জ্বলদর্চি

বৌদ্ধ দর্শন - ৩ /বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বৌদ্ধ দর্শন  -  ৩

বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়


বৌদ্ধ দর্শন - ১ --এ আমরা দশ (১০) টি  পারমী-র উল্লেখ্
করেছি । এটা সকলের মনে আছে নিশ্চয় । যাঁরা বুদ্ধত্ব লাভের ইচ্ছা করেন তাঁদের কে এই  দশ (১০) টি প্রধান দায়িত্ব পালন করতেই হয় । পালি ভাষায় এই দশটি প্রধান দায়িত্বকে বলা হয় 'দস পারমী' এই পারমী গুলি সহজেই ব্যাখ্যা করার
জন্য বুদ্ধের 'জাতক' গল্পের দৃষ্টান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে ।
এখন এই 'জাতক' বলতে কি বোঝায় সেটা জেনে নেওয়া
দরকার । 'জাতক' হলো বুদ্ধদেবের পূর্ব পূর্ব জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কাহিনী গুলি অবলম্বন করে পালি ভাষায় রচিত কথ্য গ্রন্থ । অবশ্য এই দশটি  নীতির  (পারমী)
স্তরে তার তম্য আছে  - অধম , মধ্যম ও উত্তম । এখানে এই
পারমী গুলির সহজ বোধগম্যতার জন্য  জাতক
হতে একটি গল্প উল্লেখ করি :
একবার বোধিসত্ত্ব বনের বানর রূপে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ।
একজন ব্রাহ্মণ (ইনি পরবর্তী কালে দেবদত্ত হয়েছিলেন । এই
দেবদত্তই হলেন জাতক কাহিনীর খল নায়ক বা malicious and crooked natured villain ) .   এই ব্রাহ্মণ গভীর বনে তাঁরগাভীর খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে এক গভীর কূপে পড়ে
 গিয়েছিলেন । এটা দেখেছিলেন বানর রূপী বোধিসত্ত্ব ।

(১)ব্রাহ্মণকে এই বিপন্ন অবস্থায় দেখে তাঁর হৃদয় প্রেমে ও
করুণায় পূর্ণ হয়ে উঠে ছিলো। তাঁর মনে হয়েছিলো যেন তাঁর নিজের সন্তানই এই ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে । আর এই বিপন্ন জনকে বাঁচাতেই হবে যে ভাবেই হোক ।

(২)বোধিসত্ত্ব নিজের জীবন বিপন্ন করেও ব্রাহ্মণকে বাঁচানোর
সংকল্প করলেন । আর তিনি তাঁর সংকল্প রক্ষাও  করেছিলেন।

(৩)ব্রাহ্মণকে রক্ষা করার জন্য তিনি নানা উপায় চিন্তা করতে
লাগলেন।শেষে তিনি স্থির করলেন  তাঁকে পিঠে চাপিয়ে ওপরে তুলে আনবেন । 

(৪)কিন্তু এতে বিপদের সম্ভাবনাও  আছে । এই লাফটার
পরিমাপ ঠিক মতো হওয়া চাই । যদি পরিমাপ অতিরিক্ত 
হয়ে যায় তবে ব্রাহ্মণ মারা  পড়বেন। তাই তিনি ব্রাহ্মণের
আনুমানিক ওজন পরিমাণ একটা পাথর পিঠে বেঁধে কয়েক বার কূপ হতে ওঠা অভ্যাস করে নিলেন । এর পরে তিনি ব্রাহ্মণকে ঠিক মতো ওপরে তুলে আনতে পারলেন ।

(৫)বোধিসত্ত্ব জানতেন এই প্রচেষ্টার ফলে তাঁর নিজের
প্রাণ বিপন্ন হতে পারে । তবুও তিনি নিজের মৃত্যুর ভয় না করেই এই প্রচেষ্টা করেছিলেন ।

(৬) যখন ব্রাহ্মণ কে বিপদ হতে মুক্ত করে তিনি ওপরে
উঠলেন তখন তিনি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন । ক্লান্তি
দূর করতে তিনি ব্রাহ্মণের কোলে মাথা রেখে একটু শোয়ার
চেষ্টা করলেন ।ব্রাহ্মণ কিন্তু খুবই অকৃতজ্ঞ । তিনি ঠিক করলেন এই বানরটিকে হত্যা করে তার মাংস বাড়িতে নিয়ে
যাবেন । কিন্তু বানরটিকে কিভাবে হত্যা করা যায় ? তাঁর
কাছে সে রকম কোনও অস্ত্র না থাকায় তিনি একটি বড়ো
প্রস্তর খণ্ড তুলে নিয়ে বেশ জোরে  বানরটির মাথায় আঘাত
করলেন । বানর রূপী বোধিসত্বের কিন্তু মৃত্যু ঘটলো না । প্রাণ বাঁচানোর স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে তিনি দ্রুত কাছের একটি গাছে উঠে পড়লেন । তাঁর মস্তকের আঘাত হতে রক্ত পড়ছিলো
ফোঁটায় ফোঁটায় । তিনি খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন । কিন্তু তাঁর
মনে ব্রাহ্মণের প্রতি তবুও কোনও ক্রোধের ভাব আসে নি ।

