পটশিল্পের গ্রাম রঘুরাজপুর
অর্হণ জানা
পুরী মানেই সমুদ্র, জগন্নাথের মন্দির, স্বর্গদ্বারের গিজগিজে দোকান বাজার আর পুরী থেকে এদিক ওদিক কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে কোনারক, ধৌলি, নন্দন কানন, ভুবনেশ্বর ইত্যাদি বা চিল্কার সাতপাড়া। কিন্তু রঘুরাজপুর? এখানে খুব বেশি লোকজন আসেন না, নামটাই হয়তো চেনা নয় অনেকের কাছে। পুরী থেকে মাত্র চোদ্দ কিলোমিটার দূরে একটি ছোট্ট গ্রাম। পুরীর এত কাছে অবস্থিত হয়েও এখনও অনেকটাই অজানা, অচেনা।
পুরী থেকে এক বিকেলে একটা অটো ভাড়া করে রওনা হয়েছিলাম রঘুরাজপুরের উদ্দেশ্যে। এখানে বলে রাখি, পুরীর স্বর্গদ্বার থেকে অটো বুক করে গেলে ভাড়া নেবে আনুমানিক ৪০০ থেকে ৬০০ প্রতি জন। এ ছাড়া টোটোর ব্যবস্থাও আছে। যাতায়াতে সময় লাগে মোটামুটি এক থেকে দেড় ঘণ্টা। টোটোয় গেলে সামান্য বেশি সময় লাগতে পারে।
রঘুরাজপুরের প্রবেশপথ
তাল, নারকোল গাছে ঘেরা এই ছোট্ট গ্রামটাতে ঢুকেই প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল তা হল--- রাস্তার দু'ধারে প্রতিটা বাড়ির দেয়ালে অসাধারণ সব ছবি আঁকা। কোথাও শ্রীকৃষ্ণের জীবন কাহিনির নানান দৃশ্য, কোথাও হনুমান, কোথাও গণেশ, কোথাও যুদ্ধের রথে অর্জুন এবং পার্থসারথি, কোথাও বা সুন্দর সুন্দর নকশা। ঢুকলাম একটা বাড়িতে। ঢুকেই কিছুক্ষণের জন্য বাকশক্তিরহিত হয়ে গেলাম। একটা ছোট গ্রামে, অতি সাধারণ একটি বাড়ির ভেতরে যে অসাধারণ সমস্ত চিত্র রয়েছে তা কল্পনারও অতীত।
🍂
পটচিত্র কথাটি এসেছে 'পট্ট' এবং 'চিত্র' শব্দ দু'টি থেকে; পট্ট অর্থাৎ বস্ত্র এবং চিত্র অর্থাৎ ছবি। সোজা কথায়, পটচিত্র কাপড়ের ওপর আঁকা ছবি। এর উৎপত্তি হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে। পুরীতে জগন্নাথদেবের প্রধান দুটো উৎসব হল--- স্নানযাত্রা এবং রথযাত্রা। স্নানযাত্রার সময় জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে একশো আট ঘড়ার জলে স্নান করানোর রীতি আছে। এর ফলে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তখন তাঁদের দর্শন পাওয়া যায় না। আবার রথযাত্রায় তিন ভাই বোন মাসির বাড়ি যান, তখনও মন্দিরে তাঁরা থাকেন না। এই সময় সর্বসাধারণের দর্শনের জন্যে জগন্নাথদেবের পরিধেয় বস্ত্রের ওপর তাঁদের তিন ভাই বোনের ছবি আঁকার প্রচলন হয়, কালক্রমে যা 'পটচিত্র' নামে বিখ্যাত হয়। বংশপরম্পরায় এই ছবি আজও এঁকে চলেছেন রঘুরাজপুরের পটুয়া শিল্পীরা। একজন শিল্পীর বাড়িতে ঢুকে জানলাম, সাত প্রজন্ম ধরে পটচিত্র আঁকছেন ওঁরা। তা হলে বুঝতেই পারছেন, কোন আদি যুগ থেকে তাঁরা এই পটশিল্পের সঙ্গে জড়িত!
পটচিত্র এখন আঁকা হয় তসর বা অন্য কোনও কাপড়ে। এ ছাড়া তালপাতার ওপর, মসলিন কাপড়ের ওপর, বাড়ির পুরনো তাঁতের শাড়ি দিয়ে বানানো পটের ওপরেও আঁকা হয় পটচিত্র। সুনিপুণভাবে তুলে ধরা হয় রামায়ণ, মহাভারতের নানান ঘটনা। এমনকী, দেব-দেবীদের অসুরবধের কাহিনিও। প্রথমে কাপড়ের টুকরোর ওপর তেঁতুলের বীচির আঠার প্রলেপ দেওয়া হয়। প্রয়োজনে দুটো কাপড়ের টুকরোকেও একসঙ্গে জোড়া হয়। এর পর শুরু হয় আঁকার কাজ। বিভিন্ন পাথর ঘষে কিংবা শাকসবজি থেকে তৈরি পটের রঙ ব্যবহার করেন ওঁরা। এবং সেজন্যই পটচিত্রের দাম বিভিন্ন রকমের হয়। ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা অবধি পটচিত্র আছে। আবার পঁচিশ হাজার টাকার হাতে আঁকা পটচিত্রও পাবেন।
এখানেই শেষ নয়। রঘুরাজপুরের হস্তশিল্পের আরও সুন্দর সুন্দর নমুনা আছে। যেমন, নারকোল ছোবড়া দিয়ে নানা রকম ঘর সাজানোর জিনিস তৈরি করা হয়। ঘোড়া, হরিণ, নারকোল গাছ, বাবুই পাখির বাসা--- কোনও কিছুই বাদ নেই। সুপুরির ওপরে রঙ করে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকা, তার পর সুপুরির মাথার ওপর একটা ছোট আংটি জুড়ে তাতে সুতো লাগিয়ে ঝোলানোর ব্যবস্থাও আছে। নারকোলের ফেলে দেওয়া মালাকে আবার জোড়া হয়। তার ওপর কাদার প্রলেপ লাগিয়ে সাদা রঙ করা হয়। তার পরে তাতেও সুন্দর সুন্দর ছবি, নকশা ইত্যাদি এঁকে ঝোলানোর ব্যবস্থা করা হয়। নিজেদের গৃহশোভার জন্যই নয়, কাউকে উপহার দেওয়ার জন্যও খুব ভাল এই পটচিত্রগুলি।
বিখ্যাত ওড়িশি নৃত্যুগুরু কেলুচরণ মহাপাত্রর জন্মস্থান এই ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এখন একশো ষাটটির মতো পরিবার বাস করে এখানে। সবাই এই সব শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। যে কোনও বাড়িতে ঢুকলেই পটচিত্রের বিপুল সম্ভার চোখে পড়ে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কলকাতাতেও এসেছেন হস্তশিল্পের মেলায় অংশগ্রহণ করতে। যদিও তাঁদের আক্ষেপ, পটচিত্র দেখতে বা কিনতে ওঁদের কাছে খুব কম লোকই আসে। যে দু'-একজনও আসেন, তাঁরা শুধুমাত্র দেখেই চলে যান। সেজন্য সেভাবে প্রচারও পায় না ওঁদের কাজ, ওঁদের গ্রামের কথা।
পটচিত্র তৈরিতে ব্যস্ত দুই পটুয়া শিল্পী (ছবি সৌজন্যে: puri.nic.in)
১৯৯৮ সালে রঘুরাজপুরের ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করে ইন্টার-ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ। তার পরেই পরিচিতি পায় এই গ্রাম। ইউনেসকো এই গ্রামটিকে ২০০০ সালে 'হেরিটেজের' তকমা দেয়। কিন্তু সরকারের উদাসীনতায় আর প্রচারের অভাবে আজও অন্ধকারে পড়ে রয়েছেন এখানকার শিল্পীরা। তবুও নিরলস ভাবে দিন রাত এক করে তাঁরা তাঁদের শিল্পকে চিত্রপটে ফুটিয়ে চলেছেন।
তাই পরের বার পুরী গেলে একবার অন্তত ঘুরে আসুন পটশিল্পের গ্রাম রঘুরাজপুর থেকে। পট কিনুন বা না কিনুন।
0 Comments