মান ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি সেলানের সেইন নদীর জলে নিজেকে নিক্ষিপ্ত করার মর্মান্তিক কাহিনী । এক জেলে তাঁর মৃতদেহ আবিস্কার করেছিল নদীর জলে । তখনও কবির মুখে প্রসন্ন হাসি । যেন মৃত্যুকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন তিনি । যেন এক নিঃশব্দ ছায়াপথ অতিক্রম করে চলেছে জলে ভিজে যাওয়া শব্দগুচ্ছ । হ্যাঁ , হোল্ডারলিনের সেই অমোঘ বাণী যা ছিল সেলানের প্রাণের আশ্রয় - হৃদয়ের অতল অনুসন্ধানের জন্য জলের কাছেই আসতে হবে । কবি অরুনেশ ঘোষ জলের গভীরেই খুঁজে পেয়েছিলেন নরক ও নক্ষত্রলোকের নদী । পুকুরের জল থেকে তার চেতনাহীন দেহ তুলে আনা হলেও ময়নাতদন্তে কোন জলের অনুসন্ধান মেলেনি । ভার্জিনিয়া উলফ কোন এক সূর্য না ওঠা সকালে নদীর জলে নেমে এসেছিলেন । ইয়োলো নদীতে প্রতিবিম্বিত চাঁদকে দেখে মোহিত হয়ে জলের অতলে নিজেকে বিলীন করেছিলেন চীনের কবি লী-পো । কবি যোগব্রত চক্রবর্তী যাকেও গ্রাস করে নিয়েছিল নদী।যার স্মরণে কবি পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছিলেন-‘ নিজের খাটের চেয়ে শ্যাওলার বিছানা কি অধিক নরম? যোগো/ জলের ভিতরে গিয়ে কার কার কবিতা কুড়োলি?’
জল ও জীবন এক পরম্পরা । জলের কথা আসলে জীবনেরই কথা । জীবনের শনাক্তকরণ । মৃত্যুর বোতাম খুলে দেখা । পাশে বসিয়ে তার বোতাম খুলে দেখি
শ্যামল অরণ্যের ভিতর দিয়ে পায়ে চলার পথ
যেন ঐ পথ আমার গন্তব্য জেনে আগেভাগে
চলে গেছে কোনও এক অনিবার্য নিয়তির দিকে
মৃত্যুকে বলেছি যদি আসতে হয়- এসো তবে ভোরবেলা
প্রকৃতি তখন বালিকার মত হয়ে থাকে, স্বচ্ছ দুচোখে
তার কোন কালিমা থাকেনা । ( অন্ধকারে ঢাকা )
জীর্ণ বস্ত্রের মত ত্যাগ করে দিয়েছেন কবিতার এই ভুবন । ভাবলেশহীন বন্ধ দরজার সামনে বারবার কড়া নাড়ার অনিবার্য তাড়না । জল ও মৃত্যু নিয়ে এত লেখা তাঁর । কেউ জলে নামলে ওরও ইচ্ছে হত জলে নামার । জল নিয়ে ভয় ছিল । কি তাঁর ? ভয় নয় এক অনন্ত আকর্ষণ ছিল । কৌতূহল ছিল । অস্থিরতাও কি ছিলনা ? ছিল । আর তাই বিশ্ব আবর্তনের মধ্যে এক প্রাকারবিহীন দৃশ্য নিসর্গের অন্বেষণ । অনুবর্তিত শাখায়িত শরীরপথের ক্রমসুচনা । জন্মাবস্থার জরায়ু কালীন স্মৃতিঘাট চেনার জন্য মৃত্যুর কথা তো এডগার এলান পো ও বলেছিলেন । অমিতেশ কি ছুঁতে চাননি সেই স্মৃতি ঘাট ?
জলের ভিতর গিয়ে
অতলের দিকে যে কটা জানালা, যে কটা দরজা
চুমুতে চুমুতে আজ খুলে দিই
কোমল নিষেধের প্রান্তে রেখে আসি নশ্বর সাবান ( জলের ঘরবাড়ি )
এভাবেই জলের শরীরে নিজেকে প্রোথিত করার বাসনা এবং উল্লাস অমিতেশের কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে । আদি ও অনাদি দুটি হাতে খনন করতে চেয়েছেন স্বরচিত বন্দর । যেখানে তিনি মুছে ফেলতে চান জন্মানোর অপরাধ
জন্মানোর অপরাধে এক অনিবার্য প্রায়শ্চিত্তের জন্য
মানুষ তা জেনেও গভীর ভালোবাসায় জীবনের হাতে হাত রাখে (দাসত্ব )
পথ চলার ক্লান্তি গ্লানি আর ঘুমের ইপ্সিত প্রার্থনায় তিনি ভারাক্রান্ত নন । তা আসলে জীবনের নবায়নের আকুতি
পথ চলার ক্লান্তি আর গ্লানি
তখনই থই থই করছে শরীরে , ঘুমের নরম মাংসে
দাগ রাখছে গোলাপি নখ
স্বপ্ন আর জল
ফেনা আর উষ্ণতা ( জলের ঘরবাড়ি )
জল আর স্বপ্নের ভেতরে ফিরে এসেছে কিছু উষ্ণতার মুহুর্ত । নীরবতার ভেতর এক বধির প্রতিধ্বনির মধ্যে ঝন ঝন করে বেজে উঠছে জীবনের দর্পণ । কেউ যেন ডাকছে বেল বাজিয়ে । কে ? অস্থিত জিজ্ঞাসার মধ্যে অমলিন ধুলো সরিয়ে মৌন জানলায় কবি দেখছেন -
আজ নদী দূর পাহাড় থেকে ডাকতে এসেছে-
আমি চলে যাব, এভাবেই যেতে হয় তাই...
তুমি মুখ ফিরিয়ে রাখো
চোখ রাখো দূর নীলাকাশে ( মুখ ফিরিয়ে রাখো )
এভাবেই তাঁর কবিতার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই অমিতেশকে । স্পর্শ করি অনুভূতির মৌলিক আকাশ । যে বিস্ময়কর অনুভব থেকে তিনি চিনতে চেয়েছেন ব্যাকরন বর্জিত দুনিয়া । মৃত্যুর প্রতি এক অপ্টিমিস্টিক অ্যাটিটিউট থেকে জীবনের উপর আলো ফেলেছেন তিনি । বায়োলজিক্যাল এক্সিজটেন্স এর বাইরেও এক আত্মিক অবস্থানের ধারনায় উপনীত হওয়ার প্রয়াস । যা এক নীল জলের মত , দেখা যায়না তার গভীর রহস্য । দেহগত শর্ত পেরিয়ে প্রাচীর অতিক্রম করে এক ধ্রুবতার দিকে তাঁর অধিগমন । সুক্ষ দেহাতীত এক চেতনা থেকে জীবনের পরিক্রমা ... এই আশ্চর্য বর্ণহীন বর্ণময়তাকেই তো ধরার আকাঙ্ক্ষা অনাদি কালের –
বাণীর ভেতর উবু হয়ে বসে আছে
আমাদের বেদনালব্ধ জীবন
হাওয়া এসে দুলিয়ে দিচ্ছে সেই জীবনের ডালপালা
আর আত্মমগ্ন পাখি
ডাকছে, ডেকে – ডেকে ফিরছে যাকে
গানের আড়ালে থাকা তোমাকে আমাকে ( গানের আড়ালে )
দক্ষ সাতারুর মত অমিতেশ স্পর্শ করেছেন জীবন যাপনের এই অলৌকিক উদাসীনতা। বস্তুগত সত্যকে অতিক্রম করে নাগাল পেতে চেয়েছেন এক আধ্যাত্মিক সত্যের।এই তার অনন্ত পরিক্রমা।এভাবেই তাঁর নির্মিত শব্দকোষে তাঁর চিরন্তন মুক্তির অভিলাষ । নৈরাশ্যের ভেতর , আলোর কাছে নীরবতা পাবার আকাঙ্ক্ষার ভেতর অথবা পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি একাকীত্বের ভেতর খুঁজতে চেয়েছেন সান্ত্বনার হাত । কখনও প্রেমে কখনও আশ্রয়ে -
রঙের ওলটপালট স্রোতে ঘুম ভেঙে গেলে
একটি বিশাল অলীক পালকে
দুজনেই নগ্ন শুয়ে থাকি
তুমিই ফেলে গেছ পালক , ও অচিনপাখী (স্বপ্ন , খড়কুটোর মতো )
এই ভাবনার নামই তো অমিতেশ । তার বিষাদ এক সুরভিত দৃশ্যের বলয়ে বাঁধা পড়ে এভাবেই । স্বপ্নতাপিত স্পর্শময় ছবির ফ্রেমে । নাগরিকতার পিচ্ছিল প্রবাহে এই স্ফুরণ আর ব্যপ্তির দ্রুততা । এও একান্তই অমিতেশীয় । যে ছবির উপর ছায়া এসে পড়ছে । আলো ফুরিয়ে যাচ্ছে । আর ধুয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের রঙ । এই খণ্ড বিখন্ড ছবিগুলোই তো জীবন । তাকেই বাঁচিয়ে রাখতে চান কবি । জল যতই মুছে দিক সেই প্রবাহ । জল যতই আর্দ্র করে দিক মলিন করে দিক তার উজ্জ্বলতা । তবু তা আছে এক মহার্ঘ সময়ের অতলে । দীক্ষিত পাঠক ডুবুরির মতো একদিন ঠিক তুলে আনবে এইসব মনিমুক্তো ।
‘ফেনা আর উষ্ণতা
মিশে যাচ্ছে ভেসে যাচ্ছে আরও আরও অতলের দিকে-
এই জলেই লেখা রইল আত্মজীবন
অবসর পেলে কোনোদিন - একা একা পড়ো।’
0 Comments