(৭) তিনি না কথায় না আচরণে ব্রাহ্মণের প্রতি ক্ষোভ বা
রাগ প্রদর্শন করেন নি ।

(৮) তাঁর জীবন নাশের যে প্রচেষ্টা ব্রাহ্মণ করে ছিলেন তা
তিনি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন । কারণ সেটা মনে রাখা
ন্যায়সঙ্গত নয় ।

(৯) বোধিসত্ব এও বুঝে ছিলেন ব্রাহ্মণ পথ চিনে বাড়ি ফিরতে
পারবেন না । তাই ব্রাহ্মণকে পথ নির্দেশ দেওয়ার জন্য
তিনি ওপরের গাছে গাছে এগিয়ে চললেন । তাঁর মাথার ক্ষত
হতে ঝরে পড়া রক্তের চিহ্ন ব্রাহ্মণকে পথ নির্দেশনা দিতে
লাগলো । এভাবেই বোধিসত্ত্ব সেই ব্রাহ্মণকে বাঁচানোর
প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত বজায় রেখে ছিলেন ।

(১০) ব্রাহ্মণকে বাঁচানোর এই প্রচেষ্টার পিছনে বোধিসত্বের
কোনও স্বার্থ চিন্তা ছিলো না । জাগতিক লাভ ও প্রশংসার
মোহ ত্যাগ করেই তিনি  কাজটি করেছিলেন ।

আসুন এবার আমরা এই জাতক কাহিনী হতে উপমা (analogy) বিচার করে পারমী গুলিকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি :
(১) নিজের প্রাণ দিয়েও ব্রাহ্মণকে বাঁচানোর যে প্রচেষ্টা 
বোধিস্বত্ব করে ছিলেন তা হলো  'দান পারমী' ।

(২) ব্রাহ্মণ পাথর দিয়ে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করার
চেষ্টা করলেও তিনি না বাক্যে না অচরণে কোনও বিদ্বেষ
ভাব দেখান নি এটি হলো 'সীল পারমী'

(৩) ব্রাহ্মণকে রক্ষা করার প্রচেষ্টার পরিবর্তে তিনি কোনও
প্রত্যুপকার প্রত্যাশা করেন নি এটি হলো -  'নেক্্খম
পারমী'

(৪) ব্রাহ্মণকে রক্ষা করার জন্য তিনি যে উপায় উদ্ভাবনেরন
প্রচেষ্টা করেছিলেন তা হলো  :পঞ্ঞা  পারমী'

(৫) ব্রাহ্মণের রক্ষা সম্বন্ধে সু নিশ্চিত হওয়ার জন্য  বোধিসত্ব
যে কূপ অভ্যন্তরে বার বার লাফিয়ে ওঠার পরীক্ষা চালিয়েছিলেন তা হলো - 'বীরিয় পারমী'

(৬)  মস্তকে গুরুতর আঘাত পাওয়া সত্বেও তিনি ব্রাহ্মণের প্ৰতি ক্রুদ্ধ হন নি বা শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন নি এটি
হলো :  'খন্তী পারমী'

(৭)   নিজের জীবন বিপন্ন করেও বোধিসত্ব ব্রাহ্মণকে রক্ষা
করার প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছিলেন । এটির নাম হলো :
'সচ্ চ পারমী'

(৮) অকৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ বোধিসত্বের প্রাণ নেওয়ার চেষ্টা
করেছিলেন কিন্তু বোধিসত্ব ব্রাহ্মণকে রক্ষা করার সংকল্পে
তবুও অবিচল ছিলেন এটি হলো -:অধিট্ ঠান পারমী'

(৯) কূপে পতিত ব্রাহ্মণের দুর্দশা দেখে তাঁর মনে যে করুণা
বা দয়ার উদ্রেক হয়েছিলো তা হলো ,-  'মেত্তা পারমী' ।

(১০) বোধিসত্ত্ব ভুলে যেতে পেরেছিলেন ভুলেও গিয়ে ছিলেন
যে ব্রাহ্মণ তাঁকে হত্যা করতে চেয়ে ছিলেন এটি হলো -
'উপেক্ খা পারমী'
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments