জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা /প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৪৭

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 স্বামী অদ্বৈতানন্দ

 জন্ম: ১৮২৮ সালের কোনও একদিন
জন্মস্থান: রাজপুর ( জগদ্দল ), দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা
পূর্বাশ্রমের নাম: গোপাল চন্দ্র ঘোষ
মৃত্যু: ২৮ ডিসেম্বর, ১৯০৯
অধিক বয়সে শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসেন গোপালচন্দ্র ঘোষ। পত্নী বিয়োগের শোকে তখন তিনি প্রবল শোকগ্রস্ত। বয়সে ঠাকুরের চেয়েও কয়েক বৎসর বড় ছিলেন। এই কারণে ঠাকুর তাঁকে ‘বুড়ো-গোপাল’ বা ‘মুরুব্বি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ভক্তদের কাছে গোপাল দাদা বা গোপালদা নামেই বেশি পরিচিতি ছিল তাঁর। যাই হোক, পত্নী বিয়োগের কালে সংসারের অসারতা সম্যকভাবে উপলব্ধি করলেন। এই সময় বরানগরের সিঁথি-নিবাসী মহেন্দ্র কবিরাজ দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে যাতায়াত করতেন। তিনি গোপাল দাদার বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। পত্নীবিয়োগে বন্ধুর অবস্থা দেখে তাঁকে ঠাকুরের কথা বললেন। কবিরাজ মহেন্দ্র পালের সঙ্গে ঠাকুরের কাছে গেলেন তিনি। কিন্তু প্রথম সাক্ষাতে ঠাকুরের সান্নিধ্যে যেন বিশেষ কোনও আশার আলো দেখতে পেলেন না। এই বিষয়টি স্বামী গম্ভীরানন্দজী ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে --“আত্মীয়বিয়োগের ক্ষত কত গভীর তাহা বিষাদগ্রস্ত ব্যক্তিও প্রথমে ধারণা করিতে পারেন না; কিন্তু উপযুক্ত চিকিৎসক যখন তাঁহাকে ক্রমে সুস্থ করিয়া তুলিলেন, তখন তাহার বুঝিতে বাকি থাকে না যে, এতাদৃশ সুচিকিৎসক ভিন্ন ঈদৃশ রোগের উপশম সুদূরপরাহত।”( শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা, স্বামী গম্ভীরানন্দ প্রণীত, উদ্বোধন কার্যালয় ) এদিকে বন্ধু মহেন্দ্র নাছোড়বান্দা, গোপালদাও সহজে নিরাশ হয়ে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। সুতরাং পুনরায় তাঁরা ঠাকুরের কাছে দক্ষিণেশ্বরে গমন করলেন। দ্বিতীয়বার এসে ঠাকুরের ভালোবাসায় বাঁধা পড়লেন গোপালদা। এই ভালোবাসার বন্ধনই ক্রমশ ঠাকুরের একান্ত আপনজন করে তুলল তাঁকে। শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে নিরন্তর ঈশ্বর প্রসঙ্গ, ত্যাগ, বৈরাগ্যের কথা শুনে তিনি ক্রমশ সংসার বন্ধন ছিন্ন করে নতুন বৈরাগ্যপূর্ণ জীবনের আলো দেখতে পেলেন। মানবসাধারণের জীবনে স্ত্রী বিয়োগের ঘটনা প্রতিনিয়তই দেখা যায়, কিন্তু এই স্ত্রী বিয়োগ গোপালদা'কে এনে দিল ভিন্ন প্রত্যয়। তিনি পেলেন অবতার বরিষ্ঠের সন্ধান, যিনি গুরুরূপে তাঁকে কৃপা করে তাঁর জীবন ধন্য ও পরিপূর্ণ করে তুললেন।
 গোপালদা ক্রমশ লাটুর সহযোগী হয়ে ( উত্তরকালে লাটু মহারাজ, স্বামী অদ্ভুতানন্দ ) দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীমায়ের সেবায় নিযুক্ত হলেন। তাঁর মনে বিশেষ বাসনা ছিল ঠাকুরের কাছ থেকে দীক্ষা নেবেন। অন্তরের ইচ্ছা নানাজনের মাঝে ঠাকুরকে জানানোর সুযোগও পাচ্ছিলেন না। কিন্তু মনে একটা অভাববোধ সবসময় ক্রিয়া করতে থাকে। এমতাবস্থায় একদিন দুপুরে ঠাকুরকে একাকী বাগানে ভ্রমণরত অবস্থায় পেয়ে তাঁর শ্রীচরণে মনোবাসনা নিবেদন করলেন। এই ঘটনাটি দূর থেকে লক্ষ্য করেছিলেন অপর সেবক লাটু। তিনি দেখলেন গোপালদা নতজানু হয়ে ঠাকুরের চরণ ধারণ করে খুব কাঁদছেন। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ঠাকুর তাঁকে হাত ধরে তুললেন। এরপর কী হয়েছিল তা লাটু জানতেন না। তবে এরপর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে গোপালদাকে বিষ্ণু মন্দিরে  কীর্তন করতে দেখা যেত। এই ঘটনাটি সম্ভবত ১৮৮৫ সালে ঘটে। অথচ এর আগেও ঠাকুরকে দেখেছিলেন গোপালদা, উত্তর সিঁথির বেণীমাধব পালের বাড়িতে। বেণীমাধব পালের কলকাতাস্থ চিনাবাজারে বুরুশ, ম্যাটিং, খড়রা, পাপোশ ইত্যাদির একটি দোকান ছিল। দোকানটিতে কাজ করতেন গোপালদা। বেণীপাল যদিও ব্রাহ্মভক্ত ছিলেন, শরৎ ও বসন্তকালের উৎসবসমূহে শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে নিজ ভবনে আমন্ত্রিত করতেন। এখানেই শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন একবার পেয়েছিলেন গোপালদা। এই দর্শন বিষয়ে পুনরায় গম্ভীরানন্দজীর অনুসরণ করা যাক। তিনি লিখছেন --“দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ চরণে আত্মসমর্পণের পূর্বে এই বাটীতে গোপালদা একবার তাঁহার দর্শন পাইয়াছিলেন, কিন্তু উহা প্রাণের নিরীক্ষণ নহে -- চক্ষের দর্শন অথবা ঔৎসুক্যের উদাস ঈক্ষণ মাত্র। উহা গোপালদার চিত্তে বৈরাগ্যের আকাঙ্ক্ষা জাগায় নাই বা ভগবানলাভের জন্য কোনও উদ্দীপনার সঞ্চার করে নাই। তবে তিনি সেইদিনই চিনিয়াছিলেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণ সত্যসত্যই ভগবৎ প্রেমিক।” ( শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা, স্বামী গম্ভীরানন্দ প্রণীত, উদ্বোধন কার্যালয় )
 কাশীপুর উদ্যানবাটীতে গোপালদা-কে কৃপা করেছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর। এই বিষয়ে আমরা ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ অনুসরণ করব। কথামৃতে বর্ণনা এইরকম --“শুক্রবার, ১১ ই ডিসেম্বর, ২৭ শে অগ্রহায়ণ, শুক্লা পঞ্চমীতে শ্যামপুকুর হইতে ঠাকুর কাশীপুরের বাগানে আইসেন আজ বারো দিন হইল। ছোকরা ভক্তেরা ক্রমে কাশীপুরে আসিয়া অবস্থিতি করিতেছেন -- ঠাকুরের সেবার জন্য। এখনও বাটী হইতে অনেকে যাতায়াত করেন। গৃহী ভক্তেরা প্রায় প্রত্যহ দেখিয়া যান -- মধ্যে মধ্যে রাত্রেও থাকেন।

