ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বনাম মিস মেরি কার্পেন্টার
ভারতবর্ষে নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে মিস মেরি কার্পেন্টার ১৮৬৬ সালে ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় আসেন। মেরি কার্পেণ্টার কলকাতায় অবস্থানকালীন কয়েকটি বক্তৃতা করেন । একটি সভাতে তিনি ইংলণ্ডের সমাজ-বিজ্ঞান সভার কার্য্য বর্ণনা করেন। এই সভার পরের বৎসরই বঙ্গদেশীয় সমাজ বিজ্ঞান সভা (Bengal Social Science Association ) স্থাপিত হয় ৷ উপযুক্ত বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হল বটে; কিন্তু ; ফিমেল, নৰ্ম্মালি উপযুক্ত শিক্ষয়িত্রী পাওয়া দুর্লভ হয়ে গেলো। বালিকাদের শিক্ষা দেওয়ার পথ রইলো বাধাপ্রাপ্ত। এই দেখে তিনি শিক্ষয়িত্রী প্রস্তুত করবার জন্য "ফিমেল্ নৰ্ম্মাল (Female Normal School) স্কুল' স্থাপন করতে চেষ্টা করলেন। এই বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে ভারতের তদানীন্তন স্টেট সেক্রেটারী - লর্ড সলব্রেরীকে সমুদয় অবস্থা অবগত করে ছিলেন। ভারতের তৎকালিন গবর্ণর জেনারেল স্যার জন লরেন্স, স্যার রিচার্ড টেম্পল, শিক্ষা ডিরেক্টর ও প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীদের স্ত্রী-শিক্ষা এবং ফিমেল্ নর্ম্মাল স্কুল স্থাপনের গুরুতর প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলেন ।
তৎকালীন ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন -- মি. অ্যাটকিনসনের মাধ্যমে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মেরি কার্পেন্টারের সাক্ষাৎ হয়। মেরি কার্পেন্টার কে নারীশিক্ষা বিষয়ে বিদ্যাসাগর মশাই নানা ধরনের পরামর্শ দিতেন, একসঙ্গে পরিদর্শনে যেতেন বিভিন্ন অঞ্চলের বালিকা বিদ্যালয় গুলিতে । নারীশিক্ষা বিস্তারে দুজনের সহযোগ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
🍂
কিন্তু বেথুন গার্লস স্কুলের একটা অংশে শিক্ষয়িত্রী প্রশিক্ষণের জন্য 'নর্মাল স্কুল' খোলা নিয়ে মেরি কার্পেন্টারের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতবিরোধ ঘটে। ফলে মেরি কার্পেন্টারের সঙ্গে বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে আর যেতেন না বিদ্যাসাগর।
বেথুন গার্লস স্কুলের একটা অংশে 'নর্মাল স্কুল' প্রতিষ্ঠার যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত বিরোধিতা করেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে মেরি কার্পেন্টারের সেযাত্রায় জয় হলো এবং উপেক্ষিত হলো বিদ্যাসাগরের অভিমত। বেথুন গার্লস স্কুল ভবনেই নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মি. অ্যাটকিনসন , গার্লস স্কুল পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেন এবং স্কুল পরিচালনার ভার দেন স্কুল ইন্সপেক্টর মি. উড্রোর ওপর। মি. উড্রোর সঙ্গে মেরি কার্পেন্টারের ছিল গভীর সম্পর্ক। দুজনেরই কৌশল ছিল কীভাবে বিদ্যাসাগরকে স্কুল পরিচালনার সংশ্লিষ্টতা থেকে বাদ দেওয়া যায়।
এ-উদ্দেশ্যেই মি. উড্রো পূর্বতন কমিটির স্থলে নতুন একটা পরামর্শ সভা গঠনের উদ্যোগ নিলেন। উড্রোর পরামর্শে অ্যাটকিনসন ভূতপূর্ব পরিচালনা কমিটির সদস্যদের কাছে জানতে চান, প্রস্তাবিত পরামর্শ সভার সদস্য হিসেবে তাঁরা কাজ করতে সম্মত আছেন কি না ? ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অসৎ উদ্দেশ্য অনুধাবন করে অ্যাটকিনসনের প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়ে বেথুন গার্লস স্কুলের পরামর্শ সভায় থাকতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন বিদ্যাসাগর। এই প্রেক্ষাপটে ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে বেথুন স্কুল পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেন বিদ্যাসাগর।
ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে মতাদর্শগত বিরোধের কারণে বেথুন গার্লস স্কুলের সঙ্গে সব ধরনের সংশ্লিষ্টতা ছিন্ন করেন তিনি, অথচ এই প্রতিষ্ঠানটিকে তিনিই ভালোবাসতেন গভীরভাবে। স্কুলটির কোনো ধরনের ক্ষতি বা অবমূল্যায়ন কল্পনাও করতে পারেননি বিদ্যাসাগর।
মেরি কার্পেন্টার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছোটলাট উইলিয়ম গ্রে বেথুন গার্লস স্কুলের একাংশে নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে গোটা স্কুলটিকেই শিক্ষয়িত্রী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রূপান্তরের চিন্তা করেন। কেননা, ঔপনিবেশিক প্রশাসন মনে করতেন, স্কুলটির জন্য সরকার যে-পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন, সে-অনুপাতে ফল লাভ সন্তোষজনক নয়। ( হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭১)।
উইলিয়ম গ্রে এবিষয়ে বিদ্যাসাগরের অভিমত জানতে চান। গ্রে-র চিঠির উত্তরে বিদ্যাসাগর তাঁর অভিমত চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেন। কার্পেন্টার বা গ্রে-র প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর তাঁর চিঠিতে লেখেন :--
" শিক্ষয়িত্রীদের জন্যে একটি ট্রেনিং স্কুল থাকা উচিত, মেরি কার্পেন্টারের এই অভিমত নীতিগতভাবে ঠিক, কিন্তু বাস্তবতার দিক দিয়ে অকেজো। এর কারণ হলো, অল্পসংখ্যক সহায়-সম্বলহীন বিধবা ভিন্ন এই প্রশিক্ষণ নিতে ইচ্ছুক বয়ঃপ্রাপ্তা স্ত্রীলোক পাওয়া যাবে না, যেহেতু জনমত স্ত্রীলোকদের এই উপজীবিকা অবলম্বনের বিরোধী। … আপনাকে এই আশ্বাস দেওয়া বাহুল্য যে, স্ত্রীলোক শিক্ষার্থী স্ত্রীলোকদের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করবেন, এটাই যে আবশ্যক এবং বাঞ্ছনীয় তা আমি পরিপূর্ণভাবেই উপলব্ধি করি, কিন্তু সমাজজীবন সম্বন্ধে আমার স্বদেশবাসীদের কতগুলি ভ্রান্ত ধারণা এ বিষয়ে অনতিক্রমণীয় বাধা স্বরূপ। তা যদি না হতো, আমি সকলের আগে এই প্রস্তাবটিকে সমর্থন করতাম, এবং সর্বান্তঃকরণে, তাকে তার লক্ষ্যাভিমুখে অগ্রসর করে দেবার কাজে সহযোগিতা করতাম। " (হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭১)। এই চিঠিতে তিনি আরো লেখেন – বেথুন স্কুল সম্পর্কে অভিমত দেওয়ার অধিকার আছে বলেই মেরি কার্পেন্টার বা উইলিয়ম গ্রে-র অভিমতের বিরোধিতা করেছেন তিনি। এই স্কুলটি নারীশিক্ষা বিস্তারে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে আসছে – তাই স্কুলটিকে কিছুতেই বিলুপ্ত করা যাবে না। এভাবে সেদিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একাই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ঔপনিবেশিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। সেদিন যদি বিদ্যাসাগর বেথুন স্কুল রক্ষার পক্ষে না দাঁড়াতেন, তবে গোটা এশিয়াতেই নারীশিক্ষার প্রাথমিক একটি উদ্যোগের অকালমৃত্যু হতো ।
0 Comments