'কেন লিখি' আসলে লেখকের আত্মজিজ্ঞাসা /ঋত্বিক ত্রিপাঠী
'কেন লিখি' আসলে লেখকের আত্মজিজ্ঞাসা
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
প্রকাশিত হল জ্বলদর্চির 'কেন লিখি' বিশেষ সংখ্যা।
সম্পাদকীয় অংশটি এখানে থাকলো। ইচ্ছে হলে সংখ্যাটি সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। যোগাযোগ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪
আত্মজিজ্ঞাসা
১.
বিষয় যাই হোক সৃষ্টিশীল রচনা - তা-ই এখানে 'লেখা'। কিন্তু কেন লিখি? এ এক অবশ্যম্ভাবী আত্মজিজ্ঞাসা--সমস্ত সৎ লেখকের কাছে। এই স্বাস্থ্যকর প্রশ্নের উত্তরে কলম ধরেছেন বিশিষ্ট লেখকগণ। তাঁরা নিরপেক্ষভাবেই জানিয়েছেন তাঁদের আত্মজ অভিমত। এইসব অভিমত জবাবদিহিও বটে, সাহিত্যের এক ভিন্ন ধারাও বটে। উৎসাহী পাঠকের মনন নিয়ে সম্পাদকের কৌতূহল--কেন লেখেন! পত্রিকার পক্ষে হতে পারে আপাত প্রশ্ন, লেখকের কাছে কিন্তু চিরন্তন আত্মজিজ্ঞাসা-আত্মসমালোচনা।
উপমা-অলংকার আর রীতি তো সাহিত্যের বাইরের শক্তি। মূল তো নৈয়ায়িকের দর্শন ও বর্ণন। সহজগুণ হল সেই প্রজ্ঞা যার কারণে স্রষ্টা আবিষ্কার করেন। এই গুণেই তাঁর না-দেখা বিষয় ও তত্ত্ব প্রত্যক্ষের মতো হয়ে ওঠে। আর তার সঙ্গে যুক্ত অমৃত-আনন্দ। অমৃত-আনন্দ হল আত্মোপলব্ধির, যা শুদ্ধ ও অনির্বচনীয়। আর বর্ণন-কঠিন কাজ তথা ভাষা মাধ্যমে সাধারণ কথাকে অসাধারণ করে প্রকাশে স্রষ্টার ব্যক্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের কারণেই যে-কোনও শিল্পের এত বৈচিত্র। বিশেষ একক অনুভবকে আরও বিশেষ বহুমাত্রায় করে তোলাই তো মূল লক্ষ্য শিল্পের। সময়ের হয়েও সময়কে অতিক্রম করা, কালান্তর করে তোলা। চিরন্তন-দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ধর্ম তো মৌলিক তত্ত্ব, সাহিত্য তথা যে-কোনও সৃষ্টিশীল শিল্পের স্বভাবচরিত্র। মৌলিক বিষয় যখন ভাষারূপ পায়, মুদ্রণসৌভাগ্য লাভ করে তখন তা আর শুধুমাত্র লেখকের নয়, বরং তখন লেখকও পাঠক। স্রষ্টাও তখন এক নিরপেক্ষ বিচারবোধ পান। অনেকক্ষেত্রে তিনিও হয়ে ওঠেন সমালোচক। সুযোগ পেলে পরবর্তী সংস্করণে পরিমার্জন করেন। আসলে পাঠক খুঁজে বেড়ান চিত্তবৃত্তির গূঢ়তম সংস্কার ও বাসনা। সংস্কার হল বাস্তব। বাসনা হল বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে অন্য কিছু। তার স্থির সংজ্ঞা ও সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যার অতীত।
কেন লিখি-- এর উত্তর অনেকের কাছে অনেকরকম। তবে সাধারণভাবে, প্রাথমিক লক্ষ্য একটাই--তা হল নিজের সংস্কার ও বাসনাকে প্রকাশ করা। সে লেখা জনপ্রিয়তা পাবে কি না, পাঠকের পছন্দ হবে কি না, সময়ের স্রোতে থাকবে কি না, বাণিজ্যিক সফলতা তথা কিছু লক্ষ্মীলাভ ঘটবে কি না--এসব চিন্তা-প্রবৃত্তি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে না। বিশেষ করে রচনাকালে। থাকলেও লেখা খুব প্রভাবিত হয় কি? যেহেতু লেখা ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। সৃষ্টিসুখই তখন মুখ্য। আর এও ঠিক যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে যে লেখা তাও অনেকক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট হতেই পারে। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েও সৃষ্টিশীল রচনা সম্ভব। সৃষ্টিশীল অক্ষরশিল্প তো জীবনেরই এক অংশ। তাকে বিচ্ছিন্ন করে নিছক শুদ্ধ-রচনা বলে দূরে সরিয়ে রাখলে জীবনও হবে খণ্ডিত, লেখাও হবে অপূর্ণ।
লেখার মধ্যে ধরা থাকে সময় ও সমাজ। কিন্তু ব্যক্তিত্বের কারণে বহু লেখকের লেখা বহুরকম। লেখকের ব্যক্তিসত্তার গুণেই, লেখার উদ্দেশ্য প্রায় এক হলেও রীতি বদলে যায়। এটাই স্বাস্থ্যকর--অন্তত চিরন্তন বৈচিত্র সৃষ্টিতে। কিন্তু লেখক কি তাঁর নিজের লেখাতে পূর্ণরূপে ধরা দেন! ধরা দিতে পারেন! ধরা দেওয়া সম্ভবও নয়, বোধ হয়। একইভাবে আত্মজিজ্ঞাসা(কেন লিখি) থেকে উঠে আসে যে বক্তব্য, তা হয়তো নিরপেক্ষ, তবে সময় অনুসারী। সময়ের বদলে একই লেখকের ভাবনা বদল হতেই পারে। অর্থাৎ এ সংখ্যার মাধ্যমে লেখকদের এই সময়ের ভাবনাকে ধরা যায় মাত্র। এখানেই এ সংখ্যার সফলতা ও ব্যর্থতা।
২.
২০১২ এবং ২০১৩ সালে জ্বলদর্চি থেকে প্রকাশ পেয়েছিল 'কেন লিখি' প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। এবার প্রকাশ পেল তৃতীয় খণ্ড। লেখক সম্পাদক সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের সম্মতিতে 'কেন লিখি'(সম্পাদনা: সুভাষ মুখোপাধ্যায় / মিত্র ও ঘোষ/ ২০০০) থেকে পুনর্মুদ্রিত হল ছ'জন কালজয়ী লেখকের লেখা। লেখাগুলির বানান অপরিবর্তিত রেখেই মুদ্রিত হল। ভালোবেসে চিত্রশিল্পী শ্যামল জানা এ সংখ্যার প্রচ্ছদ (পিট মন্ড্রিয়ান-এর চিত্র অনুসরণে) উপহার দিয়েছেন। সবিতেন্দ্রনাথ রায় ও শ্যামল জানার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
এ বছর জ্বলদর্চি তিরিশ বছরে পড়ল। লেখক-পাঠক-শুভানুধ্যায়ী সকলকেই কৃতজ্ঞতা জানাই। সবাই ভালো থাকুন।
Comments
Post a Comment