 ...আজ সকালে প্রেমের ছড়াছড়ি। নিরঞ্জনকে বলছেন, ‘তুই আমার বাপ, তোর কোলে বসব।’ কালীপদর বক্ষ স্পর্শ করিয়া বলিতেছেন, ‘যে আন্তরিক ঈশ্বরকে ডেকেছে বা সন্ধ্যা- আহ্নিক করেছে, তার এখানে আসতেই হবে।’ আজ সকালে দুইটি ভক্ত স্ত্রীলোকের উপরও কৃপা করিয়াছেন। সমাধিস্থ হইয়া তাহাদের বক্ষে চরণ দ্বারা স্পর্শ করিয়াছেন। তাঁহারা অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন, একজন কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, ‘আপনার এত দয়া।’ প্রেমের ছড়াছড়ি। সিঁথির গোপালকে কৃপা করিবেন বলিয়া বলিতেছেন, ‘গোপালকে ডেকে আন’।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম কথিত, দ্বিতীয় খণ্ড )
 গোপালদার তীর্থভ্রমণের প্রবণতা ছিল। এই বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ বোধ যে ঈশ্বর সেথা সেথা, ততক্ষণ অজ্ঞান। যখন হেথা হেথা, তখনই জ্ঞান। যা চায়, তা কাছেই; অথচ লোকে নানা স্থানে ঘোরে।’ কাশীপুরে থাকাকালীন তিনি একবার তীর্থদর্শনে গিয়েছিলেন। আরেকবার কলকাতায় জড়ো হওয়া গঙ্গাসাগর অভিমুখী সাধু সন্ন্যাসীদের গেরুয়া বস্ত্র, রুদ্রাক্ষের মালা ও চন্দন দানের মনোবাসনা হয় তাঁর। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঠাকুর তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এইসব জিনিসগুলি বরং ত্যাগী ভক্তদের দান করলে ভালো হবে। কেননা এঁদের চেয়ে উঁচুস্তরের সাধু আর কোথায় পাওয়া যাবে? গোপাল-দা ঠাকুরের নির্দেশ পালন করে দ্বাদশ সংখ্যক গেরুয়াবস্ত্র ও রুদ্রাক্ষের মালা ঠাকুরের হাতে তুলে দেন। ঠাকুর এইগুলি নরেন্দ্র প্রমুখ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করেন। ভাবী সন্ন্যাসী সঙ্ঘের বীজ এইভাবেই প্রোথিত হয়েছিল স্বয়ং ঠাকুর কর্তৃকই। সুনির্দিষ্টভাবে যেসব ত্যাগীদের মধ্যে এইগুলি বিতরিত হয়েছিল তাঁরা হলেন -- নরেন্দ্র, রাখাল, যোগীন্দ্র, বাবুরাম, নিরঞ্জন, তারক, শরৎ, শশী, গোপাল, কালী ও লাটু। উদ্বৃত্ত গেরুয়াটি পরে গ্রহণ করেছিলেন গিরিশচন্দ্র। অক্ষয়কুমার সেন বিরচিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি’ অনুযায়ী দেহত্যাগের আগে শ্রীশ্রীঠাকুর এই এগারো জনকে ভিন্নভাবেও সন্ন্যাস দেন।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments